ধর্ম-ইসলাম মানবপ্রেমের কথা বলে by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে মানুষের হূদয়বৃত্তির ব্যাপক একটি ভুবনের কথা বলা হয়েছে। ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ স্বভাবতই নিজেকে ভালোবাসে। এ কারণে সে তার সৃষ্টিকর্তাকেও ভালোবাসে। মূলত ভালোবাসা দুটি পর্যায়ে বিভক্ত, একটি হলো স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির প্রেম আর অপরটি হলো সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির প্রেম।


নিজের প্রতি ভালোবাসার মূলসূত্র ধরেই মানুষ তার বাবা-মা, ভাইবোন, সন্তানসন্ততি, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এমনকি উপকারীকেও ভালোবাসে। আর এ ভালোবাসা পেতেই সে অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রয়াসে লিপ্ত হয়। স্রষ্টা নিজেও তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসার পাত্রের জন্য পৃথিবীকে সুশোভিত করে সাজিয়ে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন এবং তারা আল্লাহকে ভালোবাসে।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-৫৪)
মানুষকে সৃষ্টিগত দাবি অনুসারেই সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে হবে এবং তিনি যে পথ অনুসরণ করতে বলেছেন, তা অনুসরণ করতে হবে। স্রষ্টাপ্রেম হবে সব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে এবং সে পথ হবে সব পথের ঊর্ধ্বে। তাহলেই হবে সৃষ্টির সার্থকতা এবং স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সুসম্পর্ক। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা স্রষ্টাপ্রদত্ত একটি স্বাভাবিক ও অনিবার্য বিষয়; তাই এটি মানব মন ও দৈনন্দিন জীবনে ঈমানের দাবি। প্রাকৃতিক পরিবেশের অপরূপ সৌন্দর্য তথা গাছপালা, ফুল-পাখি, নদী-সমুদ্র, আকাশ এবং নানা মনোহারিণী বিষয়কে না ভালোবাসলে নিজের সন্তানকেও ভালোবাসা যায় না। তেমনি সৃষ্টিজগৎকে না ভালোবাসলে স্রষ্টাকেও ভালোবাসা যায় না। ফলে কোনো রকম প্রত্যাশা ছাড়াই মানুষ প্রকৃতিপ্রেমে নিমগ্ন হয়, অনেকে আপনজনহীন হয়েও একদল অনাত্মীয়ের ভীড়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। কেউ অসহায় কোনো মানুষ, শিশু বা জীবজন্তুর প্রতিও নিঃস্বার্থে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং তাকে কেন্দ্র করে নিজের জীবন চলার পথ বদলে ফেলে। মানবপ্রেম সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আর-রূম, আয়াত-২১)
জাগতিক সব কাজকর্ম ও নেক আমল আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সুদৃঢ় করার উপলক্ষ মাত্র। সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভই ধর্মপ্রাণ মানুষের সর্বোচ্চ মর্যাদার সম্বল। স্রষ্টাপ্রেম অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে তাঁর প্রতি গভীর ধ্যানমগ্নতা, আত্মসমর্পণ ও মনোনিবেশ করা। সমগ্র সৃষ্টি তার স্রষ্টাকে ভালোবাসে, আর স্রষ্টা নিজে তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টি ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ভালোবাসেন। মানবীয় গুণাবলির বিকাশ সাধন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং পরপারে পরিত্রাণ লাভ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ বাস্তবায়ন ও তাঁর ভালোবাসা অন্তরে স্থান দেওয়া ব্যতীত কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে দিকনির্দেশনা প্রদান করে ঘোষিত হয়েছে, ‘বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৩১)
ইসলামের দৃষ্টিতে মানবশ্রেণীতে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠতম পাত্র হচ্ছেন বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ (সা.)। কারণ, উম্মতে মুহাম্মদীর প্রতি তাঁর অনুগ্রহ ও অবদান সবচেয়ে বেশি। নবী করিম (সা.) তাঁর উম্মতকে দুটি কারণে ভালোবাসেন। ১. যারা তাঁর আনীত বিধিবিধান তথা পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী নিজের জীবন পরিচালিত করবে। ২. তাঁকে ভালোবেসে যাঁরা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং তাঁর ভালোবাসার পাত্র হয়েছিলেন। ইসলামি শরিয়তে নবী করিম (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা একটি অপরিহার্য কর্তব্য, যার অবর্তমানে ঈমানই পরিশুদ্ধ হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তানসন্ততি এবং সমগ্র বিশ্ববাসী অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় না হব।’ (বুখারি ও মুসলিম) তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা ঈমান না আনা পর্যন্ত বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। আবার পরস্পরকে ভালোবাসতে না পারা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না।’ (মুসলিম)
মানুষ যে উৎসের পরিপ্রেক্ষিতে একে অন্যকে ভালোবাসে, এ সম্পর্কে গভীরভাবে বিবেচনা করলে নির্দ্বিধায় বলতে বাধ্য হবে—আমার প্রেম-ভালোবাসা, জীবন-মৃত্যু, আমার সর্বস্ব সেই মহান সত্তার জন্য নিবেদিত, যিনি আমার সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা; যেমনিভাবে বলেছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ—সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, যিনি নিখিল বিশ্বের প্রতিপালক।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত-১৬২) তাই মুমিন মুসলমান হতে হলে অবশ্যই প্রত্যেক মানুষকে তার জীবন, সম্পদ, সন্তানসন্ততি—সবকিছুর চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে সর্বাধিক ভালোবাসতে হবে। তাঁর হুকুম-আহকাম বা বিধিবিধানগুলো শুধু জাহান্নামের ভয়েই নয়, বরং স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার জন্য পালন করতে হবে।
সৃষ্টিকর্তা মানুষের স্বভাব-চরিত্রে যে প্রেমবোধ দিয়েছেন, তা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সর্বব্যাপী। তাই মানুষ আপনজনের গণ্ডি ছাড়িয়ে তার ভালোবাসা আশপাশের সুবিস্তৃত পরিবেশমণ্ডলীতে ছড়িয়ে দেয়। ফলে দয়া-মায়া, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা এবং হূদয়ের টান একজন মানুষের পক্ষ থেকে অন্য মানুষ অবশ্যই পেতে পারে। একজন মানবের ভালোবাসা একজন মানবীও পেতে পারেন। তবে সে ভালোবাসা হতে হবে বৈধ ও অনুমোদিত। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসা, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা কেবল শরিয়তের অনুমোদনের গণ্ডিতেই আবদ্ধ নয়; বরং তা বহুবিধ পুণ্যময় কাজ। ভালোবাসা পোষণ ও প্রকাশের বৈধ কোনো সম্পর্ক ছাড়া ইসলামে একজন মানব-মানবীর মধ্যে হূদয়ের কোনো টান থাকা এবং প্রেমকে আরও গভীর করার কোনো সুযোগ নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে একজনের প্রতি অন্যের ভালোবাসা হতে হবে ‘ফিল্লাহ’ বা আল্লাহর ওয়াস্তে। অর্থাৎ, আমি তাকে ভালোবাসব এ জন্য যে তার প্রতি আমার ভালোবাসা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত। কেননা যারা মুমিন, তারা আল্লাহকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
তবে প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশের প্রতিযোগিতায় জঘন্য পাপাচার, ব্যভিচার ও অশ্লীলতায় নিমজ্জিত হওয়ার চেয়ে মনকে প্রকৃত অর্থে মানবপ্রেমের উপযোগী করে গড়ে তোলার চেষ্টা একান্ত কর্তব্য হওয়া উচিত। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে সঠিকভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে প্রাণাধিক ভালোবাসার তাওফিক দান করুন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.