ইতিউতি-কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদে যাতায়াতের জন্য by আতাউস সামাদ
এক. বাংলাদেশের একটা অংশ এখন শোকে পাথর। আর সে জন্য সারা দেশ দুঃখভারাক্রান্ত। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মায়ানী ও মঘাদিয়া ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামে চলছে কান্নার রোল। গত সোমবার ওই গ্রামগুলোর ৪৮ কিশোর মারা গেল একটা উল্টে যাওয়া মিনিট্রাক আর পথের পাশের জলাশয়ের পানির মধ্যে বন্দি হয়ে।
পরে ওই দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে একজন হাসপাতালে মারা গেছে। তারা বঙ্গবন্ধু ফুটবল প্রতিযোগিতায় তাদের স্কুলের খেলা দেখে ওই ট্রাকে করে বাড়ি ফিরছিল। ওই এলাকারই একটা ধানকলের ট্রাক ছিল সেটা। ছাত্ররা খেলা দেখতে যাওয়ার জন্য মিলমালিকের কাছ থেকে ট্রাকটা চেয়ে নিয়েছিল। বাংলাদেশে এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে এতগুলো কিশোর নিহত হয়নি। এতে প্রকৃতপক্ষে সারা দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে।
ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরপরই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অকুস্থলে ছুটে যান। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গত পরশু (বৃহস্পতিবার) সেখানে গিয়েছিলেন দলের ও তাঁর নিজের সহানুভূতি জানাতে। তিনি তাঁর দলের পক্ষ থেকে নিহত কিশোরদের পরিবারগুলোকে কিছু অর্থসাহায্য দিয়েছেন। আর্থিক সহায়তায় তো পুত্র হারাদের শোক মুছে যাবে না, তবে এই যে কেউ সুদূর ঢাকা থেকে পাশে এসে দাঁড়ালেন, এতে তাঁরা কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন। আর সামান্য যে অর্থসাহায্য পেলেন, তা দিয়ে ঘরের অপর কোনো শিক্ষার্থী সন্তানের পড়াশোনা কিছুটা এগিয়ে নেবেন। গতকাল শুক্রবার যখন এই লেখাটা শেষ হয়েছে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিরসরাই গেছেন। তিনি সেখানে নিহতদের প্রতিটি পরিবারকে এক লাখ টাকা এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছেন।
স্বজন হারানো পরিবারগুলোর সদস্যদের আহাজারি হয়তো একদিন থেমে যাবে, তবে বুকের শূন্যতা ভরাট হবে না কোনো দিন। ওই এলাকার অধিবাসীরাও প্রতিদিনই দেখতে পাবেন ৪৯টি কবরের মধ্যে একটা না একটা এবং বিষাদে আক্রান্ত হবেন। ভালো হবে যদি তারা একই সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবকদের এবং সরকারকে মনে করিয়ে দেন যে বাংলাদেশের আর কোথাও যাতে এ রকম হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা না ঘটে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
আমার মনে হয়েছে, একটা স্কুলের ছাত্ররা যখন দলবেঁধে দূরে খেলা দেখতে যাচ্ছিল, তখন সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত ছিল তাদের সড়কপথের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া। তাঁরা যদি ছাত্রদের বোঝাতেন যে ট্রাকে করে মানুষ চলাচল করা স্বাভাবিক ব্যাপার নয় এবং অত বেশি সংখ্যায় ছাত্র একটা মাত্র মিনিট্রাকে চড়লে বিপদ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। দেশে-বিদেশে বারকয়েক ট্রাকে করে গন্তব্যে যেতে হয়েছে বিধায় আমার এমন উপলব্ধি হয়েছে, তাহলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। শিক্ষকরা একাধিক বাহনের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে পারতেন। সবচেয়ে বড় কথা, অন্তত একজন শিক্ষক হলেও ছাত্রদের সঙ্গে থাকা এবং ট্রাকচালকের পাশে বসে তাকে সাবধান রাখা প্রয়োজন ছিল। অভিভাবকদের উচিত ছিল আগে থাকতেই শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাত্রদের যাওয়া-আসা তত্ত্বাবধান করার ব্যবস্থা করা। আর যিনি ছাত্রদের তাঁর ট্রাকযাত্রী বহনের জন্য দিলেন, অর্থাৎ ছাত্রদের যাতায়াতের কাজে ব্যবহার করতে দিলেন, তাঁর উচিত ছিল মিনিট্রাকটির চালক ও তাঁর সহকারীকে খুবই সতর্কভাবে গাড়ি চালাতে নির্দেশ দেওয়া। মোটকথা স্কুলের ছেলেমেয়েদের আনন্দ ভ্রমণে আয়োজনের কাজটা অবশ্যই বড়দের করা উচিত।
খবরের কাগজে পড়েছি, সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছে তা প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্তে পেঁৗছেছে। দুর্ঘটনার সময় যিনি ট্রাকটি চালাচ্ছিলেন তাঁর অদক্ষতাই এ জন্য দায়ী। তবে তাঁরা যখন আরো বিস্তারিত অনুসন্ধান করবেন তখন দুর্ঘটনাস্থলে রাস্তাটির অবস্থা, সেটি একসঙ্গে কয়টি যানবাহন চলাচলের উপযোগী এবং ওই রাস্তায় চলাচলের জন্য কী কী সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, তাও দেখবেন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাস্তা তৈরি করা হয়েছে অথবা উঁচু করা হয়েছে পথের পাশের মাটি কেটে। ফলে বর্ষার সময় প্রায়ই এসব রাস্তার পাশে পানিতে টইটমু্বর খাল অথবা ডোবা থাকে। কোনো বাহন রাস্তা থেকে ওই সব জলাশয়ে ছিটকে পড়লে কারো না কারো সলিল সমাধি হওয়া অবধারিত। এ জন্যই আমাদের দেশে সড়কপথে চলাচলের জন্য বিশেষভাবে সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি।
বাংলাদেশে মানুষ বাড়ছে, সে সঙ্গে বাড়ছে চলাচল। রাস্তা পাকা করা হচ্ছে। ফলে বেশি সংখ্যায় বাস, ট্রাক ও নানা ধরনের ছোট কলের গাড়িও চলছে। গরিব মানুষ, বিশেষত যাঁরা শ্রমিক, তাঁরা কম খরচে যাতায়াতের জন্য খালি ট্রাকে চড়েন। আজকাল তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের পেছনে লাগানো ট্রেইলার। এগুলো মনুষ্য পরিবহনের জন্য নয়, তবুও যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে এসবে করে। ফলে চারদিকে পথঘাটে একটা বিশৃঙ্খল লেগেই আছে। সরকারকে এ বিশৃঙ্খলা দূর করার চেষ্টা করতেই হবে, কাজটা যতই কঠিন হোক।
দুই.
এখানে পুরনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ছে। গাঁও-গেরামের কথা। তখন নদী আর খাল দিয়ে নৌকা চলাচলের সময় কিছু নিয়ম মানতে হতো। বিশেষ করে দুটি নৌকা পাশাপাশি এসে গেলে কী করতে হবে এবং কোনো ঘাটে নৌকা ভেড়ানোর সময় অন্য নৌকার সঙ্গে যাতে ধাক্কা না লাগে, কেউ যেন অহেতুক ঢেউ না তোলে। নৌকার ভারসাম্য যেন নষ্ট না হয়_এসব বিষয়ে অলিখিত বেশ কিছু নিয়ম মানতেই হতো। এটা ছিল সামাজিক শৃঙ্খলার অংশ।
একইভাবে গ্রামের মাটির পথে চলাচলেরও কিছু নিয়ম ছিল। যেমন_গরুর গাড়ি চলবে পথের কতটুকু জুড়ে। হেঁটে যাচ্ছেন যাঁরা তাঁদের জন্য কতটুকু ছেড়ে দিতে হবে বা তাঁরাই কখন পথের পাশে দাঁড়িয়ে পড়বেন কোনো বাহন চলে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে, কাঁধে ভারা নিয়ে যাঁরা ছুটতেন তাঁদের যেন হঠাৎ থেমে যেতে বাধ্য না হতে হয়, কর্দমাক্ত স্থান পার হওয়ার সময় যেন ঠেলাঠেলি না হয়, গৃহস্থ বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গরুর গাড়ি বা গরুর পাল যেন অতিরিক্ত ধুলা না উড়ায়_এসব খেয়াল রাখতে হতো। কম বয়সীরা প্রবীণদের দেখে শিখে নিতেন। এখন বোধ হয় পল্লী অঞ্চলের এই সামাজিক নিয়মগুলো উঠে যাচ্ছে বা যান্ত্রিক দুনিয়ার বিস্তার লাভ ও তার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নতুন প্রজন্ম হয়তো এ রকম সামাজিক নিয়ম-কানুনের কথা শোনার ও জানার অবকাশ পাচ্ছে না, কিন্তু তা হলেও সবই যে উঠে গেছে অথবা সবাই যে এসব নিয়মকানুন ভুলে গেছেন, তাও তো নয়। একটু চেষ্টা করলে সবাইকে সেসব মনে করিয়ে দেওয়া যায়। এখানে আমি মূলত যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, আমাদের সমাজে জীবনের সব দিকেই শৃঙ্খলা রক্ষা করার ঐতিহ্য ছিল। সে ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে আমরা নতুন করে শৃঙ্খলাবোধ ও রীতিনীতি তৈরি করতে পারি। রবঞ্চ সেভাবে অগ্রসর হলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
তিন.
মিরসরাইয়ের হতভাগ্য কিশোররা যে প্রতিযোগিতার খেলা দেখতে গিয়েছিল, পত্রিকায় পড়েছি সেটির নাম বঙ্গবন্ধু ফুটবল টুর্নামেন্ট। হয়তো এটাই সঠিক নামটি নয়, তবে এলাকার স্কুলগুলোর মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতার নামের মধ্যে যে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি রাষ্ট্রপতি 'বঙ্গবন্ধু' খেতাবটি আছে তা নিশ্চিত। কী দুর্ভাগ্যের কথা, আমরা যতবার মিরসরাই ট্র্যাজেডির কথা মনে করব ততবার 'বঙ্গবন্ধু' উল্লেখ হবে।
সে জন্যই এই টুর্নামেন্টের উদ্যোক্তা, আয়োজক, অংশগ্রহণকারী বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের উচিত ছিল প্রথম থেকেই এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। এরই অংশ হতো শিক্ষার্থীদের খেলা দেখতে নিয়ে যাওয়া এবং ফিরিয়ে আনার আয়োজন।
দৈনিক যুগান্তর খবর দিয়েছে, শেখ রাসেল স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বদলে সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পরিচালনায় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এই বিশাল টুর্নামেন্টটির আয়োজন করা হয়েছে। এতে সারা দেশ থেকে ৩০ হাজার মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসা অংশ নেবে। উপজেলা ও থানা পর্যায় থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে জিলা ও বিভাগীয় পর্যায় হয়ে চূড়ান্তভাবে জাতীয় পর্যায়ে খেলা হবে। এই প্রতিযোগিতার একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হবে প্রতিভা অন্বেষণ_অর্থাৎ ভালো নতুন খেলোয়াড় তৈরি করার জন্য কিশোরদের মধ্য থেকে সম্ভাবনাময়দের বেছে আনা। অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো_সারা দেশে কিশোরদের মধ্যে ফুটবল খেলার আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া। এ রকম একটা টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী কেবল দলে স্থান পাওয়া কিশোর খেলোয়াড়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, খেলতে নামা প্রতিটি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও দর্শক হিসেবে এতে শরিক হয়ে এর আনন্দ উপভোগ করতে চাইবে। খেলোয়াড়রাও তাদের সমর্থকদের দেখতে চাইবে দর্শকদের মধ্যে। কাজেই শেখ রাসেল জাতীয় ফুটবল টুর্নামেন্ট চলার সময় বহু বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশকে নানা জায়গায় টুর্নামেন্টের মাঠে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করতে হবে, খেলোয়াড়দের তো বটেই, এ ক্ষেত্রে টুর্নামেন্ট আয়োজনের সঙ্গে নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা, সতর্কতা অবলম্বন ও দায়িত্বশীল তত্ত্বাবধান থাকা অত্যাবশ্যক হিসেবে বিবেচনা করতেই হবে।
তা ছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যতই আধুনিক বিষয় ও ধ্যান-ধারণা প্রবেশ করতে থাকবে, যা করার উদ্যোগ বর্তমান সরকার নিচ্ছে, ততই ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাসফর, গবেষণার সঙ্গে পরিচিতি, বিভিন্ন বিষয়ে আন্তবিদ্যালয় প্রতিযোগিতা এবং বিনোদন ভ্রমণ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত বাড়তে থাকবে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে এসব সময়ে শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা। এই দায়িত্ব পালন করার জন্য বড়দের যা যা শিখতে হবে, তা শেখা এখন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরপরই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অকুস্থলে ছুটে যান। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গত পরশু (বৃহস্পতিবার) সেখানে গিয়েছিলেন দলের ও তাঁর নিজের সহানুভূতি জানাতে। তিনি তাঁর দলের পক্ষ থেকে নিহত কিশোরদের পরিবারগুলোকে কিছু অর্থসাহায্য দিয়েছেন। আর্থিক সহায়তায় তো পুত্র হারাদের শোক মুছে যাবে না, তবে এই যে কেউ সুদূর ঢাকা থেকে পাশে এসে দাঁড়ালেন, এতে তাঁরা কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন। আর সামান্য যে অর্থসাহায্য পেলেন, তা দিয়ে ঘরের অপর কোনো শিক্ষার্থী সন্তানের পড়াশোনা কিছুটা এগিয়ে নেবেন। গতকাল শুক্রবার যখন এই লেখাটা শেষ হয়েছে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিরসরাই গেছেন। তিনি সেখানে নিহতদের প্রতিটি পরিবারকে এক লাখ টাকা এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছেন।
স্বজন হারানো পরিবারগুলোর সদস্যদের আহাজারি হয়তো একদিন থেমে যাবে, তবে বুকের শূন্যতা ভরাট হবে না কোনো দিন। ওই এলাকার অধিবাসীরাও প্রতিদিনই দেখতে পাবেন ৪৯টি কবরের মধ্যে একটা না একটা এবং বিষাদে আক্রান্ত হবেন। ভালো হবে যদি তারা একই সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবকদের এবং সরকারকে মনে করিয়ে দেন যে বাংলাদেশের আর কোথাও যাতে এ রকম হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা না ঘটে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
আমার মনে হয়েছে, একটা স্কুলের ছাত্ররা যখন দলবেঁধে দূরে খেলা দেখতে যাচ্ছিল, তখন সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত ছিল তাদের সড়কপথের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া। তাঁরা যদি ছাত্রদের বোঝাতেন যে ট্রাকে করে মানুষ চলাচল করা স্বাভাবিক ব্যাপার নয় এবং অত বেশি সংখ্যায় ছাত্র একটা মাত্র মিনিট্রাকে চড়লে বিপদ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। দেশে-বিদেশে বারকয়েক ট্রাকে করে গন্তব্যে যেতে হয়েছে বিধায় আমার এমন উপলব্ধি হয়েছে, তাহলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। শিক্ষকরা একাধিক বাহনের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে পারতেন। সবচেয়ে বড় কথা, অন্তত একজন শিক্ষক হলেও ছাত্রদের সঙ্গে থাকা এবং ট্রাকচালকের পাশে বসে তাকে সাবধান রাখা প্রয়োজন ছিল। অভিভাবকদের উচিত ছিল আগে থাকতেই শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাত্রদের যাওয়া-আসা তত্ত্বাবধান করার ব্যবস্থা করা। আর যিনি ছাত্রদের তাঁর ট্রাকযাত্রী বহনের জন্য দিলেন, অর্থাৎ ছাত্রদের যাতায়াতের কাজে ব্যবহার করতে দিলেন, তাঁর উচিত ছিল মিনিট্রাকটির চালক ও তাঁর সহকারীকে খুবই সতর্কভাবে গাড়ি চালাতে নির্দেশ দেওয়া। মোটকথা স্কুলের ছেলেমেয়েদের আনন্দ ভ্রমণে আয়োজনের কাজটা অবশ্যই বড়দের করা উচিত।
খবরের কাগজে পড়েছি, সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছে তা প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্তে পেঁৗছেছে। দুর্ঘটনার সময় যিনি ট্রাকটি চালাচ্ছিলেন তাঁর অদক্ষতাই এ জন্য দায়ী। তবে তাঁরা যখন আরো বিস্তারিত অনুসন্ধান করবেন তখন দুর্ঘটনাস্থলে রাস্তাটির অবস্থা, সেটি একসঙ্গে কয়টি যানবাহন চলাচলের উপযোগী এবং ওই রাস্তায় চলাচলের জন্য কী কী সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, তাও দেখবেন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাস্তা তৈরি করা হয়েছে অথবা উঁচু করা হয়েছে পথের পাশের মাটি কেটে। ফলে বর্ষার সময় প্রায়ই এসব রাস্তার পাশে পানিতে টইটমু্বর খাল অথবা ডোবা থাকে। কোনো বাহন রাস্তা থেকে ওই সব জলাশয়ে ছিটকে পড়লে কারো না কারো সলিল সমাধি হওয়া অবধারিত। এ জন্যই আমাদের দেশে সড়কপথে চলাচলের জন্য বিশেষভাবে সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি।
বাংলাদেশে মানুষ বাড়ছে, সে সঙ্গে বাড়ছে চলাচল। রাস্তা পাকা করা হচ্ছে। ফলে বেশি সংখ্যায় বাস, ট্রাক ও নানা ধরনের ছোট কলের গাড়িও চলছে। গরিব মানুষ, বিশেষত যাঁরা শ্রমিক, তাঁরা কম খরচে যাতায়াতের জন্য খালি ট্রাকে চড়েন। আজকাল তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের পেছনে লাগানো ট্রেইলার। এগুলো মনুষ্য পরিবহনের জন্য নয়, তবুও যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে এসবে করে। ফলে চারদিকে পথঘাটে একটা বিশৃঙ্খল লেগেই আছে। সরকারকে এ বিশৃঙ্খলা দূর করার চেষ্টা করতেই হবে, কাজটা যতই কঠিন হোক।
দুই.
এখানে পুরনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ছে। গাঁও-গেরামের কথা। তখন নদী আর খাল দিয়ে নৌকা চলাচলের সময় কিছু নিয়ম মানতে হতো। বিশেষ করে দুটি নৌকা পাশাপাশি এসে গেলে কী করতে হবে এবং কোনো ঘাটে নৌকা ভেড়ানোর সময় অন্য নৌকার সঙ্গে যাতে ধাক্কা না লাগে, কেউ যেন অহেতুক ঢেউ না তোলে। নৌকার ভারসাম্য যেন নষ্ট না হয়_এসব বিষয়ে অলিখিত বেশ কিছু নিয়ম মানতেই হতো। এটা ছিল সামাজিক শৃঙ্খলার অংশ।
একইভাবে গ্রামের মাটির পথে চলাচলেরও কিছু নিয়ম ছিল। যেমন_গরুর গাড়ি চলবে পথের কতটুকু জুড়ে। হেঁটে যাচ্ছেন যাঁরা তাঁদের জন্য কতটুকু ছেড়ে দিতে হবে বা তাঁরাই কখন পথের পাশে দাঁড়িয়ে পড়বেন কোনো বাহন চলে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে, কাঁধে ভারা নিয়ে যাঁরা ছুটতেন তাঁদের যেন হঠাৎ থেমে যেতে বাধ্য না হতে হয়, কর্দমাক্ত স্থান পার হওয়ার সময় যেন ঠেলাঠেলি না হয়, গৃহস্থ বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গরুর গাড়ি বা গরুর পাল যেন অতিরিক্ত ধুলা না উড়ায়_এসব খেয়াল রাখতে হতো। কম বয়সীরা প্রবীণদের দেখে শিখে নিতেন। এখন বোধ হয় পল্লী অঞ্চলের এই সামাজিক নিয়মগুলো উঠে যাচ্ছে বা যান্ত্রিক দুনিয়ার বিস্তার লাভ ও তার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নতুন প্রজন্ম হয়তো এ রকম সামাজিক নিয়ম-কানুনের কথা শোনার ও জানার অবকাশ পাচ্ছে না, কিন্তু তা হলেও সবই যে উঠে গেছে অথবা সবাই যে এসব নিয়মকানুন ভুলে গেছেন, তাও তো নয়। একটু চেষ্টা করলে সবাইকে সেসব মনে করিয়ে দেওয়া যায়। এখানে আমি মূলত যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, আমাদের সমাজে জীবনের সব দিকেই শৃঙ্খলা রক্ষা করার ঐতিহ্য ছিল। সে ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে আমরা নতুন করে শৃঙ্খলাবোধ ও রীতিনীতি তৈরি করতে পারি। রবঞ্চ সেভাবে অগ্রসর হলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
তিন.
মিরসরাইয়ের হতভাগ্য কিশোররা যে প্রতিযোগিতার খেলা দেখতে গিয়েছিল, পত্রিকায় পড়েছি সেটির নাম বঙ্গবন্ধু ফুটবল টুর্নামেন্ট। হয়তো এটাই সঠিক নামটি নয়, তবে এলাকার স্কুলগুলোর মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতার নামের মধ্যে যে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি রাষ্ট্রপতি 'বঙ্গবন্ধু' খেতাবটি আছে তা নিশ্চিত। কী দুর্ভাগ্যের কথা, আমরা যতবার মিরসরাই ট্র্যাজেডির কথা মনে করব ততবার 'বঙ্গবন্ধু' উল্লেখ হবে।
সে জন্যই এই টুর্নামেন্টের উদ্যোক্তা, আয়োজক, অংশগ্রহণকারী বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের উচিত ছিল প্রথম থেকেই এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। এরই অংশ হতো শিক্ষার্থীদের খেলা দেখতে নিয়ে যাওয়া এবং ফিরিয়ে আনার আয়োজন।
দৈনিক যুগান্তর খবর দিয়েছে, শেখ রাসেল স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বদলে সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পরিচালনায় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এই বিশাল টুর্নামেন্টটির আয়োজন করা হয়েছে। এতে সারা দেশ থেকে ৩০ হাজার মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসা অংশ নেবে। উপজেলা ও থানা পর্যায় থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে জিলা ও বিভাগীয় পর্যায় হয়ে চূড়ান্তভাবে জাতীয় পর্যায়ে খেলা হবে। এই প্রতিযোগিতার একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হবে প্রতিভা অন্বেষণ_অর্থাৎ ভালো নতুন খেলোয়াড় তৈরি করার জন্য কিশোরদের মধ্য থেকে সম্ভাবনাময়দের বেছে আনা। অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো_সারা দেশে কিশোরদের মধ্যে ফুটবল খেলার আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া। এ রকম একটা টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী কেবল দলে স্থান পাওয়া কিশোর খেলোয়াড়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, খেলতে নামা প্রতিটি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও দর্শক হিসেবে এতে শরিক হয়ে এর আনন্দ উপভোগ করতে চাইবে। খেলোয়াড়রাও তাদের সমর্থকদের দেখতে চাইবে দর্শকদের মধ্যে। কাজেই শেখ রাসেল জাতীয় ফুটবল টুর্নামেন্ট চলার সময় বহু বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশকে নানা জায়গায় টুর্নামেন্টের মাঠে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করতে হবে, খেলোয়াড়দের তো বটেই, এ ক্ষেত্রে টুর্নামেন্ট আয়োজনের সঙ্গে নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা, সতর্কতা অবলম্বন ও দায়িত্বশীল তত্ত্বাবধান থাকা অত্যাবশ্যক হিসেবে বিবেচনা করতেই হবে।
তা ছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যতই আধুনিক বিষয় ও ধ্যান-ধারণা প্রবেশ করতে থাকবে, যা করার উদ্যোগ বর্তমান সরকার নিচ্ছে, ততই ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাসফর, গবেষণার সঙ্গে পরিচিতি, বিভিন্ন বিষয়ে আন্তবিদ্যালয় প্রতিযোগিতা এবং বিনোদন ভ্রমণ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত বাড়তে থাকবে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে এসব সময়ে শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা। এই দায়িত্ব পালন করার জন্য বড়দের যা যা শিখতে হবে, তা শেখা এখন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments