অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ, কারখানা হচ্ছে কৃষিজমি আবাসিক এলাকায় by মো. মাহবুবুল আলম,
দরজা-জানালা, পিলারের রড, বৈদ্যুতিক তার, বাথরুমের পাইপ, ম্যানহোলের ঢাকনা, এমনকি দেয়ালের ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। দেখে মনে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো শহরের ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন।এটি টঙ্গী শিল্প এলাকার বন্ধ হয়ে যাওয়া এক কারখানার চিত্র। ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান পাইওনিয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। একসময় এ কারখানায় তৈরি মানসম্পন্ন ওষুধ বিদেশে রপ্তানি হতো। ১৮ বছর ধরে কারখানাটি বন্ধ। বিশিষ্ট রাজনীতিক প্রয়াত মিজানুর রহমান চৌধুরীর মালিকানাধীন এ কারখানা ঋণে জর্জরিত হয়ে এখন মৃতপ্রায়।এমনি দুরবস্থা শিল্পাঞ্চল টঙ্গীর অর্ধশতাধিক কারখানার।
মালিক, শ্রমিক, কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব কারখানা বন্ধের পেছনে মূল কারণগুলো হচ্ছে শ্রমিক-মালিক অসন্তোষ, চলতি মূলধনের অভাব, প্রশাসনিক ও ব্যাংকঋণের জটিলতা, সুষ্ঠু পুঁজি বিনিয়োগের অভাব, রাজনৈতিক চাপ, উৎপাদিত পণ্যের বাজার অর্জনে ব্যর্থতা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির দাপট।
ষাটের দশকের প্রথম দিকে টঙ্গীতে শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার পর নির্ধারিত শিল্প প্লটগুলোতে এখন পর্যন্ত অবকাঠামো পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে ওঠেনি। শিল্প আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় একদিকে বহু শিল্প প্লট খালি পড়ে আছে দীর্ঘদিন; অন্যদিকে নতুন করে গড়ে উঠছে আবাদি জমি ও আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, যাতে নেই কোনো পরিকল্পনার ছোঁয়া। ফলে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে আর অব্যবহৃত পড়ে থাকছে মূল্যবান শিল্প প্লট।
টঙ্গীর মুদাফা এলাকার কৃষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এক দশক আগেও টঙ্গীর বেশির ভাগ এলাকা ছিল কৃষিজমিতে পূর্ণ। সবুজ মাঠ ভরা ছিল ফসলে। এখন সাতাইশ, তিলারগাতি, মুদাফা, ভাদাম, পাগাড়, বাকরাল, আউচপাড়া, দত্তপাড়া, দেওড়া ও গাজীপুরা এলাকার রাস্তার দুই পাশসহ প্রায় সব ধানের জমিতে কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন পার্টি আসছে, চড়া দামে জমি কিনে বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে রাখছে। দুই পাশে কারখানা থাকলে মাঝের জমিতে ফসল ফলে না। তাই বাধ্য হয়ে লোকজন জমি বিক্রি করছে।
ঢাকা বিভাগীয় দলিল লেখক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মো. আলাছ আলী বলেন, টঙ্গীতে শিল্প প্লট খালি না পেয়ে দুই দশক ধরে এলাকার ধানের জমি কিনে কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়ও দেদার শিল্প-কারখানা করা হচ্ছে। উদ্যোক্তারা টঙ্গীর আবাদি জমি অনেক কম দামে কেনার সুযোগ পাচ্ছেন বলে এমনটি হচ্ছে। টঙ্গী এসআর অফিসে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে জমি বেচাকেনা হচ্ছে, তার একটি বড় অংশে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। আর কয়েক দিন পর আবাদি জমি বলে অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না।
জানা গেছে, টঙ্গীতে বিসিক, রাজউক ও ব্যক্তিগত জমিতে সব মিলিয়ে বর্তমানে শিল্প-কারখানার সংখ্যা ৭২২। এর মধ্যে অর্ধশতাধিকই বন্ধ। কোনোটিতে অবকাঠামো রয়েছে কিন্তু উৎপাদন নেই। আবার কোনো প্লটের চারপাশে দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। বেশ কিছু কারখানা রয়েছে যেখানে ১৫ থেকে ২০ বছর আগে ভবন তৈরি করা হয়েছিল, এখন তা ব্যবহার অযোগ্য।
টঙ্গী পৌরসভার কর নির্ধারক কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্প মিলে ৬০ থেকে ৬৫টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন মিল্লাত মেটানেঙ্ ইন্ডাস্ট্রিজ ২০ বছর ধরে কর দিচ্ছে না। কারখানাটি ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরের পর বন্ধ হয়ে যায়। সেই বকেয়া কর এখনো পরিশোধ করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠান হাই সন্স গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজসহ এমন বহু কারখানা রয়েছে, যেগুলো দীর্ঘদিন বন্ধের কারণে কর পরিশোধ করছে না।
সরেজমিনে বন্ধ কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, এগুলো সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। রাজউকের প্লট নম্বর ১৮২, ১৮৩, ১৮৪, ১৮৫ নিয়ে গঠিত তিস্তা টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ ১৯৭৮ সাল থেকে বন্ধ। আফসার আলী, গফুর মিয়া, মোস্তফা কামাল ও আবদুল মালেক কারখানার সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। কারখানার ভেতরে তাঁরা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সংসার পেতেছেন। খালি জমিতে পুঁইশাক, ঢ্যাঁড়স, চিচিঙ্গাসহ নানা সবজির বাগান করেছেন। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সমস্যা থাকায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আওলাদ হোসেন নামের এক কর্মকর্তাকে এখানে নিয়োগ করেছে। পাঁচ বছর ধরে তিনি গেটের কাছে চেয়ারে বসে দায়িত্ব পালন করছেন। গ্যাস-বিদ্যুৎ নেই। সঙ্গে আছেন ব্যাংকের পিয়ন মিন্টু গাজী। গাছের শুকনো পাতা, ডালপালা দিয়ে চলে রান্নাবান্না।
১৯৯১ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে কমনওয়েলথ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। নিরাপত্তাকর্মী রুহুল আমিন জানান, আটজন পালা করে এ কারখানা পাহারা দেন। কারখানাটি যখন চালু ছিল, তখন তিনি ছিলেন প্যাকিং বিভাগের শ্রমিক। ক্রমেই লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। সিগারেট, জুস, জেলি, চিপস, প্লাস্টিক সামগ্রী ও সুতা তৈরি হতো এর ছয়টি ইউনিটে। মালিক খান মোহাম্মদ ইকবাল কখনো এখানে আসেন না। কারখানার সব মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। চুরি হয়ে গেছে অনেক যন্ত্রপাতি। পাঁচ মাস ধরে নিরাপত্তাকর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না। কয়েক মাস পরপর হেড অফিস থেকে বেতন দেওয়া হয়। কারখানার খালি জমিতে কলা, পেঁপে ও বেগুন চাষ করা হয়েছে। পেঁপে আর বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে তিন বেলা চলে নিরাপত্তাকর্মীদের।
রাজউকের ১৮০ নম্বর প্লটে রহমানিয়া অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি। চার দেয়ালের ভেতরে ছোট্ট একটি ঘর। আঙ্গিনাজুড়ে ছানাপোনা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে মুরগির দল। রোকেয়া বেগম স্বামী মনির হোসেনকে নিয়ে এখানে সংসার পেতেছেন অনেক দিন হলো। ছেলে রাকিব চতুর্থ শ্রেণীতে ও মেয়ে জান্নাতুল দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। পেয়ারা, আম, কাঁঠালগাছে ঘেরা বাড়ির আশপাশে নানা রকম সবজির চাষ করা হয়েছে। কারখানা নয়, মনে হবে গ্রামের বাড়ি। বাইরে থেকে গেটে দুটি তালা। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। রোকেয়া বলেন, তাঁরা চার হাজার টাকা বেতনে এ কারখানা পাহারা দেন। সংসারের খরচ বেড়ে গেছে; কিন্তু তাতে কী? বেশ তো আছেন।
বিসিক শিল্পাঞ্চলে ১৪টি প্লট নিয়ে গঠিত সবচেয়ে বড় শিল্প ইউনিট মডার্ন ব্রেড অ্যান্ড রোলস ফ্যাক্টরি। ক্রমেই লোকসানের পর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন নিয়ন্ত্রিত এ কারখানা ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরও এক যুগ হলো কারখানা চালু হয়নি। সুদৃশ্য ভবন, মেশিন, আসবাব, যানবাহন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম_সবই বিকল হয়ে গেছে। পুরো কারখানাকে যেন গ্রাস করে ফেলেছে আগাছা। ভেতরে অন্ধকার, ভুতুড়ে পরিবেশ। ঢাকা স্টিল মিলসের সাবেক ফোরম্যান নূরুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত এই বিশাল কারখানা ১৯৯২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ভেতর থেকে যন্ত্রাংশ, ধাতব সামগ্রী চুরি হয়ে যাচ্ছে। কিছু অংশ বেদখলও হয়ে গেছে।
এভাবে বিসিক শিল্পাঞ্চলের তাজ টিউবস, এবি বিস্কুট, আজাদ বিস্কুট, ওভারসিস পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজ; রাজউক শিল্পাঞ্চলের সোনালী টোবাকো, ইপসি শু কম্পানি, আশরাফ টেঙ্টাইল, হাইসন্স গ্লাস, মিল্লাত মেটালেঙ্ ইন্ডাস্ট্রিজসহ বহু কারখানা প্রায় ১৫ বছর ধরে উৎপাদনহীন।
টঙ্গীর বিসিক শিল্প মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বন্ধ কারখানা সম্পর্কে বলেন, কোনো কোনো মালিকের উদাসীনতা মূলত কারখানা বন্ধের কারণ। কেউ আবার ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তা ঠিকমতো পরিশোধ না করতে পেরে জটিল অবস্থায় পড়েছেন। কোনো কোনো শিল্প মালিক পণ্য উৎপাদন করে তা বাজারজাত করতে গিয়ে লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। হয়তো এভাবেই তাঁরা কারখানা চালু রাখতে পারছেন না।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট, টেঙ্টাইল অ্যান্ড লেদার ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের বলেন, টঙ্গীর বেশির ভাগ বন্ধ কারখানার পেছনে রয়েছে শ্রমিক-মালিক অসন্তোষ ও সুষ্ঠু পুঁজি বিনিয়োগের অভাব। একজন কারখানা মালিক যদি তাঁর প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের প্রতি ঠিকমতো নজর রাখেন, তা হলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যদি কিছু কর্মকর্তার প্রতি অতি-বিশ্বস্ত হয়ে দূরে সরে যান শ্রমিকদের কাছ থেকে, তবেই সমস্যা দেখা দেয়। মালিকরা যদি সত্যি পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহী হন, তা হলে কারখানা বন্ধ হওয়ার কথা নয়।
টঙ্গী শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো কারখানা যদি বরাদ্দের দুই বছরের মধ্যে উৎপাদনে যেতে ব্যর্থ হয়, তা হলে তার বরাদ্দ বাতিলের বিধান রয়েছে। অন্য উদ্যোক্তাকে তা আবার বরাদ্দ দেওয়া হবে।
'বহু শিল্প-কারখানা যুগ যুগ ধরে বন্ধ রয়েছে; কিন্তু সেগুলোর বরাদ্দ বাতিল করে নতুনভাবে কেন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না' জানতে চাইলে আবুল বাশার বলেন, 'ব্যাংকঋণের জটিলতা ও মামলার কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে কারখানা সচল থাকে।'
ষাটের দশকের প্রথম দিকে টঙ্গীতে শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার পর নির্ধারিত শিল্প প্লটগুলোতে এখন পর্যন্ত অবকাঠামো পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে ওঠেনি। শিল্প আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় একদিকে বহু শিল্প প্লট খালি পড়ে আছে দীর্ঘদিন; অন্যদিকে নতুন করে গড়ে উঠছে আবাদি জমি ও আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, যাতে নেই কোনো পরিকল্পনার ছোঁয়া। ফলে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে আর অব্যবহৃত পড়ে থাকছে মূল্যবান শিল্প প্লট।
টঙ্গীর মুদাফা এলাকার কৃষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এক দশক আগেও টঙ্গীর বেশির ভাগ এলাকা ছিল কৃষিজমিতে পূর্ণ। সবুজ মাঠ ভরা ছিল ফসলে। এখন সাতাইশ, তিলারগাতি, মুদাফা, ভাদাম, পাগাড়, বাকরাল, আউচপাড়া, দত্তপাড়া, দেওড়া ও গাজীপুরা এলাকার রাস্তার দুই পাশসহ প্রায় সব ধানের জমিতে কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন পার্টি আসছে, চড়া দামে জমি কিনে বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে রাখছে। দুই পাশে কারখানা থাকলে মাঝের জমিতে ফসল ফলে না। তাই বাধ্য হয়ে লোকজন জমি বিক্রি করছে।
ঢাকা বিভাগীয় দলিল লেখক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মো. আলাছ আলী বলেন, টঙ্গীতে শিল্প প্লট খালি না পেয়ে দুই দশক ধরে এলাকার ধানের জমি কিনে কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়ও দেদার শিল্প-কারখানা করা হচ্ছে। উদ্যোক্তারা টঙ্গীর আবাদি জমি অনেক কম দামে কেনার সুযোগ পাচ্ছেন বলে এমনটি হচ্ছে। টঙ্গী এসআর অফিসে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে জমি বেচাকেনা হচ্ছে, তার একটি বড় অংশে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। আর কয়েক দিন পর আবাদি জমি বলে অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না।
জানা গেছে, টঙ্গীতে বিসিক, রাজউক ও ব্যক্তিগত জমিতে সব মিলিয়ে বর্তমানে শিল্প-কারখানার সংখ্যা ৭২২। এর মধ্যে অর্ধশতাধিকই বন্ধ। কোনোটিতে অবকাঠামো রয়েছে কিন্তু উৎপাদন নেই। আবার কোনো প্লটের চারপাশে দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। বেশ কিছু কারখানা রয়েছে যেখানে ১৫ থেকে ২০ বছর আগে ভবন তৈরি করা হয়েছিল, এখন তা ব্যবহার অযোগ্য।
টঙ্গী পৌরসভার কর নির্ধারক কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্প মিলে ৬০ থেকে ৬৫টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন মিল্লাত মেটানেঙ্ ইন্ডাস্ট্রিজ ২০ বছর ধরে কর দিচ্ছে না। কারখানাটি ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরের পর বন্ধ হয়ে যায়। সেই বকেয়া কর এখনো পরিশোধ করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠান হাই সন্স গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজসহ এমন বহু কারখানা রয়েছে, যেগুলো দীর্ঘদিন বন্ধের কারণে কর পরিশোধ করছে না।
সরেজমিনে বন্ধ কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, এগুলো সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। রাজউকের প্লট নম্বর ১৮২, ১৮৩, ১৮৪, ১৮৫ নিয়ে গঠিত তিস্তা টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ ১৯৭৮ সাল থেকে বন্ধ। আফসার আলী, গফুর মিয়া, মোস্তফা কামাল ও আবদুল মালেক কারখানার সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। কারখানার ভেতরে তাঁরা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সংসার পেতেছেন। খালি জমিতে পুঁইশাক, ঢ্যাঁড়স, চিচিঙ্গাসহ নানা সবজির বাগান করেছেন। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সমস্যা থাকায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আওলাদ হোসেন নামের এক কর্মকর্তাকে এখানে নিয়োগ করেছে। পাঁচ বছর ধরে তিনি গেটের কাছে চেয়ারে বসে দায়িত্ব পালন করছেন। গ্যাস-বিদ্যুৎ নেই। সঙ্গে আছেন ব্যাংকের পিয়ন মিন্টু গাজী। গাছের শুকনো পাতা, ডালপালা দিয়ে চলে রান্নাবান্না।
১৯৯১ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে কমনওয়েলথ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। নিরাপত্তাকর্মী রুহুল আমিন জানান, আটজন পালা করে এ কারখানা পাহারা দেন। কারখানাটি যখন চালু ছিল, তখন তিনি ছিলেন প্যাকিং বিভাগের শ্রমিক। ক্রমেই লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। সিগারেট, জুস, জেলি, চিপস, প্লাস্টিক সামগ্রী ও সুতা তৈরি হতো এর ছয়টি ইউনিটে। মালিক খান মোহাম্মদ ইকবাল কখনো এখানে আসেন না। কারখানার সব মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। চুরি হয়ে গেছে অনেক যন্ত্রপাতি। পাঁচ মাস ধরে নিরাপত্তাকর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না। কয়েক মাস পরপর হেড অফিস থেকে বেতন দেওয়া হয়। কারখানার খালি জমিতে কলা, পেঁপে ও বেগুন চাষ করা হয়েছে। পেঁপে আর বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে তিন বেলা চলে নিরাপত্তাকর্মীদের।
রাজউকের ১৮০ নম্বর প্লটে রহমানিয়া অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি। চার দেয়ালের ভেতরে ছোট্ট একটি ঘর। আঙ্গিনাজুড়ে ছানাপোনা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে মুরগির দল। রোকেয়া বেগম স্বামী মনির হোসেনকে নিয়ে এখানে সংসার পেতেছেন অনেক দিন হলো। ছেলে রাকিব চতুর্থ শ্রেণীতে ও মেয়ে জান্নাতুল দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। পেয়ারা, আম, কাঁঠালগাছে ঘেরা বাড়ির আশপাশে নানা রকম সবজির চাষ করা হয়েছে। কারখানা নয়, মনে হবে গ্রামের বাড়ি। বাইরে থেকে গেটে দুটি তালা। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। রোকেয়া বলেন, তাঁরা চার হাজার টাকা বেতনে এ কারখানা পাহারা দেন। সংসারের খরচ বেড়ে গেছে; কিন্তু তাতে কী? বেশ তো আছেন।
বিসিক শিল্পাঞ্চলে ১৪টি প্লট নিয়ে গঠিত সবচেয়ে বড় শিল্প ইউনিট মডার্ন ব্রেড অ্যান্ড রোলস ফ্যাক্টরি। ক্রমেই লোকসানের পর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন নিয়ন্ত্রিত এ কারখানা ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরও এক যুগ হলো কারখানা চালু হয়নি। সুদৃশ্য ভবন, মেশিন, আসবাব, যানবাহন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম_সবই বিকল হয়ে গেছে। পুরো কারখানাকে যেন গ্রাস করে ফেলেছে আগাছা। ভেতরে অন্ধকার, ভুতুড়ে পরিবেশ। ঢাকা স্টিল মিলসের সাবেক ফোরম্যান নূরুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত এই বিশাল কারখানা ১৯৯২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ভেতর থেকে যন্ত্রাংশ, ধাতব সামগ্রী চুরি হয়ে যাচ্ছে। কিছু অংশ বেদখলও হয়ে গেছে।
এভাবে বিসিক শিল্পাঞ্চলের তাজ টিউবস, এবি বিস্কুট, আজাদ বিস্কুট, ওভারসিস পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজ; রাজউক শিল্পাঞ্চলের সোনালী টোবাকো, ইপসি শু কম্পানি, আশরাফ টেঙ্টাইল, হাইসন্স গ্লাস, মিল্লাত মেটালেঙ্ ইন্ডাস্ট্রিজসহ বহু কারখানা প্রায় ১৫ বছর ধরে উৎপাদনহীন।
টঙ্গীর বিসিক শিল্প মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বন্ধ কারখানা সম্পর্কে বলেন, কোনো কোনো মালিকের উদাসীনতা মূলত কারখানা বন্ধের কারণ। কেউ আবার ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তা ঠিকমতো পরিশোধ না করতে পেরে জটিল অবস্থায় পড়েছেন। কোনো কোনো শিল্প মালিক পণ্য উৎপাদন করে তা বাজারজাত করতে গিয়ে লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। হয়তো এভাবেই তাঁরা কারখানা চালু রাখতে পারছেন না।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট, টেঙ্টাইল অ্যান্ড লেদার ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের বলেন, টঙ্গীর বেশির ভাগ বন্ধ কারখানার পেছনে রয়েছে শ্রমিক-মালিক অসন্তোষ ও সুষ্ঠু পুঁজি বিনিয়োগের অভাব। একজন কারখানা মালিক যদি তাঁর প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের প্রতি ঠিকমতো নজর রাখেন, তা হলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যদি কিছু কর্মকর্তার প্রতি অতি-বিশ্বস্ত হয়ে দূরে সরে যান শ্রমিকদের কাছ থেকে, তবেই সমস্যা দেখা দেয়। মালিকরা যদি সত্যি পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহী হন, তা হলে কারখানা বন্ধ হওয়ার কথা নয়।
টঙ্গী শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো কারখানা যদি বরাদ্দের দুই বছরের মধ্যে উৎপাদনে যেতে ব্যর্থ হয়, তা হলে তার বরাদ্দ বাতিলের বিধান রয়েছে। অন্য উদ্যোক্তাকে তা আবার বরাদ্দ দেওয়া হবে।
'বহু শিল্প-কারখানা যুগ যুগ ধরে বন্ধ রয়েছে; কিন্তু সেগুলোর বরাদ্দ বাতিল করে নতুনভাবে কেন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না' জানতে চাইলে আবুল বাশার বলেন, 'ব্যাংকঋণের জটিলতা ও মামলার কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে কারখানা সচল থাকে।'
No comments