সত্যনিষ্ঠ আলেম শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) by মুফতি এনায়েতুল্লাহ
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী ব্যক্তিত্ব মোজাহেদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) সম্পর্কে মুসলমান সমাজ কমবেশি অবগত। তিনি সদর সাহেব হুজুর নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের কোরআন-সুন্নাহ ও আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ যে ক'জন ক্ষণজন্মা মনীষী জন্ম নিয়ে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে মানুষের হেদায়েতের প্রেরণারূপে গণ্য হতেন তাদের মধ্যে হজরত সদর সাহেব ছিলেন অন্যতম।
আমাদের দেশে সাধারণত ওলামা-মাশায়েখদের দেশ ও জাতির বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে অসচেতন দেখা যায়। তারা এসব সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখার চেয়ে ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আসকার ও ওয়াজ-নসিহতেই নিজেদের বেশি ব্যস্ত রাখেন। বলা যায়, অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই দূরে থাকতে চান। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কোথায় কী ঘটছে সেদিকে তাদের নজর থাকে না। এদিক থেকে আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ছিলেন ব্যতিক্রমী চরিত্রের। তিনি যেমন ছিলেন সুফি মানসের অধিকারী, তেমনি ছিলেন পূর্ণ সমাজ সচেতন এবং হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনের নীতি-আদর্শের ধারক-বাহক। বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের প্রতি ছিল তার সজাগ দৃষ্টি। ১৮৯৫ সালে গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মনীষী ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। সদর সাহেব ছিলেন স্বভাবগতভাবে বিনয়ী, নম্র ও মিষ্টভাষী। তবে জাতীয় জীবনের যে কোনো সমস্যায় তিনি নির্ভীক ভূমিকা পালন করতেন। তিনি কারও রক্তচক্ষুকে পরোয়া করে কথা বলতেন না। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, সাংবাদিকতাসহ সর্বক্ষেত্রে ইসলামী জীবন-আদর্শের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন তিনি। এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রধানত শিক্ষা-সাহিত্য অঙ্গনে বিরাট অবদান রাখেন। প্রতিষ্ঠা করেন প্রচুর কওমি মাদ্রাসা। এর মধ্যে ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসা, বড়কাটারা মাদ্রাসা, ফরিদাবাদ মাদ্রাসাসহ গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা অন্যতম। এ ছাড়া তিনি দেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র রচনা ও ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে জীবনের শেষ দিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সদর সাহেবকে প্রত্যক্ষভাবে তেমন একটা দেখা না গেলেও ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে তার যোগাযোগ ছিল। তিনি ছিলেন যাবতীয় কোন্দল ও সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব। দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণীর আলেম এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সাধনে সদা সচেষ্ট। তিনি মনে করতেন, ইসলামী শিক্ষা আর জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন থাকলেও মুসলমান হিসেবে তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ থাকতে পারে না। এ বিভেদ মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। তিনি আরও বলতেন, ধর্মহীন কর্মশিক্ষা আর কর্মহীন ধর্ম শিক্ষার কোনো মূল্য নেই_ এর সমন্বয় দরকার।
সদর সাহেব (রহ.) বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার, শিরক ও বিদ'আতের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। ধর্মের নামে ব্যবসা এবং পীর-মুরিদিকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারে তিনি তীব্র নিন্দা করতেন। বিভিন্ন জাতীয় সমস্যায় দেশের ইসলামী নেতৃবৃন্দ ও আলেম সমাজের সর্বসম্মত রায়ের খেলাপ কোনো আলেম বা পীর ক্ষমতাসীন সরকারের অনুসৃত ভ্রান্ত নীতিকে সমর্থন করলে তিনি তাদের ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। ধর্মীয় কোনো ফিতনার উদ্ভব ঘটলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে তা মোকাবেলায় এগিয়ে আসতেন। আইয়ুব শাসন আমলে হাদিস অস্বীকৃতি ও ইসলামী পারিবারিক আইনের বিকৃতি এবং এর আগে কাদিয়ানি ফেতনার সময় সেগুলোর মোকাবেলায় তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বস্তুবাদী শিক্ষা ও জীবন-দর্শনের প্রাধান্যহেতু বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সমাজের ধর্মবিমুখতা এবং সমাজের ক্রমবর্ধমান নৈতিক অবক্ষয় অকৃত্রিম সমাজ দরদি ব্যক্তিটিকে বিচলিত করে তুলত। এ দুরবস্থা থেকে সমাজ রক্ষাকল্পে ওলামাকুল শিরোমণি সদর সাহেব (রহ.) সদা উদ্বিগ্ন থাকতেন। শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সমাজের সার্বিক পরিবর্তন সাধনকল্পে তিনি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি এ উদ্দেশে তার ওস্তাদ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর (রহ.) আদর্শে দীনি শিক্ষার বিস্তার ও মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। সমাজ সংস্কার এবং মানুষকে সৎ কর্মশীল ও ইসলামী আদর্শের অনুসারী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে চলি্লশের দশক থেকেই বাংলা ভাষায় লেখালেখি ও গ্রন্থ রচনার কাজে হাত দেন_ যখন বাংলা ভাষার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। এভাবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি অন্তরের গভীর দরদ দিয়ে দুই শতাধিক বই রচনা করে গেছেন। অন্য ভাষাভাষী মনীষীদের একাধিক গ্রন্থ তিনি অনুবাদও করেছেন। তার লিখিত এসব বই কেবল বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারের সম্পদ নয়_ মানুষকে চরিত্রবান, খোদাভীরুকরণ ও সমাজ সংস্কারে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। তার জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো_ তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষাবিদ, সংস্কারক, লেখক, সমাজসেবী নেতা এবং নিঃস্বার্থ পীর। তিনি সব শ্রেণীর মানুষের পরম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। নীতি-আদর্শের প্রশ্নে কোনোদিন অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথা নত করেননি। লোভ-প্রলোভন ও চাপের মুখে নতি স্বীকার করা তার স্বভাববিরুদ্ধ ছিল।
সদর সাহেবের অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। শত শত ছাত্র তার কাছে ইসলামী শিক্ষা লাভ করে সমাজে ইসলামের আলো বিস্তার করছেন। সদর সাহেবের মতো আদর্শবান এবং বিভিন্নমুখী জ্ঞান প্রতিভার অধিকারী, খোদাভীরু আলেমের নেতৃত্ব যে মুহূর্তে সমাজের অধিক প্রয়োজন সে মুহূর্তে তার এ শূন্যতা পূরণে অনুরূপ চরিত্রের কোনো শিষ্য অনুসারীই উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেন।
এই মহান মনীষী ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহতায়ালা তার কবরকে জান্নাতের বাগানে পরিণত করুন। আমিন।
muftianaet@gmail.com
সদর সাহেব (রহ.) বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার, শিরক ও বিদ'আতের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। ধর্মের নামে ব্যবসা এবং পীর-মুরিদিকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারে তিনি তীব্র নিন্দা করতেন। বিভিন্ন জাতীয় সমস্যায় দেশের ইসলামী নেতৃবৃন্দ ও আলেম সমাজের সর্বসম্মত রায়ের খেলাপ কোনো আলেম বা পীর ক্ষমতাসীন সরকারের অনুসৃত ভ্রান্ত নীতিকে সমর্থন করলে তিনি তাদের ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। ধর্মীয় কোনো ফিতনার উদ্ভব ঘটলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে তা মোকাবেলায় এগিয়ে আসতেন। আইয়ুব শাসন আমলে হাদিস অস্বীকৃতি ও ইসলামী পারিবারিক আইনের বিকৃতি এবং এর আগে কাদিয়ানি ফেতনার সময় সেগুলোর মোকাবেলায় তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বস্তুবাদী শিক্ষা ও জীবন-দর্শনের প্রাধান্যহেতু বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সমাজের ধর্মবিমুখতা এবং সমাজের ক্রমবর্ধমান নৈতিক অবক্ষয় অকৃত্রিম সমাজ দরদি ব্যক্তিটিকে বিচলিত করে তুলত। এ দুরবস্থা থেকে সমাজ রক্ষাকল্পে ওলামাকুল শিরোমণি সদর সাহেব (রহ.) সদা উদ্বিগ্ন থাকতেন। শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সমাজের সার্বিক পরিবর্তন সাধনকল্পে তিনি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি এ উদ্দেশে তার ওস্তাদ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর (রহ.) আদর্শে দীনি শিক্ষার বিস্তার ও মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। সমাজ সংস্কার এবং মানুষকে সৎ কর্মশীল ও ইসলামী আদর্শের অনুসারী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে চলি্লশের দশক থেকেই বাংলা ভাষায় লেখালেখি ও গ্রন্থ রচনার কাজে হাত দেন_ যখন বাংলা ভাষার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। এভাবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি অন্তরের গভীর দরদ দিয়ে দুই শতাধিক বই রচনা করে গেছেন। অন্য ভাষাভাষী মনীষীদের একাধিক গ্রন্থ তিনি অনুবাদও করেছেন। তার লিখিত এসব বই কেবল বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারের সম্পদ নয়_ মানুষকে চরিত্রবান, খোদাভীরুকরণ ও সমাজ সংস্কারে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। তার জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো_ তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষাবিদ, সংস্কারক, লেখক, সমাজসেবী নেতা এবং নিঃস্বার্থ পীর। তিনি সব শ্রেণীর মানুষের পরম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। নীতি-আদর্শের প্রশ্নে কোনোদিন অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথা নত করেননি। লোভ-প্রলোভন ও চাপের মুখে নতি স্বীকার করা তার স্বভাববিরুদ্ধ ছিল।
সদর সাহেবের অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। শত শত ছাত্র তার কাছে ইসলামী শিক্ষা লাভ করে সমাজে ইসলামের আলো বিস্তার করছেন। সদর সাহেবের মতো আদর্শবান এবং বিভিন্নমুখী জ্ঞান প্রতিভার অধিকারী, খোদাভীরু আলেমের নেতৃত্ব যে মুহূর্তে সমাজের অধিক প্রয়োজন সে মুহূর্তে তার এ শূন্যতা পূরণে অনুরূপ চরিত্রের কোনো শিষ্য অনুসারীই উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেন।
এই মহান মনীষী ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহতায়ালা তার কবরকে জান্নাতের বাগানে পরিণত করুন। আমিন।
muftianaet@gmail.com
No comments