বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী: কমছে নাকি বাড়ছে? by তাফসীর বাবু
ঢাকায় হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব |
গত ১৭ ই জুলাই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু
অধিকার আন্দোলনের একজন নেত্রী প্রিয়া সাহা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে
সেদেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন
বিষয়ে যেসব বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তা নিয়ে বাংলাদেশে এখনো
আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
মার্কিন
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ঐদিন হোয়াইট হাউসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত
থেকে আসা ২৭ জন ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তির সাথে কথা বলেন
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এরা সবাই গত ১৬ থেকে ১৮ই জুলাই পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে আয়োজনে অনুষ্ঠিত একটি ইভেন্টে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন - যার নাম ছিল 'সেকেন্ড মিনিস্টারিয়াল টু এ্যাডভান্স রিলিজিয়াস ফ্রিডম'।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এতে পাঁচ জন বাংলাদেশী এবং দু'জন রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীর একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় - যার একজন ছিলেন প্রিয়া সাহা।
এরা সবাই গত ১৬ থেকে ১৮ই জুলাই পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে আয়োজনে অনুষ্ঠিত একটি ইভেন্টে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন - যার নাম ছিল 'সেকেন্ড মিনিস্টারিয়াল টু এ্যাডভান্স রিলিজিয়াস ফ্রিডম'।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এতে পাঁচ জন বাংলাদেশী এবং দু'জন রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীর একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় - যার একজন ছিলেন প্রিয়া সাহা।
বিশেষ করে প্রিয়া সাহা ৩ কোটি ৭০ লাখ
সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিখোঁজের যে তথ্য দিয়েছেন তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন
মন্ত্রী, রাজনীতিক এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যেও
নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যাগত চিত্রটা আসলে কেমন? আর প্রিয়া সাহার বক্তব্য কতটা বাস্তবসম্মত?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে নমুনা এলাকা বাড়ানোর কারণে হিন্দু জনগোষ্ঠির সংখ্যা বেড়েছে। |
ব্রিটিশ
আমলের পূর্ববঙ্গ, পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকিস্তান আর বর্তমান বাংলাদেশে
বিভিন্ন সময়ে জনসংখ্যার একটা হিসাব পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে হওয়া
আদমশুমারিতে।
এসব তথ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোতে রক্ষিত আছে।
সেখানে
আদমশুমারির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ৪৭ এর ভারত ভাগের পর থেকে এ পর্যন্ত
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আর এখনকার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের
জনসংখ্যা কখনোই দেড় কোটি ছাড়ায়নি।
১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিলো ৯৭ লাখ ৬ হাজার।
১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে এ সংখ্যা ৯৯ লাখ ৫০ হাজার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে এ সংখ্যা হয় ১ কোটি চার লাখ ৩৯ হাজার।
আর সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এই সংখ্যা ১ কোটি ৩৮ লাখ।
অর্থাৎ এই ভূখন্ডে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কখনোই ৩ কোটি ৭০ লাখ বা এর অর্ধেকও ছিলো না।
নিখোঁজ নিয়ে প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যা
ডোনাল্ড
ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহা যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, রোববার রাতে ইউটিউবে
আপলোড করা এক ভিডিওতে অবশ্য সে বিষয়ে নিজের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন প্রিয়া
সাহা।
তাতে ৩ কোটি ৭০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিখোঁজ হওয়ার পরিসংখ্যানের ব্যাখ্যা দেন তিনি।
তিনি
বলেন, "২০০১ সালের পরিসংখ্যানে সংখ্যালঘুদের উপর একটা চ্যাপ্টার রয়েছে।
সেনসাস (আদমশুমারি) অনুসারে দেশভাগের সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিলো মোট জনসংখ্যার ২৯.৭ শতাংশ। এখন তা কমে ৯.৭
শতাংশ।"
আনুপাতিক হারে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কমেছে। |
প্রিয়া সাহা বলছেন, "সংখ্যালঘুদের শতকরা ভাগ যদি এখনো একই
রকম থাকতো তাহলে বর্তমানে তাদের সংখ্যা ৩ কোটি ৭০ লাখের বেশি হতো। সেটাই
আমি বলতে চেয়েছি।"
তাহলে নিখোঁজ মানুষগুলো কোথায় গেছে? এমন প্রশ্নের অবশ্য সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর দেননি প্রিয়া সাহা।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কি কমেছে?
আদমশুমারিতে অবশ্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
ভারত-ভাগের পর ১৯৫১ সালে ৯৭ লাখ ৬ হাজার থেকে ২০১১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৮ লাখে।
কিন্তু মোট জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আনুপাতিক হার অবশ্য কমেছে।
তবে এই কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান শুধু পাকিস্তান আমলে কিংবা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরই যে দেখা যাচ্ছে তেমন নয়।
বরং ব্রিটিশ আমলেও এই অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের আনুপাতিক হার কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
সেসময় শুমারিতে অবশ্য মূলত: হিন্দুদের সংখ্যাই দেয়া হয়েছে।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের পরিসংখ্যান
১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সেসময় পূর্ব বাংলায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার ছিলো ৩১ শতাংশ।
১৯৪১ সালে ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২০ বছরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার কমেছে ৩ শতাংশ।
তবে এরপরই হিন্দু জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার দ্রুত গতিতে আরো কমতে থাকে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর আকার বেড়েছে। |
১৯৪১ থেকে ১৯৭৪ এই ৩৩ বছরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার কমে যায় প্রায় ১৫ শতাংশ।
১৯৪৭
এর ভারত-ভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ বিভিন্ন কারণে সেসময় অবশ্য পূর্ব
বাংলা থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনেকেই ভারতে চলে গিয়েছিলেন।
একইভাবে
ভারত থেকেও অনেক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন। আবার বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও অনেক হিন্দু দেশান্তরি হয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পরের চিত্র
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোট জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কমে যাওয়ার হারে আবারো ধীরগতি দেখা যায়।
১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারিতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ছিলো ১৪.৬ শতাংশ।
২০১১ সালে সেটি কমে আসে ৯.৬ শতাংশে।
অর্থাৎ বাংলাদেশ আমলে ৩৭ বছরে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার কমেছে ৫ শতাংশ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সামনে অভিযোগ তুলছেন প্রিয়া সাহা, যে ভিডিওটি বাংলাদেশে ভাইরাল হয়েছে |
আদমশুমারিতে অবশ্য সবসময়ই মুসলিম জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা এবং আনুপাতিক হার দুটোই বেড়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ আমলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ৫ শতাংশ কমে যাওয়া কতটা অস্বাভাবিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারপার্সন মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম অবশ্য একে অস্বাভাবিক মনে করেন না।
তিনি বলছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হার কমলেও আকার কিন্তু কমছে না, বরং বাড়ছে।
কিন্তু
আনুপাতিক হার কেন কমছে এমন প্রশ্নে তিনি বলছেন, "সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর
সঙ্গে যদি মুসলিম সম্প্রদায়ের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে মুসলিম
সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার কিংবা সন্তান বেশি নেবার প্রবণতা বেশি। এটা
বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক গবেষণাতেও দেখা গেছে যে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার
বেশি। বাংলাদেশেও আমরা ছোট আকারে বিভিন্ন গবেষণায় এটা দেখেছি।"
তিনি
বলছেন, একদিকে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি। অন্যদিকে তাদের মধ্যে জন্মহারও
বেশি। ফলে তাদের আকার যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি মোট জনসংখ্যায়
আনুপাতিক হারেও এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আকার
বাড়লেও আনুপাতিক হার কমছে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা। |
No comments