আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬২)-পঁচিশে মার্চের রাত by আলী যাকের
আমরা তিন বন্ধু- মাহমুদুর রহমান বেণু, কমলদা (মাসরুরুল হক সিদ্দিকী), যত দূর মনে পড়ে, লুৎফর রহমান খোকা, ওয়াহিদ ভাই এবং আমি রংপুরের উদ্দেশে রওনা হলাম। মনে আছে, রাস্তাঘাট সুনসান ছিল। ফলে আরিচা থেকে নগরবাড়ী পর্যন্ত ফেরি থাকা সত্ত্বেও নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাওয়া গেল। সেখানে সন্জীদা আপা এক তরুণ দম্পতির সঙ্গে একটি কোয়ার্টারে একসঙ্গে থাকতেন। তাঁকে প্রস্তুত হতে বলে আমরা সবাই দিনাজপুরের পথে রওনা হলাম। বুদ্ধিটা ওয়াহিদ ভাইয়েরই ছিল।
এত দূর যখন এসেছি, দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির আর রামসাগর- এই ঐতিহাসিক নিদর্শন দুটি দেখে যাওয়া যাক।
এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। আমরা দিনাজপুরের পথে চা খাওয়ার জন্য পথের ধারের একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে গাড়ি থামালাম। তখন সন্ধ্যা। মোটা কাচের চশমা পরা এক বৃদ্ধ একা বসে চা খাচ্ছিলেন। আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন কি না। আমাদের এই প্রশ্ন শুনে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাঁর নিজস্ব রংপুরের ভাষায় বললেন, 'দিয়েছি বৈকি।' আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কাকে ভোট দিয়েছেন? তিনি বললেন, 'কেন? শেখের ব্যাটাকে।' একটু দুষ্টুমি করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কেন শেখকে ভোট দিলেন? তিনি বললেন, "তাহলে শুনুন, শেখ যাবে এখান দিয়ে, আমরা সবাই রাস্তার দুই ধারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, শেখের গাড়ির বহর আসছে। শেখের গাড়ি এসে ঠিক আমার সামনে থেমে গেল। গাড়ি থেকে নামল শেখ মুজিব। আর কোনো দিকে না তাকিয়ে আমার কাছে এসে আমার দুই হাত ধরে বলল, 'বাবা, আমাকে একটু দেখবেন।' তারপর ভোটের দিন আমি দশ গ্রামের মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে এসে শেখের পক্ষে ভোট দিয়েছি।" তাঁর এই সহজ-সরল কথায় আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি সম্পর্কে আবারও একবার নিশ্চিত হলাম। সাধারণ মানুষের নাড়ির সঙ্গে ছিল তাঁর যোগ। এমন নেতা কখনোই বিফল হতে পারেন না। দেখতে দেখতে সেই অমোঘ ২৫শে মার্চ একেবারে দোরগোড়ায় চলে এলো।
২৫শে মার্চও সন্ধ্যা থেকে ভাষা শহীদ মিনারে দেশাত্মবোধক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। হঠাৎ সাড়ে ৯টার দিকে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে লক্ষ করিনি, কিন্তু পরে দেখলাম যে চারদিকে কেমন যেন একধরনের ভৌতিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম, শহীদ মিনার অন্ধকার, কোথাও কেউ নেই। ওই ভবনের ক্যাফেটারিয়ার মালিক বলাই আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, 'মনে হয় অবস্থা খুব ভালো না। আপনারা বাড়ি চইলা যান।' আমরা পাঁচ বন্ধু, প্রায় পঞ্চপাণ্ডবের মতো, আমার গাড়িতে চড়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম। পরে শুনেছি, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত এবং তাঁর বন্ধুরাও সেই সময় বলাইয়ের ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিতেন। তাঁরা প্রায় সন্ধ্যায়ই আমাদের গাড়িটা ওই ভবনে যাওয়া-আসা করতে দেখতেন এবং ভাবতেন যে গাড়িটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুপ্তচরদের। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে এই কদিন আগে আমার কথা শুনে প্রথমবারের মতো তাঁর ভুল ভাঙল। যা হোক, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আসলে কী ঘটছে জানার জন্য আমরা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে, বঙ্গবন্ধু ভবনে যাব। গাড়ি করে যখন রোকেয়া হলের সামনে এসেছি, তখন দেখতে পেলাম, রোকেয়া হলের সামনে সদ্য ফেলে রাখা একটি বিশাল শিরীষ বৃক্ষ কেটে সাফ করা হচ্ছে। এই বৃক্ষটি ওখানে রাখা হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যাত্রাপথে ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য। এবং গাছটি কাটছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরই কয়েকজন সদস্য। ডানে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে দুই ট্রাক ভর্তি অস্ত্রসজ্জিত সেনা সদস্য উপস্থিত। আমরা একটু অবাকই হলাম। কেননা ১ মার্চ থেকে পাকিস্তানি আর্মি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে কখনো শহরে প্রবেশ করেনি। ৩২ নম্বরে যখন পৌঁছলাম, তখন চারদিক সুনসান। গেটে কেবল একজন দ্বাররক্ষী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সব নেতা কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলে গেছেন তাঁদের গন্তব্যে। পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপ বিফল হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি এও বললেন, 'আপনারা যাঁর যাঁর বাড়িতে চলে যান। কেননা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার রাস্তায় নামবে।' আমরা গাড়ি করে তড়িঘড়ি মগবাজারে এলাম। কেননা সেখানেই আমাদের পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে চারজনের গন্তব্য ছিল। তাদের সেখানে নামিয়ে দিলাম। তারপর আমি একা গাড়ি চালিয়ে রাজারবাগে আমাদের বাসস্থানে গিয়ে পৌঁছলাম। সেই বাড়িতে আমি থাকতাম আমার বড় ভাই এবং ভাবির সঙ্গে। রাত তখন পৌনে ১১টা হবে। হাত-মুখ ধুয়ে কেবল খেতে বসেছি, এমন সময় সামনের রাস্তা থেকে একটা হৈচৈয়ের শব্দ পেলাম। আমি খাওয়া ছেড়ে উঠে দ্রুত হাত ধুয়ে দৌড়ে গেলাম রাজারবাগের সামনের সদর রাস্তায়, যেটি আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে ছিল। গিয়ে দেখি, সেখানে পাড়ার সব লোক জড়ো হয়েছে। তারা সবাই উত্তেজিত। কেউ কেউ 'জয় বাংলা' বলে স্লোগান দিচ্ছে। রাজারবাগে যেসব পুলিশ ভাই থাকতেন, তাঁরা রাইফেল হাতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন এবং সবাইকে বোঝাচ্ছেন নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে। কেননা নিরস্ত্র মানুষ রাস্তায় থাকলে পাকিস্তানিরা তাদের মেরে ফেলবে, আর তাতে পুলিশের পক্ষে প্রতিরোধবূ্যহ রচনা করা প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়বে। তাঁরা এও বললেন যে শেষ বুলেটটি থাকা পর্যন্ত এবং তাঁদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ে যাবেন। আমরা যার যার বাসায় ফিরে এলাম।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। আমরা দিনাজপুরের পথে চা খাওয়ার জন্য পথের ধারের একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে গাড়ি থামালাম। তখন সন্ধ্যা। মোটা কাচের চশমা পরা এক বৃদ্ধ একা বসে চা খাচ্ছিলেন। আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন কি না। আমাদের এই প্রশ্ন শুনে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাঁর নিজস্ব রংপুরের ভাষায় বললেন, 'দিয়েছি বৈকি।' আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কাকে ভোট দিয়েছেন? তিনি বললেন, 'কেন? শেখের ব্যাটাকে।' একটু দুষ্টুমি করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কেন শেখকে ভোট দিলেন? তিনি বললেন, "তাহলে শুনুন, শেখ যাবে এখান দিয়ে, আমরা সবাই রাস্তার দুই ধারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, শেখের গাড়ির বহর আসছে। শেখের গাড়ি এসে ঠিক আমার সামনে থেমে গেল। গাড়ি থেকে নামল শেখ মুজিব। আর কোনো দিকে না তাকিয়ে আমার কাছে এসে আমার দুই হাত ধরে বলল, 'বাবা, আমাকে একটু দেখবেন।' তারপর ভোটের দিন আমি দশ গ্রামের মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে এসে শেখের পক্ষে ভোট দিয়েছি।" তাঁর এই সহজ-সরল কথায় আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি সম্পর্কে আবারও একবার নিশ্চিত হলাম। সাধারণ মানুষের নাড়ির সঙ্গে ছিল তাঁর যোগ। এমন নেতা কখনোই বিফল হতে পারেন না। দেখতে দেখতে সেই অমোঘ ২৫শে মার্চ একেবারে দোরগোড়ায় চলে এলো।
২৫শে মার্চও সন্ধ্যা থেকে ভাষা শহীদ মিনারে দেশাত্মবোধক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। হঠাৎ সাড়ে ৯টার দিকে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে লক্ষ করিনি, কিন্তু পরে দেখলাম যে চারদিকে কেমন যেন একধরনের ভৌতিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম, শহীদ মিনার অন্ধকার, কোথাও কেউ নেই। ওই ভবনের ক্যাফেটারিয়ার মালিক বলাই আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, 'মনে হয় অবস্থা খুব ভালো না। আপনারা বাড়ি চইলা যান।' আমরা পাঁচ বন্ধু, প্রায় পঞ্চপাণ্ডবের মতো, আমার গাড়িতে চড়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম। পরে শুনেছি, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত এবং তাঁর বন্ধুরাও সেই সময় বলাইয়ের ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিতেন। তাঁরা প্রায় সন্ধ্যায়ই আমাদের গাড়িটা ওই ভবনে যাওয়া-আসা করতে দেখতেন এবং ভাবতেন যে গাড়িটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুপ্তচরদের। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে এই কদিন আগে আমার কথা শুনে প্রথমবারের মতো তাঁর ভুল ভাঙল। যা হোক, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আসলে কী ঘটছে জানার জন্য আমরা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে, বঙ্গবন্ধু ভবনে যাব। গাড়ি করে যখন রোকেয়া হলের সামনে এসেছি, তখন দেখতে পেলাম, রোকেয়া হলের সামনে সদ্য ফেলে রাখা একটি বিশাল শিরীষ বৃক্ষ কেটে সাফ করা হচ্ছে। এই বৃক্ষটি ওখানে রাখা হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যাত্রাপথে ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য। এবং গাছটি কাটছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরই কয়েকজন সদস্য। ডানে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে দুই ট্রাক ভর্তি অস্ত্রসজ্জিত সেনা সদস্য উপস্থিত। আমরা একটু অবাকই হলাম। কেননা ১ মার্চ থেকে পাকিস্তানি আর্মি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে কখনো শহরে প্রবেশ করেনি। ৩২ নম্বরে যখন পৌঁছলাম, তখন চারদিক সুনসান। গেটে কেবল একজন দ্বাররক্ষী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সব নেতা কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলে গেছেন তাঁদের গন্তব্যে। পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপ বিফল হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি এও বললেন, 'আপনারা যাঁর যাঁর বাড়িতে চলে যান। কেননা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার রাস্তায় নামবে।' আমরা গাড়ি করে তড়িঘড়ি মগবাজারে এলাম। কেননা সেখানেই আমাদের পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে চারজনের গন্তব্য ছিল। তাদের সেখানে নামিয়ে দিলাম। তারপর আমি একা গাড়ি চালিয়ে রাজারবাগে আমাদের বাসস্থানে গিয়ে পৌঁছলাম। সেই বাড়িতে আমি থাকতাম আমার বড় ভাই এবং ভাবির সঙ্গে। রাত তখন পৌনে ১১টা হবে। হাত-মুখ ধুয়ে কেবল খেতে বসেছি, এমন সময় সামনের রাস্তা থেকে একটা হৈচৈয়ের শব্দ পেলাম। আমি খাওয়া ছেড়ে উঠে দ্রুত হাত ধুয়ে দৌড়ে গেলাম রাজারবাগের সামনের সদর রাস্তায়, যেটি আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে ছিল। গিয়ে দেখি, সেখানে পাড়ার সব লোক জড়ো হয়েছে। তারা সবাই উত্তেজিত। কেউ কেউ 'জয় বাংলা' বলে স্লোগান দিচ্ছে। রাজারবাগে যেসব পুলিশ ভাই থাকতেন, তাঁরা রাইফেল হাতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন এবং সবাইকে বোঝাচ্ছেন নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে। কেননা নিরস্ত্র মানুষ রাস্তায় থাকলে পাকিস্তানিরা তাদের মেরে ফেলবে, আর তাতে পুলিশের পক্ষে প্রতিরোধবূ্যহ রচনা করা প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়বে। তাঁরা এও বললেন যে শেষ বুলেটটি থাকা পর্যন্ত এবং তাঁদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ে যাবেন। আমরা যার যার বাসায় ফিরে এলাম।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments