অবক্ষয়-বাংলাদেশে কি দুর্নীতি আদৌ কমবে? by মামুন রশীদ

আমাদের দেশের সব মানুষই সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির দৌরাত্ম্যের সঙ্গে কমবেশি পরিচিত, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে দুর্নীতির দায়ে অপদস্থ হওয়ায় দেশের সব সচেতন মানুষের মনে এক ব্যাপক গ্লানিবোধ সঞ্চারিত হয় কিংবা এরই মধ্যে হয়েছে।


আমরা সবাই এক বাক্যে সমাজে দুর্নীতির সংক্রমণ স্বীকার করে নিয়েছি। দুর্নীতির এই সংক্রমণ আগেও ছিল, কিন্তু জনমনে এখন এই ধারণা দৃঢ় যে বর্তমানে দুর্নীতির বিস্তার হয়েছে কল্পনাতীতভাবে এবং জনজীবনের প্রায় কোনো অংশই এই প্রভাবের বাইরে নয়। পরিস্থিতি এতই নৈরাশ্যজনক যে রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ দুর্নীতির এই বিস্তার প্রতিরোধে ক্রমাগত উদ্যমহীন হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথায় অনুরণিত হয়ে সবারই মনে জিজ্ঞাসা, পথের শেষ কোথায়?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে, কেন দুর্নীতি হয় বা দুর্নীতি বিস্তারের প্রক্রিয়া কীভাবে বাড়ে। সার্বিকভাবে দেখলে দুর্নীতির ব্যাপকতার সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি সম্পর্ক আছে। কিন্তু কেবল মূল্যবোধের অবক্ষয় বাংলাদেশের দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। কেননা দুর্নীতি পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা জনগণের মনে যে পরিমাণ হতাশার সৃষ্টি করেছে, তা তুলনাহীন। দুর্নীতি কেবল ওপর মহলে হয়, তা-ই নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণকে দুর্নীতির প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। এই অংশগ্রহণের কারণ সব ক্ষেত্রেই শুধু লোভ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে ন্যূনতম জীবনযাপনের প্রচেষ্টা। এই অসহায়ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃষ্টান্তের, যেখানে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির সুযোগ নেই, বরং কাউকে কাউকে মূল্য দিতে হয় সৎ থাকার জন্য। জনগণের কাছে এই ধারণা ক্রমেই দৃঢ় হয়েছে, সমাজে নীতিবান হয়ে থাকার মাঝে কোনো গৌরব নেই, বরং আছে বহু ভোগান্তি। সমাজের সুশীল অংশেও ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা পরিষ্কার নয়।
আগেই বলেছি, পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি দুর্নীতি আছে, তাহলে বাংলাদেশে থাকতে পারে না কেন? এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই দুর্নীতি জনগণের মনে ব্যাপক হতাশাবোধের জন্ম দিয়েছে। এই হতাশাবোধের মূল কারণ হচ্ছে, দেশের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যকর ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন সমাজব্যবস্থার প্রধানতম ভিত্তি হওয়ার কথা এসব প্রতিষ্ঠানের। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অগ্রগণ্য হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম, সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র, জাতীয় সংসদ, সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি খাত। আমরা কয়েক দশক ধরে এসব প্রতিষ্ঠানকে ক্রমান্বয়ে ধ্বংস বা অকার্যকর করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চালিত করেছি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে দুর্নীতি। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। জনগণের আকাঙ্ক্ষা থাকে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো দিকনির্দেশনা দেবে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নেওয়ার, ক্রান্তিকালে পথ দেখাবে উত্তরণের; নাগরিকের আস্থা ও নির্ভরতার আশ্রয়স্থল হবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। জবাবদিহিতার অভাব বেপরোয়া ভাবকে উত্সাহিত করছে প্রতিনিয়ত।
আমাদের উচ্চশিক্ষার মূল ভিত্তি সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় চলছে চরম রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পদ উপাচার্য নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনাই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। আর ছাত্ররাজনীতির কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। যে ছাত্ররাজনীতি ছিল জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার আধার, সব গৌরবোজ্জ্বল অতীতের সূতিকাগার, সেই ছাত্ররাজনীতি এখন হয়েছে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের আঁতুড় ঘর।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে জাতীয় সংসদ। অথচ আমাদের সংসদের কার্যক্রম সত্যিকার অর্থে স্থবির। বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেয়ে কীভাবে তহবিল গঠন করা যায়, সেদিকে ব্যস্ত বলেই সাধারণ জনগণ মনে করে। সরকারি দল এবং বিরোধী দল এই দুটো শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে কার্যক্রমের বিস্তর ফারাক। সাধারণ মানুষও কেমন জানি সৃষ্টিকর্তার চাইতে পুলিশ বা র্যাবকেই ধর্তব্যে আনছে। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই র্যাব বা পুলিশের নীতি-নৈতিকতাও দুর্নীতি রোধের পথে বাধা।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নিয়োগে যেসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়, সেখানে নৈর্ব্যক্তিক ও রচনামূলক পরীক্ষার পাশাপাশি থাকে মৌখিক পরীক্ষা। বর্তমানে সমগ্র প্রক্রিয়াটি চরম কলুষিত এবং পরীক্ষার্থীদের মূল যোগ্যতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়। নিয়োগ পাওয়ার পরপরই রাজনৈতিক যোগ্যতায় উত্তীর্ণ এই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার দায়িত্ব পান এবং স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের চাইতে রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণে তত্পর থাকেন বেশি।
‘বাংলাদেশে দুর্নীতি চলবেই’—এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মনে। কারণ, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ভূমিকা পালনের অবকাশ রাখেনি। সমাজ ও রাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা দেশের জনগণের মনে তীব্র হতাশার সৃষ্টি করেছে, দুর্নীতির পথে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে সৃষ্টি করেছে বাধা। যত দিন এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভূমিকা কার্যকরভাবে পালন করতে পারবে না, সমাজে দুর্নীতির ব্যাপক দৌরাত্ম্যের প্রতাপ আমাদের দেখে যেতে হবে। দুর্নীতির যে ধারণা আমরা সৃষ্টি করেছি, সেই ধারণাকে বদলাতে হবে আমাদেরই।

নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.