কাশ্মির : নেহরু থেকে মোদির শাসনামল by ইকবাল জাসসাত
ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন থেকে
মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা উদযাপন করতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রতীক্ষায় আছে
কাশ্মিরিরা। কিন্তু হায়, সাত দশক ধরে পৃথিবীর মুক্ত জাতি হিসেবে গর্বভরে
উঠে দাঁড়ানোর গভীর আকাক্সক্ষা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। মুক্ত, স্বাধীন ও
সার্বভৌম কাশ্মির প্রতিষ্ঠার ৭০ বছরের সংগ্রাম রুখে দেয়া হয়েছে অগণিত খুন,
হত্যা, ধর্ষণ আর খেয়ালি নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে
আজকের ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে এই সংগ্রামের ক্রমধারার তেমন
কোনো পার্থক্য নেই। বরাবরের মতো এখানেও দখলদারেরা আগ্রাসী, আর যারা দখলের
শিকার, তারা মজলুম। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকায় শুরু হওয়া যুদ্ধের
মতোই নির্যাতনকারীরা যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে।ঔপনিবেশিক
দখলদারিত্বের মতো ফিলিস্তিনিরাও একই রকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে যেখানে
পুরো রাষ্ট্রটাই দখল করে নেয়া হয়েছে এবং সেখানে যা হচ্ছে তাকে জাতিগত
নিধনের চিরস্থায়ী বেহায়াপনা ছাড়া আর কী বলা যায়? কাশ্মিরী জনগণ ভারতীয়
সেনাবাহিনীর নির্মমতার চূড়ান্ত রূপ প্রত্যক্ষ করছে। দিল্লির নির্দেশ
অনুযায়ী, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য কাশ্মিরিদের স্বপ্ন যেকোনো
মূল্যে ধূলিসাৎ করা। সে কারণেই সেখানে কেবল দেখা মিলবে ভাঙা অবকাঠামো,
টুটে
যাওয়া স্বপ্ন আর নির্মম দায়িত্বহীনতার।ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
রাষ্ট্রনা য়ক হিসেবে নিজের জনপ্রিয়তা বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে ট্রাম্প,
নেতানিয়াহু ও অন্যান্য কট্টরপন্থী নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর ভুল পথে
হাঁটছেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ তৎপরতা তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড়
গণতান্ত্রিক দেশের ‘নেতা’র পরিবর্তে ‘যুদ্ধবাজ’ হিসেবেই পরিচিত করাচ্ছে।
২০০২ সালের গুজরাট হত্যাকাণ্ডের জন্য সহায়তাকারী হিসেবে মোদিকে সন্ত্রাসী
তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর এক রাতের ব্যবধানেই এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়
যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসঙ্ঘ। এতে মনে হয়, ওয়াশিংটন ও জাতিসঙ্ঘ উভয়ই মোদির
মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ ও স্মৃতি সবই ভুলে গেছে। নিজের অনুসারীদের মধ্যে
অপরাজেয়তার এক আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন মোদি। ভারতকে হিন্দু
জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বানানোর দায়িত্ব তাকে দিয়েছে চরম কট্টরপন্থী দল
বিজেপি। কাজেই অনিবার্যভাবে কাশ্মিরেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিজেপি
প্রায়ই অভিযোগ করে, অধিকৃত কাশ্মিরে তাদের নীতি আগের কংগ্রেস সরকারের চেয়ে
ভিন্ন কিছু নয়। কাশ্মিরিদের ওপর নির্মম নির্যাতনের অভিযোগের জবাবে বিজেপি
এবং মোদি বলে থাকেন, তারা আগের সরকারের একই নীতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা শুধু
বজায় রেখেছেন। সত্যিকার অর্থে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র থেকে স্বাধীনতা
পাওয়ার ঊষালগ্ন থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কাশ্মিরে সামরিকীকরণের
কাজটি বজায় রেখেছেন তারা। কাশ্মির নিয়ে গণভোটের ওপর অনেক ইতিহাসবিদের
গবেষণা প্রমাণ করে দিয়েছে, কিভাবে এ মূল স্তম্ভটির অপব্যবহার করা হয়েছে; তা
সত্ত্বেও মোদির সাথে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম নেতা জওয়াহেরলাল
নেহরুর নীতির ফারাক বিস্তর। দুঃখজনক হলেও সত্য, পাকিস্তানের সাথে চুক্তিতে
পৌঁছানোর জন্য ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসের গণভোটকে নেহরু নানাভাবে ব্যবহার
করেছেন এবং সময়ক্ষেপণের জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিলেন। কাশ্মিরবিষয়ক
প্রখ্যাত লেখক এ জি নুরানীর লেখা থেকে উদ্ধৃতি ওই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে
পরিষ্কার ধারণা দেয় : ‘নেহরুর অন্য পরিকল্পনা ছিল। ১৯৪৭ সালে গণভোটের
ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন খুব বিরোধী। তবে জনসমক্ষে অন্তত ১৯৫৪
সাল পর্যন্ত গণভোট দেয়ার ব্যাপারে তাকে খুবই স্পষ্ট ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হয়।
এর অন্তত পাঁচ বছর পর ‘জওয়াহেরলাল নেহরুর নির্বাচিত কাজ’-এর ২২তম খণ্ড
প্রকাশিত হলে কাশ্মির নিয়ে তার নীতি প্রকাশ পেয়ে যায়। ১৯৫২ সালের ২৫ আগস্ট
কাশ্মিরের সোনমার্গে প্রচারণা চালানোর সময় শেখ আবদুল্লাহকে উদ্দেশ করে
নেহরু একটি গোপন চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। এটি তার দুষ্প্রাপ্য রচনাগুলোর একটি
যা ছিল খুবই অকাট্য, বিস্তৃত, আবেগবর্জিত, কিন্তু নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের
পূর্বাভাস।
এর ধারণাগুলো ছিল এমন : ১. মানুষ কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়; ২. জাতিসঙ্ঘ ক্ষমতাহীন; ৩. যেহেতু ‘আমরা সামরিক ও শিল্প ক্ষমতার দিক দিয়ে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে’, তাই ভারত বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান তা বিনা শর্তে মেনে নেবে; ৪. সংযুক্তি হতে হবে শর্তহীন এবং চূড়ান্ত; ৫. যে সংশয় সাধারণ জনগণ ও সমর্থকদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে, কাশ্মিরের নেতাদের মনের এমন সংশয়ও ঝেড়ে ফেলতে হবে, ভবিষ্যতে কোনো বিতর্ক বা অভিযোগ থাকতে পারবে না; সংযুক্তি চূড়ান্ত হিসেবে সংরক্ষিত হতে হবে এবং কোনো কিছুই একে অস্থিতিশীল করতে পারবে না। এমন দ্বৈত উচ্চারণ ভারতকে পরিচিত করেছে প্রতারক হিসেবে এবং কাশ্মিরের শোচনীয় অধীনতাকে তুলে ধরেছে। মোদি সম্ভবত নির্যাতনের ক্ষেত্রে মাত্রা অতিক্রম করেছেন। তবে নেহরুর দ্বিমুখী নীতির চেয়ে তিনি তার সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে অন্তত স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ফিলিস্তিনিদের মতো কাশ্মিরিদেরও স্বাধীনতার জন্য প্রত্যয় এখনো অটল। কাশ্মির একটি চমৎকার পাহাড়ি এলাকাসমৃদ্ধ সরস ভূখণ্ড। বিশেষ করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, জিনজিয়াং ও তিব্বতের সাথে লাগানো জম্মু, মুজাফ্ফরবাদ, গিলগিট, বালটিস্তান ও লাদাখ সীমান্ত। নেহরু যেমন কাশ্মিরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন, তার পরের সব সরকারের মতো একইভাবে মোদিও একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম
এর ধারণাগুলো ছিল এমন : ১. মানুষ কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়; ২. জাতিসঙ্ঘ ক্ষমতাহীন; ৩. যেহেতু ‘আমরা সামরিক ও শিল্প ক্ষমতার দিক দিয়ে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে’, তাই ভারত বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান তা বিনা শর্তে মেনে নেবে; ৪. সংযুক্তি হতে হবে শর্তহীন এবং চূড়ান্ত; ৫. যে সংশয় সাধারণ জনগণ ও সমর্থকদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে, কাশ্মিরের নেতাদের মনের এমন সংশয়ও ঝেড়ে ফেলতে হবে, ভবিষ্যতে কোনো বিতর্ক বা অভিযোগ থাকতে পারবে না; সংযুক্তি চূড়ান্ত হিসেবে সংরক্ষিত হতে হবে এবং কোনো কিছুই একে অস্থিতিশীল করতে পারবে না। এমন দ্বৈত উচ্চারণ ভারতকে পরিচিত করেছে প্রতারক হিসেবে এবং কাশ্মিরের শোচনীয় অধীনতাকে তুলে ধরেছে। মোদি সম্ভবত নির্যাতনের ক্ষেত্রে মাত্রা অতিক্রম করেছেন। তবে নেহরুর দ্বিমুখী নীতির চেয়ে তিনি তার সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে অন্তত স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ফিলিস্তিনিদের মতো কাশ্মিরিদেরও স্বাধীনতার জন্য প্রত্যয় এখনো অটল। কাশ্মির একটি চমৎকার পাহাড়ি এলাকাসমৃদ্ধ সরস ভূখণ্ড। বিশেষ করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, জিনজিয়াং ও তিব্বতের সাথে লাগানো জম্মু, মুজাফ্ফরবাদ, গিলগিট, বালটিস্তান ও লাদাখ সীমান্ত। নেহরু যেমন কাশ্মিরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন, তার পরের সব সরকারের মতো একইভাবে মোদিও একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম
No comments