সময়ের প্রেক্ষিত-বাংলাদেশ-জাপান: চার দশকের মৈত্রী by মনজুরুল হক
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে জাপান স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, আমাদের দেশ শত্রুর রাহুকবল থেকে মুক্ত হওয়ার মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে। ওই সময়ের আগে পর্যন্ত ভারত ও ভুটানের বাইরে পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত বলয়ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ ছাড়া অন্য আর কোনো দেশ আমাদের স্বাধীন অস্তিত্ব মেনে নেয়নি।
সেই হিসেবে জাপান হচ্ছে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দেশ, যে কিনা স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছিল স্বাধীন দেশের মর্যাদায় আমাদের গ্রহণ করতে। সেদিক থেকে জাপানের স্বীকৃতি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, যে স্বীকৃতি আমাদের মনোবলকেই কেবল চাঙা করে তোলেনি, একই সঙ্গে অন্যান্য অগ্রসর দেশকেও শক্তিধর কিছু রাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব মেনে নেওয়ায় অনুপ্রাণিত করেছিল।
জাপানের পথ ধরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় উত্তর ইউরোপের এগিয়ে আসা ওই সময়ের সেরকম বাস্তবতার প্রতিফলন তুলে ধরে। অথচ তখনকার আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশের আলোকে যে ছবি আমরা পাই, তা কিন্তু পরিষ্কারভাবে বলে দেয় যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া জাপানের জন্য সহজ মোটেও ছিল না। কেন তবে জাপানের সেরকম আগ বাড়িয়ে এগিয়ে আসা? প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যে দেওয়া সম্ভব নয়।
একাধিক যেসব উপাদান জাপানের সেই চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কাজ করেছে, তার শুরুতেই আছে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি জাপানিদের মনে দেখা দেওয়া গভীর একধরনের সহানুভূতির মনোভাব, যে মনোভাব জাগিয়ে তুলতে নিরলসভাবে যাঁরা সেদিন কাজ করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে শুরুতেই নাম করতে হয়, সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মের কিছু জাপানির, যাঁদের একদিকে যেমন ছিলেন ডানপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসীরা, অন্যদিকে তেমনই ছিলেন বাম আদর্শের প্রত্যয়ী তরুণেরা। এঁদেরই বিচ্ছিন্ন অথচ নিরলস প্রচেষ্টায় পাকিস্তানি বর্বরতার শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া লাখো শরণার্থীর কথা যেমন জাপানিরা জানতে পেরেছিল, ঠিক তেমনিভাবে জেনেছিল আমাদের বীর তরুণদের অস্ত্রহাতে স্বঘোষিত বীর শত্রুর মোকাবিলা করায় ঝাঁপিয়ে পড়ার খবর।
মনে পড়ে বছর ১৫ আগে একাত্তরের তেমনি এক জাপানি তরুণের সাক্ষাৎকার নেওয়ার স্মৃতি, যাতে তিনি বলেছিলেন—জাপানের অন্যতম প্রভাবশালী দৈনিক মায়নিচি শিম্বুন-এর প্রথম পাতায় কুকুরের মৃতদেহ ভক্ষণের ছবি দেখে সারা রাত অনিদ্রায় কাটানোর কথা। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে যে কাজটি তিনি করেছিলেন তা হলো, সমমনা কিছু তরুণকে জড়ো করে বাংলাদেশ সলিডারিটি লিগ নামের একটি সংগঠন দাঁড় করানো, জাপানিদের মধ্যে বাংলাদেশের দুর্দশার কথা প্রচার করে সেদিনের সেই স্বাধীনতাপ্রত্যাশী দেশটির জন্য কিছু করা যায় কি না, সেই চেষ্টা শুরুর সেই দিন থেকে যে সংগঠন করে গেছে। সেদিনের সেই তরুণ, বামপন্থী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ কবি কেন আরিমিতসুর পাশাপাশি ভিন্ন বলয়ে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন সেই সময়ে মাত্র পেশাগত জীবন শুরু করা বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞ, তরুণ অধ্যাপক ৎসুইয়োসি নারা এবং আরও অনেকে। আর মাঠপর্যায়ে এঁরা কর্মরত থাকা অবস্থায় নেপথ্যে যিনি জাপান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে নিয়োজিত থেকেছেন, তিনি হলেন সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ, রাজনীতিবিদ তাকেশি হায়াকাওয়া। এঁদেরই নিরলস পরিশ্রম ও সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে হঠাৎ বইতে থাকা অনুকূল এক হাওয়া জাপানের জন্য ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিল।
শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা করতে পারা জাপানের পক্ষে তখন তেমন সহজ কাজ ছিল না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সেই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভাজনে জাপানের তখন পরিষ্কারভাবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের জোটে অন্তর্ভুক্ত থাকা। ভিয়েতনামযুদ্ধ তখন অনেকটাই তুঙ্গে এবং জাপান সরকারের অবস্থান ছিল পরিষ্কারভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে, যদিও নাগরিকদের মধ্যে বিরাজমান কঠোর যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের কারণে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া জাপানের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে চলতে থাকা বাকযুদ্ধে জাপান বরাবরই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। ফলে সেই হিসেবে বলা যায়, ১৯৭১-৭২ সালে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণের দরজা জাপানের জন্য অনেকটাই ছিল বন্ধ। তার পরও আমরা দেখি, আমাদের মুক্তির যুদ্ধ চলতে থাকার পুরো সময় ধরে জাপানের অবস্থান ছিল যেন পরক্ষে আমাদের ঠিক পাশে থাকা। এর কারণ অবশ্যই হচ্ছে অনুকূল জনমত, যেটা গড়ে নিতে সাহায্য করেছিলেন ৎসুইয়োসি নারা, কেন আরিমিতসু এবং সর্বোপরি তাকেশি হায়াকাওয়ার মতো বিদগ্ধজনেরা। অনুকূল সেই জনমতকে অগ্রাহ্য করা মার্কিন-ঘেঁষা সেদিনের সেই সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি বলেই পাকিস্তানের প্রচণ্ড আপত্তি সত্ত্বেও দলত্যাগী বাংলাদেশি কূটনীতিকদের টোকিওতে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পথে কোনো রকম বাধা জাপান দেয়নি।
ষোলোই ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার সময় অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘটে যায়, যা কিনা অন্যদিকে আবার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে চটজলদি স্বীকৃতি দেওয়ার পথ জাপানের জন্য খুলে দিয়েছিল। আমরা জানি, সেই সময়ে হেনরি কিসিঞ্জার চীন সফরে গিয়েছিলেন এবং চীনের মিত্র পাকিস্তান গোপন সেই সফরে ব্যবস্থা করে দেওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভণ্ডুল করে দিতে সব রকম প্রচেষ্টা তিনি চালান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সেই তৎপরতা, অন্যদিকে জাপানের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সংশয়ের জন্ম এ কারণে দিয়েছিল যে, এশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রকে পাশ কাটিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নেওয়াকে জাপান অনেকটা যেন বিশ্বাসভঙ্গ হিসেবে মনে করে নিয়েছিল, যা কিনা কিছুটা হলেও একলা চলার মনোভাব জাপানিদের মধ্যে উসকে দিয়েছিল। বাংলাদেশের দ্রুত স্বীকৃতিও বলা যায় সেই পথ ধরেই এসেছে।
তবে সেদিনের আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে যে রকম বাস্তবতাই বিরাজমান থাক না কেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে গত চার দশকে দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের কোনো রকম টানাপোড়েন দেখা যায়নি। বাংলাদেশ সব সময় জাপানের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন থেকে গেছে এবং জাপানও সেই সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশের প্রতি সাহায্য আর সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত রেখেছে। দ্বিপক্ষীয় সেই হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পথে আরেকটি মাইলফলক ছিল ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর। হেনরি কিসিঞ্জারের দেওয়া তলাবিহীন ঝুড়ির পদবি বহন করে যাওয়ার মুখে বঙ্গবন্ধুর সেই সফর বাস্তবায়িত হলেও জাপান কিন্তু মার্কিন সেই অবজ্ঞাকে মোটেই আমলে নেয়নি, বরং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাড়িয়ে রেখেছিল মৈত্রীর হাত। সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির এটাও তো হচ্ছে আরেক বিস্ময়, যা কিনা অনেকটাই সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কল্যাণে।
গত চার দশকে গভীর সেই সম্পর্ককে আরও গভীরতর করে নিতে অন্য আরও অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও যে পরোক্ষ ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছিল তা হলো, ১৯৭৭ সালের জাপান এয়ারলাইনসের বিমান হাইজ্যাক। বাংলাদেশে তখন অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা থাকা সত্ত্বেও সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্য করা থেকে তৎকালীন সরকার বিরত থাকেনি, যা জাপানকে মুগ্ধ করেছিল। সেদিনের স্মৃতি আজও তৃপ্তির সঙ্গে স্মরণ করেন জাপানের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃস্থানীয় সাংসদ হাজিমে ইশি, সংসদীয় উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সমস্যার সমাধান খুঁজে নিতে বেশ কিছুদিন সেবার যাঁকে বাংলাদেশে থাকতে হয়েছিল, যে সুবাদে সেই সময়ে বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এ জি মাহমুদের সঙ্গে যাঁর গড়ে ওঠে আজীবন সখ্য।
রাজনৈতিক সম্পর্কের বাইরে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক যে বেশ কিছু উপাদান সম্পর্ক আরও পোক্ত করে নেওয়ায় অবদান রেখেছে, তার শুরুতেই আছে বঙ্গভাষী বেশ কিছু জাপানির নিরলস প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম। শুধু বাংলা ভাষা শেখার মধ্যেই এঁদের কর্মকাণ্ড সীমিত থাকেনি। কেউ হাত দিয়েছেন বাংলাদেশের সাহিত্য জাপানি ভাষায় অনুবাদ করার কাজে, কেউ বা আবার ভাষার দখল নিয়ে ছুটে গেছেন বাংলাদেশের দূর গ্রামে দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে, কেউ আবার বাংলাদেশ নিয়ে লেখা জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য বই বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার কাজে হাত দিয়েছেন। শেষের এই দলে সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক কাযুও আজুমা, কিওকো নিওয়া, মাসাআকি ওহাশি ও কাজুহিরো ওয়াতানাবের নাম উল্লেখ করতে হলেও তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চার দশক পূরণ করতে চললেও সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল আরও অনেক আগে, বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে। তেনশিন ওকাকুরা ভারত সফরে এসেছিলেন শতাব্দীর একেবারে সূচনাতে। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করলেও পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করা তাঁর হয়ে ওঠেনি। ফলে ঠিক একালের বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সেই ভারত ভ্রমণকে একসূত্রে গেঁথে নেওয়া দুষ্কর। সেদিক থেকে ঢাকার নারী হরিপ্রভা তাকেদার স্বামী উয়েমন তাকেদাকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আদি পুরুষ ধরে নেওয়া যেতে পারে। ঢাকায় তাঁর আগমন ঘটেছিল ১৯০৩ সালে অর্থাৎ ওকাকুরার ভারত ভ্রমণের দুই বছরের মাথায়।
আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করে যাঁকে অগ্রণী হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে, তিনি হলেন এখন থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে বাঙালি পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেই একই বছর, ১৯৬২ সালে ঢাকায় চলে আসা জাপানি নারী রিতসুকো আবেদিন। স্বামী প্রয়াত হলেও আজও তিনি বাংলাদেশ ও তার মানুষকে ভালোবেসে সেখানেই থেকে গেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৪০তম বার্ষিকী তাই একই সঙ্গে সেই সব আড়ালে থেকে যাওয়া মানুষকে স্মরণ করা, যাঁদের নীরব অবদান গড়ে দিয়েছে চিরস্থায়ী এক মৈত্রীর ভিত্তি।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
জাপানের পথ ধরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় উত্তর ইউরোপের এগিয়ে আসা ওই সময়ের সেরকম বাস্তবতার প্রতিফলন তুলে ধরে। অথচ তখনকার আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশের আলোকে যে ছবি আমরা পাই, তা কিন্তু পরিষ্কারভাবে বলে দেয় যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া জাপানের জন্য সহজ মোটেও ছিল না। কেন তবে জাপানের সেরকম আগ বাড়িয়ে এগিয়ে আসা? প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যে দেওয়া সম্ভব নয়।
একাধিক যেসব উপাদান জাপানের সেই চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কাজ করেছে, তার শুরুতেই আছে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি জাপানিদের মনে দেখা দেওয়া গভীর একধরনের সহানুভূতির মনোভাব, যে মনোভাব জাগিয়ে তুলতে নিরলসভাবে যাঁরা সেদিন কাজ করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে শুরুতেই নাম করতে হয়, সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মের কিছু জাপানির, যাঁদের একদিকে যেমন ছিলেন ডানপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসীরা, অন্যদিকে তেমনই ছিলেন বাম আদর্শের প্রত্যয়ী তরুণেরা। এঁদেরই বিচ্ছিন্ন অথচ নিরলস প্রচেষ্টায় পাকিস্তানি বর্বরতার শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া লাখো শরণার্থীর কথা যেমন জাপানিরা জানতে পেরেছিল, ঠিক তেমনিভাবে জেনেছিল আমাদের বীর তরুণদের অস্ত্রহাতে স্বঘোষিত বীর শত্রুর মোকাবিলা করায় ঝাঁপিয়ে পড়ার খবর।
মনে পড়ে বছর ১৫ আগে একাত্তরের তেমনি এক জাপানি তরুণের সাক্ষাৎকার নেওয়ার স্মৃতি, যাতে তিনি বলেছিলেন—জাপানের অন্যতম প্রভাবশালী দৈনিক মায়নিচি শিম্বুন-এর প্রথম পাতায় কুকুরের মৃতদেহ ভক্ষণের ছবি দেখে সারা রাত অনিদ্রায় কাটানোর কথা। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে যে কাজটি তিনি করেছিলেন তা হলো, সমমনা কিছু তরুণকে জড়ো করে বাংলাদেশ সলিডারিটি লিগ নামের একটি সংগঠন দাঁড় করানো, জাপানিদের মধ্যে বাংলাদেশের দুর্দশার কথা প্রচার করে সেদিনের সেই স্বাধীনতাপ্রত্যাশী দেশটির জন্য কিছু করা যায় কি না, সেই চেষ্টা শুরুর সেই দিন থেকে যে সংগঠন করে গেছে। সেদিনের সেই তরুণ, বামপন্থী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ কবি কেন আরিমিতসুর পাশাপাশি ভিন্ন বলয়ে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন সেই সময়ে মাত্র পেশাগত জীবন শুরু করা বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞ, তরুণ অধ্যাপক ৎসুইয়োসি নারা এবং আরও অনেকে। আর মাঠপর্যায়ে এঁরা কর্মরত থাকা অবস্থায় নেপথ্যে যিনি জাপান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে নিয়োজিত থেকেছেন, তিনি হলেন সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ, রাজনীতিবিদ তাকেশি হায়াকাওয়া। এঁদেরই নিরলস পরিশ্রম ও সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে হঠাৎ বইতে থাকা অনুকূল এক হাওয়া জাপানের জন্য ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিল।
শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা করতে পারা জাপানের পক্ষে তখন তেমন সহজ কাজ ছিল না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সেই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভাজনে জাপানের তখন পরিষ্কারভাবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের জোটে অন্তর্ভুক্ত থাকা। ভিয়েতনামযুদ্ধ তখন অনেকটাই তুঙ্গে এবং জাপান সরকারের অবস্থান ছিল পরিষ্কারভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে, যদিও নাগরিকদের মধ্যে বিরাজমান কঠোর যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের কারণে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া জাপানের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে চলতে থাকা বাকযুদ্ধে জাপান বরাবরই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। ফলে সেই হিসেবে বলা যায়, ১৯৭১-৭২ সালে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণের দরজা জাপানের জন্য অনেকটাই ছিল বন্ধ। তার পরও আমরা দেখি, আমাদের মুক্তির যুদ্ধ চলতে থাকার পুরো সময় ধরে জাপানের অবস্থান ছিল যেন পরক্ষে আমাদের ঠিক পাশে থাকা। এর কারণ অবশ্যই হচ্ছে অনুকূল জনমত, যেটা গড়ে নিতে সাহায্য করেছিলেন ৎসুইয়োসি নারা, কেন আরিমিতসু এবং সর্বোপরি তাকেশি হায়াকাওয়ার মতো বিদগ্ধজনেরা। অনুকূল সেই জনমতকে অগ্রাহ্য করা মার্কিন-ঘেঁষা সেদিনের সেই সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি বলেই পাকিস্তানের প্রচণ্ড আপত্তি সত্ত্বেও দলত্যাগী বাংলাদেশি কূটনীতিকদের টোকিওতে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পথে কোনো রকম বাধা জাপান দেয়নি।
ষোলোই ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার সময় অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘটে যায়, যা কিনা অন্যদিকে আবার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে চটজলদি স্বীকৃতি দেওয়ার পথ জাপানের জন্য খুলে দিয়েছিল। আমরা জানি, সেই সময়ে হেনরি কিসিঞ্জার চীন সফরে গিয়েছিলেন এবং চীনের মিত্র পাকিস্তান গোপন সেই সফরে ব্যবস্থা করে দেওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভণ্ডুল করে দিতে সব রকম প্রচেষ্টা তিনি চালান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সেই তৎপরতা, অন্যদিকে জাপানের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সংশয়ের জন্ম এ কারণে দিয়েছিল যে, এশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রকে পাশ কাটিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নেওয়াকে জাপান অনেকটা যেন বিশ্বাসভঙ্গ হিসেবে মনে করে নিয়েছিল, যা কিনা কিছুটা হলেও একলা চলার মনোভাব জাপানিদের মধ্যে উসকে দিয়েছিল। বাংলাদেশের দ্রুত স্বীকৃতিও বলা যায় সেই পথ ধরেই এসেছে।
তবে সেদিনের আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে যে রকম বাস্তবতাই বিরাজমান থাক না কেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে গত চার দশকে দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের কোনো রকম টানাপোড়েন দেখা যায়নি। বাংলাদেশ সব সময় জাপানের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন থেকে গেছে এবং জাপানও সেই সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশের প্রতি সাহায্য আর সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত রেখেছে। দ্বিপক্ষীয় সেই হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পথে আরেকটি মাইলফলক ছিল ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর। হেনরি কিসিঞ্জারের দেওয়া তলাবিহীন ঝুড়ির পদবি বহন করে যাওয়ার মুখে বঙ্গবন্ধুর সেই সফর বাস্তবায়িত হলেও জাপান কিন্তু মার্কিন সেই অবজ্ঞাকে মোটেই আমলে নেয়নি, বরং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাড়িয়ে রেখেছিল মৈত্রীর হাত। সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির এটাও তো হচ্ছে আরেক বিস্ময়, যা কিনা অনেকটাই সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কল্যাণে।
গত চার দশকে গভীর সেই সম্পর্ককে আরও গভীরতর করে নিতে অন্য আরও অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও যে পরোক্ষ ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছিল তা হলো, ১৯৭৭ সালের জাপান এয়ারলাইনসের বিমান হাইজ্যাক। বাংলাদেশে তখন অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা থাকা সত্ত্বেও সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্য করা থেকে তৎকালীন সরকার বিরত থাকেনি, যা জাপানকে মুগ্ধ করেছিল। সেদিনের স্মৃতি আজও তৃপ্তির সঙ্গে স্মরণ করেন জাপানের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃস্থানীয় সাংসদ হাজিমে ইশি, সংসদীয় উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সমস্যার সমাধান খুঁজে নিতে বেশ কিছুদিন সেবার যাঁকে বাংলাদেশে থাকতে হয়েছিল, যে সুবাদে সেই সময়ে বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এ জি মাহমুদের সঙ্গে যাঁর গড়ে ওঠে আজীবন সখ্য।
রাজনৈতিক সম্পর্কের বাইরে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক যে বেশ কিছু উপাদান সম্পর্ক আরও পোক্ত করে নেওয়ায় অবদান রেখেছে, তার শুরুতেই আছে বঙ্গভাষী বেশ কিছু জাপানির নিরলস প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম। শুধু বাংলা ভাষা শেখার মধ্যেই এঁদের কর্মকাণ্ড সীমিত থাকেনি। কেউ হাত দিয়েছেন বাংলাদেশের সাহিত্য জাপানি ভাষায় অনুবাদ করার কাজে, কেউ বা আবার ভাষার দখল নিয়ে ছুটে গেছেন বাংলাদেশের দূর গ্রামে দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে, কেউ আবার বাংলাদেশ নিয়ে লেখা জাপানের কিছু উল্লেখযোগ্য বই বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার কাজে হাত দিয়েছেন। শেষের এই দলে সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক কাযুও আজুমা, কিওকো নিওয়া, মাসাআকি ওহাশি ও কাজুহিরো ওয়াতানাবের নাম উল্লেখ করতে হলেও তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চার দশক পূরণ করতে চললেও সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল আরও অনেক আগে, বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে। তেনশিন ওকাকুরা ভারত সফরে এসেছিলেন শতাব্দীর একেবারে সূচনাতে। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করলেও পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করা তাঁর হয়ে ওঠেনি। ফলে ঠিক একালের বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সেই ভারত ভ্রমণকে একসূত্রে গেঁথে নেওয়া দুষ্কর। সেদিক থেকে ঢাকার নারী হরিপ্রভা তাকেদার স্বামী উয়েমন তাকেদাকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আদি পুরুষ ধরে নেওয়া যেতে পারে। ঢাকায় তাঁর আগমন ঘটেছিল ১৯০৩ সালে অর্থাৎ ওকাকুরার ভারত ভ্রমণের দুই বছরের মাথায়।
আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করে যাঁকে অগ্রণী হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে, তিনি হলেন এখন থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে বাঙালি পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেই একই বছর, ১৯৬২ সালে ঢাকায় চলে আসা জাপানি নারী রিতসুকো আবেদিন। স্বামী প্রয়াত হলেও আজও তিনি বাংলাদেশ ও তার মানুষকে ভালোবেসে সেখানেই থেকে গেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৪০তম বার্ষিকী তাই একই সঙ্গে সেই সব আড়ালে থেকে যাওয়া মানুষকে স্মরণ করা, যাঁদের নীরব অবদান গড়ে দিয়েছে চিরস্থায়ী এক মৈত্রীর ভিত্তি।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments