সুবিধাবাদী ছাত্র নেতৃত্ব চাই না-ছাত্ররাজনীতি by মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার

শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো এরকম যোগ্য নেতৃত্বের কারণে বারবার অস্থিতিশীল হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। ছাত্রলীগের রাজনীতি যদি ছাত্রদের কল্যাণের রাজনীতি হয়ে ওঠে, তবে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির চেহারাটাই বদলে যাবে। কারণ বৃহৎ এই ছাত্র সংগঠনের প্রভাবে অন্য সংগঠনও বদলে যেতে বাধ্য হবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে।


প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্যাম্পাসে অথবা এর বাইরের সাংগঠনিক ইউনিটগুলোতে বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘাতের ঘটনা পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। বুয়েট, ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, শাহজালালসহ সব কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃদলীয় কোন্দলের ঘটনা যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করত যে, জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্র্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বিশেষ করে হলগুলোতে অস্ত্রের মহড়া দেয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দেখে এখন তারা কী বলবেন? হয়তো চিরাচরিত কথা ছাত্রলীগের মধ্যে শিবির অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু এ ধরনের কথা বারবার বলার অর্থ হচ্ছে এই সংগঠনের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ করা। কারণ শিবিরের নেতাকর্মীরা যদি ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হয়ে ওঠে তা হলে প্রকৃত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোথায়? আর একটি প্রশ্ন প্রসঙ্গক্রমে এসে যায় যে, শিবিরের নেতাকর্মীরা যদি ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তবে প্রকৃত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কেন তাদের প্রতিহত করে না? প্রকৃতপক্ষে দায় এড়ানোর জন্য যে ধরনের কথা বলা হোক না কেন এই বিষয়টি এখন স্পষ্ট যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এই সংগঠন এখন বহু সুবিধবাদীর আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকে আর ছাত্রলীগের যদি নেতা হওয়া যায় তবে কথা নেই, কীভাবে টাকা আয় করা যাবে অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সুবিধা পাওয়া যাবে_ তার চেষ্টায় সর্বদা ব্যস্ত থাকা এই সংগঠনের অধিকাংশ নেতাকর্মীর অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে উঠেছে। আজ যারা নেতা তারা এই ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির জন্য তার অনুগত কর্মীকে ব্যবহার করছে। কাল যখন এই কর্মী নেতা হচ্ছে তখন সেও অনুরূপ কাজ করছে। ফলে প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ভুলে তারা এখন টাকার আদর্শের জয়গান গাইছে। জুবায়েরের বাবার কথা এ ক্ষেত্রে আমার বারবার মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন যে, তারা একটি ফুলকে ফুটতে দিল না। সত্যি তো তাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রত্যেক শিক্ষার্থী একটি ফুল। এই ছাত্র নামধারী ছাত্রনেতাদের একটি ভুলে প্রতিবছর অগণিত ফুল ঝরে যাচ্ছে। আমরা কয়জনের খবর রাখি। কেউ একজন মারা গেলে তখন হয়তো সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারি। এর বাইরেও যে অনেক ঘটনা আছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয় তারা অবশ্যই মেধাবী। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে এমন অনেকে আছে শেষ পর্যন্ত পড়ালেখা সমাপ্ত করতে পারে না। এ রকম ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত তার কোনো হিসাব আমরা কি রাখি? জরিপ করলে বেরিয়ে আসবে এক ভয়াবহ চিত্র। এ জন্য আমি শুধু ছাত্রলীগকে দোষারোপ করছি না। বর্তমান ছাত্ররাজনীতির সামগ্রিক চিত্রটাই এ রকম। তবে অন্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ছাত্রলীগের মেলানো ঠিক হবে না। কারণ এটি যে জাতির জনকের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল যে একটি ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাই পরে একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতার দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল ও অগণিত ছাত্রলীগ কর্মীর রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত সোনার বাংলার সামগ্রিক ছাত্ররাজনীতির কলুষমুক্ত রাখা প্রকৃতপক্ষে ছাত্রলীগের পবিত্র দায়িত্ব। কিন্তু বর্তমানের ছাত্রনেতাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, ছাত্রলীগ মনে হয় এই বিষয়টি ভুলে গেছে।
এবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে নজর দিলে আর একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষক হিসেবে সেদিনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি আমি। ক্লাস শেষ করে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার অতিক্রম করার প্রাক্কালে বিবদমান দুটি গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার চিত্র নজরে পড়ল। দুটি গ্রুপই দেশীয় অস্ত্রে সুসজ্জিত। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুটি গ্রুপই জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, যদি দুটি গ্রুপই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী হয়, তবে কেন পরস্পর পরস্পরকে অস্ত্র হাতে ধাওয়া করবে? তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, মতের অমিল থাকতে পারে। কিন্তু তার জন্য কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক-বাহক অপর দলকে ধাওয়া করতে হবে? একটি জাতীয় দৈনিকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিষয়টি দু'দিন পর স্পষ্ট হয়ে উঠল। পত্রিকার ভাষ্য মতে, মূল কারণ অনেকটা এ রকম পদবঞ্চিত ও উঠতি নেতারা ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। ক্যাম্পাসে এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করলে কেন্দ্রীয় নেতারা ক্যাম্পাসের আহ্বায়ক কমিটির ব্যর্থ এই অজুহাত দেখিয়ে আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে দেবে এবং নতুন কমিটির নাম ঘোষণা করবে। ফলে পদবঞ্চিত ও উঠতি নেতাদের পদ পাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। হায়রে বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের চিন্তাধারা! পদ পাওয়াই যেন মূলনীতি!
পরিশেষে বলতে চাই, এখনও সময় আছে ছাত্রলীগের নেতাদের, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের। তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত যেন ব্যর্থতায় পরিণত না হয় সেই বিষয়টি ভাবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে ব্যক্তিগতভাবে এই দু'জনকে চিনি। সেই জায়গা থেকে বলছি আপনারা যেমন নিজেদের সব বিতর্কের ঊধর্ে্ব রেখেছেন, তেমনি এই সংগঠনের সাংগঠনিক কাঠামোর দিকে নজর দিন। টাকা অথবা পেশিশক্তিনির্ভর নেতা নির্বাচন না করে প্রকৃত ছাত্রনেতাদের হাতে সংগঠনের দায়িত্ব দিন। মেধাবী ছাত্ররা যদি সংগঠনের দায়িত্ব পায় তবে হয়তোবা এই সংগঠন তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। নতুবা কোনো একটি ঘটনা ঘটলে অনুপ্রবেশকারীদের ওপর দোষ চাপিয়ে অথবা কয়েকজনকে বহিষ্কার করে সংগঠনের ভবিষ্যৎ পতনকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। ভাবছেন ছাত্রলীগ অনেক বড় সংগঠন, এর কর্মী সংখ্যা অনেক। কিন্তু যদি কর্মীদের অধিকাংশ সুবিধাবাদী হয় তবে বিপদের দিনে অথবা সংগঠনের দুর্দিনে সার্চলাইট দিয়েও তাদের খুঁজে পাবেন না। আর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ত্যাগী নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন না করলে বিপদের দিনে রাগ-ক্ষোভ আর অভিমানে তারাও রাজপথে নামবে না। তাই সময় থাকতেই সচেতন হোন। আপনার দেশব্যাপী কমিটি গঠন করবেন। মেধাবী, যোগ্য ও ত্যাগী কর্মীদের হাতে নেতৃত্বের ভার অর্পণ করুন। তাহলে হয়তো ছাত্রলীগের রাজনীতি কলুষমুক্ত হবে। মেধাবী, ত্যাগী, যোগ্য প্রকৃত ছাত্রলীগ কর্মী অন্তত এই সংগঠনের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করবে না। তারা চাইবে না তাদের কারণে সংগঠনের সুনাম ক্ষুণ্ন হোক। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো এরকম যোগ্য নেতৃত্বের কারণে বারবার অস্থিতিশীল হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। ছাত্রলীগের রাজনীতি যদি ছাত্রদের কল্যাণের রাজনীতি হয়ে ওঠে, তবে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির চেহারাটাই বদলে যাবে। কারণ বৃহৎ এই ছাত্র সংগঠনের প্রভাবে অন্য সংগঠনও বদলে যেতে বাধ্য হবে। দয়া করে এ বিষয়টি আপনারা একবার ভাববেন কি? না হয় ছাত্রলীগের রাজনীতি যে অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে তার দায়ভার আপনারাও এড়াতে পারবেন না।

মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
salah.sakender@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.