গ্যাসসম্পদ-গ্যাজপ্রমের সঙ্গে পেট্রোবাংলার চুক্তি কী দেবে? by মুশফিকুর রহমান
পেট্রোবাংলার অধীন বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড ও বাপেক্সের সঙ্গে গত ২০ জানুয়ারি গ্যাজপ্রম ২০ মাসে মোট ১০টি গ্যাসকূপ খননের চুক্তি অনুস্বাক্ষর করেছে। সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর অধীনে এ চুক্তি সম্পাদিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়ায় আন্তর্জাতিক বাঘসংক্রান্ত সম্মেলনে গেলে দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে জ্বালানি খাতসহ বহুমুখী সহযোগিতার আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ তেল-গ্যাস উত্তোলন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম বাংলাদেশে পেট্রোবাংলার সঙ্গে কাজের আগ্রহ দেখায়। স্মর্তব্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে রাশিয়ার সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কামতা ও বেগমগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে রুশ সহযোগিতায়।
অনুস্বাক্ষর করা চুক্তির আইনগত ভেটিং শেষে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর (আশা করা হচ্ছে, এই ফেব্রুয়ারি মাসে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হবে) গ্যাজপ্রম কারিগরি জনবলসহ দুটি ড্রিলিং রিগ আমদানি করে তিতাস (চারটি), রশীদপুর (একটি), সেমুতাং (একটি), বেগমগঞ্জ (একটি), শ্রীকাইল (একটি) ও শাহবাজপুরে (দুটি) গ্যাসকূপ খনন করবে। গড়ে প্রায় তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ মিটার গভীরতার ১০টি গ্যাসকূপ সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারলে পেট্রোবাংলা গ্যাজপ্রমকে পর্যায়ক্রমে ১৯৩.৩২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে। চুক্তি অনুযায়ী, গ্যাজপ্রমকে কূপ খননের পাশাপাশি সম্ভাব্য ব্লো-আউট বা বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। তা ছাড়া কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ঠিকাদার হিসেবে গ্যাজপ্রম আন্তর্জাতিক ইনসু্যুরেন্সের অধীনে ক্ষতিপূরণ দিতে দায়বদ্ধ। বিশেষভাবে এ বিষয়টি তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসকূপ খননের বিপদমাত্রা বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ।
পেট্রোবাংলা আশা করছে ১০টি গ্যাসকূপ খনন সম্পন্ন করে সেগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদন করা গেলে ২০১৩ সালের মধ্যে দৈনিক প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে। পেট্রোবাংলা ১৫ বছরের বিভিন্ন গ্যাসকূপ খননের (বাপেক্স ও এ দেশে বহুজাতিক কোম্পানির কূপ খনন ব্যয়সহ) ব্যয় পর্যালোচনায় গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সম্মত হওয়া ব্যয় সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচনা করছে। তা ছাড়া নতুন গ্যাসকূপ খননের পর তা গ্যাস উৎপাদন শুরু করলে বিনিয়োজিত অর্থ দ্রুতই উঠে আসবে।
সম্প্রতি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেছেন, ২০১৫ পর্যন্ত জ্বালানি গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে, সংস্থাটির পক্ষের সে চাহিদার গ্যাস সরবরাহ সম্ভব নয়। জ্বালানি গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতির বিভিন্ন খবর প্রচারমাধ্যমে নিয়মিতই প্রকাশিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের গ্যাসসংকট নিয়ে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বৃহত্তর চট্টগ্রামের রাউজান ও শিকলবাহা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গত নভেম্বর থেকে গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে। কিন্তু রাউজান বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দেওয়া গেলে সেখানকার দুই ইউনিট থেকে ৩৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারত। এ জন্য দরকার হতো দৈনিক ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট পরিমাণ গ্যাস। একইভাবে কর্ণফুলী পাড়ের শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬০ মেগাওয়াট ও ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দুটি ইউনিট চালাতে দৈনিক প্রয়োজন প্রায় ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার প্রায় ৬৭ শতাংশ এখনো প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। দেশে শিল্প, বাণিজ্য ও গৃহস্থালির চাহিদা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন উৎপাদন যোগ করা সত্ত্ব্বেও প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি এখন স্পষ্ট। গ্যাসের নতুন সংযোগ পেতে আগ্রহী গ্রাহকের চাহিদা হিসাবে নিলে প্রাক্কলিত ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
গ্যাস উৎপাদনে পেট্রোবাংলার সঙ্গে অংশীদারি চুক্তির অধীনে বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া ও পটুয়াখালীর কাজল এলাকার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে কূপ খনন করে গ্যাস না পাওয়ায় গ্যাসের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের পরিকল্পনা বড় রকমের হোঁচট খেয়েছে। একই সঙ্গে স্বল্প গভীরের সমুদ্রবক্ষে সাংগু গ্যাসক্ষেত্রও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এক দশক আগেও যে সাংগু গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হতো, এখন সেখান থেকে দৈনিক মাত্র সাত-আট মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির অধীনে বহুজাতিক কোম্পানি সান্তোস সম্প্রতি সাংগুতে তিনটি কূপ খনন করেছে কিন্তু সেগুলোতে প্রত্যাশার গ্যাস মেলেনি। সেই প্রেক্ষাপটে পেট্রোবাংলার অধীন কোম্পানি বাপেক্সের গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন দ্রুততর করা এবং উৎপাদনক্ষম গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে আরও বেশি উৎপাদন কূপ খনন করা এখন জরুরি।
বাপেক্স এখন অন্য সময়ের তুলনায় গ্যাস অনুসন্ধান ও কূপ খননকাজে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছে। ইতিমধ্যে ত্রিমাত্রিক ও দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপে বাপেক্স নতুন কূপ খননের জায়গা চিহ্নিত করছে। ২০১৫ সালের মধ্যে বাপেক্সের বিদ্যমান পাঁচটি ড্রিলিং রিগ ও কারিগরি জনবল দিয়ে দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে ন্যূনতম ২৪টি গ্যাসকূপ খনন করার কথা। বাপেক্সের বিদ্যমান সামর্থ্য দিয়ে একের পর এক গ্যাসকূপ খনন অব্যাহত রাখলেও দেশের স্থলভাগে কাজের পরিমাণ বিবেচনায় তা অপর্যাপ্ত। ফলে পেট্রোবাংলাকে কনট্রাক্টর ড্রিলিং কোম্পানির সন্ধান করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে বিশেষায়িত ঠিকাদার নির্বাচন বেশ সময়সাপেক্ষ কিন্তু পেট্রোবাংলার ওপর গ্যাস সরবরাহ দ্রুততর করার চাপ প্রবল। ২০১০ সালের নভেম্বরে পেট্রোবাংলা বৃহত্তর চট্টগ্রামের পটিয়া, জলদি, কাসালং ও সীতাপাহাড়ের সম্ভাবনাময় গ্যাসসমৃদ্ধ ভূগঠনে অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য রাশিয়া, চীন, কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতের আগ্রহী আটটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার কোম্পানির কাছ থেকে যৌথ অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব আহ্বান করে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার গ্যাজপ্রম, চীনের সিনোপেক, সিনুক, থাইল্যান্ডের পিটিটিইপি, ভারতের ওএনজিসি-বিদেশ আগ্রহ দেখালেও পরবর্তী সময়ে কাজের সীমিত পরিমাণের কারণে গ্যাজপ্রম পিছিয়ে যায়। চীনের সিনোপেকের সঙ্গে ওই চারটি ভূগঠনে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ আংশীদারির চুক্তি নিয়ে আলোচনা অনেকটুকু এগিয়েছে। বাপেক্স আশা করছে সিনোপেকের সঙ্গে এ চুক্তি নিয়ে সমঝোতা হবে।
ইতিপূর্বে দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্র তিতাস, রশীদপুরে পাঁচটি গ্যাস উন্নয়নকূপ খননের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের চেষ্টায় আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত পোল্যান্ডের ক্রাকভের সঙ্গে আলোচনা শেষপর্যায়ে এসে ভেঙে যায়। ২০০৫ থেকে একটানা তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস উদগিরণ ক্রাকভকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। এরই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি পেট্রোবাংলার জন্য স্বস্তির সুযোগ এনে দিয়েছে।
যদি বর্তমানের গ্যাসের চাহিদা (দৈনিক প্রায় দুই হাজার ৫২০ মিলিয়ন ঘনফুট) অনড় থাকত এবং পেট্রোবাংলার প্রত্যাশা অনুযায়ী পেট্রোবাংলার পরিকল্পিত গ্যাসকূপগুলোর খনন সময়মতো সফলভাবে সম্পন্ন হতো; তাহলে দেশের গ্যাস সরবরাহের বর্তমান ঘাটতি প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে আসতে পারত। কিন্তু উৎপাদন কূপগুলোর কোনো কোনোটির গ্যাস ফুরিয়ে আসছে; অন্যদিকে উৎপাদনের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস সঞ্চালনের অবকাঠামো ঘাটতি বাধা হিসেবে বিদ্যমান। সেই সঙ্গে বাড়ছে সরবরাহ ও চাহিদার ব্যবধান। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান সে কারণেই সম্ভবত বলছেন, তাঁর সংস্থার একক প্রচেষ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি গ্যাস চাহিদার সবটুকু জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য প্রাথমিক জ্বালানির বহুমুখী সরবরাহ উৎস নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।
অনুস্বাক্ষর করা চুক্তির আইনগত ভেটিং শেষে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর (আশা করা হচ্ছে, এই ফেব্রুয়ারি মাসে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হবে) গ্যাজপ্রম কারিগরি জনবলসহ দুটি ড্রিলিং রিগ আমদানি করে তিতাস (চারটি), রশীদপুর (একটি), সেমুতাং (একটি), বেগমগঞ্জ (একটি), শ্রীকাইল (একটি) ও শাহবাজপুরে (দুটি) গ্যাসকূপ খনন করবে। গড়ে প্রায় তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ মিটার গভীরতার ১০টি গ্যাসকূপ সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারলে পেট্রোবাংলা গ্যাজপ্রমকে পর্যায়ক্রমে ১৯৩.৩২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে। চুক্তি অনুযায়ী, গ্যাজপ্রমকে কূপ খননের পাশাপাশি সম্ভাব্য ব্লো-আউট বা বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। তা ছাড়া কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ঠিকাদার হিসেবে গ্যাজপ্রম আন্তর্জাতিক ইনসু্যুরেন্সের অধীনে ক্ষতিপূরণ দিতে দায়বদ্ধ। বিশেষভাবে এ বিষয়টি তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসকূপ খননের বিপদমাত্রা বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ।
পেট্রোবাংলা আশা করছে ১০টি গ্যাসকূপ খনন সম্পন্ন করে সেগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদন করা গেলে ২০১৩ সালের মধ্যে দৈনিক প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে। পেট্রোবাংলা ১৫ বছরের বিভিন্ন গ্যাসকূপ খননের (বাপেক্স ও এ দেশে বহুজাতিক কোম্পানির কূপ খনন ব্যয়সহ) ব্যয় পর্যালোচনায় গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সম্মত হওয়া ব্যয় সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচনা করছে। তা ছাড়া নতুন গ্যাসকূপ খননের পর তা গ্যাস উৎপাদন শুরু করলে বিনিয়োজিত অর্থ দ্রুতই উঠে আসবে।
সম্প্রতি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেছেন, ২০১৫ পর্যন্ত জ্বালানি গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে, সংস্থাটির পক্ষের সে চাহিদার গ্যাস সরবরাহ সম্ভব নয়। জ্বালানি গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতির বিভিন্ন খবর প্রচারমাধ্যমে নিয়মিতই প্রকাশিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের গ্যাসসংকট নিয়ে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বৃহত্তর চট্টগ্রামের রাউজান ও শিকলবাহা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গত নভেম্বর থেকে গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে। কিন্তু রাউজান বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দেওয়া গেলে সেখানকার দুই ইউনিট থেকে ৩৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারত। এ জন্য দরকার হতো দৈনিক ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট পরিমাণ গ্যাস। একইভাবে কর্ণফুলী পাড়ের শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬০ মেগাওয়াট ও ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দুটি ইউনিট চালাতে দৈনিক প্রয়োজন প্রায় ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার প্রায় ৬৭ শতাংশ এখনো প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। দেশে শিল্প, বাণিজ্য ও গৃহস্থালির চাহিদা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন উৎপাদন যোগ করা সত্ত্ব্বেও প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি এখন স্পষ্ট। গ্যাসের নতুন সংযোগ পেতে আগ্রহী গ্রাহকের চাহিদা হিসাবে নিলে প্রাক্কলিত ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
গ্যাস উৎপাদনে পেট্রোবাংলার সঙ্গে অংশীদারি চুক্তির অধীনে বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া ও পটুয়াখালীর কাজল এলাকার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে কূপ খনন করে গ্যাস না পাওয়ায় গ্যাসের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের পরিকল্পনা বড় রকমের হোঁচট খেয়েছে। একই সঙ্গে স্বল্প গভীরের সমুদ্রবক্ষে সাংগু গ্যাসক্ষেত্রও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এক দশক আগেও যে সাংগু গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হতো, এখন সেখান থেকে দৈনিক মাত্র সাত-আট মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির অধীনে বহুজাতিক কোম্পানি সান্তোস সম্প্রতি সাংগুতে তিনটি কূপ খনন করেছে কিন্তু সেগুলোতে প্রত্যাশার গ্যাস মেলেনি। সেই প্রেক্ষাপটে পেট্রোবাংলার অধীন কোম্পানি বাপেক্সের গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন দ্রুততর করা এবং উৎপাদনক্ষম গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে আরও বেশি উৎপাদন কূপ খনন করা এখন জরুরি।
বাপেক্স এখন অন্য সময়ের তুলনায় গ্যাস অনুসন্ধান ও কূপ খননকাজে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছে। ইতিমধ্যে ত্রিমাত্রিক ও দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপে বাপেক্স নতুন কূপ খননের জায়গা চিহ্নিত করছে। ২০১৫ সালের মধ্যে বাপেক্সের বিদ্যমান পাঁচটি ড্রিলিং রিগ ও কারিগরি জনবল দিয়ে দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে ন্যূনতম ২৪টি গ্যাসকূপ খনন করার কথা। বাপেক্সের বিদ্যমান সামর্থ্য দিয়ে একের পর এক গ্যাসকূপ খনন অব্যাহত রাখলেও দেশের স্থলভাগে কাজের পরিমাণ বিবেচনায় তা অপর্যাপ্ত। ফলে পেট্রোবাংলাকে কনট্রাক্টর ড্রিলিং কোম্পানির সন্ধান করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে বিশেষায়িত ঠিকাদার নির্বাচন বেশ সময়সাপেক্ষ কিন্তু পেট্রোবাংলার ওপর গ্যাস সরবরাহ দ্রুততর করার চাপ প্রবল। ২০১০ সালের নভেম্বরে পেট্রোবাংলা বৃহত্তর চট্টগ্রামের পটিয়া, জলদি, কাসালং ও সীতাপাহাড়ের সম্ভাবনাময় গ্যাসসমৃদ্ধ ভূগঠনে অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য রাশিয়া, চীন, কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতের আগ্রহী আটটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার কোম্পানির কাছ থেকে যৌথ অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব আহ্বান করে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার গ্যাজপ্রম, চীনের সিনোপেক, সিনুক, থাইল্যান্ডের পিটিটিইপি, ভারতের ওএনজিসি-বিদেশ আগ্রহ দেখালেও পরবর্তী সময়ে কাজের সীমিত পরিমাণের কারণে গ্যাজপ্রম পিছিয়ে যায়। চীনের সিনোপেকের সঙ্গে ওই চারটি ভূগঠনে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ আংশীদারির চুক্তি নিয়ে আলোচনা অনেকটুকু এগিয়েছে। বাপেক্স আশা করছে সিনোপেকের সঙ্গে এ চুক্তি নিয়ে সমঝোতা হবে।
ইতিপূর্বে দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্র তিতাস, রশীদপুরে পাঁচটি গ্যাস উন্নয়নকূপ খননের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের চেষ্টায় আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত পোল্যান্ডের ক্রাকভের সঙ্গে আলোচনা শেষপর্যায়ে এসে ভেঙে যায়। ২০০৫ থেকে একটানা তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস উদগিরণ ক্রাকভকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। এরই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি পেট্রোবাংলার জন্য স্বস্তির সুযোগ এনে দিয়েছে।
যদি বর্তমানের গ্যাসের চাহিদা (দৈনিক প্রায় দুই হাজার ৫২০ মিলিয়ন ঘনফুট) অনড় থাকত এবং পেট্রোবাংলার প্রত্যাশা অনুযায়ী পেট্রোবাংলার পরিকল্পিত গ্যাসকূপগুলোর খনন সময়মতো সফলভাবে সম্পন্ন হতো; তাহলে দেশের গ্যাস সরবরাহের বর্তমান ঘাটতি প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে আসতে পারত। কিন্তু উৎপাদন কূপগুলোর কোনো কোনোটির গ্যাস ফুরিয়ে আসছে; অন্যদিকে উৎপাদনের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস সঞ্চালনের অবকাঠামো ঘাটতি বাধা হিসেবে বিদ্যমান। সেই সঙ্গে বাড়ছে সরবরাহ ও চাহিদার ব্যবধান। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান সে কারণেই সম্ভবত বলছেন, তাঁর সংস্থার একক প্রচেষ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি গ্যাস চাহিদার সবটুকু জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য প্রাথমিক জ্বালানির বহুমুখী সরবরাহ উৎস নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments