সুস্থ হয়ে উঠুন ফারুক ভাই by ববিতা

গত ১৬ মে ফারুক ভাইকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। তিনি তাকিয়ে থাকলেন। মাথার কাছে একটু বসলাম। আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিলাম। আমি এরপর চলে যাই সিঙ্গাপুর। নিজের চিকিৎসা করিয়ে দেশে ফিরে শুনলাম, ফারুক ভাইয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মনটা খারাপ হয়ে গেল।


চোখের সামনে ভেসে উঠছে কত স্মৃতি!
সে কবেকার কথা! নারায়ণ ঘোষ ওরফে মিতা আলোর মিছিল নামের একটি চলচ্চিত্রের গল্প শোনালেন। সেখানে রাজ্জাক ভাই আমার মামা। সুজাতা ভাবি মামি। মিতাদা বললেন, ‘একটি নতুন ছেলে তোর নায়ক হবে।’
অনেক পরিচালক আমাকে এ চলচ্চিত্রে কাজ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ, সেখানে নাকি রাজ্জাক ভাই ও সুজাতা ভাবি প্রধান দুটি চরিত্রে কাজ করছেন। আর ফারুক ভাই সম্পর্কে শুনেছিলাম, তিনি নাকি খুবই রাগী একজন মানুষ। কথাবার্তা শুনে তো একটু ভয়ই পেয়েছিলাম!
তবুও কেন যেন এ চলচ্চিত্রে কাজ করলাম। প্রথম দিন দেখলাম ফারুক ভাইকে। খুব বেশি কথা হলো না। আস্তে আস্তে কাজ শুরুর পর দেখলাম অসাধারণ একজন মানুষ। কে বলবে এই মানুষ এর আগে কখনো অভিনয় করেননি? কে বলবে এই মানুষ এতটা প্রাণ খুলে কথা বলতে জানেন?
মনে মনে ভাবলাম, এ চলচ্চিত্রে যদি কাজ না করতাম, তবে মিতাদার প্রতি অন্যায় করা হতো।
আলোর মিছিল বেশ আলোচিত চলচ্চিত্র হয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল। চলচ্চিত্রশিল্প পেল একজন ভালো অভিনেতা।
ফারুক ভাইকে একটি কথা অনেক দিনই বলতে চেয়েছি। বলেছি কি না মনে নেই। গ্রামীণ পটভূমির চলচ্চিত্রে তিনি একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা—এ কথা তাঁর শত্রুকেও বলতে হবে।
লাঠিয়াল ছবির কথাই ধরুন না। যেখানে আছেন আনোয়ার হোসেনের মতো অভিনতো, আছেন রোজী আফসারীর মতো অভিনেত্রী, সেখানে তিনি কী অসাধারণ অভিনয় করে সবাইকে মাতিয়ে দিলেন!
আপনারা যাঁরা নয়ন মনি চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, সেখানে নয়নের বিকল্প চরিত্র হিসেবে কি অন্য কাউকে ভাবতে পারেন?
আবার তোরা মানুষ হ চলচ্চিত্রে আমরা কত শিল্পী অভিনয় করেছি। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ফারুক ভাই যেভাবে অভিনয় করেছেন, একবারের জন্যও আমার কাছে অন্তত মনে হয়নি তিনি অভিনয় করছেন। সত্যিই, সেসব দিনের কথা মনে হলে এখনো ভেবে পাই না যে ফারুক ভাই কীভাবে কাজগুলো করছিলেন!
ফারুক ভাই, আপনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। আপনার মনের অবস্থা কেমন, জানি না। তবে প্রার্থনা করি, আপনি ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুন। আমি জানি, আমার এই লেখা পড়ার আগেই দেশের অগণিত মানুষ আপনার সুস্থতার প্রতাশায় আছে।
মনে পড়ে কাজী জহিরের কথা দিলাম চলচ্চিত্রের কথা। কী সাংঘাতিক ব্যবসাই না করল চলচ্চিত্রটি! এ চলচ্চিত্রের গান কী জনপ্রিয়ই না হয়েছিল! মনে পড়ে ফারুক ভাই, গোলাপী এখন ট্রেনে চলচ্চিত্রের কথা। আমজাদ হোসেনের নয়ন মনির পর গোলাপী এখন ট্রেনে কী সাড়াই না ফেলেছিল!
ফারুক ভাই, আজ আপনার কাছে একটা ছোট্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই। আমি পৃথিবীর অনেক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছি। আমার সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পী সেসব উৎসবে অংশ নিয়েছেন। একবার ফারুক ভাই, আপনি ও আমি তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছিলাম। সেখান থেকে আসার পর আপনি একটি খবরের কাগজে বলেছিলেন, ‘দেখে এলাম, তাসখন্দে ববিতা কতটা জনপ্রিয়। যেখানে রাজ কাপুরের বড় বড় ছবি শোভা পাচ্ছে, সেখানে আমাদের ববিতার ছবিও শোভা পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ববিতা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে তুলে ধরেছে। আমাদের জন্য তা অনেক আনন্দের।’
সত্যিই ফারুক ভাই, আপনার সেদিনের সেই সাক্ষাৎকারের কথা মনে হলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি।
ফারুক ভাই, আপনি ফিরে আসুন। আবার আমরা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যাব। আপনার অভিমানী সংলাপ শুনব। আপনার চোখমুখের এক্সপ্রেশন দেখে অভিভূত হব। অবশ্যই আপনি ফিরে আসবেন।

No comments

Powered by Blogger.