বাংলাদেশের লুঙ্গির সুনাম এখন বিশ্বজুড়ে
বাংলাদেশের
বৃহত্তর পাবনাসহ কয়েকটি জেলার তাঁতীদের তৈরি লুঙ্গির সুনাম ও কদর দেশের
গন্ডি পেড়িয়ে এখন বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবছর বিশ্বের ২৫টি দেশে
প্রায় দুই কোটি পিস লুঙ্গি রফতানি হচ্ছে। এ খাত থেকে বছরে প্রায় এক হাজার
২০০ কোটি টাকা আয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা
জানান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহারাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত,
লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের ২৫টি দেশে
লুঙ্গি রফতানি হচ্ছে। এসব দেশে বসবাসকারী বাঙালিরাই মূলত এই লুঙ্গির
ক্রেতা। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশের লোকজন শখ করে বাংলাদেশি লুঙ্গি
কিনেন। ব্যবসায়ীরা জানান, পাবনা জেলার হাতিগাড়া, বনগ্রাম, সান্যালপাড়া,
ছেঁচানিয়া, দোগাছি, সুজানগর, ড়েমরা, ঢহরজানি, সোনাতলা, বিলসলঙ্গী,
চাঁচকিয়া, কুলোনিয়া, হাটুরিয়া, রাকশা, মৈত্রবাধা, সাঁথিয়া, বাটিয়াখড়া,
পেঁচাকোলা, ঈশ্বরদী, সিরাজগঞ্জের পুকুরপাড়, নগরডালা, ডায়া, খুকনী, শিবপুর
গাছপাড়া, তালতলা, এনায়েতপুর, বেতিল, উল্লাপাড়া, মনিরামপুর, খঞ্জনদিয়ার,
রামবাড়ি, পুকুরপাড়, মনিরামপুর, প্রাণনাথপুর, শক্তিপুর, ঘাটপাড়া, পোতাজিয়া,
আন্ধারকোঠাপাড়া, রূপপুর, উড়িয়ারচর, নগরডালা, ডায়া, হামলাকোলা, জুগ্নিদহ,
খুকনী, শিবপুর, গাছপাড়া, কামালপুর, রূপসী, ছোট চাঁনতারা ও নরসিংদী জেলার
চরসুবুদ্ধি, হাইরমারা, নিলক্ষা, আমিরগঞ্জ, কাট্রাখালি, মনিপুরা, মুদাফত,
হাজীপুর, ঘোড়াদিয়া, করিমপুর, নজরপুর, বাবুরহাট, মাধবদী, পৌলানপুর, ভাটপাড়া
ভাগীরথপুর, ঘোড়াশাল, পাইকশা, সনেরবাড়ী টাংগাইল জেলার পাথরাইল, চন্ডি,
নলসুধা, চিনাখোলা, দেওজান, নলুয়া, হিঙ্গানগর, এলাসিন, বাতুলি, বাজিদপুর,
বল্লা, রামপুরসহ তাঁত প্রধান এলাকার তাঁতে তৈরি লুঙ্গির সুনাম ও কদর এখন
দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জানা যায়, দেশে ১৯৯৮ সালে
বিদ্যুৎচালিত পাওয়ারলুমে লুঙ্গি তৈরি শুরু হয়। বার্তমানে এ ধরনের তাঁতেই ৯০
ভাগ লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। এছাড়া চিত্তরঞ্জন ও পিটলুমে লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। আর
উৎপাদিত লুঙ্গির বেশির ভাগই বিদেশে রফতানি হচ্ছে। পাবনা, সিরাজগঞ্জ,
টাংগাইল ও নরসিংদী জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে লুঙ্গি প্রস্তুতকারক ও বিপণনকারী
প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান শুধু
স্থানীয়ভাবে লুঙ্গি তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই তাঁত
মালিকদের কাছে অর্ডার দিয়ে লুঙ্গি তৈরি করিয়ে আনে। পরে এসব প্রতিষ্ঠান এতে
নিজেদের প্রতীক বা স্টিকার লাগিয়ে ওই লুঙ্গি বাজারজাত করেন।
তাঁতীরা জানান,
এক সময় নামে-বেনামে বিক্রি হওয়া লুঙ্গি এখন পরিচিতি পাচ্ছে নিজস্ব
ব্রান্ডে। দেশে প্রথম লুঙ্গি ব্রান্ডিং শুরু করে নরসিংদীর হেলাল অ্যান্ড
ব্রাদার্স। বাজারে সোনার বাংলা টেক্সটাইল, ডিসেন্ট, ইউনিক, স্ট্যান্ডার্ড,
আমানত শাহ, রূহিতপুরী, স্মার্ট, অমর, পাকিজা, এটিএম, বোখারী, ফজর আলী,
অনুসন্ধান, জেএম, স্কাই, ওয়েষ্ট, রংধনুসহ ১২৫ ব্রান্ডের লুঙ্গি বাজারে
বিক্রি হচ্ছে। ৮০/৮০, ৬২/৮০, ৬২/৬২, ৪০/৬২, ৪০/৪০ কাউন্ট সুতাতে এ সব
লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। মান ভেদে প্রতি পিস লুঙ্গি ৩৫০ টাকা থেকে ৭০০০ টাকা দরে
বিক্রি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে লুঙ্গি বাজারে। রং ও
ডিজাইনে বৈচিত্র্যের মাধ্যমে লুঙ্গি সবার কাছে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে
কাজ করে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। লুঙ্গি এখন শুধু বাঙালি পুরুষের
পোষাকই নয়, গুণ-মান এবং ভালো ডিজাইনের কারণে বাংলাদেশের লুঙ্গির দিকে নজর
এখন বিদেশিদেরও। তবে বাংলাদেশি লুঙ্গির বড় ক্রেতা ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। তারা
বাংলাদেশ থেকে লুঙ্গি ভারতে নিয়ে সেখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি
করছে। এসব লুঙ্গি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বাজারে প্রতি পিস এক হাজার থেকে
আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভারতের মালদাহ জেলার আমদানি ও রফতানিকারক
এমএম ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী অজিত দত্ত সমকাল’কে জানান, ভারতে
বিভিন্ন রাজ্যের ১২ জন আমদানি-রফতানিকারক বাংলাদেশের আতাইকুলা, শাহজাদপুর,
এনায়েতপুর, করোটিয়া ও বাবুরহাট থেকে লুঙ্গি কিনে সড়ক পথে ট্রাকে করে ভারতের
পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও দিল্লীতে মজুদ করে। এরপর সেখানে
ভারতের বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানে স্টিকার লাগিয়ে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব,
কাতার, লেবানন, ওমান, বাহারাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া,
কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে। ভারতীয়
আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ পিস লুঙ্গি
ক্রয় করে বলে তিনি জানান। শাহজাদপুরের পাইকারী কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল
মাসুদ সমকাল’কে জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও
এনায়েতপুরহাট, পাবনার আতাইকুলাহাট, টাংগাইলের করটিয়াহাট ও নরসিংদীর
বাবুরহাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২৫ কোটি টাকার কাপড় কিনেন। এতে এ
অঞ্চলের তাঁতশিল্প প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ভারতের কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপাল
চন্দ্র সেন জানান, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে কাপড়ের দাম তুলনামূলক কম এবং
উন্নতমানের হওয়ায় তারা এখান থেকে লুঙ্গি ও শাড়ী কাপড় কিনছেন। সোনার বাংলা
টেক্সটাইলের মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, এখন ক্রেতারা লুঙ্গি কেনার ক্ষেত্রে
ব্রান্ডকে প্রাধান্য দেয়। আর এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে সোনার বাংলা
টেক্সটাইল লুঙ্গি। ডিজাইন ও মানের কারণে সব বয়সী মানুষের দৃষ্টি কাড়ছে।
একারণে প্রতিবছর তাদের ৭০ থেকে ৭৫ কোটি টাকার লুঙ্গি বিক্রি হচ্ছে। পাবনা
জেলা তাঁতী দলের সভাপতি মোঃ শাহজাহান আলী আশরাফী সমকাল’কে বলেন, কয়েক বছর
ধরে সুতার অস্থিতিশীল বাজার, রং ও কেমিক্যালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির
কারণে লুঙ্গি তৈরির খরচ বেড়েছে। কিন্তু এত প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যেও কয়েক
বছরে লুঙ্গি খাতের ব্যাপক প্রসার হয়েছে। বাংলাদেশ লুঙ্গি
ম্যানুফ্যাকচারার্স, এক্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি ও
আমানত শাহ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোঃ হেলাল মিয়া জানান, গত বছর তার প্রতিষ্ঠান
প্রায় ১৫ লাখ ডলারের লুঙ্গি রফতানি করেছে। প্রতি বছরই রফতানির পরিমাণ
বাড়ছে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের লুঙ্গির মান সবচেয়ে ভালো। রফতানিতেও অনেক
সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এসময় সরকারি সহযোগীতা পেলে তৈরি পোষাকের পর লুঙ্গি
দিয়েই বিশ্ববাজারে নতুন জায়গা করে নেয়া যাবে বলে দাবি করেন তিনি।
No comments