বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে বাংলাদেশ by এম এ খালেক
চলতি
অর্থ বছরে (২০১৯-২০) বিশ্বের অধিকাংশ দেশের প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের
তুলনায় হ্রাস পেলেও বাংলাদেশ বিস্ময়করভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পূর্বাভাস দিচ্ছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি
সঠিক এবং গতিশীল ধারায় প্রবহমান রয়েছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে চলতি
অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের মর্যাদা
লাভ করবে। বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অতি
সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকের সম্পূরক প্রতিবেদনে
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভূয়সী প্রশংসা করেছে। এডিবি বলেছে,
সদ্যসমাপ্ত অর্থ বছরে (২০১৮-১৯) প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জিডিপি
প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এই উচ্চ মাত্রায় জিডিপি
প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে মূলত শিল্প ও সেবা খাতই মূল ভূমিকা পালন করেছে। এই
দুটি খাতের গতিশীলতার কারণেই সার্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এতটা বৃদ্ধি
পেয়েছে। আগের বছর বাংলাদেশ ৭ দশমিক ৯ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন
করেছিল। সদ্যবিদায়ি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৩
শতাংশ অতিক্রম করে যাবে বলে সরকারিভাবে সাময়িক প্রাক্কলন করা হয়েছে। অনেকেই
মনে করছেন, চূড়ান্ত হিসাবে গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার আরো বৃদ্ধি পেতে
পারে। উল্লেখ্য, উন্নয়ন সহযোগীরা সাধারণত অত্যন্ত রক্ষণশীলভাবে জিডিপি
প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করে থাকে। ফলে সরকারি হিসাবের সঙ্গে তাদের দেয়া
পরিসংখ্যানের প্রায় ১ শতাংশ ব্যবধান থাকে। এডিবি প্রথমবারের মতো ৮ শতাংশের
বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করল।
বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান দেশ চীনের অর্থনৈতিক অবস্থাও এই মুহূর্তে খুব একটা ভালো নয়। বছরের শুরুতেই চীনের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। চলতি পঞ্জিকা বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগের প্রান্তিকে চেয়ে দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। গত ২৯ বছরে এটাই চীনের সর্বনিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি। কয়েক দশক ধরে চীন উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছিল। তারা মুক্ত বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করলেও মার্কিনি ধাঁচের মুক্তবাজার অর্থনীতি তারা গ্রহণ করেনি। বরং তারা মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে নিজেদের দেশের উপযোগী করে বাস্তবায়ন করেছে। অনেকের মনেই বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে এটা ভেবে যে, চীনের মতো জনবহুল একটি দেশ কীভাবে এত উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, চীনের এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে তাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিশেষ ভাবে কাজ করেছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা সঠিকভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারা। একটি দেশের যখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সূচনা হয় তখন সেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ বছর স্থায়ী হয়। বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপান বেশ কয়েক দশক আগে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা অতিক্রম করে এসেছে। জাপানে এখন বৃদ্ধ বা প্রবীণ লোকের সংখ্যা বেশি। তারা ক্রমশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর এক আদেশে চীনকে দেয়া শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা বাতিল করেন। চীনা পণ্যের ওপর বর্ধিত হারে শুল্কারোপ করা হয়। পালটা ব্যবস্থা হিসেবে চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্কারোপ করে। ফলে দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়। ইতিমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চীনা অর্থনীতির ওপর। চীনের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে এ বাণিজ্যযুদ্ধ কাজ করছে বলে অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন। যেসব মার্কিন কোম্পানি চীনে বিনিয়োগ করেছিল তারা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন, চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনের প্রবৃদ্ধির এ শ্লথ গতি আগামীতেও অব্যাহত থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এটাই চেয়েছিল। চীন বাণিজ্য যুদ্ধে চাপে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করুক—এটাই যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে শুধু যে এই দুটি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে এই বাণিজ্য যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। সেটাই হচ্ছে মূল আশঙ্কার কারণ। উল্লেখ্য, ১৯২৯-১৯৩৩ সময়কালে সৃষ্ট বাণিজ্যযুদ্ধের সময় ২০ হাজার পণ্যের ওপর ব্যাপক মাত্রায় শুল্কারোপ করা হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করে চলেছে। বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক দেশের জন্যই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বয়স এখন ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে।
জনসংখ্যা এমনই এক অর্থনৈতিক উপকরণ যা একই সঙ্গে ‘সম্পদ’ এবং ‘দায়’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ করে তোলা যায় তাহলে জনসংখ্যা হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কারণ যে কোনো উন্নয়ন কাজের জন্যই দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত লোকবল প্রয়োজন। আবার জনসংখ্যা যদি অপ্রশিক্ষিত হয় এবং অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠে, তবে তা হবে সবচেয়ে বড় একটি রাষ্ট্রীয় দায়। বাংলাদেশের জন্য সংখ্যাকে এখনো আমরা জনসম্পদে পরিণত করতে পারিনি। বাংলাদেশের ১ কোটিরও বেশি শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থান করছে। তারা বছরে প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রেরণ করছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স প্রেরণ করেছে। এটা এ যাবত্কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ যদি প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ পেশাজীবীদের বিদেশে প্রেরণ করতে পারত তাহলে বিদ্যমান প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমেই কয়েক গুণ বেশি রেমিট্যান্স আহরণ করা যেত। প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রতি বছর যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করছে তার একটি বড় অংশই আবার বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি এক্সপার্টদের বেতন-ভাতা পরিশোধে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলকারখানায় যেসব বিদেশি এক্সাপার্ট কাজ করছেন তাদের পেছনে বছরে প্রায় ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। আমরা যদি দক্ষ জনশক্তির জোগান দিতে পারতাম তাহলে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশেই থেকে যেত। চলতি অর্থবছর থেকে কারিগরি শিক্ষার ওপর ব্যাপকভাবে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এ ছাড়া আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকার সমস্যা দূরীকরণের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেসব তরুণ-তরুণী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চান তাদের স্টার্ট আপের জন্য ১০০ কেটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার জন্য বাজেটে গবেষণার জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চাকরিজীবী নয়, উদ্যোক্তা সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন। কয়েক বছর ধরে কৃষি ও পল্লি ঋণ নামে এক বিশেষ ধরনের ঋণকার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে—পল্লি এলাকায় কৃষিনির্ভর ছোটো ছোটো শিল্প গড়ে তোলা। কিন্তু পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এই বিশেষ ঋণ উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে তেমন একটা অবদান রাখতে পারছে না। অনেকেই এ ঋণ নিয়ে তা অন্য খাতে প্রবাহিত করছেন।
বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে সত্য, কিন্তু এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা মানসম্পন্ন, টেকসই এবং উত্পাদনশীল খাত থেকে আসছে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের রেটিং অনুযায়ী, বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে আগামী ১২ বছরে আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় দ্বিগুণ করতে হবে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ১ হাজার ৭৫০ মার্কিন ডলার। উচ্চ আয়ের দেশ হতে হলে এই মাথাপিছু জাতীয় আয়কে অন্তত পক্ষে ৩ হাজার ৯৯৬ মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে হবে। একই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১০ থেকে ১১ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু শুধু রেকর্ড মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেই চলবে না। সেই প্রবৃদ্ধির সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবাই পাচ্ছে কি না তা ভেবে দেখতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির অভাব এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টিত না হওয়ায় দারিদ্র্য বিমোচনের হার কমছে।
>>>লেখক : অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান দেশ চীনের অর্থনৈতিক অবস্থাও এই মুহূর্তে খুব একটা ভালো নয়। বছরের শুরুতেই চীনের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। চলতি পঞ্জিকা বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগের প্রান্তিকে চেয়ে দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। গত ২৯ বছরে এটাই চীনের সর্বনিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি। কয়েক দশক ধরে চীন উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছিল। তারা মুক্ত বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করলেও মার্কিনি ধাঁচের মুক্তবাজার অর্থনীতি তারা গ্রহণ করেনি। বরং তারা মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে নিজেদের দেশের উপযোগী করে বাস্তবায়ন করেছে। অনেকের মনেই বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে এটা ভেবে যে, চীনের মতো জনবহুল একটি দেশ কীভাবে এত উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, চীনের এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে তাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিশেষ ভাবে কাজ করেছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা সঠিকভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারা। একটি দেশের যখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সূচনা হয় তখন সেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ বছর স্থায়ী হয়। বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপান বেশ কয়েক দশক আগে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা অতিক্রম করে এসেছে। জাপানে এখন বৃদ্ধ বা প্রবীণ লোকের সংখ্যা বেশি। তারা ক্রমশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর এক আদেশে চীনকে দেয়া শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা বাতিল করেন। চীনা পণ্যের ওপর বর্ধিত হারে শুল্কারোপ করা হয়। পালটা ব্যবস্থা হিসেবে চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্কারোপ করে। ফলে দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়। ইতিমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চীনা অর্থনীতির ওপর। চীনের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে এ বাণিজ্যযুদ্ধ কাজ করছে বলে অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন। যেসব মার্কিন কোম্পানি চীনে বিনিয়োগ করেছিল তারা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন, চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনের প্রবৃদ্ধির এ শ্লথ গতি আগামীতেও অব্যাহত থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এটাই চেয়েছিল। চীন বাণিজ্য যুদ্ধে চাপে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করুক—এটাই যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে শুধু যে এই দুটি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে এই বাণিজ্য যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। সেটাই হচ্ছে মূল আশঙ্কার কারণ। উল্লেখ্য, ১৯২৯-১৯৩৩ সময়কালে সৃষ্ট বাণিজ্যযুদ্ধের সময় ২০ হাজার পণ্যের ওপর ব্যাপক মাত্রায় শুল্কারোপ করা হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করে চলেছে। বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক দেশের জন্যই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বয়স এখন ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে।
জনসংখ্যা এমনই এক অর্থনৈতিক উপকরণ যা একই সঙ্গে ‘সম্পদ’ এবং ‘দায়’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ করে তোলা যায় তাহলে জনসংখ্যা হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কারণ যে কোনো উন্নয়ন কাজের জন্যই দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত লোকবল প্রয়োজন। আবার জনসংখ্যা যদি অপ্রশিক্ষিত হয় এবং অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠে, তবে তা হবে সবচেয়ে বড় একটি রাষ্ট্রীয় দায়। বাংলাদেশের জন্য সংখ্যাকে এখনো আমরা জনসম্পদে পরিণত করতে পারিনি। বাংলাদেশের ১ কোটিরও বেশি শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থান করছে। তারা বছরে প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রেরণ করছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স প্রেরণ করেছে। এটা এ যাবত্কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ যদি প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ পেশাজীবীদের বিদেশে প্রেরণ করতে পারত তাহলে বিদ্যমান প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমেই কয়েক গুণ বেশি রেমিট্যান্স আহরণ করা যেত। প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রতি বছর যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রেরণ করছে তার একটি বড় অংশই আবার বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি এক্সপার্টদের বেতন-ভাতা পরিশোধে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলকারখানায় যেসব বিদেশি এক্সাপার্ট কাজ করছেন তাদের পেছনে বছরে প্রায় ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। আমরা যদি দক্ষ জনশক্তির জোগান দিতে পারতাম তাহলে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশেই থেকে যেত। চলতি অর্থবছর থেকে কারিগরি শিক্ষার ওপর ব্যাপকভাবে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এ ছাড়া আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকার সমস্যা দূরীকরণের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেসব তরুণ-তরুণী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চান তাদের স্টার্ট আপের জন্য ১০০ কেটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার জন্য বাজেটে গবেষণার জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চাকরিজীবী নয়, উদ্যোক্তা সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন। কয়েক বছর ধরে কৃষি ও পল্লি ঋণ নামে এক বিশেষ ধরনের ঋণকার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে—পল্লি এলাকায় কৃষিনির্ভর ছোটো ছোটো শিল্প গড়ে তোলা। কিন্তু পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এই বিশেষ ঋণ উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে তেমন একটা অবদান রাখতে পারছে না। অনেকেই এ ঋণ নিয়ে তা অন্য খাতে প্রবাহিত করছেন।
বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে সত্য, কিন্তু এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা মানসম্পন্ন, টেকসই এবং উত্পাদনশীল খাত থেকে আসছে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের রেটিং অনুযায়ী, বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে আগামী ১২ বছরে আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় দ্বিগুণ করতে হবে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ১ হাজার ৭৫০ মার্কিন ডলার। উচ্চ আয়ের দেশ হতে হলে এই মাথাপিছু জাতীয় আয়কে অন্তত পক্ষে ৩ হাজার ৯৯৬ মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে হবে। একই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১০ থেকে ১১ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু শুধু রেকর্ড মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেই চলবে না। সেই প্রবৃদ্ধির সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবাই পাচ্ছে কি না তা ভেবে দেখতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির অভাব এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টিত না হওয়ায় দারিদ্র্য বিমোচনের হার কমছে।
>>>লেখক : অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
No comments