ভারতে লোকপাল নিয়োগের বিতর্ক এবং বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত by এ এম এম শওকত আলী
লোকপাল মানে অমবুডসম্যান (Ombudsman)। এ প্রতিষ্ঠানটির উৎস স্ক্যান্ডিনেভিয়ান (Scandinavian) দেশে। ওই সব দেশেই অমবুডসম্যান শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অমবুডসম্যান দুর্নীতিসহ অন্যান্য অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ প্রতিরোধের দায়িত্বে নিযুক্তি লাভ করে।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে অমবুডসম্যান রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকারীদের দুর্নীতি, অনাচার ও অনিয়ম রোধে কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানে অমবুডসম্যান শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৮০ সালের দিকে এ-সংক্রান্ত একটি আইন প্রণীত হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই অমবুডসম্যান নিযুক্তির বিষয়ে কোনো আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। রাষ্ট্রবহির্ভূত কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে মাঝেমধ্যে কিছু গুরুত্ব আরোপ করলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরদের যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারেনি।
এ ক্ষেত্রে ভারতের চিত্র অনেকটা এক রকম হলেও সাম্প্রতিককালে কিছু ব্যক্তি ও তাঁদের সমর্থকরা ক্ষমতাসীন সরকারকে বহুলাংশে প্রভাবিত করার বিষয়ে সাফল্য অর্জন করেছেন। আন্না হাজারে নামীয় গান্ধীবাদী এক ব্যক্তি লোকপাল নিয়োগের জন্য চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে আমরণ অনশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর ফলে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারসহ কংগ্রেস ভীত হয়ে হাজারের সঙ্গে সংলাপও করে। হাজারের দাবি ছিল, এ-সংক্রান্ত খসড়া বিল নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিতর্কের একপর্যায়ে জানা যায় যে দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে খসড়া বিলের বিষয়ে বিরোধের অনেকটা নিষ্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।
হাজারে প্রথমে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠান। সময় ছিল ১০ মার্চ ২০১১। এতে হাজারে বলেন, 'আমি আমরণ অনশন করব, যদি না খসড়া প্রণয়ন সংক্রান্ত কমিটিতে ৫০ শতাংশ সদস্য নাগরিক সমাজ থেকে অন্তর্ভুক্ত হয়।' তিনি ৫ এপ্রিলের এক চিঠিতে এ বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি খসড়া বিলে জনলোকপাল শব্দটি ব্যবহার করেন। হাজারের আগে যোগগুরু রামদেব দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে সোচ্চার হয়েছিলেন। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তাঁর অন্যতম দাবি ছিল, বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের মতো ভারতেও কালো টাকার পরিমাণের বিষয়টি অনেকটা অস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফিনামিয়াল ইন্টিগ্রিটি নামীয় প্রতিষ্ঠানের মতে, ১৯৪৮-২০০৮ সময়কালে বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকার পরিমাণ ভারতের ক্ষেত্রে ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের টাকার পরিমাণের বিষয়টি বিতর্কিত। তবে এ বিতর্কে দেশের অভ্যন্তরে কালো টাকার পরিমাণের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। যোগগুরু রামদেবকে শেষ পর্যন্ত দিলি্ল পুলিশ শহর থেকে রাতের অন্ধকারে জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়। এরপর রামদেবের সম্পদ ও নগদ অর্থের পরিমাণও মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়।
হাজারের অনুসারী কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির বিষয়েও কিছু অনিয়মের তথ্য প্রকাশ করা হয়। বলা হয় যে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তি ও তাঁর ছেলে উত্তর প্রদেশের (ইউপি) মুখ্যমন্ত্রীর সহায়তায় বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হয়েছেন। ওই ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে একটি দুর্নীতির মামলা যাতে ব্যর্থ হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করেন। অর্থাৎ তিনি অন্যায়ভাবে পুরস্কৃত হন। এটাই ছিল তাঁর বিরুদ্ধে মিডিয়ায় অভিযোগ। এ ঘটনা উল্লেখ করে কিছু ভারতীয় সংবাদপত্র যে মন্তব্য করে তা ছিল, কংগ্রেস এ বিষয়ে গোপনে যথেষ্ট অনুশীলন করেছে।
ভারতে লোকপাল নিয়োগ সংক্রান্ত আইনি খসড়ার ইতিহাস অত্যন্ত পুরনো। ১৯৬৬ সাল থেকেই এ প্রচেষ্টার সূত্রপাত। ওই সময় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন লোকপাল নিয়োগের সুপারিশ করে। এরপর সংবিধান পর্যালোচনা কমিশন (২০০২) এবং পরবর্তী প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন (২০০৭) একই ধরনের সুপারিশ করে। প্রথম লোকপাল বিল ১৯৬৮ সালে প্রণীত হয়। লোকসভায় এ বিলটি পাস করা হয়। কিন্তু রাজ্যসভা বিলটি প্রত্যাখ্যান করে। এরপর ১৯৭১, ১৯৭৭, ১৯৮৫, ১৯৮৯, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ২০০১, ২০০৫ ও ২০০৮ সালে বিলটি সংসদে উত্থাপিত হয়। তবে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। রাজ্য পর্যায়ে লোকযুক্ত পদ সৃষ্টি এবং নিযুক্তি করা হয় মোট ১৮টি রাজ্যে। তবে নাগরিক লোকযুক্ত সম্পর্কে নাগরিক সমাজের ধারণা নেতিবাচক। তাদের মতে, এ ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হয়নি। লোকপাল বিল আইনে রূপান্তরিত না হওয়ার কারণ হিসেবে নাগরিক সমাজ একটি বিষয় চিহ্নিত করে। তাদের মতে, রাজনীতিবিদরা কোনো সময়ই তাঁদের ওপর নজরদারি হোক তা চান না। রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের আধিকারিক, যেমন_প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও বিচারপতিদের ওপর লোকপালের নজরদারি রইবে কি না, সে বিষয়টিও বিতর্কিত। এ সম্পর্কে একটি মতবাদ হলো, সবার জন্য লোকপালের নজরদারি আবশ্যক। অন্যটি হলো, অন্তত প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের নজরদারির বাইরে থাকবেন। পর্যায়ক্রমে দুটি সংবিধান পর্যালোচনা কমিশনের এ বিষয়ে সুপারিশ ছিল_প্রধানমন্ত্রীকে লোকপালের আওতাবহির্ভূত করা প্রয়োজন।
কমিশনের প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে যুক্তিও দেওয়া হয়েছিল। বলা হয় যে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করলে তিনি স্বীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবেন। হাজারের বর্তমান দাবির মধ্যে এ বিষয়টি সরকার ও তাঁর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। হাজারে প্রধানমন্ত্রীকেও লোকপালের অধিক্ষেত্রভুক্ত করতে আগ্রহী। জানা যায়, সরকার শেষ পর্যন্ত নমনীয় হয়ে প্রস্তাব করে যে প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার সময় তদন্ত হতে পারে। হাজারে তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। লোকপালের নিয়োগের দাবি এমন এক সময় হয়েছে, যখন ২জি-সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় ক্ষমতাসীন জোটের টেলিকমমন্ত্রী ও একজন মহিলা সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। পক্ষান্তরে এ কথাও বলা যায় যে এদের গ্রেপ্তার ও পরবর্তী সময়ে বিচারকাজ শুরু হয় এমন এক সময়, যখন লোকপালের অস্তিত্ব ছিল না। এ সত্ত্বেও নাগরিক সমাজের দাবি যে প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই লোকপালের আওতার মধ্যে থাকবেন।
ভারতসহ বিদেশের কিছু সাংবাদিক ও কলামিস্ট হাজারের দাবি সম্পর্কে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। প্রশ্নটি হলো, লোকপাল নিয়োগের মাধ্যমেই কি দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব? এ প্রসঙ্গে আরো যুক্তি প্রদান করা হয়েছে যে হাজারের মতে, লোকপাল নিয়োগের মাধ্যমে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ দুর্নীতি হ্রাস পাওয়ার দাবি নিতান্তই বায়বীয়। এসব সমালোচকের অভিমত হলো, বর্তমান শাসনব্যবস্থায় ঘুষ আদান-প্রদানের প্রবণতা অপরিবর্তিত থাকবে। এ ছাড়া দুর্নীতির শাস্তি যত কঠোর হবে, দুর্নীতি-সংক্রান্ত ঘুষের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে মোটামুটিভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তবে এ প্রতিষ্ঠানের নজরদারির কোনো কাঠামো নেই। নাগরিক সমাজ আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রতিষ্ঠানকে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা প্রদানে আগ্রহী। এর ফলে এখনো সরকার অথবা সংসদ সদস্য ও নাগরিক সমাজের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে মতভেদ অত্যন্ত দৃশ্যমান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে একটি সংসদীয় কমিটি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মধ্যে এ নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধ লক্ষ করা গেছে। এ ক্ষেত্রেও যে বিষয়টি মুখ্য তা হলো, নির্বাহী বিভাগ দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করছে কি না? এ প্রসঙ্গে কমিশনের চেয়ারম্যানের প্রকাশ্য উক্তি ছিল স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ থেকে তাঁর ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ হয় না। এ সত্ত্বেও নাগরিক সমাজ স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার। এ বিষয়ে সর্বশেষ উত্তেজনার বিষয় হলো, সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা। সম্প্রতি কমিশন-সংক্রান্ত আইন সংশোধনের বিষয়ে এ প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সংশোধিত খসড়া আইনে নির্বাহী বিভাগ কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার আগে সরকারের পূর্বানুমতির বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে নাগরিক সমাজ ও কমিশন সমস্বরে বলেছে, এর ফলে কমিশনের তদন্ত করার অধিকার বাধাগ্রস্ত হবে।
এ বিষয়ে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধিমালায় এ ধরনের কোনো বাধা স্থায়ীভাবে না রাখারও বিধান রয়েছে। বিধানটি হলো, অনধিক ৬০ দিনের মধ্যে সরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য কোনো বাধা নেই। এ বিষয় নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরেও কিছু মতভেদ রয়েছে। একজন প্রবীণ মন্ত্রী পূর্বানুমতি-সংক্রান্ত বিধান না রাখার পক্ষে। তবে এটা তাঁর ব্যক্তিগত মত। মূল বিষয়বস্তু লোকপাল নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত থেকে মুক্ত নন। বাস্তবে দেখা গেছে যে তদন্ত শুরু হয় সরকার পরিবর্তনের অব্যবহিত পর।
বাংলাদেশে লোকপাল বা 'অমবুডসম্যান' নিয়োগের কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। এ বিষয়ে একজন প্রবীণ মন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছেন, নেতিবাচক রাজনৈতিক ধারার কারণেই এটা হয়নি। যে বিষয়টি তিনি ঊহ্য রেখেছেন তা হলো, নির্বাচিত কর্মকর্তারা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে তাঁদের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ করুন_এটা চান না। এটা তাঁদের কাম্য নয়। বিদ্যমান আইনটি তিন দশক আগের। এ আইনটি আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। আইনটি প্রয়োজনীয় সংশোধনের সময় এর প্রভাব দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর পড়বে কি না সে বিষয়টি মুখ্য। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের মডেলটি পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। কারণ সে দেশে 'অমবুডসম্যান'সহ দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
এ ক্ষেত্রে ভারতের চিত্র অনেকটা এক রকম হলেও সাম্প্রতিককালে কিছু ব্যক্তি ও তাঁদের সমর্থকরা ক্ষমতাসীন সরকারকে বহুলাংশে প্রভাবিত করার বিষয়ে সাফল্য অর্জন করেছেন। আন্না হাজারে নামীয় গান্ধীবাদী এক ব্যক্তি লোকপাল নিয়োগের জন্য চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে আমরণ অনশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর ফলে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারসহ কংগ্রেস ভীত হয়ে হাজারের সঙ্গে সংলাপও করে। হাজারের দাবি ছিল, এ-সংক্রান্ত খসড়া বিল নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিতর্কের একপর্যায়ে জানা যায় যে দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে খসড়া বিলের বিষয়ে বিরোধের অনেকটা নিষ্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।
হাজারে প্রথমে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠান। সময় ছিল ১০ মার্চ ২০১১। এতে হাজারে বলেন, 'আমি আমরণ অনশন করব, যদি না খসড়া প্রণয়ন সংক্রান্ত কমিটিতে ৫০ শতাংশ সদস্য নাগরিক সমাজ থেকে অন্তর্ভুক্ত হয়।' তিনি ৫ এপ্রিলের এক চিঠিতে এ বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি খসড়া বিলে জনলোকপাল শব্দটি ব্যবহার করেন। হাজারের আগে যোগগুরু রামদেব দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে সোচ্চার হয়েছিলেন। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তাঁর অন্যতম দাবি ছিল, বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের মতো ভারতেও কালো টাকার পরিমাণের বিষয়টি অনেকটা অস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফিনামিয়াল ইন্টিগ্রিটি নামীয় প্রতিষ্ঠানের মতে, ১৯৪৮-২০০৮ সময়কালে বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকার পরিমাণ ভারতের ক্ষেত্রে ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের টাকার পরিমাণের বিষয়টি বিতর্কিত। তবে এ বিতর্কে দেশের অভ্যন্তরে কালো টাকার পরিমাণের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। যোগগুরু রামদেবকে শেষ পর্যন্ত দিলি্ল পুলিশ শহর থেকে রাতের অন্ধকারে জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়। এরপর রামদেবের সম্পদ ও নগদ অর্থের পরিমাণও মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়।
হাজারের অনুসারী কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির বিষয়েও কিছু অনিয়মের তথ্য প্রকাশ করা হয়। বলা হয় যে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তি ও তাঁর ছেলে উত্তর প্রদেশের (ইউপি) মুখ্যমন্ত্রীর সহায়তায় বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হয়েছেন। ওই ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে একটি দুর্নীতির মামলা যাতে ব্যর্থ হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করেন। অর্থাৎ তিনি অন্যায়ভাবে পুরস্কৃত হন। এটাই ছিল তাঁর বিরুদ্ধে মিডিয়ায় অভিযোগ। এ ঘটনা উল্লেখ করে কিছু ভারতীয় সংবাদপত্র যে মন্তব্য করে তা ছিল, কংগ্রেস এ বিষয়ে গোপনে যথেষ্ট অনুশীলন করেছে।
ভারতে লোকপাল নিয়োগ সংক্রান্ত আইনি খসড়ার ইতিহাস অত্যন্ত পুরনো। ১৯৬৬ সাল থেকেই এ প্রচেষ্টার সূত্রপাত। ওই সময় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন লোকপাল নিয়োগের সুপারিশ করে। এরপর সংবিধান পর্যালোচনা কমিশন (২০০২) এবং পরবর্তী প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন (২০০৭) একই ধরনের সুপারিশ করে। প্রথম লোকপাল বিল ১৯৬৮ সালে প্রণীত হয়। লোকসভায় এ বিলটি পাস করা হয়। কিন্তু রাজ্যসভা বিলটি প্রত্যাখ্যান করে। এরপর ১৯৭১, ১৯৭৭, ১৯৮৫, ১৯৮৯, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ২০০১, ২০০৫ ও ২০০৮ সালে বিলটি সংসদে উত্থাপিত হয়। তবে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। রাজ্য পর্যায়ে লোকযুক্ত পদ সৃষ্টি এবং নিযুক্তি করা হয় মোট ১৮টি রাজ্যে। তবে নাগরিক লোকযুক্ত সম্পর্কে নাগরিক সমাজের ধারণা নেতিবাচক। তাদের মতে, এ ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হয়নি। লোকপাল বিল আইনে রূপান্তরিত না হওয়ার কারণ হিসেবে নাগরিক সমাজ একটি বিষয় চিহ্নিত করে। তাদের মতে, রাজনীতিবিদরা কোনো সময়ই তাঁদের ওপর নজরদারি হোক তা চান না। রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের আধিকারিক, যেমন_প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও বিচারপতিদের ওপর লোকপালের নজরদারি রইবে কি না, সে বিষয়টিও বিতর্কিত। এ সম্পর্কে একটি মতবাদ হলো, সবার জন্য লোকপালের নজরদারি আবশ্যক। অন্যটি হলো, অন্তত প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের নজরদারির বাইরে থাকবেন। পর্যায়ক্রমে দুটি সংবিধান পর্যালোচনা কমিশনের এ বিষয়ে সুপারিশ ছিল_প্রধানমন্ত্রীকে লোকপালের আওতাবহির্ভূত করা প্রয়োজন।
কমিশনের প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে যুক্তিও দেওয়া হয়েছিল। বলা হয় যে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করলে তিনি স্বীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবেন। হাজারের বর্তমান দাবির মধ্যে এ বিষয়টি সরকার ও তাঁর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। হাজারে প্রধানমন্ত্রীকেও লোকপালের অধিক্ষেত্রভুক্ত করতে আগ্রহী। জানা যায়, সরকার শেষ পর্যন্ত নমনীয় হয়ে প্রস্তাব করে যে প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার সময় তদন্ত হতে পারে। হাজারে তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। লোকপালের নিয়োগের দাবি এমন এক সময় হয়েছে, যখন ২জি-সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় ক্ষমতাসীন জোটের টেলিকমমন্ত্রী ও একজন মহিলা সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। পক্ষান্তরে এ কথাও বলা যায় যে এদের গ্রেপ্তার ও পরবর্তী সময়ে বিচারকাজ শুরু হয় এমন এক সময়, যখন লোকপালের অস্তিত্ব ছিল না। এ সত্ত্বেও নাগরিক সমাজের দাবি যে প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই লোকপালের আওতার মধ্যে থাকবেন।
ভারতসহ বিদেশের কিছু সাংবাদিক ও কলামিস্ট হাজারের দাবি সম্পর্কে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। প্রশ্নটি হলো, লোকপাল নিয়োগের মাধ্যমেই কি দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব? এ প্রসঙ্গে আরো যুক্তি প্রদান করা হয়েছে যে হাজারের মতে, লোকপাল নিয়োগের মাধ্যমে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ দুর্নীতি হ্রাস পাওয়ার দাবি নিতান্তই বায়বীয়। এসব সমালোচকের অভিমত হলো, বর্তমান শাসনব্যবস্থায় ঘুষ আদান-প্রদানের প্রবণতা অপরিবর্তিত থাকবে। এ ছাড়া দুর্নীতির শাস্তি যত কঠোর হবে, দুর্নীতি-সংক্রান্ত ঘুষের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে মোটামুটিভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তবে এ প্রতিষ্ঠানের নজরদারির কোনো কাঠামো নেই। নাগরিক সমাজ আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রতিষ্ঠানকে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা প্রদানে আগ্রহী। এর ফলে এখনো সরকার অথবা সংসদ সদস্য ও নাগরিক সমাজের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে মতভেদ অত্যন্ত দৃশ্যমান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে একটি সংসদীয় কমিটি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মধ্যে এ নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধ লক্ষ করা গেছে। এ ক্ষেত্রেও যে বিষয়টি মুখ্য তা হলো, নির্বাহী বিভাগ দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করছে কি না? এ প্রসঙ্গে কমিশনের চেয়ারম্যানের প্রকাশ্য উক্তি ছিল স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ থেকে তাঁর ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ হয় না। এ সত্ত্বেও নাগরিক সমাজ স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার। এ বিষয়ে সর্বশেষ উত্তেজনার বিষয় হলো, সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা। সম্প্রতি কমিশন-সংক্রান্ত আইন সংশোধনের বিষয়ে এ প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সংশোধিত খসড়া আইনে নির্বাহী বিভাগ কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার আগে সরকারের পূর্বানুমতির বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে নাগরিক সমাজ ও কমিশন সমস্বরে বলেছে, এর ফলে কমিশনের তদন্ত করার অধিকার বাধাগ্রস্ত হবে।
এ বিষয়ে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধিমালায় এ ধরনের কোনো বাধা স্থায়ীভাবে না রাখারও বিধান রয়েছে। বিধানটি হলো, অনধিক ৬০ দিনের মধ্যে সরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য কোনো বাধা নেই। এ বিষয় নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরেও কিছু মতভেদ রয়েছে। একজন প্রবীণ মন্ত্রী পূর্বানুমতি-সংক্রান্ত বিধান না রাখার পক্ষে। তবে এটা তাঁর ব্যক্তিগত মত। মূল বিষয়বস্তু লোকপাল নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত থেকে মুক্ত নন। বাস্তবে দেখা গেছে যে তদন্ত শুরু হয় সরকার পরিবর্তনের অব্যবহিত পর।
বাংলাদেশে লোকপাল বা 'অমবুডসম্যান' নিয়োগের কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। এ বিষয়ে একজন প্রবীণ মন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছেন, নেতিবাচক রাজনৈতিক ধারার কারণেই এটা হয়নি। যে বিষয়টি তিনি ঊহ্য রেখেছেন তা হলো, নির্বাচিত কর্মকর্তারা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে তাঁদের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ করুন_এটা চান না। এটা তাঁদের কাম্য নয়। বিদ্যমান আইনটি তিন দশক আগের। এ আইনটি আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। আইনটি প্রয়োজনীয় সংশোধনের সময় এর প্রভাব দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর পড়বে কি না সে বিষয়টি মুখ্য। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের মডেলটি পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। কারণ সে দেশে 'অমবুডসম্যান'সহ দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments