রাষ্ট্রপতির প্রত্যাশিত উচ্চশিক্ষা by মিল্টন বিশ্বাস

উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং বেশির ভাগ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. জিল্লুর রহমানের একটি প্রত্যাশিত বক্তব্য গত ৫ জুলাই সব জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি শিক্ষার মান সম্পর্কে কথা বলেছেন।


বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের প্রত্যাশা আমাদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং দিকনির্দেশনামূলক। কারণ পৃথিবী যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই আমরা এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পেছনে হাঁটতে শুরু করেছি। প্রতিনিয়তই তার দৃষ্টান্ত আমাদের চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি সনদ এবং বইনির্ভরতার পরিবর্তে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুনভাবে নিযুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যমণ্ডলী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় তিনি একই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। উপরন্তু তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী-শিক্ষিকা হয়রানির অভিযোগের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে রাষ্ট্রপতি জানেন, কিভাবে দেশের উন্নয়নে অবকাঠামো তৈরি করা যায়। আর শিক্ষার মান এবং অধিকার সম্পর্কে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গী হিসেবে প্রথম থেকেই সচেতন। তাই তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাস, উন্নত অবকাঠামো এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। আর সব শ্রেণীর মানুষ যেন সেসব প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, বর্তমানে মানবতার পরিবর্তে বৈষয়িক প্রাপ্তি গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই প্রকৃত মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাকে কাজে লাগানোর নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি ঠিকই বলেছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় সমাপ্ত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা শুধু একটি সনদ উপার্জনের জন্যই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না, বরং সংস্কারমুক্ত ও যুক্তিশীল মননের অধিকারী একজন ব্যক্তি হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অন্যতম পুরোধাও তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানার্জনে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং সত্য অনুসন্ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা জানি, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ছিল জ্ঞান সৃষ্টি করা, জ্ঞান-জগতের বিচিত্র উদ্ভাবনের নতুন ব্যাখ্যা-বিশ্ল্লেষণ, সর্বোপরি শ্রেণীকক্ষে পাঠদান ও গবেষণায় শিক্ষার্থীদের নিয়ত নিয়োজিত রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একাধারে জ্ঞানদান করেন, নিজে জ্ঞান সৃষ্টির জন্য আত্মনিমগ্ন থাকেন, শিক্ষার্থীর সুপ্ত জ্ঞান অভীপ্সা জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হন, সর্বোপরি মানব কল্যাণে জ্ঞানকে ব্যবহার করেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, গবেষণা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। 'বর্তমানে মানবতার পরিবর্তে বৈষয়িক প্রাপ্তি গুরুত্ব পাচ্ছে'_রাষ্ট্রপতির এই মন্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করতে হলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
তবে উচ্চশিক্ষার মান অনেক ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে। সেখান থেকে যথাযথ শিক্ষা সম্পন্ন করা হলেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়-আঙিনায় সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়। অথচ আমরা একই দিনের সংবাদপত্রে দেখলাম, একজন এমপি এক কলেজ শিক্ষককে বেধড়ক পিটিয়েছেন। কোন এক স্কুলে ডাস্টার ছুড়ে ছাত্রীর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন একজন শিক্ষক। ভিকারুননিসার ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা বহুল আলোচিত। আবার স্বামীর অত্যাচারে বর্তমানে অন্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রুমানার ঘটনাও মর্মস্পর্শী। এসব দৃষ্টান্ত গত এক মাসের মধ্যে সংঘটিত ঘটনা থেকে নেওয়া। এর বাইরে বছরের প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসীরা পেটাচ্ছে শিক্ষকদের। অবৈধ ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য ছাত্রসংগঠনের নেতারা হুমকি দিচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ব্যক্তিদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন মেধার এক শিক্ষক অন্য মেধাবী শিক্ষককে শায়েস্তা করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে মর্যাদা ছিল, তা বর্তমান সমাজে নেই বললেই চলে। সেই সময় গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে আসা একজন ছাত্রের উচ্চশিক্ষা অর্জন এবং মেধার পরিচয় দেওয়াটা ছিল একটা প্রচলিত ঘটনা। বর্তমানে গ্রাম থেকে ছাত্রদের ঢাকা শহরে এসে মেধাবী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার ঘটনা কমে এসেছে। ধনী এবং উচ্চ-মধ্যবিত্তরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকছে। কারণ সেখানে রাজনীতি ও সেশনজট নেই। টাকা বেশি ব্যয় হলেও শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নেন এবং অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করে বেরিয়ে আসতে পারে শিক্ষার্থীরা। চাকরি ছেড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। সুযোগ-সুবিধাসহ বেশি বেতন পাচ্ছেন সেখানে। পক্ষান্তরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় এমনসব নিম্ন মেধার ব্যক্তিরা শিক্ষক হয়েছেন, যা উচ্চশিক্ষার মানকে বাধাগ্রস্ত করছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতপন্থী একাধিক শিক্ষক শিক্ষাজীবনে ছাত্রশিবিরের ক্যাডার ছিলেন। এমনকি ছাত্রজীবনে পরীক্ষায় নকল করে বহিষ্কৃত হয়েছেন, এমন ব্যক্তিও শিক্ষক হয়েছেন এখানে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং এমফিল-পিএইচডিসহ প্রথম শ্রেণী বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। পিএইচডিধারী, কিন্তু চারটি দ্বিতীয় শ্রেণী প্রাপ্তকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমরা কেউ দেখতে চাই না। আবার একটি তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণী পাওয়া প্রার্থী স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণী পেলেও তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা দরকার। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে ছাত্রজীবনে কোনো ধরনের তৃতীয় শ্রেণী গ্রহণযোগ্য হতে পারবে না। নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করা ও জবাবদিহিতায় আনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, সেসব শিক্ষকের পরীক্ষায় পাসের ফল ও উচ্চতর ডিগ্রির বিবরণসহ একটি করে ডিরেক্টরি প্রকাশ করা হোক। এমনকি যোগ্যতা ঠিক আছে কি না, এ তথ্য যাচাই করার জন্য ইউজিসি মনিটরিং করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইউজিসির কাছে নিয়োগকৃত শিক্ষকের বায়োডাটা পাঠানো হোক। উল্লেখ্য, ইউজিসি নিয়োগকৃত যোগ্য শিক্ষকের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। এমনকি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে খবরদারি করতে পারে। মূলত ইউজিসি শক্তিশালী হলে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বন্ধ হতে পারে। উচ্চশিক্ষাকে বৈশ্বিক মানে উত্তীর্ণ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করা বর্তমান সরকারের অবশ্যই কর্তব্য হিসেবে পরিগণিত হোক_শিক্ষক হিসেবে এটাই আমার প্রত্যাশা।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
dr.miltonbis@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.