বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪১৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মেহবুবুর রহমান, বীর উত্তম দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধার কথা কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত মিয়াবাজার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। গেরিলা অপারেশন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ওই এলাকা দিয়ে চলাচল করতে হয়।
কিন্তু পাকিস্তানি ওই ক্যাম্পের কারণে তাঁদের বেশ অসুবিধা হতে থাকল। তাঁরা কয়েকবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অ্যামবুশে পড়ল। এতে তাঁদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলো।
মিয়াবাজার মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরের আওতাধীন এলাকা। আগস্ট মাসে সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে সেখানে নির্দেশ এল অবিলম্বে মিয়াবাজার থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদের।
নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি দলের দলনেতা মেহবুবুর রহমান। তাঁর ওপরই দায়িত্ব পড়ল পাকিস্তানি সেনাদের মিয়াবাজার থেকে উচ্ছেদ করার। দায়িত্ব পেয়েই তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকলেন আক্রমণের।
কয়েক দিন পর মেহবুবুর রহমান তাঁর দল দিয়ে রাতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেন। ভোর রাতে অতর্কিতে আক্রমণ চালালেন পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে। কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হলো কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। আহত হলো অনেক। এই আক্রমণে পাকিস্তানিরা এতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল যে মিয়াবাজারের অবস্থান পরিত্যাগ করে তারা কুমিল্লায় চলে গেল।
অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে খবর এল, পাকিস্তানিরা মিয়াবাজারে আবার ক্যাম্প স্থাপন করেছে। তখন নির্ভয়পুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক মেহবুবুর রহমান নিজেই। তিনি বুঝতে পারলেন, পুনরায় ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানিরা কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহবুব সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তানিদের এই পরিকল্পনা যেকোনো মূল্যে নস্যাৎ করতে হবে।
মেহবুবুর রহমান কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে সেখানে আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। তারপর ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যার পর এক দল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভারত থেকে রওনা হলেন মিয়াবাজারের উদ্দেশে। দীর্ঘ পথ হেঁটে পৌঁছালেন লক্ষ্যস্থলে। গোপনে অবস্থান নিলেন শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটির আশপাশে।
রাত আনুমানিক ১১টা। সহযোদ্ধাদের নিয়ে মেহবুব আক্রমণ চালালেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে। আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি সেনারা। প্রায় দেড় ঘণ্টা যুদ্ধ চলল। আক্রমণে নিহত হলো দুজন পাকিস্তানি সেনা। আহত হলো পাঁচ-ছয়জন। তবে পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলো না। কারণ, তারা আগের তুলনায় শক্তিশালী। এ কারণে শেষ রাতে তিনি সহযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দিলেন।
তিন দিন পর ২০ অক্টোবর। মেহবুবুর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে আবার আক্রমণ চালালেন মিয়াবাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরেকটি ঘাঁটিতে। তখন আনুমানিক ভোর চারটা। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল পাকিস্তানি সেনারা। দুই ঘণ্টার যুদ্ধে নিহত হলো ২১ জন পাকিস্তানি সেনা। আহত হলো আরও বেশি। এরপর তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন নিরাপদ স্থানে। পরদিন স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে তাঁরা জানতে পারলেন, পাকিস্তানিরা নিহত ও আহত সেনাদের গাড়িতে করে কুমিল্লা নিয়ে যাচ্ছে।
মেহবুবুর রহমান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধযুেদ্ধ অংশ নেন। পরে যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। অনেক যুদ্ধ তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংঘটিত হয়। এর মধ্যে কুমিল্লার জগমোহনপুর, ধনাপুর, রাজারমার দিঘি, ফুলতলী, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, আশিকাটি উল্লেখযোগ্য। নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে পাকিস্তানিদের কাছে তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মেহবুবুর রহমানকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২০।
মেহবুবুর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) হত্যা ঘটনায় ১ বা ২ জুন নিহত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার বানাবাড়িয়া গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা: ৩৩/২ মাটিকাটা (অবেলার স্মৃতি), ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা। তাঁর বাবার নাম মুস্তাফিজুর রহমান, মা লুৎফুন্নাহার।
সূত্র: লুৎফুন্নাহার, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, পতাকার প্রতি প্রণোদনা, মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভুঁইয়া ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মিয়াবাজার মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরের আওতাধীন এলাকা। আগস্ট মাসে সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে সেখানে নির্দেশ এল অবিলম্বে মিয়াবাজার থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদের।
নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি দলের দলনেতা মেহবুবুর রহমান। তাঁর ওপরই দায়িত্ব পড়ল পাকিস্তানি সেনাদের মিয়াবাজার থেকে উচ্ছেদ করার। দায়িত্ব পেয়েই তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকলেন আক্রমণের।
কয়েক দিন পর মেহবুবুর রহমান তাঁর দল দিয়ে রাতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেন। ভোর রাতে অতর্কিতে আক্রমণ চালালেন পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে। কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হলো কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। আহত হলো অনেক। এই আক্রমণে পাকিস্তানিরা এতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল যে মিয়াবাজারের অবস্থান পরিত্যাগ করে তারা কুমিল্লায় চলে গেল।
অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে খবর এল, পাকিস্তানিরা মিয়াবাজারে আবার ক্যাম্প স্থাপন করেছে। তখন নির্ভয়পুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক মেহবুবুর রহমান নিজেই। তিনি বুঝতে পারলেন, পুনরায় ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানিরা কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহবুব সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তানিদের এই পরিকল্পনা যেকোনো মূল্যে নস্যাৎ করতে হবে।
মেহবুবুর রহমান কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে সেখানে আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। তারপর ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যার পর এক দল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভারত থেকে রওনা হলেন মিয়াবাজারের উদ্দেশে। দীর্ঘ পথ হেঁটে পৌঁছালেন লক্ষ্যস্থলে। গোপনে অবস্থান নিলেন শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটির আশপাশে।
রাত আনুমানিক ১১টা। সহযোদ্ধাদের নিয়ে মেহবুব আক্রমণ চালালেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে। আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি সেনারা। প্রায় দেড় ঘণ্টা যুদ্ধ চলল। আক্রমণে নিহত হলো দুজন পাকিস্তানি সেনা। আহত হলো পাঁচ-ছয়জন। তবে পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলো না। কারণ, তারা আগের তুলনায় শক্তিশালী। এ কারণে শেষ রাতে তিনি সহযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দিলেন।
তিন দিন পর ২০ অক্টোবর। মেহবুবুর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে আবার আক্রমণ চালালেন মিয়াবাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরেকটি ঘাঁটিতে। তখন আনুমানিক ভোর চারটা। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল পাকিস্তানি সেনারা। দুই ঘণ্টার যুদ্ধে নিহত হলো ২১ জন পাকিস্তানি সেনা। আহত হলো আরও বেশি। এরপর তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন নিরাপদ স্থানে। পরদিন স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে তাঁরা জানতে পারলেন, পাকিস্তানিরা নিহত ও আহত সেনাদের গাড়িতে করে কুমিল্লা নিয়ে যাচ্ছে।
মেহবুবুর রহমান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধযুেদ্ধ অংশ নেন। পরে যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। অনেক যুদ্ধ তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংঘটিত হয়। এর মধ্যে কুমিল্লার জগমোহনপুর, ধনাপুর, রাজারমার দিঘি, ফুলতলী, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, আশিকাটি উল্লেখযোগ্য। নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে পাকিস্তানিদের কাছে তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মেহবুবুর রহমানকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২০।
মেহবুবুর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) হত্যা ঘটনায় ১ বা ২ জুন নিহত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার বানাবাড়িয়া গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা: ৩৩/২ মাটিকাটা (অবেলার স্মৃতি), ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা। তাঁর বাবার নাম মুস্তাফিজুর রহমান, মা লুৎফুন্নাহার।
সূত্র: লুৎফুন্নাহার, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, পতাকার প্রতি প্রণোদনা, মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভুঁইয়া ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments