চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-বেঁচে থাকতে হলে আশাবাদী হতেই হবে by যতীন সরকার
অপরিমেয় রক্ত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাকিস্তানের শৃঙ্খল ছিন্ন করে যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সেই বাংলাদেশেই যখন পাকিস্তানের ভূতের আছর হয়, এবং 'এর চেয়ে পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম'-এর মতো কথা বাংলাদেশের মানুষই যখন বলে ফেলে, বিশেষ করে পাকিস্তানের মতোই বাংলাদেশকে যখন বারবার সেনাশাসনে নিষ্পিষ্ট হতে দেখি, তখন এক অসহনীয় বেদনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। সেই বেদনা থেকে কি কোনো দিন আমাদের মুক্তি ঘটবে না?
পাকিস্তানের ভূতের আছর থেকে কি কোনো দিনই আমরা মুক্ত হতে পারব না? এ রকম প্রশ্নে যে সময় প্রতিনিয়তই বিদ্ধ হচ্ছিলাম, সে সময়ই হাতে আসে 'পূর্বাপর ১৯৭১' নামের একটি বই। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত বইটির লেখক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুহাম্মদ খলিলুর রহমান। বইটির পরিচিতি প্রসঙ্গে এর মলাটে যা লেখা হয়েছে তার শেষ দুটি বাক্য- 'কেবল সামরিক ইতিহাস বিবেচনায় নয়, পাকিস্তান-যুগ এবং তৎকালীন সামরিক রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক উপাদান মিলবে এই গ্রন্থে। ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, সমরশক্তির গঠন ও মনস্তত্ত্ব যাঁদের বিবেচ্য, তাঁদের বারবার ফিরতে হবে এই গ্রন্থের কাছে।'
কথাগুলো যে পুরোপুরি সত্য, বইটির পাঠ সমাপনের পর সে বিষয়ে আমি নিঃসংশয়। বইটি সম্পর্কে আগে আমি অন্যত্র যা লিখেছি, সে কথাগুলোই আজ আবার কালের কণ্ঠের পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করছি।
'বেঙ্গল রেজিমেন্টের পথিকৃৎ' মেজর খলিল ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালেও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পালাতে পারেননি। এরপর তিনি আটক হন বন্দিশিবিরে। সেসব অভিজ্ঞতা নিয়েই রচিত তাঁর বই 'পূর্বাপর ১৯৭১'। বইটির উপশিরোনাম 'পাকিস্তানি সেনা-গহ্বর থেকে দেখা'। এই উপশিরোনামটিই বইয়ের বর্ণনীয় বিষয়কে স্পষ্ট করে তুলেছে, 'সেনা-গহ্বর' কথাটি হয়েছে খুবই তাৎপর্যবহ। যে স্থানে তিনি কর্মজীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন, সে স্থানটিকে 'গহ্বর' ছাড়া আর কিছুই বলা যেতে পারে না। এই গহ্বরে যাঁরা তাঁর সহবাসী ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশকেই বলা যায় 'কূপমণ্ডূক' বা কুয়ার ব্যাঙ।
এই কুয়ার ব্যাঙদের পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে, 'পাকিস্তানিদের সীমাহীন অজ্ঞতা' শিরোনামে। ব্রিগেডিয়ার তোজাম্মেল, ক্যাপ্টেন জিলানি, মেজর মাহমুদ আতাউল্লাহ, অনারারি ক্যাপ্টেন সৈয়দ আসকার হুসেন, কর্নেল শিনারি- এ রকম বিভিন্ন পদমর্যাদার সেনানায়করা যে একেকজন ছিলেন অজ্ঞতার ডিপো, সে কথা মেজর জেনারেল খলিলের বইয়ে না পড়ে অন্য কারো মুখে শুনলে আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না। বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে ওদের অজ্ঞতা ও অজ্ঞতাজাত অবজ্ঞা যে ছিল সীমাহীন, তাঁর বইয়ে সেসবের বহু দৃষ্টান্ত তিনি উপস্থাপন করেছেন। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মানুষ যে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে- এই জ্ঞানটুকুও ওখানকার সেনাপতিদের ছিল না। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে ওরা মনে করত পাকিস্তানে দুশমন ভারতীয়দের সৃষ্ট 'গণ্ডগোল' মাত্র।
শুধু সেনানায়করা নয়, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সব শ্রেণী-পেশার মানুষই বাঙাল মুলুক সম্পর্কে ছিল একই রকম অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা। কিছু 'উচ্চশিক্ষিত ও পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি, যাঁরা পূর্বাঞ্চলে পশ্চিমের শোষণ-শাসন সম্পর্কে তাঁদের লেখায় ও কথায় প্রতিবাদ করতেন' তাঁরা ছিলেন একেবারেই 'মুষ্টিমেয় সংখ্যক'। আর সেখানকার 'অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত জনগণ, যারা পুরো জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ' তাদের মতামত সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলেই খলিল মনে করেন না। কারণ 'এই উপমহাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে সামন্ততন্ত্র বিদ্যমান এবং তা অত্যন্ত রূঢ় ও কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই সামন্ততন্ত্রে জমির মালিকানার ক্ষেত্রে প্রজাদের কোনো অধিকার নেই। এরা যখন তখন মালিকের খামখেয়ালির ওপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। সামন্তপ্রভু তাদের যা জানাবে তা-ই তারা জানবে, যা শেখাবে তা-ই তারা শিখবে, যাকে ভোট দিতে বলবে তাকেই তারা ভোট দেবে।'
এদের সঙ্গে প্রতিতুলনায় বাংলাদেশের 'অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত জনগণ' যে অনেক বেশি অগ্রসর, সে কথা ভেবে খুবই আত্মপ্রসন্ন হতে পারি বৈকি। আমাদের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তো গর্ব করার মতো অনেক কিছুই আছে। তবু ওই বুদ্ধিজীবীদের ভেতরকার গাদ্দার ও মেরুদণ্ডহীনদের সংখ্যাটিও একেবারে ক্ষীণ নয়। এ রকম কিছুসংখ্যক বাঙালির প্রসঙ্গও খলিলের বইয়ে উঠে এসেছে। এদের মধ্যেই আছে শহীদ মুনীর চৌধুরীর ভাই কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরীর নাম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সুযোগ পেয়েও কাইয়ুম চৌধুরী পালিয়ে তো আসেনইনি, বরং সে সময় রেডিও পাকিস্তানে প্রচারিত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে 'গাদ্দার' সম্বোধন করে বলেন, 'মুজিব তুমি জানো না তোমার মতো কুলাঙ্গার এই সোনার দেশটির কী ক্ষতি করেছে ও করছে।' একাত্তরের চৌদ্দই ডিসেম্বরে তাঁর ভাই মুনীর চৌধুরীর শহীদ হওয়ার খবর পেয়েও তিনি বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেই ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মুক্তিযোদ্ধারাই মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করেছে।
তবু, এর পরও, কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরীর জন্য আমার মনের গভীরে কিছুটা হলেও শ্রদ্ধার উপস্থিতি অনুভব করি। কারণ তিনি পাকিস্তানকেই তাঁর স্বদেশ বলে গ্রহণ করেছেন, সেই স্বদেশের প্রতি প্রীতিতে তাঁর একটুও খাদ নেই, পাকিস্তানের সেবাদাসত্ব করেছেন মনপ্রাণ দিয়ে, এখনো তা-ই করে যাচ্ছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফিরে এসে নানা ধানাইপানাই করে নিজেকে ধোয়া তুলসীপাতা প্রমাণের চেষ্টা করেননি। নিজের বিশ্বাসে তিনি সৎ, তাঁর এই সততা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
কিন্তু সামান্য প্রশংসা কি প্রাপ্য পাকিস্তানপ্রেমী বাঙালি কূটনীতিক রিয়াজ রহমানের? দখলদার পাকিস্তানি সেনানায়কের আদেশে বিদেশে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারকারী বিদ্বান কাজী দীন মুহম্মদের? একই রকম অপকর্মে নিয়োজিত মেরুদণ্ডহীন অথচ ব্যক্তিগত স্বার্থসচেতন বিচারপতি নূরুল ইসলামের?
দিলি্ল দূতাবাসে পাকিস্তান কর্তৃক নিযুক্ত বাঙালি দ্বিতীয় সচিব রিয়াজ রহমান বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যোগ না দিয়ে একাত্তরের জুন-জুলাইয়ের দিকে চলে যান করাচিতে। দীর্ঘকাল একান্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে পাকিস্তানি প্রভুদের মনোরঞ্জন করে ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং অধিষ্ঠিত হন এ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে- একসময় রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিবের পদও লাভ করেন। বিচারপতি নূরুল ইসলামও শেখ মুজিব সরকারের পতনের পর 'রাজনীতিতে জড়িত হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গেই একাত্ম' হন। তেমনই স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতকারী ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদও স্বাধীন দেশে মর্যাদাপূর্ণ জীবনই যাপন করে গেলেন। অথচ এদেরই বিপরীতে অবস্থান নিয়ে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতাসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেককেই স্বাধীন দেশে চূড়ান্ত মর্যাদাহীন জীবন কাটাতে হয়েছে। এসব দেখেশুনেই মেজর জেনারেল খলিল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন-
'মুক্তিযুদ্ধকে যদি একটি বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে এটাও প্রকাশ পাবে যে বিপ্লবের চিরাচরিত নীতি অনুযায়ী বিপ্লব-পরবর্তী ইতিহাসের অধ্যায় বিপ্লবের সন্তানরাই প্রথম কোরবানি হয় এবং যারা বিপ্লবের বিরোধিতা করে কিংবা যারা বিপ্লব থেকে নিজেদের সযত্নে দূরে রাখে, তারাই বিপ্লবের ফল ভোগ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।'
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তথা জাতীয় বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকরা যেসব কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, সেসবেরই একটি হলো শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। ঊনসত্তরের 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' ও তার পরিণতির কথা আমরা সবাই জানি; কিন্তু একাত্তরে বন্দি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে পাকিস্তান যে বিচারের প্রহসন করেছিল, সে সম্পর্কে সামান্য ভাসা ভাসা কথা ছাড়া তেমন কিছু আমাদের জানা নেই। এই প্রায়-অজানা বিষয়টি খলিল তাঁর বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে বিবৃত করেছেন। এটি পড়ে জানা যায় যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ঊনসত্তরের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতোই দাঁড় করানো হয়েছিল 'জয়দেবপুর ষড়যন্ত্র মামলা'। খলিলের বর্ণনায়-
'তথাকথিত ষড়যন্ত্রটি হয়েছিল জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে, ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে। সেখানে তখন মোতায়েন ছিল দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট। তার অধিনায়ক ছিলেন কর্নেল মাসুদ। ষড়যন্ত্রটিতে জেনারেল ওসমানী, মজুমদারসহ সব বাঙালি সিনিয়র অফিসার জড়িত ছিলেন। ষড়যন্ত্রের কথিত সিদ্ধান্ত ছিল যে সব বাঙালি সৈনিক অতর্কিতে পাকিস্তান সেনাছাউনিতে পাঞ্জাবি সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করবে এবং তাদের অস্ত্রাগার দখল করে নেবে। এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকবে না, অতএব পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে।'
সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট এই 'ষড়যন্ত্র মামলা'র বিচারের জন্য লায়ালপুরে কোর্ট মার্শাল গোছের একটি বিশেষ আদালত স্থাপন করে তার প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার রহিমউদ্দিনকে। আর এই প্রহসনের বিচারে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিকে দিয়ে সাক্ষ্য দেয়ানো হলেও আসল সাক্ষী ছিলেন তিনজন বাঙালি সেনা অফিসার- ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদার, লেফটেনেন্ট কর্নেল মুহম্মদ ইয়াসিন ও লেফটেনেন্ট কর্নেল মাসুদুল হুসেন খান। তাঁদের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য যে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল, খলিলের বইয়ে তার বিবরণ পড়ে রক্ত হিম হয়ে যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে, ঘৃণায় সব শরীর কুঞ্চিত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের প্রতিই নয় শুধু, এ কে ব্রোহীর মতো বিদ্বান বুদ্ধিজীবীর আচরণেও গা শিরশির করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদিও পাকিস্তানি সেনা শাসকদের প্রহসনের আদালতকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দেননি বা কোনো আইনজীবী নিয়োগে রাজি হননি, তবু দুনিয়ার সামনে বিচারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক সরকার সিন্ধুর প্রখ্যাত আইনজীবী এ কে ব্রোহীকে ডিফেন্স কাউন্সিলর নিযুক্ত করে। কিন্তু ব্রোহী কেবল সাক্ষীগোপাল হয়েই থাকলেন, ডিফেন্স কাউন্সিলর হিসেবে কোনো দায়িত্বই তিনি পালন করলেন না, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের অবৈধ বিচারপ্রক্রিয়া বৈধতা প্রদানের কাজটিই বিশ্বস্ততার সঙ্গে করে গেলেন। প্রহসনের বিচারে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলো।
তবু এতসব ষড়যন্ত্র আর অমানবিক আচরণ ও পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারল না, বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করল, বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানের বর্বর শাসকদের ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। অনেক দিন পাকিস্তানের বন্দিশিবিরে বাস করে, অনেক অভিজ্ঞতার ঝুলি কাঁধে নিয়ে মেজর জেনারেল মুহাম্মদ খলিলুর রহমানও ফিরে এলেন স্বাধীন স্বদেশেই- ১৯৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর।
বইয়ের এক স্থানে লেখক পাকিস্তানের দুজন একান্ত সংবেদনশীল ও দূরদর্শী মানুষের স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটি 'ভবিষ্যদ্বাণী'র উল্লেখ করেছেন। একটি পাকিস্তানের একজন সুশিক্ষিত উচ্চমানসম্পন্ন ও চরিত্রবান সেনানায়ক জেনারেল শওকত রেজার, অন্যটি 'সীমান্ত গান্ধী' খান আবদুল গাফ্ফার খানের। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে- এই খবরটি শুনে শওকত রেজা লেখককে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। ওখানে কোনো প্রতিরক্ষার সমস্যা নেই বলে তেমন কোনো বৃহৎ প্রতিরক্ষা বাহিনীর কিংবা প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত খরচের প্রয়োজনও নেই। অতএব, অতি শিগগির তোমরা অর্থনৈতিক উন্নতির দিক দিয়ে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাবে।'
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফ্ফার খান ছিলেন কাবুলে স্বেচ্ছানির্বাসিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, 'এই উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাদেশেই নিখুঁত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে ও কার্যকর থাকবে।'
বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনারেল শওকত রেজা ও সীমান্ত গান্ধীর বলিষ্ঠ আশাবাদের কথা স্মরণ করে খলিল লিখেছেন-
'প্রতিভাবান ও প্রজ্ঞাবান এই দুই ব্যক্তির ভবিষ্যদ্বাণী এখনো প্রায় প্রতিদিন আমার মনে পড়ে। তাঁদের কথা আংশিকভাবে সত্য হয়নি, এ কথা বলতে পারব না। তবে পুরোপুরি সত্য হওয়ার জন্য এখনো এই তিন যুগ পরও অপেক্ষা করে আছি। আমার বিশ্বাস, দুজনেরই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হবে। তবে কত দিন লাগবে জানি না।'
আমরা কেউই জানি না। কিন্তু এই দুজন ধীমানের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে বলে যদি না মানি, তাহলে আমাদের কারোরই বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। বেঁচে থাকতে হলে আশাবাদী হতেই হবে। তবে সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকেরই মনে রাখা উচিত : আশাবাদকে সার্থক করতে হলে প্রতি মুহূর্তেই সতর্ক ও সক্রিয় হতে হয়, অসতর্ক ও নিষ্ক্রিয় আশাবাদ বুদ্ধুদের মতোই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর মহৎ মানুষ কখনো ফলিত জ্যোতিষীর মতো ভবিষ্যদ্বাণী করেন না; তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী কতকগুলো সম্ভাবনার প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করে মাত্র, সংশ্লিষ্ট মানুষজনকে কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তব করে তুলতে হয় এবং তখনই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়ে ওঠে। শওকত রেজা ও গাফ্ফার খানের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।
মেজর জেনারেল মুহাম্মদ খলিলুর রহমানের বইয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার বিবরণ পড়তে পড়তে উনিশ শতকের একজন প্রায় অখ্যাত লেখক সেখ আবদুল লতিফের (ইনি সেই প্রখ্যাত নবাব আবদুল লতিফ নন) কথা আমার বারবার মনে পড়ছিল। সেখ আবদুল লতিফ মনে করতেন যে 'সৈনিক বৃত্তি অবলম্বন করে মানুষ তার মহৎ শক্তির অপব্যবহার করে।' ১৮৭৮ সালে ইনি 'মানব সংস্কারক' নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। সে বইয়ে 'সৈন্য' শীর্ষক প্রবন্ধটিকে তিনি লিখেছিলেন-
'আহা! কতদিনে সংসারে ধর্মের রাজত্ব হইবে, যুদ্ধের মূল উচ্ছেদ হইবে, সৈনিক কর্ম অদৃশ্য হইবে। একবার ভাব পৃথিবীতে কত সৈন্য আছে, তাহারা কত অর্থ অপব্যবহার করিতেছে, কত পরিশ্রমে নষ্ট করিতেছে; তাহারা কত কর্মসাধন করিতে পারিত, সমাজের কত উপকার করিতে পারিত। এক দেশে সৈন্য থাকিলে অন্য দেশীয়রা ভয় করিতে পারে, কোন দেশে না থাকে কিছু সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে না। আহা! কতদিনে সেই দিনের উদয় হইবে।'
যত দিনই লাগুক 'সেই দিনের উদয় হইবেই' এবং সেদিনই আমাদের মুক্তির সংগ্রাম প্রকৃত অর্থে সার্থক হয়ে উঠবে- আমার মনের গভীরে আমি এ রকম গভীর বিশ্বাসই লালন করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
কথাগুলো যে পুরোপুরি সত্য, বইটির পাঠ সমাপনের পর সে বিষয়ে আমি নিঃসংশয়। বইটি সম্পর্কে আগে আমি অন্যত্র যা লিখেছি, সে কথাগুলোই আজ আবার কালের কণ্ঠের পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করছি।
'বেঙ্গল রেজিমেন্টের পথিকৃৎ' মেজর খলিল ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালেও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পালাতে পারেননি। এরপর তিনি আটক হন বন্দিশিবিরে। সেসব অভিজ্ঞতা নিয়েই রচিত তাঁর বই 'পূর্বাপর ১৯৭১'। বইটির উপশিরোনাম 'পাকিস্তানি সেনা-গহ্বর থেকে দেখা'। এই উপশিরোনামটিই বইয়ের বর্ণনীয় বিষয়কে স্পষ্ট করে তুলেছে, 'সেনা-গহ্বর' কথাটি হয়েছে খুবই তাৎপর্যবহ। যে স্থানে তিনি কর্মজীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন, সে স্থানটিকে 'গহ্বর' ছাড়া আর কিছুই বলা যেতে পারে না। এই গহ্বরে যাঁরা তাঁর সহবাসী ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশকেই বলা যায় 'কূপমণ্ডূক' বা কুয়ার ব্যাঙ।
এই কুয়ার ব্যাঙদের পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে, 'পাকিস্তানিদের সীমাহীন অজ্ঞতা' শিরোনামে। ব্রিগেডিয়ার তোজাম্মেল, ক্যাপ্টেন জিলানি, মেজর মাহমুদ আতাউল্লাহ, অনারারি ক্যাপ্টেন সৈয়দ আসকার হুসেন, কর্নেল শিনারি- এ রকম বিভিন্ন পদমর্যাদার সেনানায়করা যে একেকজন ছিলেন অজ্ঞতার ডিপো, সে কথা মেজর জেনারেল খলিলের বইয়ে না পড়ে অন্য কারো মুখে শুনলে আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না। বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে ওদের অজ্ঞতা ও অজ্ঞতাজাত অবজ্ঞা যে ছিল সীমাহীন, তাঁর বইয়ে সেসবের বহু দৃষ্টান্ত তিনি উপস্থাপন করেছেন। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মানুষ যে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে- এই জ্ঞানটুকুও ওখানকার সেনাপতিদের ছিল না। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে ওরা মনে করত পাকিস্তানে দুশমন ভারতীয়দের সৃষ্ট 'গণ্ডগোল' মাত্র।
শুধু সেনানায়করা নয়, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সব শ্রেণী-পেশার মানুষই বাঙাল মুলুক সম্পর্কে ছিল একই রকম অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা। কিছু 'উচ্চশিক্ষিত ও পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি, যাঁরা পূর্বাঞ্চলে পশ্চিমের শোষণ-শাসন সম্পর্কে তাঁদের লেখায় ও কথায় প্রতিবাদ করতেন' তাঁরা ছিলেন একেবারেই 'মুষ্টিমেয় সংখ্যক'। আর সেখানকার 'অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত জনগণ, যারা পুরো জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ' তাদের মতামত সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলেই খলিল মনে করেন না। কারণ 'এই উপমহাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে সামন্ততন্ত্র বিদ্যমান এবং তা অত্যন্ত রূঢ় ও কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই সামন্ততন্ত্রে জমির মালিকানার ক্ষেত্রে প্রজাদের কোনো অধিকার নেই। এরা যখন তখন মালিকের খামখেয়ালির ওপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। সামন্তপ্রভু তাদের যা জানাবে তা-ই তারা জানবে, যা শেখাবে তা-ই তারা শিখবে, যাকে ভোট দিতে বলবে তাকেই তারা ভোট দেবে।'
এদের সঙ্গে প্রতিতুলনায় বাংলাদেশের 'অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত জনগণ' যে অনেক বেশি অগ্রসর, সে কথা ভেবে খুবই আত্মপ্রসন্ন হতে পারি বৈকি। আমাদের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তো গর্ব করার মতো অনেক কিছুই আছে। তবু ওই বুদ্ধিজীবীদের ভেতরকার গাদ্দার ও মেরুদণ্ডহীনদের সংখ্যাটিও একেবারে ক্ষীণ নয়। এ রকম কিছুসংখ্যক বাঙালির প্রসঙ্গও খলিলের বইয়ে উঠে এসেছে। এদের মধ্যেই আছে শহীদ মুনীর চৌধুরীর ভাই কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরীর নাম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সুযোগ পেয়েও কাইয়ুম চৌধুরী পালিয়ে তো আসেনইনি, বরং সে সময় রেডিও পাকিস্তানে প্রচারিত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে 'গাদ্দার' সম্বোধন করে বলেন, 'মুজিব তুমি জানো না তোমার মতো কুলাঙ্গার এই সোনার দেশটির কী ক্ষতি করেছে ও করছে।' একাত্তরের চৌদ্দই ডিসেম্বরে তাঁর ভাই মুনীর চৌধুরীর শহীদ হওয়ার খবর পেয়েও তিনি বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেই ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মুক্তিযোদ্ধারাই মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করেছে।
তবু, এর পরও, কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরীর জন্য আমার মনের গভীরে কিছুটা হলেও শ্রদ্ধার উপস্থিতি অনুভব করি। কারণ তিনি পাকিস্তানকেই তাঁর স্বদেশ বলে গ্রহণ করেছেন, সেই স্বদেশের প্রতি প্রীতিতে তাঁর একটুও খাদ নেই, পাকিস্তানের সেবাদাসত্ব করেছেন মনপ্রাণ দিয়ে, এখনো তা-ই করে যাচ্ছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফিরে এসে নানা ধানাইপানাই করে নিজেকে ধোয়া তুলসীপাতা প্রমাণের চেষ্টা করেননি। নিজের বিশ্বাসে তিনি সৎ, তাঁর এই সততা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
কিন্তু সামান্য প্রশংসা কি প্রাপ্য পাকিস্তানপ্রেমী বাঙালি কূটনীতিক রিয়াজ রহমানের? দখলদার পাকিস্তানি সেনানায়কের আদেশে বিদেশে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারকারী বিদ্বান কাজী দীন মুহম্মদের? একই রকম অপকর্মে নিয়োজিত মেরুদণ্ডহীন অথচ ব্যক্তিগত স্বার্থসচেতন বিচারপতি নূরুল ইসলামের?
দিলি্ল দূতাবাসে পাকিস্তান কর্তৃক নিযুক্ত বাঙালি দ্বিতীয় সচিব রিয়াজ রহমান বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যোগ না দিয়ে একাত্তরের জুন-জুলাইয়ের দিকে চলে যান করাচিতে। দীর্ঘকাল একান্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে পাকিস্তানি প্রভুদের মনোরঞ্জন করে ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং অধিষ্ঠিত হন এ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে- একসময় রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিবের পদও লাভ করেন। বিচারপতি নূরুল ইসলামও শেখ মুজিব সরকারের পতনের পর 'রাজনীতিতে জড়িত হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গেই একাত্ম' হন। তেমনই স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতকারী ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদও স্বাধীন দেশে মর্যাদাপূর্ণ জীবনই যাপন করে গেলেন। অথচ এদেরই বিপরীতে অবস্থান নিয়ে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতাসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেককেই স্বাধীন দেশে চূড়ান্ত মর্যাদাহীন জীবন কাটাতে হয়েছে। এসব দেখেশুনেই মেজর জেনারেল খলিল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন-
'মুক্তিযুদ্ধকে যদি একটি বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে এটাও প্রকাশ পাবে যে বিপ্লবের চিরাচরিত নীতি অনুযায়ী বিপ্লব-পরবর্তী ইতিহাসের অধ্যায় বিপ্লবের সন্তানরাই প্রথম কোরবানি হয় এবং যারা বিপ্লবের বিরোধিতা করে কিংবা যারা বিপ্লব থেকে নিজেদের সযত্নে দূরে রাখে, তারাই বিপ্লবের ফল ভোগ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।'
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তথা জাতীয় বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকরা যেসব কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, সেসবেরই একটি হলো শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। ঊনসত্তরের 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' ও তার পরিণতির কথা আমরা সবাই জানি; কিন্তু একাত্তরে বন্দি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে পাকিস্তান যে বিচারের প্রহসন করেছিল, সে সম্পর্কে সামান্য ভাসা ভাসা কথা ছাড়া তেমন কিছু আমাদের জানা নেই। এই প্রায়-অজানা বিষয়টি খলিল তাঁর বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে বিবৃত করেছেন। এটি পড়ে জানা যায় যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ঊনসত্তরের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতোই দাঁড় করানো হয়েছিল 'জয়দেবপুর ষড়যন্ত্র মামলা'। খলিলের বর্ণনায়-
'তথাকথিত ষড়যন্ত্রটি হয়েছিল জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে, ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে। সেখানে তখন মোতায়েন ছিল দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট। তার অধিনায়ক ছিলেন কর্নেল মাসুদ। ষড়যন্ত্রটিতে জেনারেল ওসমানী, মজুমদারসহ সব বাঙালি সিনিয়র অফিসার জড়িত ছিলেন। ষড়যন্ত্রের কথিত সিদ্ধান্ত ছিল যে সব বাঙালি সৈনিক অতর্কিতে পাকিস্তান সেনাছাউনিতে পাঞ্জাবি সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করবে এবং তাদের অস্ত্রাগার দখল করে নেবে। এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকবে না, অতএব পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে।'
সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট এই 'ষড়যন্ত্র মামলা'র বিচারের জন্য লায়ালপুরে কোর্ট মার্শাল গোছের একটি বিশেষ আদালত স্থাপন করে তার প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার রহিমউদ্দিনকে। আর এই প্রহসনের বিচারে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিকে দিয়ে সাক্ষ্য দেয়ানো হলেও আসল সাক্ষী ছিলেন তিনজন বাঙালি সেনা অফিসার- ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদার, লেফটেনেন্ট কর্নেল মুহম্মদ ইয়াসিন ও লেফটেনেন্ট কর্নেল মাসুদুল হুসেন খান। তাঁদের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য যে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল, খলিলের বইয়ে তার বিবরণ পড়ে রক্ত হিম হয়ে যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে, ঘৃণায় সব শরীর কুঞ্চিত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের প্রতিই নয় শুধু, এ কে ব্রোহীর মতো বিদ্বান বুদ্ধিজীবীর আচরণেও গা শিরশির করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদিও পাকিস্তানি সেনা শাসকদের প্রহসনের আদালতকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দেননি বা কোনো আইনজীবী নিয়োগে রাজি হননি, তবু দুনিয়ার সামনে বিচারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক সরকার সিন্ধুর প্রখ্যাত আইনজীবী এ কে ব্রোহীকে ডিফেন্স কাউন্সিলর নিযুক্ত করে। কিন্তু ব্রোহী কেবল সাক্ষীগোপাল হয়েই থাকলেন, ডিফেন্স কাউন্সিলর হিসেবে কোনো দায়িত্বই তিনি পালন করলেন না, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের অবৈধ বিচারপ্রক্রিয়া বৈধতা প্রদানের কাজটিই বিশ্বস্ততার সঙ্গে করে গেলেন। প্রহসনের বিচারে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলো।
তবু এতসব ষড়যন্ত্র আর অমানবিক আচরণ ও পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারল না, বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করল, বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানের বর্বর শাসকদের ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। অনেক দিন পাকিস্তানের বন্দিশিবিরে বাস করে, অনেক অভিজ্ঞতার ঝুলি কাঁধে নিয়ে মেজর জেনারেল মুহাম্মদ খলিলুর রহমানও ফিরে এলেন স্বাধীন স্বদেশেই- ১৯৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর।
বইয়ের এক স্থানে লেখক পাকিস্তানের দুজন একান্ত সংবেদনশীল ও দূরদর্শী মানুষের স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটি 'ভবিষ্যদ্বাণী'র উল্লেখ করেছেন। একটি পাকিস্তানের একজন সুশিক্ষিত উচ্চমানসম্পন্ন ও চরিত্রবান সেনানায়ক জেনারেল শওকত রেজার, অন্যটি 'সীমান্ত গান্ধী' খান আবদুল গাফ্ফার খানের। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে- এই খবরটি শুনে শওকত রেজা লেখককে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। ওখানে কোনো প্রতিরক্ষার সমস্যা নেই বলে তেমন কোনো বৃহৎ প্রতিরক্ষা বাহিনীর কিংবা প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত খরচের প্রয়োজনও নেই। অতএব, অতি শিগগির তোমরা অর্থনৈতিক উন্নতির দিক দিয়ে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাবে।'
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফ্ফার খান ছিলেন কাবুলে স্বেচ্ছানির্বাসিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, 'এই উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাদেশেই নিখুঁত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে ও কার্যকর থাকবে।'
বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনারেল শওকত রেজা ও সীমান্ত গান্ধীর বলিষ্ঠ আশাবাদের কথা স্মরণ করে খলিল লিখেছেন-
'প্রতিভাবান ও প্রজ্ঞাবান এই দুই ব্যক্তির ভবিষ্যদ্বাণী এখনো প্রায় প্রতিদিন আমার মনে পড়ে। তাঁদের কথা আংশিকভাবে সত্য হয়নি, এ কথা বলতে পারব না। তবে পুরোপুরি সত্য হওয়ার জন্য এখনো এই তিন যুগ পরও অপেক্ষা করে আছি। আমার বিশ্বাস, দুজনেরই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হবে। তবে কত দিন লাগবে জানি না।'
আমরা কেউই জানি না। কিন্তু এই দুজন ধীমানের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে বলে যদি না মানি, তাহলে আমাদের কারোরই বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। বেঁচে থাকতে হলে আশাবাদী হতেই হবে। তবে সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকেরই মনে রাখা উচিত : আশাবাদকে সার্থক করতে হলে প্রতি মুহূর্তেই সতর্ক ও সক্রিয় হতে হয়, অসতর্ক ও নিষ্ক্রিয় আশাবাদ বুদ্ধুদের মতোই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর মহৎ মানুষ কখনো ফলিত জ্যোতিষীর মতো ভবিষ্যদ্বাণী করেন না; তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী কতকগুলো সম্ভাবনার প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করে মাত্র, সংশ্লিষ্ট মানুষজনকে কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তব করে তুলতে হয় এবং তখনই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়ে ওঠে। শওকত রেজা ও গাফ্ফার খানের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।
মেজর জেনারেল মুহাম্মদ খলিলুর রহমানের বইয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার বিবরণ পড়তে পড়তে উনিশ শতকের একজন প্রায় অখ্যাত লেখক সেখ আবদুল লতিফের (ইনি সেই প্রখ্যাত নবাব আবদুল লতিফ নন) কথা আমার বারবার মনে পড়ছিল। সেখ আবদুল লতিফ মনে করতেন যে 'সৈনিক বৃত্তি অবলম্বন করে মানুষ তার মহৎ শক্তির অপব্যবহার করে।' ১৮৭৮ সালে ইনি 'মানব সংস্কারক' নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। সে বইয়ে 'সৈন্য' শীর্ষক প্রবন্ধটিকে তিনি লিখেছিলেন-
'আহা! কতদিনে সংসারে ধর্মের রাজত্ব হইবে, যুদ্ধের মূল উচ্ছেদ হইবে, সৈনিক কর্ম অদৃশ্য হইবে। একবার ভাব পৃথিবীতে কত সৈন্য আছে, তাহারা কত অর্থ অপব্যবহার করিতেছে, কত পরিশ্রমে নষ্ট করিতেছে; তাহারা কত কর্মসাধন করিতে পারিত, সমাজের কত উপকার করিতে পারিত। এক দেশে সৈন্য থাকিলে অন্য দেশীয়রা ভয় করিতে পারে, কোন দেশে না থাকে কিছু সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে না। আহা! কতদিনে সেই দিনের উদয় হইবে।'
যত দিনই লাগুক 'সেই দিনের উদয় হইবেই' এবং সেদিনই আমাদের মুক্তির সংগ্রাম প্রকৃত অর্থে সার্থক হয়ে উঠবে- আমার মনের গভীরে আমি এ রকম গভীর বিশ্বাসই লালন করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
No comments