যুক্তি তর্ক গল্প-বড় সাফল্যের জন্য নিজেদেরই বড় হওয়া চাই by আবুল মোমেন
একাত্তর বাঙালিকে রণক্ষেত্রে নিয়ে গেছে। বাঙালি ছিল ঘরকুনো আড্ডাবাজ—নিন্দুকের ভাষায়, ভেতো আর ভীতু বাঙালি। একাত্তর তাকে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে, দিয়েছে বদলে। বাঙালি যোদ্ধার জাতে পরিণত হয়েছিল সেদিন। যুদ্ধ মানুষকে সাহসী করে এবং ঝুঁকি নিতে সাহস জোগায়।
এভাবে একদিকে তার মধ্যে বীরত্বের গুণ এসেছে, অন্যদিকে সে শিখেছে ত্যাগের মহিমা।
এই সদর্থক জাগরণ ও পরিবর্তন সহজে ঘটেছিল, কারণ সে দিন আমাদের সামনে ছিল স্বদেশ স্বাধীন করার বিশাল স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আমাদের নাগালের মধ্যে এসেছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মতো কান্ডারিদের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল ত্যাগে, বীরত্বে, প্রজ্ঞা ও অঙ্গীকারে অতুলনীয় অবস্থানে। মানুষ নেতৃত্বের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পেরেছিল, আর তারা দেখেছিল তাঁদের স্বপ্নটি সম্ভবপরতার মধ্যে চলে এসেছে।
একাত্তরে অপরাধ কমে গিয়েছিল। বাঙালির মধ্যে মানবতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব ও পরোপকারের আদর্শ সক্রিয় ছিল সেদিন। মুষ্টিমেয় কিছু দুষ্কৃতকারী ব্যতীত দেশবাসী এই এক উচ্চ আদর্শে সেদিন এক লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
আজকের সমাজকে কোনো দিক থেকেই সেই আদর্শের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না—না-সে একাত্তর-পূর্ব ঘরকুনো ভেতো বাঙালি হয়ে গেল, না-সে একাত্তরের উচ্চ আদর্শকে ধারণ করে থাকল। আজকে আমাদের সমাজে প্রতিদিনের ঘটনা ও দুর্ঘটনায় আমরা দেখছি, মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে, আপনজনের প্রতি নির্দয় হয়ে পড়ছে, সামান্য স্বার্থে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ তার করতে বাধছে না। আবার সমস্যার চাপে পড়ে সমাধানের পথ খুঁজছে আত্মবিনাশ, এমনকি সন্তানসহ আত্মঘাতী হওয়ার পথে।
পরিবারে, বাড়িতে কান পাতলে কেবল যেন ভাঙনের শব্দ শোনা যায়। সবার মনের মধ্যে অপ্রাপ্তি-অতৃপ্তির ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নানা মাত্রায় প্রকাশ পাচ্ছে। সমাজে ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। এতে নিকটজনেরা সামান্য কারণে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে প্রতিশোধ নেওয়ার জিঘাংসাবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আর তার প্রকাশ ঘটছে জঘন্য সব অপরাধের ভেতর দিয়ে।
অন্যদিকে দেখছি, স্বাধীনতার পর অনেক পাওয়ার পরও পাওয়ার দৌড়ে ক্ষান্তি নেই, সেই দৌড়ে সহযাত্রী চায় না কেউ, যে শামিল হচ্ছে সে-ই প্রতিদ্বন্দ্বী এবং যেকোনো মূল্যে তাকে দমাতে হবে—এমনটাই সবার ইচ্ছা। এভাবে সমাজের মানবিক বাতাবরণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সমাজ অমানবিক হয়ে পড়েছে।
ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ এত প্রবল ও অনমনীয় যে সমাজব্যবস্থাকে টেকানোর জন্য যেটুকু সমঝোতা করতে হয় বা মানিয়ে নিতে হয়, এর জন্যও কেউ প্রস্তুত নয়। কিছু নিতে হলে কিছু দিতে হয়, কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়—এই সামান্য নীতিটুকু মানতেও আমরা আজ আর রাজি হচ্ছি না।
ফলে সমাজে এক অশুভ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, ভেঙে পড়ছে ব্যবস্থা। বলতে দ্বিধা নেই, এ রকম পরিস্থিতি পশুদের মধ্যে তৈরি হতে পারে। বনের কর্তৃত্ব, দলের নেতৃত্ব বজায় রাখা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। সে লড়াই রক্তক্ষয়ী ও প্রাণঘাতী হয়ে থাকে। এক অঞ্চলে দুই বাঘ বা দুই সিংহ থাকে না, থাকতে পারে না। সহাবস্থানে অভ্যস্ত নয় বলেও কিন্তু বিভিন্ন প্রজাতির পশু বিলীন হয়ে যায়। সাম্প্রতিক অনেক হত্যাকাণ্ডই যেন এ রকম মানসিকতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে—এক ব্যবসায় দুই বাঘ টিকছে না, এক দলে দুই সিংহ থাকতে পারছে না। এখানে খতম করার নীতি চলছে।
একজন বিজ্ঞানী বলেছিলেন, যেসব প্রাণী নিজ প্রজাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকে, সহযোগিতা ও সহাবস্থানের বাতাবরণ নষ্ট করে, তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। তিনি মনে করেন, মানুষ ক্রমেই নিজ প্রজাতির মধ্যে হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ছে বেশি। তাঁর আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে মানব প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং তা ঘটবে শিগগিরই।
ঘুষ খাওয়া ও মিথ্যাচার বিরাটসংখ্যক মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার চেয়ে ভয়ানক হলো, একদল মানুষ তৈরি হচ্ছে, যারা সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্যের ভেদাভেদ বুঝতে পারছে না। কিছুদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে এক মাছচাষির সঙ্গে উপস্থাপকের কথা হচ্ছিল। অভিযোগটা হলো, সহজে ও দ্রুত বেশি মাছ ধরার জন্য তাঁরা স্বল্প পরিমাণ বিষ জলাশয়ে ছেড়ে দেন। তাতে মাছগুলো মরে ভেসে ওঠে এবং তাঁরা তুলে আড়তদারের কাছে বিক্রি করেন। তারপর আবার খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ক্রেতার কাছে এ মাছ পৌঁছায়। এই বিষ যে ক্ষতিকর, ধীর কিন্তু কার্যকর বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তাঁরা নিজেরাও যে এই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, সে কথা শোনার পর সেই সাধারণ মানুষটি সরলভাবে জানিয়েছিলেন, না, তাঁদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ নিজেদের খাওয়ার মাছগুলো বিষ প্রয়োগের আগেই তাঁরা তুলে নেন।
কথাটা তিনি সরলভাবে সরলবিশ্বাসে গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে বলেছিলেন, কারণ সত্যিই ভালো-মন্দের বোধ তাঁর মধ্যে নেই। আর যারা জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে বদলা নেওয়ার নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে, তারা হয়তো এককালে সত্য-মিথ্যা ও ভালো-মন্দের ফারাকটুকু জানতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লোভ-ভোগের বশবর্তী হয়ে এখন সূক্ষ্ম মানবিক বৃত্তিগুলো অসাড় ও অকেজো হয়ে গেছে। এদের কি ঊনমানব (lesser humanbeing) বলব?
কিন্তু যখন পুরো সমাজে, কিংবা সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষগুলোর মধ্যেও একই রকম অসাড়তা দেখা যায় মূল্যবোধের ক্ষেত্রে তখন? আমাদের শিক্ষকেরা কি জানেন না, মুখস্থ করে কোনো বিদ্যা অর্জন সম্ভব নয়? কেবল তাঁদের নির্বাচিত সাজেশন-নির্ভর সীমিতসংখ্যক প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করাকে বিদ্যার্জন বলা যায় না, তা কি তাঁরা জানেন না? অভিভাবকদের একটি বড় অংশ কি জানেন না, এভাবে চামচে তুলে মুখস্থ করে ভালো ফল করার কোনো দাম নেই? কিন্তু সমাজ তো সদলবলে এই দিকেই চলেছে। এ সমাজের পতন কীভাবে ঠেকানো যাবে?
রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ছোট ইংরেজ ও বড় ইংরেজের কথা বলেছেন। যারা শাসনদণ্ড নিয়ে ছলেবলে, চক্রান্ত, অন্যায় ও নিপীড়নের মাধ্যমে পরদেশ দখল করে শাসন ও শোষণ চালায়; বেনিয়াবৃত্তির বুদ্ধিতে চলে, তারা ছোট ইংরেজ। আর যারা জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ঔদার্য ও পরোপকার, অনুসন্ধিত্সা ও আবিষ্কারের নেশায় জগতের নানা দিকে ছুটে গেছে, নানা জাতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তাদের মধ্যে তিনি বড় ইংরেজদের দেখতে পেয়েছেন। হয়তো বাঙালির মধ্যে কেউ বড় বাঙালি ও ছোট বাঙালির সন্ধান করতে পারেন।
অধুনা প্রায়ই একটু সংবেদনশীল মানুষকে আফসোস করতে শোনা যায়, দেশে বড়মাপের মানুষের বড় আকাল। এমনকি চরম হতাশা থেকে বলতে শোনা যায়, দেশে মানুষেরই আকাল চলছে। কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। স্বার্থ ও বিষয়বুদ্ধির প্রেরণায় চালিত বলে মানুষের নজর যায় ছোট হয়ে, গণ্ডি হয় ক্ষুদ্র এবং বিচারবুদ্ধি ঘুরপাক খায় আপন স্বার্থকে ঘিরে। আর সামগ্রিকভাবে সমাজের বাস্তবতাটা এ রকম হলে সেখানে বড় বাঙালির জন্ম ও রক্ষা পাওয়া কঠিন।
বাঙালির মধ্যে ক্ষুদ্রতা-সংকীর্ণতার বৃত্তি নতুন নয়, অনেক পুরোনো। আদতে একাত্তর এক ব্যতিক্রমী সময়, যখন প্রধানত নেতৃত্ব ও রাজনীতির গুণে মানুষ তার অভ্যস্ত ক্ষুদ্রতার গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল; ঐক্য, ত্যাগ ও বীরত্ব তাকে বড় করেছিল, মহত্ত্বের পথে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
হয়তো বরাবরের বাঙালির ক্ষুদ্রতা-সংকীর্ণতার পাঁচালি বড়ই দীর্ঘ ও ভয়ংকর। বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি চরিত্রকে যথার্থই চিত্রিত করেছেন। ‘বিদ্যাসগরচরিত’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহঙ্কার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তি বিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’
বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগর ছিলেন এর বিপরীত চরিত্রের মানুষ। একজন সত্যিকারের বড় বাঙালি। আর স্বয়ং বিদ্যাসাগর তাঁর শেষ জীবনে ‘এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হূদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিকদের’ সংস্পর্শ এড়িয়ে তাদের ধিক্কার জানিয়ে তথাকথিত সভ্যসমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন, সরিয়ে নেন সাধারণ মানুষের মধ্যে।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, লালন—সব বড় বাঙালিকেই এই সমাজ নানাভাবে উত্ত্যক্ত, বিরক্ত এমনকি নিন্দা-সমালোচনার দ্বারা রক্তাক্ত করে ছেড়েছে। এ যেন পানাপুকুরের মতো—একাত্তর যেন সেই পুকুরে নিক্ষিপ্ত একটা ঢিলের বেশি অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারল না। তখন পানা সরে গিয়ে স্বচ্ছ জল দেখা দিয়েছিল, অবাধে সাঁতরানোর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সে পর্ব পেরিয়ে আবার পানাপুকুর দ্রুত স্বরূপে ফিরে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথের বিদ্রূপের পাত্র হয়েই থাকলাম আমরা, আর বিদ্যাসাগরের আক্ষেপকে সত্য করে তোলার ব্রত ধারণ করেছি। এখন নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এঁরা ক্ষুদ্র, তার্কিক, দাম্ভিক বাঙালিকে চিনতেন। বর্তমান কালের এই নিষ্ঠুর নির্মম বাঙালিকে তাঁরা কি চিনবেন? মুক্তিযুদ্ধের অবশেষ হিসেবে গৌরবের বাগাড়ম্বর আর রক্তের নেশাই কি থাকল আমাদের শেষ সম্বল?
বলি, কেবল অর্থনীতি নয়, রাজনীতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে, মানুষকে দেশ ও মানুষ এবং ভবিষ্যৎ-সচেতন করতে হলে যথার্থ রাজনীতির প্রয়োজন। শেখ হাসিনা এদিকে একটু মনোযোগ দিলে ভালো হয়। কারণ পিতার আরব্ধ কাজ শেষ করার দায় তো ইতিহাস তাঁর কাঁধেই চাপিয়েছে। একবার বঙ্গবন্ধুর জাদুকরি নেতৃত্বে বাঙালি তার অভ্যাসের গণ্ডি ভেঙে জাতি হিসেবে বড় হয়ে উঠেছিল এবং সেই জোরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। এবার অচলায়তন ভেঙে সামনে এগোতে হলে, মধ্য আয়ের দেশ হয়ে সম্মান নিয়ে বাঁচতে হলে আবারও বাঙালিকে সব ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থের গণ্ডি ভেঙে বড় হয়ে উঠতে হবে। এ ছাড়া কাজ হবে না। সেই কাজে কে আর নেতৃত্ব দেবে বঙ্গবন্ধু-কন্যা ছাড়া? নতুন যুগের নতুন রাজনীতির মন্ত্রে নতুন প্রজন্মের বাঙালিকে জাগিয়ে আবারও ঐক্য, ত্যাগ ও কর্মের বাতাবরণ তৈরি করে বাঙালিকে বড় করে তুলতে হবে। বড় সাফল্যের জন্য নিজেদের বড় হওয়া ছাড়া গতি নেই।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
এই সদর্থক জাগরণ ও পরিবর্তন সহজে ঘটেছিল, কারণ সে দিন আমাদের সামনে ছিল স্বদেশ স্বাধীন করার বিশাল স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আমাদের নাগালের মধ্যে এসেছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মতো কান্ডারিদের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল ত্যাগে, বীরত্বে, প্রজ্ঞা ও অঙ্গীকারে অতুলনীয় অবস্থানে। মানুষ নেতৃত্বের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পেরেছিল, আর তারা দেখেছিল তাঁদের স্বপ্নটি সম্ভবপরতার মধ্যে চলে এসেছে।
একাত্তরে অপরাধ কমে গিয়েছিল। বাঙালির মধ্যে মানবতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব ও পরোপকারের আদর্শ সক্রিয় ছিল সেদিন। মুষ্টিমেয় কিছু দুষ্কৃতকারী ব্যতীত দেশবাসী এই এক উচ্চ আদর্শে সেদিন এক লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
আজকের সমাজকে কোনো দিক থেকেই সেই আদর্শের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না—না-সে একাত্তর-পূর্ব ঘরকুনো ভেতো বাঙালি হয়ে গেল, না-সে একাত্তরের উচ্চ আদর্শকে ধারণ করে থাকল। আজকে আমাদের সমাজে প্রতিদিনের ঘটনা ও দুর্ঘটনায় আমরা দেখছি, মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে, আপনজনের প্রতি নির্দয় হয়ে পড়ছে, সামান্য স্বার্থে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ তার করতে বাধছে না। আবার সমস্যার চাপে পড়ে সমাধানের পথ খুঁজছে আত্মবিনাশ, এমনকি সন্তানসহ আত্মঘাতী হওয়ার পথে।
পরিবারে, বাড়িতে কান পাতলে কেবল যেন ভাঙনের শব্দ শোনা যায়। সবার মনের মধ্যে অপ্রাপ্তি-অতৃপ্তির ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নানা মাত্রায় প্রকাশ পাচ্ছে। সমাজে ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। এতে নিকটজনেরা সামান্য কারণে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে প্রতিশোধ নেওয়ার জিঘাংসাবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আর তার প্রকাশ ঘটছে জঘন্য সব অপরাধের ভেতর দিয়ে।
অন্যদিকে দেখছি, স্বাধীনতার পর অনেক পাওয়ার পরও পাওয়ার দৌড়ে ক্ষান্তি নেই, সেই দৌড়ে সহযাত্রী চায় না কেউ, যে শামিল হচ্ছে সে-ই প্রতিদ্বন্দ্বী এবং যেকোনো মূল্যে তাকে দমাতে হবে—এমনটাই সবার ইচ্ছা। এভাবে সমাজের মানবিক বাতাবরণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সমাজ অমানবিক হয়ে পড়েছে।
ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ এত প্রবল ও অনমনীয় যে সমাজব্যবস্থাকে টেকানোর জন্য যেটুকু সমঝোতা করতে হয় বা মানিয়ে নিতে হয়, এর জন্যও কেউ প্রস্তুত নয়। কিছু নিতে হলে কিছু দিতে হয়, কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়—এই সামান্য নীতিটুকু মানতেও আমরা আজ আর রাজি হচ্ছি না।
ফলে সমাজে এক অশুভ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, ভেঙে পড়ছে ব্যবস্থা। বলতে দ্বিধা নেই, এ রকম পরিস্থিতি পশুদের মধ্যে তৈরি হতে পারে। বনের কর্তৃত্ব, দলের নেতৃত্ব বজায় রাখা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। সে লড়াই রক্তক্ষয়ী ও প্রাণঘাতী হয়ে থাকে। এক অঞ্চলে দুই বাঘ বা দুই সিংহ থাকে না, থাকতে পারে না। সহাবস্থানে অভ্যস্ত নয় বলেও কিন্তু বিভিন্ন প্রজাতির পশু বিলীন হয়ে যায়। সাম্প্রতিক অনেক হত্যাকাণ্ডই যেন এ রকম মানসিকতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে—এক ব্যবসায় দুই বাঘ টিকছে না, এক দলে দুই সিংহ থাকতে পারছে না। এখানে খতম করার নীতি চলছে।
একজন বিজ্ঞানী বলেছিলেন, যেসব প্রাণী নিজ প্রজাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকে, সহযোগিতা ও সহাবস্থানের বাতাবরণ নষ্ট করে, তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। তিনি মনে করেন, মানুষ ক্রমেই নিজ প্রজাতির মধ্যে হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ছে বেশি। তাঁর আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে মানব প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং তা ঘটবে শিগগিরই।
ঘুষ খাওয়া ও মিথ্যাচার বিরাটসংখ্যক মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার চেয়ে ভয়ানক হলো, একদল মানুষ তৈরি হচ্ছে, যারা সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্যের ভেদাভেদ বুঝতে পারছে না। কিছুদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে এক মাছচাষির সঙ্গে উপস্থাপকের কথা হচ্ছিল। অভিযোগটা হলো, সহজে ও দ্রুত বেশি মাছ ধরার জন্য তাঁরা স্বল্প পরিমাণ বিষ জলাশয়ে ছেড়ে দেন। তাতে মাছগুলো মরে ভেসে ওঠে এবং তাঁরা তুলে আড়তদারের কাছে বিক্রি করেন। তারপর আবার খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ক্রেতার কাছে এ মাছ পৌঁছায়। এই বিষ যে ক্ষতিকর, ধীর কিন্তু কার্যকর বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তাঁরা নিজেরাও যে এই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, সে কথা শোনার পর সেই সাধারণ মানুষটি সরলভাবে জানিয়েছিলেন, না, তাঁদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ নিজেদের খাওয়ার মাছগুলো বিষ প্রয়োগের আগেই তাঁরা তুলে নেন।
কথাটা তিনি সরলভাবে সরলবিশ্বাসে গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে বলেছিলেন, কারণ সত্যিই ভালো-মন্দের বোধ তাঁর মধ্যে নেই। আর যারা জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে বদলা নেওয়ার নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে, তারা হয়তো এককালে সত্য-মিথ্যা ও ভালো-মন্দের ফারাকটুকু জানতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লোভ-ভোগের বশবর্তী হয়ে এখন সূক্ষ্ম মানবিক বৃত্তিগুলো অসাড় ও অকেজো হয়ে গেছে। এদের কি ঊনমানব (lesser humanbeing) বলব?
কিন্তু যখন পুরো সমাজে, কিংবা সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষগুলোর মধ্যেও একই রকম অসাড়তা দেখা যায় মূল্যবোধের ক্ষেত্রে তখন? আমাদের শিক্ষকেরা কি জানেন না, মুখস্থ করে কোনো বিদ্যা অর্জন সম্ভব নয়? কেবল তাঁদের নির্বাচিত সাজেশন-নির্ভর সীমিতসংখ্যক প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করাকে বিদ্যার্জন বলা যায় না, তা কি তাঁরা জানেন না? অভিভাবকদের একটি বড় অংশ কি জানেন না, এভাবে চামচে তুলে মুখস্থ করে ভালো ফল করার কোনো দাম নেই? কিন্তু সমাজ তো সদলবলে এই দিকেই চলেছে। এ সমাজের পতন কীভাবে ঠেকানো যাবে?
রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ছোট ইংরেজ ও বড় ইংরেজের কথা বলেছেন। যারা শাসনদণ্ড নিয়ে ছলেবলে, চক্রান্ত, অন্যায় ও নিপীড়নের মাধ্যমে পরদেশ দখল করে শাসন ও শোষণ চালায়; বেনিয়াবৃত্তির বুদ্ধিতে চলে, তারা ছোট ইংরেজ। আর যারা জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ঔদার্য ও পরোপকার, অনুসন্ধিত্সা ও আবিষ্কারের নেশায় জগতের নানা দিকে ছুটে গেছে, নানা জাতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তাদের মধ্যে তিনি বড় ইংরেজদের দেখতে পেয়েছেন। হয়তো বাঙালির মধ্যে কেউ বড় বাঙালি ও ছোট বাঙালির সন্ধান করতে পারেন।
অধুনা প্রায়ই একটু সংবেদনশীল মানুষকে আফসোস করতে শোনা যায়, দেশে বড়মাপের মানুষের বড় আকাল। এমনকি চরম হতাশা থেকে বলতে শোনা যায়, দেশে মানুষেরই আকাল চলছে। কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। স্বার্থ ও বিষয়বুদ্ধির প্রেরণায় চালিত বলে মানুষের নজর যায় ছোট হয়ে, গণ্ডি হয় ক্ষুদ্র এবং বিচারবুদ্ধি ঘুরপাক খায় আপন স্বার্থকে ঘিরে। আর সামগ্রিকভাবে সমাজের বাস্তবতাটা এ রকম হলে সেখানে বড় বাঙালির জন্ম ও রক্ষা পাওয়া কঠিন।
বাঙালির মধ্যে ক্ষুদ্রতা-সংকীর্ণতার বৃত্তি নতুন নয়, অনেক পুরোনো। আদতে একাত্তর এক ব্যতিক্রমী সময়, যখন প্রধানত নেতৃত্ব ও রাজনীতির গুণে মানুষ তার অভ্যস্ত ক্ষুদ্রতার গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল; ঐক্য, ত্যাগ ও বীরত্ব তাকে বড় করেছিল, মহত্ত্বের পথে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
হয়তো বরাবরের বাঙালির ক্ষুদ্রতা-সংকীর্ণতার পাঁচালি বড়ই দীর্ঘ ও ভয়ংকর। বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি চরিত্রকে যথার্থই চিত্রিত করেছেন। ‘বিদ্যাসগরচরিত’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহঙ্কার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তি বিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’
বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগর ছিলেন এর বিপরীত চরিত্রের মানুষ। একজন সত্যিকারের বড় বাঙালি। আর স্বয়ং বিদ্যাসাগর তাঁর শেষ জীবনে ‘এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হূদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিকদের’ সংস্পর্শ এড়িয়ে তাদের ধিক্কার জানিয়ে তথাকথিত সভ্যসমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন, সরিয়ে নেন সাধারণ মানুষের মধ্যে।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, লালন—সব বড় বাঙালিকেই এই সমাজ নানাভাবে উত্ত্যক্ত, বিরক্ত এমনকি নিন্দা-সমালোচনার দ্বারা রক্তাক্ত করে ছেড়েছে। এ যেন পানাপুকুরের মতো—একাত্তর যেন সেই পুকুরে নিক্ষিপ্ত একটা ঢিলের বেশি অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারল না। তখন পানা সরে গিয়ে স্বচ্ছ জল দেখা দিয়েছিল, অবাধে সাঁতরানোর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সে পর্ব পেরিয়ে আবার পানাপুকুর দ্রুত স্বরূপে ফিরে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথের বিদ্রূপের পাত্র হয়েই থাকলাম আমরা, আর বিদ্যাসাগরের আক্ষেপকে সত্য করে তোলার ব্রত ধারণ করেছি। এখন নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এঁরা ক্ষুদ্র, তার্কিক, দাম্ভিক বাঙালিকে চিনতেন। বর্তমান কালের এই নিষ্ঠুর নির্মম বাঙালিকে তাঁরা কি চিনবেন? মুক্তিযুদ্ধের অবশেষ হিসেবে গৌরবের বাগাড়ম্বর আর রক্তের নেশাই কি থাকল আমাদের শেষ সম্বল?
বলি, কেবল অর্থনীতি নয়, রাজনীতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে, মানুষকে দেশ ও মানুষ এবং ভবিষ্যৎ-সচেতন করতে হলে যথার্থ রাজনীতির প্রয়োজন। শেখ হাসিনা এদিকে একটু মনোযোগ দিলে ভালো হয়। কারণ পিতার আরব্ধ কাজ শেষ করার দায় তো ইতিহাস তাঁর কাঁধেই চাপিয়েছে। একবার বঙ্গবন্ধুর জাদুকরি নেতৃত্বে বাঙালি তার অভ্যাসের গণ্ডি ভেঙে জাতি হিসেবে বড় হয়ে উঠেছিল এবং সেই জোরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। এবার অচলায়তন ভেঙে সামনে এগোতে হলে, মধ্য আয়ের দেশ হয়ে সম্মান নিয়ে বাঁচতে হলে আবারও বাঙালিকে সব ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থের গণ্ডি ভেঙে বড় হয়ে উঠতে হবে। এ ছাড়া কাজ হবে না। সেই কাজে কে আর নেতৃত্ব দেবে বঙ্গবন্ধু-কন্যা ছাড়া? নতুন যুগের নতুন রাজনীতির মন্ত্রে নতুন প্রজন্মের বাঙালিকে জাগিয়ে আবারও ঐক্য, ত্যাগ ও কর্মের বাতাবরণ তৈরি করে বাঙালিকে বড় করে তুলতে হবে। বড় সাফল্যের জন্য নিজেদের বড় হওয়া ছাড়া গতি নেই।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments