পবিত্র লাইলাতুল বারাত-কল্যাণময় রজনী by সৈয়দ গোলাম মোরশেদ

শবেবরাত। মুসলমানদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক রজনী। মুসলমানদের বিশ্বাস, এ মোবারক রজনীতে আল্লাহপাক পরবর্তী এক বছরের জন্য তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ করে থাকেন। অর্থাৎ বলা যায়, তকদিরের বাজেট পেশ করে থাকেন।


ইরান ও বাংলা, পাক-ভারত উপমহাদেশে এ রজনীকে শবেবরাত বলা হয়, যার অর্থ নিষ্কৃতির রাত্রি, পাপ মার্জনার রাত্রি বা ভাগ্যরজনী। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, ওই রাতে আল্লাহ সর্বনিম্ন আকাশে অবতরণ করেন এবং মানুষকে তাদের পাপ মার্জনায় প্রার্থনার আহ্বান জানান ও তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন (তিরমিজি)। হাদিসে আরো উল্লেখ আছে, শাবান মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্যান্য মাস অপেক্ষা অধিক রোজা রাখতেন এবং রাতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতেন। স্বয়ং তিনি সারা রাত্রি নফল ইবাদত করতেন ও উম্মতদেরও অনুরূপ করার নির্দেশ দিয়েছেন (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি ইত্যাদি)। ১৪ শাবান দিবাগত রাত হচ্ছে সেই মহিমান্বিত রাত শবেবরাত। 'লাইলাতুল নিছফি মিন শাবান' হাদিস দ্বারা তা প্রমাণিত।
পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে যে আয়াত আছে তা হলো_'ইন্না আনজালনাহু ফী লাইলাতিল মুবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুনজিরীন, ফী হা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকীম'। [সুরা দুখান ৩-৪]
অর্থ : আমি ইহা কল্যাণময় রজনীতে নাজিল করেছি। আমিই সতর্ককারী। তাতে আমার আদেশে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মীমাংসিত হয়। ওই আয়াতে 'লাইলাতুম মুবারাকাত' বলে যে শব্দ আছে তা দ্বারা আল্লাহপাক কোন রাতকে বুঝিয়েছেন তা নিয়ে মুফাচ্ছিরদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। মুফতি সফি গং মুফাচ্ছিরদের মতে, 'লাইলাতুম মুবারাকাত' বলতে আল্লাহপাক শবে কদরকেই বুঝিয়েছেন। তাঁদের মতে শবে কদরে পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ার ব্যাপারে যেহেতু মুফাচ্ছিরদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই, সেহেতু সুরা দুখানে 'মুবারক রাতে এটা নাজিল করেছি'-এ কথার দ্বারা ওই শবে কদরের রাতকেই আল্লাহপাক 'মুবারক রাত' বলে উল্লেখ করেছেন। ইকরিমা প্রমুখ কয়েকজন মুফাচ্ছির থেকে বর্ণিত আছে, ওই আয়াতে মুবারক রাত বা বরকতের রাত বলতে শবেবরাত তথা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতকেই বোঝানো হয়েছে।
সম্ভবত দুটি পৃথক রাতে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে_এ ধারণার কারণে ওই মুবারক রাত নিয়ে তাঁদের মধ্যে এ মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। অথচ ওই দুই আয়াতের কোনোটিতেই আল্লাহপাক কোরআন শব্দটি উল্লেখ করেননি। 'হু' শব্দটি উল্লেখ করেছেন যার অর্থ 'ইহা'। ওই 'হু' বা 'ইহা'কেই তাঁরা পবিত্র কোরআন বলে ধরে নিয়েছেন। অথচ সুরা বাকারার ১৮৫ আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, শাহরু রামাদ্বানাল্লাজী উনজিলা ফীহিল কুরআন হুদালি্লন্নাছি'। অর্থাৎ পবিত্র রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল হয়, যা মানবজাতির জন্য হেদায়েতস্বরূপ। মুফাচ্ছিররা ধরে নিয়েছেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হওয়ার জিনিস হচ্ছে একমাত্র কোরআন। অথচ হজরত আদম, ঈসা ও মরিয়ম (আ.)-এর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে 'রূহ' মুমিনদের কল্যাণের জন্য লৌহ (জুলফিকার) নাজিল হওয়ার কথাও পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। হয়তো সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআনের আয়াত পবিত্র রমজান মাসে নাজিল হতে পারে, যার সমর্থন আমরা পবিত্র কোরআনেই পাই (২.১৮৫)। কিন্তু পুরো কোরআন পবিত্র রমজান মাসে নাজিল হয়েছে এমন কোনো দলিল- প্রমাণ ও ঐতিহাসিক ভিত্তি আমাদের হাতে নেই। মুফতি সফি গংয়ের মতে পবিত্র কোরআন একসঙ্গে এক দফায় প্রথম আসমানে নাজিল হয় এবং তা ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে ২৩ বছর ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর নাজিল হয়। তাঁর এ কথাও পবিত্র কোরআন সমর্থন করে না। পবিত্র কোরআন বলছে, 'সৃষ্টিজগতে এমন কোনো বস্তু নেই, যা ওই আমানতকে (কোরআন) ধারণ করবে একমাত্র মানুষ (মুহাম্মদ সা.) ছাড়া' [৩৩:৭২]
পবিত্র কোরআন কোথায় আছে এবং কোথা থেকে নাজিল হয় তাও পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত আছে। 'বাল হুয়া কোরআনুম মজিদ ফী লাওহিম মাহফুজ' [সুরা বরুজ : ২২-২৩ ]। অর্থাৎ ওই পবিত্র কোরআন লাওহে মাহফুজে (সুরক্ষিত তক্তার মধ্যে) সংরক্ষিত আছে। 'লা ইয়ামাছছুহু ইল্লাল মুতহারুন' [সুরা ওয়াকিয়াহ: ৭৭-৭৯]। অর্থ পূত-পবিত্র লোকেরা (নবী-রাসুলের পবিত্র আত্মা) ছাড়া কেউই তা স্পর্শ (ধারণ) করতে পারে না। ওই লাওহে মাহফুজ থেকে তা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র আত্মায় ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ হয়েছে বলেও পবিত্র কোরআন সাক্ষী দিচ্ছে (দেখুন সুরা বাকারা : ৯৭)।
যেহেতু প্রথম আসমান সৃষ্টবস্তু সেহেতু কোনো সৃষ্টবস্তুর ওপর কোরআন অবতীর্ণ হলেও তা ভেঙে খান খান হয়ে যেত বলেও পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে (দেখুন সুরা হাশর : ২১)।
পবিত্র কোরআন এ কথাও সাক্ষ্য দিচ্ছে, লাওহে মাহফুজ থেকে পবিত্র কোরআন এক দফায় না প্রথম আসমানে_না নবীজি (সা.)-এর ওপর নাজিল হয়েছে, বরং তা ক্রমান্বয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তঃকরণে নাজিল হয়েছে (দেখুন সুরা ফোরকান : ৩২)।
পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ার কারণেই শুধু নয় (আমাদের মুফতি মহোদয়দের ধারণা মতে) আরো অনেক আধ্যা@ি@@@ক ও জাগতিক কল্যাণের কারণে, পবিত্র কোরআন ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে এ শবেবরাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব আমাদের কাছে অপরিসীম। বিশেষ রাতের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা আল্লাহ ও রাসুল (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ওই সব বিশেষ রাতে বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা, ইবাদত-বন্দেগি করা, রহমত ও মাগফিরাত কামনা করা উম্মতের জন্য অশেষ কল্যাণময় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যারা এসব নফল ইবাদতের মধ্যে শিরক ও বেদআতের গন্ধ খুঁজে পায় তাদের কথা আলাদা। শবেবরাতে আমাদের দেশে ঘরে ঘরে হালুয়া-রুটি এবং ভালো খাবারের আয়োজন করা একটি সামাজিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এটি ইসলামি সংস্কৃতি ও ইবাদতের একটি সুন্দরতম অঙ্গ। ওই দিনে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা এবং তা গরিব মিছকিনদের খাওয়ানো, দান-খয়রাত করা, বুজর্গ ও অলি-আল্লাহর মাজার জিয়ারত করা, নফল ইবাদত করা, রোজা রাখা_এ সবই অত্যন্ত নেক আমল। বিরুদ্ধবাদীদের সব বাধা উপেক্ষা করে ওই নিয়মে বেশি বেশি করে শবেবরাত পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দিকে অগ্রসর হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, 'নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা শাবানের ১৫ রাতে বনীকেলাব, রাবিয়া ও মোদার গোত্রের মেষের লোমসংখ্যক গুনাহগার উম্মাহকে ক্ষমা ও রহমত করেন (হজরত ফরিদুদ্দিন আত্তার রচিত তাজকিরাতুল আউলিয়া)।
আশেকে রাসুল (সা.)-এর উদ্দেশে একটি ঘটনা বর্ণনা করছি_
আশেকে রাসুল (সা.) হজরত ওয়ায়েছ করনী (রা.) ওহুদের যুদ্ধে প্রিয় নবীজি (সা.)-এর একটি দন্ত মোবারক শহীদ হয়েছে শুনতে পেয়ে নিজের ৩২টি দাঁত ভেঙে ফেলেন। প্রিয় নবী (সা.) তা জানতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মা ফাতেমা (রা.)-কে আদেশ দিলেন, 'মা, আমার বন্ধু খুবই অসুস্থ। কোনো শক্ত খাবার সে খেতে পারে না। তাঁর জন্য তুমি কিছু নরম খাদ্য তৈরি করো।' মা ফাতেমা (রা.) নির্দেশিত নরম রুটি ও হালুয়া তৈরি করে দিয়েছিলেন, যা প্রিয় নবী (সা.) জিবরাইল (আ.)-এর মারফত তাঁর মাহবুব ওয়ায়েছ করনী (রা.)-এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং সেদিন ছিল ১৫ শাবান অর্থাৎ শবেবরাত। সেই থেকে শবেবরাতে হালুয়া-রুটি খাওয়া ও বিতরণ করা সুন্নতে পরিণত হলো। প্রিয় নবী (সা.) হজরত আলী ও হজরত ওমর (রা.)-এর মাধ্যমে তাঁর পবিত্র খিরকাটি তাঁর প্রিয় মাহবুব ওয়ায়েছ করনীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে আশেকে রাসুল (সা.) হালতে মৃত্যুবরণ করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
syedgolammorshed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.