একটু বাঁচান, ফেরত আনেন by মানসুরা হোসাইন
মধ্যপ্রাচ্যের
দেশ ওমান থেকে কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন বলে জানালেন মধ্যবয়সী
এক নারী। তিনি অভিযোগ করেন, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ফিরে এসেছেন। তবে
তাঁর পরিচিত বেশ কয়েকজন নারী ফিরতে পারেননি। সেখানে তাঁরা চরম নির্যাতনের
শিকার হচ্ছেন। তিনি দেশে ফেরার সময় ওই নারীদের পরিবারের সদস্যদের ফোন নম্বর
ও ঠিকানা নিয়ে এসেছেন। এখন সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে স্বজনদের
জানাচ্ছেন সে কথা। তিনি প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে বললেন, ‘ওগো একটু বাঁচান,
ওগো ফেরত আনেন।’
গত ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার কথা হয় এ নারীর সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ওমান থেকে ফেরত আসা ঢাকার একটি মেয়ে। বয়স ২৩ বছর। মেয়েটি জানান, তাঁর লম্বা চুল ছিল। ঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় ওমানে মায়া নামের বাংলাদেশি এক নারী তাঁর চুল চুলগুলো বিশ্রীভাবে কেটে দিয়েছেন। হিজাব সরিয়ে দেখালেন মাথার মাঝখানের চুলগুলো কীভাবে খুবলে খুবলে কাটা হয়েছে।
মেয়েটি জানান, তিনি বেশ অসুস্থ। অসুস্থ শরীর নিয়েই আসেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। বমিপ্রবণতা হওয়ায় কথা বলার এক ফাঁকে উঠে বমি করে আসেন। জানালেন, গর্ভপাত করাতে গিয়ে তাঁর পেটে প্রায় স্থায়ী সমস্যা দেখা দিয়েছে। পেটে ব্যথা পান। এ অবস্থা নিয়েই দালালের খপ্পরে পড়ে ওমান গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে বিমানবন্দরে বমি করলে দালালদের হাতে মার খান। তারপর মালিকের বাসায় গিয়ে কাজ করতে না পারলে সেখানকার এক অফিসে নেওয়া হয়। অসুস্থতার কথা শুনে সেখানে আরেক দফা মার খান। সব মিলিয়ে তিনি বিধ্বস্ত।
এই দুই নারীর সঙ্গে এক ছেলেও প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন তাঁর মাকে ফিরিয়ে আনার আবেদন জানানোর জন্য। ছেলেটি মাকে আনার আবেদন জানিয়ে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাব) সহযোগিতা চেয়েছেন। সংগঠনটির সহায়তায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগে লিখিতভাবে অভিযোগও করেছেন এই ভুক্তভোগীরা। সংগঠনের পক্ষ থেকে ওমানে থাকা নারীদের ফেরত আনার আবেদন জানানো হয়েছে। তবে ঈদের ছুটির জন্য আপাতত সব কাজ স্থগিত আছে। ভুক্তভোগী এবং পরিবারের সদস্যরাও ভয়ে আছেন। তাঁরা যে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করছেন, সে খবর চলে যাচ্ছে ওমানে। এতে ওমানে থাকা ওই নারীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রাটা আরও বাড়ছে বলে শুনেছেন। তাই দ্রুত ওই নারীদের ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিলেন তাঁরা।
এই দুই নারীর অভিযোগ, তাঁদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজের কথা বলে ওমানে নেওয়া হলেও কাজ করতে হতো বিভিন্ন বাসায়। বাসায় কাজ করতে না পারলে বা যৌনকাজে রাজি না হলে অফিসে এনে লাইন করে দাঁড় করানো হতো। তারপর মালিকেরা গরুকে যেভাবে পছন্দ করে অনেকটা সেই রকম পদ্ধতিতে পছন্দ করতেন। এভাবে হাতবদল হতে হয় একাধিকবার।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাব বলছে, চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত সৌদি আরব, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য গিয়েছেন ৬৮ হাজার ৯৩৮ জন নারী শ্রমিক। জুলাই মাস পর্যন্ত ওমানে বিভিন্ন কাজের জন্য নারী শ্রমিক গিয়েছেন ৭ হাজার ২৫৩ জন।
ওমান থেকে ফেরত আসা নারীরা জানালেন, তাঁদের ওমানের মাসকাটে একটি অফিসে (লায়লা অফিস) রেখে বিভিন্ন মালিকের কাছে বিক্রি করা হতো। এই অফিসের মালিক ওমানের এক নারী। আর অফিসে ভারত, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন জায়গার নারীরা কাজ করেন এবং এই নারীরাই তাঁদের মারধর করতেন। খাবার দিতেন না।
ওমান ফেরত মধ্যবয়সী নারী জানালেন, তাঁর বয়স ৪৫ বছর হলেও পাসপোর্টে বয়স ৩৭ বছর দেখানো হয়েছে। বাড়ি শরীয়তপুরে। স্বামী মারা গেছেন। তাঁর এক ছেলে, দুই মেয়ে। এর আগে তিনি সৌদি আরবে ছিলেন তিন মাস। সেখানে যেতে কোনো টাকাপয়সা লাগেনি। মালিকের মানসিক সমস্যা থাকায় মালিকের স্ত্রী তাঁকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানালেন।
তিনি জানালেন, সমিতিতে টাকা জমিয়েছিলেন, সেখান থেকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ওমান গিয়েছিলেন। যাঁর মাধ্যমে যান, তাঁর নাম ইকবাল হোসেন। যাওয়ার পর মাত্র চার মাসের মাথায় ১ আগস্ট দেশে ফেরত এসেছেন। দেশে ফেরার জন্য দালালকে উল্টো ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তিনি দেশে ফিরে বিএমইটিতে অভিযোগ করেছেন। দেশে ফেরার সময় অন্যদের টেলিফোন নম্বর ও চিঠি নিয়ে এসেছেন। সেসব সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে স্বজনদের কাছে তথ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। বলছেন তাঁদের স্বজনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে।
কথা হয় ইকবাল হোসেন নামের ওই ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি ড্রিম হলিডে নামক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হয়ে কাজ করেন। নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর আগে মেডিকেল টেস্ট করানোসহ বিভিন্ন কাজ করেন তিনি। টেলিফোনে ইকবাল হোসেন দাবি করেন, ১০ থেকে ১২ জন নারী শ্রমিককে ওমান পাঠানো হলেও মাত্র দুজন ফেরত এসেছেন। আর ফেরত আসা নারী শ্রমিকেরা নির্যাতনের যে অভিযোগ করছেন, তা সত্য নয়। এই নারীদের প্রায় ১৬ হাজার টাকা বেতন দেওয়া কথা। কিন্তু তাঁরা এই বেতনে কাজ করতে রাজি হননি। এ ছাড়া দুজনের মধ্যে একজন বয়স্ক বলে কাজ করতে পারেননি, আর একজন হাত পুড়িয়ে ফেলেন বলে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এই নারীদের ওমান যেতে এক টাকাও লাগেনি বলে তিনি দাবি করেন।
ঢাকার মেয়েটি জানান, ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ওমান যান। দেশে থাকা অবস্থাতেই গর্ভপাতসংক্রান্ত জটিলতায় তাঁর পেটটি বেশ ফুলে যায়। পরে স্বামী তাঁকে ফেলে চলে যান। ওমানে ছিলেন মাত্র দুই মাস। এর আগে সৌদি আরবে গেলেও শারীরিক অসুস্থতায় কাজ করতে না পারায় ১৮ দিনের মাথায় দেশে ফেরত এসেছিলেন।
মাকে ওমান থেকে দেশে ফেরত আনার আবেদন জানানো ছেলেটি জানান, তাঁর মা যখন সৌদি আরবে যান, তখন মোশররফ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। এবারও এই মোশাররফ ও বাতেন নামের দুজনের মাধ্যমে গত ১৫ মে ওমান যান মা। মায়ের ওমান যাওয়া নিয়ে তাঁরা কিছু জানতেন না। তিনি জানান, সৌদি আরবে থাকার সময় মা ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। সেই টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা দালালকে দিয়ে ওমান গেছেন।
ছেলে অভিযোগ করেন, ওমানে রমজানের সময় তাঁর মাকে ইফতারের সময় শুধু একটি খেজুর আর গরম পানি খেতে দেওয়া হতো। বললেন, ‘আমি মায়ের একমাত্র ছেলে। ফোনে মা খিদার জ্বালায় যখন চিৎকার করে, তখন তো আর থাকতে পারি না। মাকে ফেরত আনার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে চাকরিটাও ছাড়তে হইছে।’ তিনি জানান, ওমানে তাঁর মা এবং আরেক নারী একসঙ্গে বাসা থেকে পালান। তবে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর পুলিশ আবার ওই অফিসে দিয়ে আসে। তারপর থেকে শুরু হয় আজাবের যন্ত্রণা। দালাল ও এজেন্টকে মাকে ফেরত পাঠানোর কথা বললে ৬০ হাজার টাকা দাবি করেছে।
ছেলেটির মুঠোফোনে ওমান থেকে কথা বলা মা ছাড়াও অন্যদের ভয়েস রেকর্ড আছে। তিনি বলেন, ‘ওইখান থেকে যে ভিডিও পাঠায় তাতে মা বলে, অভিযোগ তুলে নে, আমি ভালো আছি। আর আমার কাছে মা বলে অন্য কথা। মা জানিয়েছে, মোটা লাঠি হাতে নিয়ে “ভালো আছি” বলে এই ধরনের ভিডিও করতে বাধ্য করা হয়।’
ওমানের অফিসে বাংলাদেশি নারীদের দেখভাল করেন মায়া রানী। এই মায়া রানী মারধর করেন বলে ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের অভিযোগ। তবে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে মায়া নারী শ্রমিকদের সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। জানালেন, তিনি ওমানে সাত বছর ধরে এক বাসায় কাজ করেন। কাজের পাশাপাশি বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের কথা শোনাসহ বিভিন্ন সহায়তার জন্য অফিসে তাঁকে নিয়ে আসা হয়।
মায়া উল্টো নারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ করে বলেন, ‘একেকজন ২০টি পর্যন্ত বাসা পাল্টান। আপনিই বলেন, একটা বাসাও ভালো হইবো না। অনেকে টাকাপয়সা চুরি করে। বাসা থেকে পালায়। তখন রাগ হয়ে অফিসের অন্যরা চড়–থাপ্পড় দেয়। অপরাধ করলে তো দিতেই হইবো।’
ফেরত আসা নারী শ্রমিকেরা জানালেন, এই মায়া রানীর ভাই হলেন বাতেন। তিনি দেশ থেকে ফুসলিয়ে নারী শ্রমিকদের ওমানে পাঠান। বাতেনের ভিজিটিং কার্ডে চৈতি বুটিকস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সি লেখা। ঠিকানা লেখা নারায়ণগঞ্জের।
ওকাবের প্রশিক্ষক ও কাউন্সেলর আমেনা আক্তার প্রথম আলোকে জানালেন, ফেরত আসাদের মধ্যে এক নারী এর আগে সৌদি আরবে ছিলেন মাত্র তিন মাস। সেখান থেকে ফেরার পর ওকাবে আসেন। তখন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২২ হাজার টাকার মধ্যে তিনি কী কাজ করতে চান, তার পরিকল্পনা দিতে বলা হয়। তবে এই নারী বাড়ি ফিরে আর যোগাযোগ করেননি। তারপর ওমান চলে যান। সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরার পর আবার ওকাবে আসেন। তখন তাঁর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ওমানের ওই অফিসে এখনো ২০ থেকে ২৫ জন নারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই নারীর মাধ্যমে অন্যরা ওকাবে আসেন বিভিন্ন সহযোগিতার জন্য। একজন ওকাবের আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। আরেক জন মুমূর্ষু অবস্থায় ফিরেছিলেন, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করে বাড়ি পাঠানো হয়েছে।
আমেনা আক্তার বললেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে এবং ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে অভিযোগ করা হয়েছে। ফেরত আসা নারীরা আইনি সহায়তা চাইলে তা দেওয়া হবে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো নির্যাতনের শিকার অন্য নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনা।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বললেন, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই চুক্তিভঙ্গ করে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা ও নির্যাতন করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা না কমে বরং বাড়ছে। এই নারী শ্রমিকদের শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, চুল কেটে দেওয়া, খাবার না দেওয়া, বেতন না দেওয়াসহ যেভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে, তা আধুনিক দাসপ্রথার ও পাচারেরই নামান্তর। এই নারী শ্রমিকদের পাঠাচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি। আর এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দালাল, সাব-এজেন্ট। এরা সব সময় পার পেয়ে যাচ্ছে। এদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি কার্যকর করতে হবে।
বিএমইটির পরিচালক নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বললেন, সরকারিভাবে বর্তমানে বিদেশে কাজের জন্য নারীদের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ থেকে ৩৮ বছর। তাই ৪৫ বছর বয়স্ক বা অসুস্থ কোনো নারীর বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দালাল ধরে স্মার্টকার্ড জ্বাল করে বিমানবন্দরে টাকা দিয়ে এই নারীদের বিদেশ পাঠিয়ে দিচ্ছে একটি চক্র। এ ধরনের চক্রের সঙ্গে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে। ধরা পড়লে লাইসেন্স বাতিল করা হচ্ছে।
গত ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার কথা হয় এ নারীর সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ওমান থেকে ফেরত আসা ঢাকার একটি মেয়ে। বয়স ২৩ বছর। মেয়েটি জানান, তাঁর লম্বা চুল ছিল। ঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় ওমানে মায়া নামের বাংলাদেশি এক নারী তাঁর চুল চুলগুলো বিশ্রীভাবে কেটে দিয়েছেন। হিজাব সরিয়ে দেখালেন মাথার মাঝখানের চুলগুলো কীভাবে খুবলে খুবলে কাটা হয়েছে।
মেয়েটি জানান, তিনি বেশ অসুস্থ। অসুস্থ শরীর নিয়েই আসেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। বমিপ্রবণতা হওয়ায় কথা বলার এক ফাঁকে উঠে বমি করে আসেন। জানালেন, গর্ভপাত করাতে গিয়ে তাঁর পেটে প্রায় স্থায়ী সমস্যা দেখা দিয়েছে। পেটে ব্যথা পান। এ অবস্থা নিয়েই দালালের খপ্পরে পড়ে ওমান গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে বিমানবন্দরে বমি করলে দালালদের হাতে মার খান। তারপর মালিকের বাসায় গিয়ে কাজ করতে না পারলে সেখানকার এক অফিসে নেওয়া হয়। অসুস্থতার কথা শুনে সেখানে আরেক দফা মার খান। সব মিলিয়ে তিনি বিধ্বস্ত।
এই দুই নারীর সঙ্গে এক ছেলেও প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন তাঁর মাকে ফিরিয়ে আনার আবেদন জানানোর জন্য। ছেলেটি মাকে আনার আবেদন জানিয়ে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাব) সহযোগিতা চেয়েছেন। সংগঠনটির সহায়তায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগে লিখিতভাবে অভিযোগও করেছেন এই ভুক্তভোগীরা। সংগঠনের পক্ষ থেকে ওমানে থাকা নারীদের ফেরত আনার আবেদন জানানো হয়েছে। তবে ঈদের ছুটির জন্য আপাতত সব কাজ স্থগিত আছে। ভুক্তভোগী এবং পরিবারের সদস্যরাও ভয়ে আছেন। তাঁরা যে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করছেন, সে খবর চলে যাচ্ছে ওমানে। এতে ওমানে থাকা ওই নারীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রাটা আরও বাড়ছে বলে শুনেছেন। তাই দ্রুত ওই নারীদের ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিলেন তাঁরা।
এই দুই নারীর অভিযোগ, তাঁদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজের কথা বলে ওমানে নেওয়া হলেও কাজ করতে হতো বিভিন্ন বাসায়। বাসায় কাজ করতে না পারলে বা যৌনকাজে রাজি না হলে অফিসে এনে লাইন করে দাঁড় করানো হতো। তারপর মালিকেরা গরুকে যেভাবে পছন্দ করে অনেকটা সেই রকম পদ্ধতিতে পছন্দ করতেন। এভাবে হাতবদল হতে হয় একাধিকবার।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাব বলছে, চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত সৌদি আরব, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য গিয়েছেন ৬৮ হাজার ৯৩৮ জন নারী শ্রমিক। জুলাই মাস পর্যন্ত ওমানে বিভিন্ন কাজের জন্য নারী শ্রমিক গিয়েছেন ৭ হাজার ২৫৩ জন।
ওমান থেকে ফেরত আসা নারীরা জানালেন, তাঁদের ওমানের মাসকাটে একটি অফিসে (লায়লা অফিস) রেখে বিভিন্ন মালিকের কাছে বিক্রি করা হতো। এই অফিসের মালিক ওমানের এক নারী। আর অফিসে ভারত, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন জায়গার নারীরা কাজ করেন এবং এই নারীরাই তাঁদের মারধর করতেন। খাবার দিতেন না।
ওমান ফেরত মধ্যবয়সী নারী জানালেন, তাঁর বয়স ৪৫ বছর হলেও পাসপোর্টে বয়স ৩৭ বছর দেখানো হয়েছে। বাড়ি শরীয়তপুরে। স্বামী মারা গেছেন। তাঁর এক ছেলে, দুই মেয়ে। এর আগে তিনি সৌদি আরবে ছিলেন তিন মাস। সেখানে যেতে কোনো টাকাপয়সা লাগেনি। মালিকের মানসিক সমস্যা থাকায় মালিকের স্ত্রী তাঁকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানালেন।
তিনি জানালেন, সমিতিতে টাকা জমিয়েছিলেন, সেখান থেকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ওমান গিয়েছিলেন। যাঁর মাধ্যমে যান, তাঁর নাম ইকবাল হোসেন। যাওয়ার পর মাত্র চার মাসের মাথায় ১ আগস্ট দেশে ফেরত এসেছেন। দেশে ফেরার জন্য দালালকে উল্টো ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তিনি দেশে ফিরে বিএমইটিতে অভিযোগ করেছেন। দেশে ফেরার সময় অন্যদের টেলিফোন নম্বর ও চিঠি নিয়ে এসেছেন। সেসব সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে স্বজনদের কাছে তথ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। বলছেন তাঁদের স্বজনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে।
কথা হয় ইকবাল হোসেন নামের ওই ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি ড্রিম হলিডে নামক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হয়ে কাজ করেন। নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর আগে মেডিকেল টেস্ট করানোসহ বিভিন্ন কাজ করেন তিনি। টেলিফোনে ইকবাল হোসেন দাবি করেন, ১০ থেকে ১২ জন নারী শ্রমিককে ওমান পাঠানো হলেও মাত্র দুজন ফেরত এসেছেন। আর ফেরত আসা নারী শ্রমিকেরা নির্যাতনের যে অভিযোগ করছেন, তা সত্য নয়। এই নারীদের প্রায় ১৬ হাজার টাকা বেতন দেওয়া কথা। কিন্তু তাঁরা এই বেতনে কাজ করতে রাজি হননি। এ ছাড়া দুজনের মধ্যে একজন বয়স্ক বলে কাজ করতে পারেননি, আর একজন হাত পুড়িয়ে ফেলেন বলে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এই নারীদের ওমান যেতে এক টাকাও লাগেনি বলে তিনি দাবি করেন।
ঢাকার মেয়েটি জানান, ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ওমান যান। দেশে থাকা অবস্থাতেই গর্ভপাতসংক্রান্ত জটিলতায় তাঁর পেটটি বেশ ফুলে যায়। পরে স্বামী তাঁকে ফেলে চলে যান। ওমানে ছিলেন মাত্র দুই মাস। এর আগে সৌদি আরবে গেলেও শারীরিক অসুস্থতায় কাজ করতে না পারায় ১৮ দিনের মাথায় দেশে ফেরত এসেছিলেন।
মাকে ওমান থেকে দেশে ফেরত আনার আবেদন জানানো ছেলেটি জানান, তাঁর মা যখন সৌদি আরবে যান, তখন মোশররফ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। এবারও এই মোশাররফ ও বাতেন নামের দুজনের মাধ্যমে গত ১৫ মে ওমান যান মা। মায়ের ওমান যাওয়া নিয়ে তাঁরা কিছু জানতেন না। তিনি জানান, সৌদি আরবে থাকার সময় মা ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। সেই টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা দালালকে দিয়ে ওমান গেছেন।
ছেলে অভিযোগ করেন, ওমানে রমজানের সময় তাঁর মাকে ইফতারের সময় শুধু একটি খেজুর আর গরম পানি খেতে দেওয়া হতো। বললেন, ‘আমি মায়ের একমাত্র ছেলে। ফোনে মা খিদার জ্বালায় যখন চিৎকার করে, তখন তো আর থাকতে পারি না। মাকে ফেরত আনার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে চাকরিটাও ছাড়তে হইছে।’ তিনি জানান, ওমানে তাঁর মা এবং আরেক নারী একসঙ্গে বাসা থেকে পালান। তবে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর পুলিশ আবার ওই অফিসে দিয়ে আসে। তারপর থেকে শুরু হয় আজাবের যন্ত্রণা। দালাল ও এজেন্টকে মাকে ফেরত পাঠানোর কথা বললে ৬০ হাজার টাকা দাবি করেছে।
ছেলেটির মুঠোফোনে ওমান থেকে কথা বলা মা ছাড়াও অন্যদের ভয়েস রেকর্ড আছে। তিনি বলেন, ‘ওইখান থেকে যে ভিডিও পাঠায় তাতে মা বলে, অভিযোগ তুলে নে, আমি ভালো আছি। আর আমার কাছে মা বলে অন্য কথা। মা জানিয়েছে, মোটা লাঠি হাতে নিয়ে “ভালো আছি” বলে এই ধরনের ভিডিও করতে বাধ্য করা হয়।’
ওমানের অফিসে বাংলাদেশি নারীদের দেখভাল করেন মায়া রানী। এই মায়া রানী মারধর করেন বলে ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের অভিযোগ। তবে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে মায়া নারী শ্রমিকদের সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। জানালেন, তিনি ওমানে সাত বছর ধরে এক বাসায় কাজ করেন। কাজের পাশাপাশি বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের কথা শোনাসহ বিভিন্ন সহায়তার জন্য অফিসে তাঁকে নিয়ে আসা হয়।
মায়া উল্টো নারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ করে বলেন, ‘একেকজন ২০টি পর্যন্ত বাসা পাল্টান। আপনিই বলেন, একটা বাসাও ভালো হইবো না। অনেকে টাকাপয়সা চুরি করে। বাসা থেকে পালায়। তখন রাগ হয়ে অফিসের অন্যরা চড়–থাপ্পড় দেয়। অপরাধ করলে তো দিতেই হইবো।’
ফেরত আসা নারী শ্রমিকেরা জানালেন, এই মায়া রানীর ভাই হলেন বাতেন। তিনি দেশ থেকে ফুসলিয়ে নারী শ্রমিকদের ওমানে পাঠান। বাতেনের ভিজিটিং কার্ডে চৈতি বুটিকস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সি লেখা। ঠিকানা লেখা নারায়ণগঞ্জের।
ওকাবের প্রশিক্ষক ও কাউন্সেলর আমেনা আক্তার প্রথম আলোকে জানালেন, ফেরত আসাদের মধ্যে এক নারী এর আগে সৌদি আরবে ছিলেন মাত্র তিন মাস। সেখান থেকে ফেরার পর ওকাবে আসেন। তখন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২২ হাজার টাকার মধ্যে তিনি কী কাজ করতে চান, তার পরিকল্পনা দিতে বলা হয়। তবে এই নারী বাড়ি ফিরে আর যোগাযোগ করেননি। তারপর ওমান চলে যান। সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরার পর আবার ওকাবে আসেন। তখন তাঁর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ওমানের ওই অফিসে এখনো ২০ থেকে ২৫ জন নারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই নারীর মাধ্যমে অন্যরা ওকাবে আসেন বিভিন্ন সহযোগিতার জন্য। একজন ওকাবের আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। আরেক জন মুমূর্ষু অবস্থায় ফিরেছিলেন, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করে বাড়ি পাঠানো হয়েছে।
আমেনা আক্তার বললেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে এবং ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে অভিযোগ করা হয়েছে। ফেরত আসা নারীরা আইনি সহায়তা চাইলে তা দেওয়া হবে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো নির্যাতনের শিকার অন্য নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনা।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বললেন, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই চুক্তিভঙ্গ করে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা ও নির্যাতন করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা না কমে বরং বাড়ছে। এই নারী শ্রমিকদের শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, চুল কেটে দেওয়া, খাবার না দেওয়া, বেতন না দেওয়াসহ যেভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে, তা আধুনিক দাসপ্রথার ও পাচারেরই নামান্তর। এই নারী শ্রমিকদের পাঠাচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি। আর এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দালাল, সাব-এজেন্ট। এরা সব সময় পার পেয়ে যাচ্ছে। এদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি কার্যকর করতে হবে।
বিএমইটির পরিচালক নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বললেন, সরকারিভাবে বর্তমানে বিদেশে কাজের জন্য নারীদের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ থেকে ৩৮ বছর। তাই ৪৫ বছর বয়স্ক বা অসুস্থ কোনো নারীর বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দালাল ধরে স্মার্টকার্ড জ্বাল করে বিমানবন্দরে টাকা দিয়ে এই নারীদের বিদেশ পাঠিয়ে দিচ্ছে একটি চক্র। এ ধরনের চক্রের সঙ্গে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে। ধরা পড়লে লাইসেন্স বাতিল করা হচ্ছে।
নির্যাতনের শিকার হয়ে ওমান থেকে ফিরে এসেছেন দুই নারী। ছবি: প্রথম আলো |
নির্যাতনের একপর্যায়ে চুল কেটে দেওয়া হয় এই নারীর। ছবি: প্রথম আলো |
No comments