কার পাল্লা ভারী? by সালমান তারেক শাকিল
রওশন, এরশাদ, কাদের |
হুসেইন
মুহম্মদ এরশাদের জীবিত অবস্থায়ই জাতীয় পার্টি (জাপা)-কে ভাগ করে নতুন
নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছেন তার বিশ্বস্ত কয়েকজন রাজনৈতিক সহচর। এই বিভক্তির
সর্বশেষ সংস্করণটি দৃশ্যপটে এনেছেন স্বয়ং তার স্ত্রী রওশন এরশাদ। রওশনপন্থী
কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তাকে চেয়ারম্যান
ঘোষণা করেন। এরপর এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছেন,
রওশনকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন। তাকে চেয়ারম্যান ঘোষণার পেছনে যারা দোষী,
তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এই হুঁশিয়ারিতেও টলছেন
না রওশনপন্থীরা। পরন্তু আগামী ৮ সেপ্টেম্বর সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক ডাকা
হয়েছে। বলা হচ্ছে, ওই বৈঠক থেকেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবেন রওশন এরশাদ।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ছোট ভাই জিএম কাদেরের মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন জাপার এমপিরা। ইতোমধ্যে কয়েকজন দৃশ্যত দুজনের পাশে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ বজায় রাখছেন নিরাপদ দূরত্ব। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বয়ং মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। বৃহস্পতিবার সারাদিনে তিনি দৃশ্যপটে নেই অথচ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সড়কের একটি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
জাপার উভয় অংশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের সংগঠন ও এমপিদের মধ্যে জনপ্রিয় জিএম কাদের। বিরোধীদলীয় নেতা ও রংপুর-৩ আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে বেশিরভাগ এমপির সমর্থন চেয়ারম্যানের দিকে। তারা হলেন, কাজী ফিরোজ রশীদ, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, নাজমা আকতার, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল, আহসান আদেলুর রহমান, মসিউর রহমান রাঙ্গা, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মাসুদা রশিদ চৌধুরী, লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী, নুরুল ইসলাম তালুকদার, সালমা ইসলাম, পনির উদ্দিন আহমেদ। বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদেরের পাশে ছিলেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, গোলাম কিবরিয়া টিপু এমপি, অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, সুনীল শুভরায়, লে. জে. মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী এমপি, মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, এস এম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর, কাজী মামুনুর রশিদ, আলমগীর সিকদার লোটন, এমরান হোসেন মিয়া, নাজমা আক্তার এমপি, উপদেষ্টা মেজর (অব.) আশরাফউদ দৌলা, মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, ভাইস চেয়ারম্যান সরদার শাহজাহান, আহসান আদেলুর রহমান এমপি, মোস্তাকুর রহমান, মস্তফা আল মাহমুদ, নুরুল ইসলাম তালুকদার এমপি, যুগ্ম-মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয় প্রমুখ।
আগের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রওশন এরশাদের সঙ্গে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ছাড়াও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু, মজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা, এসএম ফয়সল চিশতী, মীর আবদুস সবুর আসুদ, খালেদ আখতার, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন খোকা ও নাসিম ওসমান প্রমুখ। এছাড়া, রওশনপন্থী এমপিদের মধ্যে ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফখরুল ইমাম, মুজিবুল হক চুন্নু, নাসিম ওসমান প্রমুখ।
জিএম কাদেরপন্থী কাজী ফিরোজ রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এরশাদের জাপার পক্ষে। জিএম কাদেরকে তিনি জীবদ্দশায় চেয়ারম্যান মনোনীত করেছেন। তিনি এমপিদের অভিমত নিয়েই বিরোধীদলীয় নেতার বিষয়ে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছেন। খোদ এরশাদ আমাকে অসিয়ত করেছেন জিএম কাদেরের সঙ্গে থাকতে। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তৃতীয় একটি গোষ্ঠীর ইঙ্গিতে জাপাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। এটা শত্রুদের কাজ। জাপার সারাদেশের নেতাকর্মীরা জিএম কাদেরের সঙ্গে আছেন।’
পাল্টা মন্তব্য রওশনপন্থী এমপি ফখরুল ইমামের। তার ভাষ্য, ‘গঠনতন্ত্র মোতাবেক তো জিএম কাদের কো-চেয়ারম্যান। পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি প্রেসিডিয়ামের সঙ্গে কোনও বৈঠক না করে, আলোচনা না করে বিরোধীদলীয় নেতার বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন, এটা অন্যায় হয়েছে।’
উভয় অংশের বাইরে আছেন, জাপার এমন নেতারা বলছেন, রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের দ্বন্দ্ব ৯০-এর দশকের শুরুতেই। এটা এরশাদের জীবদ্দশাতেই একাধিকবার দৃশ্যমান হয়েছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও রওশন ও জিএম কাদেরের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে ছিল। এরপর ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি রংপুরে জাতীয় পার্টির কর্মী-সম্মেলনে এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিলে ফের রওশন বিরোধিতা করেন। পরে রওশন এরশাদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করেন এরশাদ। কিন্তু গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা হিসেবে কাদেরকে বেছে নেন। এই বছরের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে গুরুতর অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে ছোট ভাই জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন এরশাদ। কিন্তু গত ২২ মার্চ পার্টির কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে জিএম কাদেরকে সরিয়ে দেন। পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা অনুযায়ী ওই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরে চূড়ান্তভাবে গত ৪ মে প্রায় মধ্যরাতে সাংবাদিকদের ডেকে এরশাদ জানান, তার ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এরপর ১৪ জুলাই এরশাদ মারা যান। এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে রওশনপন্থীরা কোনও বিরোধিতা না করলেও আজই প্রথম জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে গেলেন রওশন।
একাধিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জাপা রংপুরকেন্দ্রিক রাজনীতিতেই এখন পর্যন্ত সক্রিয়। সারাদেশে তেমন সাংগঠনিক শক্তি না থাকলেও রংপুর বিভাগে এরশাদের জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। এক্ষেত্রে রংপুর থেকেই দলের নেতৃত্ব পরিচালিত হবে। নেতাকর্মীদের কাছেও তা গ্রহণযোগ্য হবে। আর এ কারণে জিএম কাদের স্বভাবত এগিয়ে থাকলেও সমস্যায় পড়েছেন বেশি তিনিই। রাজনৈতিকভাবে রওশন এরশাদ বা আনিসুল ইসলাম মাহমুদরা এগিয়ে থাকলেও সাংগঠনিক রাজনীতিতে তাদের অবস্থান অনেকটাই কম। যদিও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে রওশনপন্থীদের দিকে পাল্লা ঝুঁকে থাকার কথা আলোচনায় থাকলেও তা কতটা বাস্তব, আরও পরে স্পষ্ট হবে। তবে, রংপুর-৩ আসনের প্রার্থী নির্ধারণ প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছেন জাপার একাধিক নেতা।
জাপার প্রেসিডিয়ামের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা দাবি করেন, জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ দুই অংশের চেয়ারম্যান হিসেবে এখন পর্যন্ত থাকলেও চেয়ারম্যান হতে আগ্রহীদের মধ্যে আছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (রওশনপন্থী), মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী (জিএম কাদেরপন্থী)। মহাসচিব হিসেবে মসিউর রহমান রাঙ্গা থাকলেও সরকারের সমর্থন আসলে কোন দিকে যায়, সেটিও নজরে আছে তার। মহাসচিব হওয়ার দৌড়েও রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু আছেন। এই নেতার দাবি, সরকারের একটি প্রভাবশালী সংস্থা জাপা-সংকটের পেছনে আছে। ফলে, কে প্রভাবশালী বা কে সামনে এগুবে, তা নির্ভর করবে ওই সংস্থার ওপর। এছাড়া দলের মিডিয়া উইং, কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও চেয়ারম্যান কার্যালয় জিএম কাদের অনুসারীদের দখলে। এ কারণে দৃশ্যত জিএম কাদের এগিয়ে আছেন।
জাপার একাধিক নেতা জানান, জাপার উভয় অংশই এখন সরকারের দিকে ঝুঁকে আছে। জিএম কাদেরও চান সরকারের সম্মতিতে বিরোধী পক্ষ গড়ে তুলতে। সম্প্রতি ছোট ছোট কয়েকটি দলের নেতা সাক্ষাৎ করেছেন তার নেতৃত্বে রাজনৈতিক জোট করতে। যদিও এসব আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
আর জিএম কাদের মনে করছেন, সংসদীয় রাজনীতিতে সরকারের সম্মতির বাইরে কার্যকর বিরোধী দল হওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘মূলত দুটো রাজনৈতিক কারণে বিকল্প বিরোধী জোট করার পক্ষে তার কাছে মত আসছে। একটি হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১৪ দলীয় জোট আছে। জোটের শরিক দলগুলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই রাজনীতি করতে আগ্রহী। ফলে, যেকোনও দল চাইলেও সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী জোট থাকলেও দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। এ কারণেই ছোট ছোট দলগুলো জাতীয় পার্টিতে ভিড়তে চায়।’
রওশন এরশাদ দশম সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার আসনে ছিলেন। একটি সূত্র বলছে, একাদশ সংসদেও তাকে দেখতে চাইছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি পক্ষ। তবে রওশনপন্থীরা অবশ্য এখনও এ নিয়ে কিছু বলতে নারাজ। ইতোমধ্যে একজন নেতা জানান, খুব সম্ভবত সরকারের পক্ষ থেকে উভয়পক্ষকেই সমাধানে যেতে বলা হবে। অন্যথায় চলতি অবস্থাতেই কিছুদিন কার্যক্রম চলবে।
চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাবেক এমপি মুহাম্মদ নোমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রওশন এরশাদ আমাদের স্যারের স্ত্রী, দলে তার অবদান অনস্বীকার্য। আবার ভদ্রলোক হিসেবে ইতোমধ্যে জিএম কাদের সমাদৃত। তার অবদানও অনেক। আমরা চাইছি ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় পার্টিতে সমাধান আসতে। একটি কার্যকর বিরোধী দল গড়ে তুলতে ঐক্যের কোনও বিকল্প নেই।’
এদিকে, ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি গঠনের পর দফায় দফায় ভাঙনের মুখে পড়েছে জাপা। এরশাদের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহযোগীরা দল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিএনপিতে। আবার কোনও কোনও নেতা জাতীয় পার্টি নামেই করেছেন দল। এই নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজী জাফর আহমেদ, নাজিউর রহমান মঞ্জু ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সর্বশেষ রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান করে জাপায় আবার বিভক্তি শুরু করলেন দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন মজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, এস এম ফয়সল চিশতী ও সেলিম ওসমান প্রমুখ।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে পাঁচটি জাতীয় পার্টি রয়েছে। মূল দল জাতীয় পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ০১২)। এর নেতৃত্বে আছেন জিএম কাদের। মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। তবে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে নতুন চেয়ারম্যানের স্থলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম রয়েছে। নেই মহাসচিব হিসেবে কারও নাম। জাপা ছাড়া কয়েকটি দলের মহাসচিব পরিবর্তন হলেও সেখানে আপডেট নেই।
নিবন্ধিত জাপার মধ্যে বাকি তিনটি হচ্ছে—আন্দালিভ রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (নিবন্ধন নম্বর ০১৮) ও প্রফেসর ডা. এম. এ. মুকিত (চেয়ারম্যান), এ এন এম সিরাজুল ইসলামের (ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব) নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ২৮) ও জাতীয় পার্টি-জেপি (নিবন্ধন নম্বর ০০২)। দলটির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে আছে। দলটির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম। অনিবন্ধিত অবস্থায় আছে জাতীয় পার্টি (মোস্তফা জামাল হায়দার)। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক এই দলটি।
বিভক্তির মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির কার্যকারিতা এখন আর কতটুকু বাকি রইলো, এমন প্রশ্ন ছিল এরশাদের সাবেক রাজনৈতিক সহযোগী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের প্রতি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমি এরশাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছি।’ বিষয়টি নিয়ে তিনি আর কোনও কথা বলতে চান না বলেও জানান।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ছোট ভাই জিএম কাদেরের মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন জাপার এমপিরা। ইতোমধ্যে কয়েকজন দৃশ্যত দুজনের পাশে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ বজায় রাখছেন নিরাপদ দূরত্ব। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বয়ং মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। বৃহস্পতিবার সারাদিনে তিনি দৃশ্যপটে নেই অথচ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সড়কের একটি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
জাপার উভয় অংশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের সংগঠন ও এমপিদের মধ্যে জনপ্রিয় জিএম কাদের। বিরোধীদলীয় নেতা ও রংপুর-৩ আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে বেশিরভাগ এমপির সমর্থন চেয়ারম্যানের দিকে। তারা হলেন, কাজী ফিরোজ রশীদ, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, নাজমা আকতার, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল, আহসান আদেলুর রহমান, মসিউর রহমান রাঙ্গা, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মাসুদা রশিদ চৌধুরী, লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী, নুরুল ইসলাম তালুকদার, সালমা ইসলাম, পনির উদ্দিন আহমেদ। বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদেরের পাশে ছিলেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, গোলাম কিবরিয়া টিপু এমপি, অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, সুনীল শুভরায়, লে. জে. মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী এমপি, মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, এস এম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর, কাজী মামুনুর রশিদ, আলমগীর সিকদার লোটন, এমরান হোসেন মিয়া, নাজমা আক্তার এমপি, উপদেষ্টা মেজর (অব.) আশরাফউদ দৌলা, মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, ভাইস চেয়ারম্যান সরদার শাহজাহান, আহসান আদেলুর রহমান এমপি, মোস্তাকুর রহমান, মস্তফা আল মাহমুদ, নুরুল ইসলাম তালুকদার এমপি, যুগ্ম-মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয় প্রমুখ।
আগের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রওশন এরশাদের সঙ্গে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ছাড়াও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু, মজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা, এসএম ফয়সল চিশতী, মীর আবদুস সবুর আসুদ, খালেদ আখতার, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন খোকা ও নাসিম ওসমান প্রমুখ। এছাড়া, রওশনপন্থী এমপিদের মধ্যে ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফখরুল ইমাম, মুজিবুল হক চুন্নু, নাসিম ওসমান প্রমুখ।
জিএম কাদেরপন্থী কাজী ফিরোজ রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এরশাদের জাপার পক্ষে। জিএম কাদেরকে তিনি জীবদ্দশায় চেয়ারম্যান মনোনীত করেছেন। তিনি এমপিদের অভিমত নিয়েই বিরোধীদলীয় নেতার বিষয়ে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছেন। খোদ এরশাদ আমাকে অসিয়ত করেছেন জিএম কাদেরের সঙ্গে থাকতে। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তৃতীয় একটি গোষ্ঠীর ইঙ্গিতে জাপাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। এটা শত্রুদের কাজ। জাপার সারাদেশের নেতাকর্মীরা জিএম কাদেরের সঙ্গে আছেন।’
পাল্টা মন্তব্য রওশনপন্থী এমপি ফখরুল ইমামের। তার ভাষ্য, ‘গঠনতন্ত্র মোতাবেক তো জিএম কাদের কো-চেয়ারম্যান। পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি প্রেসিডিয়ামের সঙ্গে কোনও বৈঠক না করে, আলোচনা না করে বিরোধীদলীয় নেতার বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন, এটা অন্যায় হয়েছে।’
উভয় অংশের বাইরে আছেন, জাপার এমন নেতারা বলছেন, রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের দ্বন্দ্ব ৯০-এর দশকের শুরুতেই। এটা এরশাদের জীবদ্দশাতেই একাধিকবার দৃশ্যমান হয়েছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও রওশন ও জিএম কাদেরের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে ছিল। এরপর ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি রংপুরে জাতীয় পার্টির কর্মী-সম্মেলনে এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিলে ফের রওশন বিরোধিতা করেন। পরে রওশন এরশাদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করেন এরশাদ। কিন্তু গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা হিসেবে কাদেরকে বেছে নেন। এই বছরের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে গুরুতর অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে ছোট ভাই জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন এরশাদ। কিন্তু গত ২২ মার্চ পার্টির কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে জিএম কাদেরকে সরিয়ে দেন। পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা অনুযায়ী ওই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরে চূড়ান্তভাবে গত ৪ মে প্রায় মধ্যরাতে সাংবাদিকদের ডেকে এরশাদ জানান, তার ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এরপর ১৪ জুলাই এরশাদ মারা যান। এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে রওশনপন্থীরা কোনও বিরোধিতা না করলেও আজই প্রথম জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে গেলেন রওশন।
একাধিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জাপা রংপুরকেন্দ্রিক রাজনীতিতেই এখন পর্যন্ত সক্রিয়। সারাদেশে তেমন সাংগঠনিক শক্তি না থাকলেও রংপুর বিভাগে এরশাদের জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। এক্ষেত্রে রংপুর থেকেই দলের নেতৃত্ব পরিচালিত হবে। নেতাকর্মীদের কাছেও তা গ্রহণযোগ্য হবে। আর এ কারণে জিএম কাদের স্বভাবত এগিয়ে থাকলেও সমস্যায় পড়েছেন বেশি তিনিই। রাজনৈতিকভাবে রওশন এরশাদ বা আনিসুল ইসলাম মাহমুদরা এগিয়ে থাকলেও সাংগঠনিক রাজনীতিতে তাদের অবস্থান অনেকটাই কম। যদিও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে রওশনপন্থীদের দিকে পাল্লা ঝুঁকে থাকার কথা আলোচনায় থাকলেও তা কতটা বাস্তব, আরও পরে স্পষ্ট হবে। তবে, রংপুর-৩ আসনের প্রার্থী নির্ধারণ প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছেন জাপার একাধিক নেতা।
জাপার প্রেসিডিয়ামের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা দাবি করেন, জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ দুই অংশের চেয়ারম্যান হিসেবে এখন পর্যন্ত থাকলেও চেয়ারম্যান হতে আগ্রহীদের মধ্যে আছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (রওশনপন্থী), মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী (জিএম কাদেরপন্থী)। মহাসচিব হিসেবে মসিউর রহমান রাঙ্গা থাকলেও সরকারের সমর্থন আসলে কোন দিকে যায়, সেটিও নজরে আছে তার। মহাসচিব হওয়ার দৌড়েও রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু আছেন। এই নেতার দাবি, সরকারের একটি প্রভাবশালী সংস্থা জাপা-সংকটের পেছনে আছে। ফলে, কে প্রভাবশালী বা কে সামনে এগুবে, তা নির্ভর করবে ওই সংস্থার ওপর। এছাড়া দলের মিডিয়া উইং, কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও চেয়ারম্যান কার্যালয় জিএম কাদের অনুসারীদের দখলে। এ কারণে দৃশ্যত জিএম কাদের এগিয়ে আছেন।
জাপার একাধিক নেতা জানান, জাপার উভয় অংশই এখন সরকারের দিকে ঝুঁকে আছে। জিএম কাদেরও চান সরকারের সম্মতিতে বিরোধী পক্ষ গড়ে তুলতে। সম্প্রতি ছোট ছোট কয়েকটি দলের নেতা সাক্ষাৎ করেছেন তার নেতৃত্বে রাজনৈতিক জোট করতে। যদিও এসব আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
আর জিএম কাদের মনে করছেন, সংসদীয় রাজনীতিতে সরকারের সম্মতির বাইরে কার্যকর বিরোধী দল হওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘মূলত দুটো রাজনৈতিক কারণে বিকল্প বিরোধী জোট করার পক্ষে তার কাছে মত আসছে। একটি হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১৪ দলীয় জোট আছে। জোটের শরিক দলগুলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই রাজনীতি করতে আগ্রহী। ফলে, যেকোনও দল চাইলেও সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী জোট থাকলেও দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। এ কারণেই ছোট ছোট দলগুলো জাতীয় পার্টিতে ভিড়তে চায়।’
রওশন এরশাদ দশম সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার আসনে ছিলেন। একটি সূত্র বলছে, একাদশ সংসদেও তাকে দেখতে চাইছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি পক্ষ। তবে রওশনপন্থীরা অবশ্য এখনও এ নিয়ে কিছু বলতে নারাজ। ইতোমধ্যে একজন নেতা জানান, খুব সম্ভবত সরকারের পক্ষ থেকে উভয়পক্ষকেই সমাধানে যেতে বলা হবে। অন্যথায় চলতি অবস্থাতেই কিছুদিন কার্যক্রম চলবে।
চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাবেক এমপি মুহাম্মদ নোমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রওশন এরশাদ আমাদের স্যারের স্ত্রী, দলে তার অবদান অনস্বীকার্য। আবার ভদ্রলোক হিসেবে ইতোমধ্যে জিএম কাদের সমাদৃত। তার অবদানও অনেক। আমরা চাইছি ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় পার্টিতে সমাধান আসতে। একটি কার্যকর বিরোধী দল গড়ে তুলতে ঐক্যের কোনও বিকল্প নেই।’
এদিকে, ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি গঠনের পর দফায় দফায় ভাঙনের মুখে পড়েছে জাপা। এরশাদের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহযোগীরা দল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিএনপিতে। আবার কোনও কোনও নেতা জাতীয় পার্টি নামেই করেছেন দল। এই নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজী জাফর আহমেদ, নাজিউর রহমান মঞ্জু ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সর্বশেষ রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান করে জাপায় আবার বিভক্তি শুরু করলেন দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন মজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, এস এম ফয়সল চিশতী ও সেলিম ওসমান প্রমুখ।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে পাঁচটি জাতীয় পার্টি রয়েছে। মূল দল জাতীয় পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ০১২)। এর নেতৃত্বে আছেন জিএম কাদের। মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। তবে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে নতুন চেয়ারম্যানের স্থলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম রয়েছে। নেই মহাসচিব হিসেবে কারও নাম। জাপা ছাড়া কয়েকটি দলের মহাসচিব পরিবর্তন হলেও সেখানে আপডেট নেই।
নিবন্ধিত জাপার মধ্যে বাকি তিনটি হচ্ছে—আন্দালিভ রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (নিবন্ধন নম্বর ০১৮) ও প্রফেসর ডা. এম. এ. মুকিত (চেয়ারম্যান), এ এন এম সিরাজুল ইসলামের (ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব) নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (নিবন্ধন নম্বর ২৮) ও জাতীয় পার্টি-জেপি (নিবন্ধন নম্বর ০০২)। দলটির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে আছে। দলটির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম। অনিবন্ধিত অবস্থায় আছে জাতীয় পার্টি (মোস্তফা জামাল হায়দার)। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক এই দলটি।
বিভক্তির মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির কার্যকারিতা এখন আর কতটুকু বাকি রইলো, এমন প্রশ্ন ছিল এরশাদের সাবেক রাজনৈতিক সহযোগী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের প্রতি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমি এরশাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছি।’ বিষয়টি নিয়ে তিনি আর কোনও কথা বলতে চান না বলেও জানান।
একই মঞ্চে এইচএম এরশাদ, রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের |
>>>ছবি: সাজ্জাদ হোসেন।
No comments