মঙ্গা তাড়িয়ে আগাম নবান্ন by পরিমল মজুমদার,

ত্তরাঞ্চলের কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে আগাম নবান্নের উৎসব। মাত্র তিন বছর আগেও চিরায়ত পদ্ধতিতে বোনা আমন ধান কার্তিকের মঙ্গা আর দীর্ঘ উপবাস শেষে কৃষকের ঘরে উঠত। সে সময় কাজের খোঁজে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন লাখ লাখ কৃষি শ্রমিক। এখন সেই কষ্টের দিন শেষ হয়েছে। আগাম জাতের বিনা-৭ ও ব্রি-৩৩ ধান বদলে দিয়েছে উত্তরাঞ্চলের চিরচেনা মঙ্গা আর দুর্ভিক্ষের চিত্র।লালমনিরহাট জেলার তিস্তা বাজার পেরিয়ে ডান দিকে মোড় ঘুরে একটু এগোলেই কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা গ্রাম। গ্রামের ভেতর ঢুকতেই নতুন আমন ধানের গন্ধ মন চাঙা করে তোলে।


কানে ভেসে আসে আঞ্চলিক ভাষার গানের সুর 'ও তুই কিসোত্ গোসা (অভিমান) হলুরে নাল (লাল) বাজারের চ্যাংরা (তরুণ) বন্ধুরে।' মাঠে সারিবদ্ধভাবে ধান কাটার পাশাপাশি এ গান গাচ্ছিল একদল কৃষক।
কৃষক সবুরুদ্দিন জানালেন, তিন বছর আগেও এ সময়ে গ্রামে কোনো কাজ থাকত না। তখন অর্ধাহার-অনাহারে কাটত সবার দিন। কাজের খোঁজে লোকজন পাড়ি জমাত ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোয়। এখন আর সেই দিন নেই। আগাম জাতের ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হওয়ায় গ্রামে কাজের অভাব নেই, মঙ্গাও নেই। তাঁর মতো একই কথা জানালেন ধান কাটায় ব্যস্ত জবান আলী, ফণীভূষণ ও হাজিরুদ্দি।
জমির মালিক হাজী জমির উদ্দিন জানালেন, প্রতিবছর ভাদ্রের শেষ দিকে এসে তাঁর ঘরে আর খাবার মতো চাল বা ধান থাকত না। তিনি জানতে পারেন, এখন আগাম জাতের ধান বের হয়েছে যা বুনলে ভাদ্র মাসের শেষের দিকে ধান কেটে ঘরে তোলা যায়। তারপর তিনি ওই ধান জমিতে বোনেন। তাঁর ভাষায় 'তেলেসমাতি কাম হইছে। ধানও হইছে খুব ভালো'। আগাম ধান পেয়ে জমির উদ্দিনের চোখেমুখে এখন আনন্দের ঝিলিক। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা গ্রাম। প্রতিবার মঙ্গার সময় এ গ্রামের কর্মহীন মানুষ চরম দুরবস্থায় থাকত। কিন্তু এবার সেখানে আগাম জাতের ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম চলছে। বাড়ির উঠোন ভরে যাচ্ছে আমন ধানে। বেলাকা বাজারের রুহুল ইসলাম আমিন জানান, তিনি এবার আড়াই একর জমিতে বিনা-৭ ও ব্রি-৩৩ জাতের ধান বুনেছিলেন। এক শ দিনের মধ্যে ধান ঘরে তুলছেন। রুহুল ইসলামের উঠোনে কথা হয় ক্ষেতমজুর আনিছুর মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আগে মঙ্গার ঠ্যালায় ঘর ছাড়ছিনু, এবার আগাম ধান কাটা শুরু হওয়ায় বাড়ির বগলোত কাম পাইছোং। আর কোনো মঙ্গা নাই।'
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. এম এ সাত্তার কালের কণ্ঠকে জানান, মঙ্গাপীড়িত উত্তরাঞ্চলের কথা চিন্তা করেই তাঁর প্রতিষ্ঠান বিনা-৭ জাতের ধান উদ্ভাবন করে। খরাসহিষ্ণু উচ্চফলনশীল এই জাতটির পাতা পোড়া, খোল ও কাণ্ড পচাসহ নানা রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেক বেশি। খুব কম সময়ের মধ্যে ধান ঘরে তোলা যায় বলে উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা ধীরে ধীরে এ ধানচাষের দিকে ঝুঁকছে। ধান কাটার পরপরই কৃষকরা একই জমিতে স্বল্পমেয়াদি শাকসবজি বা আলু আবাদ করতে পারেন। এরপর আবার রবি মৌসুমে আলু, রসুন, পেঁয়াজ ও সরিষাও আবাদ করা যেতে পারে।
খামারবাড়ী রংপুরের উপপরিচালক গোলাম সোবহানি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মঙ্গা ও খরাপ্রবণ রংপুর অঞ্চলের মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য যুগান্তকারী দুটি জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশেরই দুটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে বিনা-৭ ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট করেছে ব্রি-৩৩ জাতের ধান। আশ্বিন ও কার্তিক মাসে রংপুর বিভাগের আট জেলায় লাখো কৃষিশ্রমিকের হাতে কোনো কাজ থাকত না। এখন আর সে অবস্থা নেই। চিরচেনা সংকটময় সময় এখন তারা ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ পাচ্ছে।'
তিনি জানান, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ছয় শতাংশ বেশি জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। ফলনের মাত্রাও বেশ ভালো। এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক লাখ ৩০ হাজার টন ধান বেশি উৎপাদন হবে। এ অঞ্চলের চাহিদা পূরণের পরও সাত লাখ টন ধান উদ্বৃত্ত থাকবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এবার রংপুর বিভাগে আমন ধান বোনা হয়েছিল এক লাখ ২৩ হাজার ৬৩৪ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ব্রি-৩৩ জাতের আবাদ হয়েছে ২৯ হাজার ৬৫৯ হেক্টর জমিতে এবং বিনা-৭-এর আবাদ করা হয় ৮৩ হাজার ৯৪৪ হেক্টর জমিতে। এই জমি থেকে তিন লাখ ৩৬ হাজার টন ধান কৃষকের গোলায় উঠবে। এবার আগাম জাতের ধান বোনা হয়েছে মোট আবাদি জমির ৪০ শতাংশে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারী জেলাতেই আবাদ হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

No comments

Powered by Blogger.