জাতীয় গ্রন্থনীতি বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই by আজিজুল পারভেজ

দেশে জাতীয় গ্রন্থনীতি ও জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি প্রণীত হলেও তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। প্রণীত নীতিতে গণগ্রন্থাগার নেটওয়ার্ক ক্রমান্বয়ে ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ে সম্প্রসারণের কথা রয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। গ্রন্থনীতি নিয়ে গত ২০ বছর ধরে চলছে আলোচনা-পর্যালোচনা। গ্রন্থনীতি চূড়ান্ত করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেওয়ায় সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা 'শিল্প' হিসেবে গড়ে ওঠেনি। নানা সমস্যায় এ খাতে চলছে স্থবিরতা। অধিক দামের কারণে বিপুল পাঠকের কাছে পেঁৗছাচ্ছে না বই। পাঠাগার আন্দোলনেও আসেনি গতি।


১৯৯২ সালে তৎকালীন সংস্কৃতি সচিবের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো প্রণীত হয়েছিল জাতীয় গ্রন্থনীতি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সে নীতি অনুমোদনও করেছিল। ওই গ্রন্থনীতিতে গণগ্রন্থাগার নেটওয়ার্ক ক্রমান্নয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পেশার মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়ার কথাও ছিল তাতে। প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পেশাগত মানোন্নয়নে প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা ছিল। এতে গ্রন্থাগার আইন প্রবর্তন, বিদেশি বইয়ের আমদানি সহজকরণ, রপ্তানি নীতিতে বইকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ভাড়া ও হ্রাসকৃত ডাকমাসুলের ব্যবস্থার প্রবর্তন, দেশব্যাপী পুস্তক বিপণনের সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, বই পরিবহনে রেয়াতি ভাড়া ও হ্রাসকৃত ডাকমাসুলের ব্যবস্থা প্রবর্তনেরও প্রস্তাব ছিল।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের শেষ দিকে গ্রন্থনীতি বাস্তবায়ন কমিটি করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে ১৯৯৮ সালে জাতীয় গ্রন্থনীতি বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি করে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বাধীন ওই কমিটি প্রণয়ন করে 'জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি'। ওই নীতিতে গণগ্রন্থাগার নেটওয়ার্ক ক্রমান্বয়ে গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার সুপারিশ করা হয়, যাতে যেকোনো নাগরিক তাঁর বাসস্থানের এক মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে একটি গণগ্রন্থাগার বা তার একটি শাখা কিংবা একটি চলমান শাখা থেকে গ্রন্থাগার পরিষেবা পেতে পারেন।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্রন্থনীতি বাস্তবায়ন এবং গণগ্রন্থাগার সম্প্রসারণে কোন মন্ত্রণালয় কী কাজ করবে, তার বিস্তারিত পরিকল্পনা অনেক যত্ন নিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু বিগত ১২ বছরেও এ নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, 'বইয়ের ব্যাপারে জাতিগতভাবেই আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের দেশ চালান যে মন্ত্রী ও আমলারা, চেক বইয়ের প্রতিই তাদের আগ্রহ বেশি।'
সর্বশেষ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এসে গ্রন্থনীতি নিয়ে আবার কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। পর্যালোচনার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। প্রথম দিকে কমিটির কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হলেও বছরখানেকের মধ্যে কোনো সভাই হয়নি। কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির পরিচালক খান মাহবুব বলেন, 'গ্রন্থনীতি প্রণয়নের পেছনেই আমরা সময় ব্যয় করছি। অথচ যে গ্রন্থনীতি আছে তার আলোকে এখনই কাজ শুরু করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কারো নজর নেই।'
কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির উপপরিচালক এবং তথ্য ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেন, 'বাংলাদেশের গ্রন্থনীতি অনেক অগ্রসর। এ যাবত পাওয়া তথ্য অনুসারে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে মালয়েশিয়ার পর আমাদের দেশেই গ্রন্থনীতি প্রণীত হয়েছে।'
প্রকাশকরা জানান, চূড়ান্ত কোনো নীতিমালা না থাকায় সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা 'শিল্প' হিসেবে দাঁড়ায়নি। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা কখনো কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পান না। ফলে সৃজনশীল প্রকাশনা খাতে চলছে স্থবিরতা। জানা যায়, অনুসরণীয় গ্রন্থনীতি না থাকায় বইয়ের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে চলছে নৈরাজ্য। প্রকাশকরা নিজেদের ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণ করেন। বই বিক্রির ক্ষেত্রে কমিশন দেওয়া হয় প্রায় ৪০ শতাংশ। মধ্যস্বত্বভোগীরা পায় এই কমিশন। ফলে বইয়ের মূল্য বেশি ধরা হয়। এ কারণে বিপুল পাঠকের কাছে বই পেঁৗছানো সহজ হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত বাংলা বইয়ের তুলনায় বাংলাদেশে প্রকাশিত বইয়ের দাম প্রায় দ্বিগুণ। বইয়ের দাম কম রাখার স্বার্থে কাগজের ওপর ভর্তুকি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন প্রকাশকরা। একই সঙ্গে সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের দাবিও প্রকাশকদের দীর্ঘদিনের।
অভিযোগ আছে, অনুসরণীয় নীতি না থাকার কারণে নামকরা কয়েকজন লেখক ছাড়া অধিকাংশ লেখকই বই প্রকাশ করে প্রতারিত হচ্ছেন। লেখকের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠাগুলো আগ্রহ দেখায় না। ফলে প্রাপ্য রয়্যালিটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন লেখকরা। বইয়ের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও কোনো ছাড় পাওয়া যাচ্ছে না। বইয়ের মান বিবেচনার ক্ষেত্রেও কোনো পদ্ধতি না থাকার কারণে মানহীন বইয়ে বাজার সয়লাব।
আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও বই বিশেষায়িত পণ্যের মর্যাদা পায়নি। এ ক্ষেত্রে উচ্চ হারে কর দিতে হয়। পরিবহন খাতে বিশেষ সুবিধা না থাকার কারণে বাংলাদেশের বই বিদেশে পাঠাতে গেলেও দাম অনেক বেড়ে যায়। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের কাছে ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও বাংলা বই সহজলভ্য হচ্ছে না।
অভিযোগ আছে, গ্রন্থনীতি না থাকায় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে বই কেনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম হয়ে থাকে। একই কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে গ্রন্থাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েও তা কোনো কাজে আসেনি। কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় বই কিনে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রন্থাগারিকের কোনো পদই নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কলেজ ও হাইস্কুল পর্যায়ে গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ জানান, সারা দেশে গণগ্রন্থাগার আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার আন্তরিক। সরকার দেশের প্রতিটি উপজেলায় গণগ্রন্থাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৫৪টি উপজেলায় গণগ্রন্থাগার স্থাপনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে।
বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক মনসুর মুসা জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমাদের সমাজ পুরোপুরি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নয়। এটা বিশ্বাসভিত্তিক সমাজ। আমরা একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ চাই। একটা বিশ্বাসভিত্তিক সমাজকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে পরিণত ও রূপান্তর করতে চাইলে জ্ঞানের বিতরণটা সুষ্ঠু হতে হবে। জ্ঞান বিতরণের অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞানের বিস্তার। বইয়ের বিস্তারের জন্য গ্রন্থনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'

No comments

Powered by Blogger.