নতুন লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ত্রিপুরা
জয়ের পর কিংবা ঘুরিয়েও বলা যায়, ত্রিপুরায় বাম-বধ পর্ব শেষে,
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট করলেন-এই হলো শূন্য থেকে শিখরে ওঠার
কাহিনি। তাঁর পরের টুইটটি ছিল-এই জয় আদর্শের। যে রাজ্যটিতে লোকসভার
আসনসংখ্যা মাত্রই দুটি, যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মোট আটটি রাজ্য মাত্র পঁচিশ
জনকে লোকসভায় পাঠায়, সেখানে মৌরসি পাট্টা গাড়তে, সিকি শতকের বাম শাসনের
অবসান ঘটাতে বিজেপি কেন এমন ব্যাকুল ছিল? কারণটা লুকিয়ে রয়েছে
প্রধানমন্ত্রী মোদির ওই টুইটে। সরকার-রাজের অবসান ঘটিয়ে দেশকে তিনি এই
বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে ভারতে কমিউনিস্ট আদর্শ অচল আধুলি। সচল ও সত্য
শুধু তাঁরাই। নামে বামফ্রন্ট হলেও ত্রিপুরার লড়াই ছিল সিপিএমের সঙ্গে
বিজেপির। ভারতের এই প্রান্তিক রাজ্যটির এই মহারণ এভাবেই চিহ্নিত হয়ে এসেছে।
অথচ ত্রিপুরায় গৈরিকরাজের কোনো ইতিহাস কখনো ছিল না। এই রাজ্যের রাজনৈতিক ও
সামাজিক অধ্যায় বরাবরই আবদ্ধ থেকেছে উপজাতিদের সঙ্গে সমতলের বাঙালির
টানাপোড়েনে। একটা সময় পর্যন্ত নিরন্তর সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়েছে রাজ্যটি।
সিপিএম সেই দুশ্চিন্তার দিনগুলোর মোকাবিলা করেছে শক্ত হাতে। উপজাতিদের
মধ্যে গড়ে তুলেছে সংগঠন। তখন থেকেই রাজ্যে বামপন্থীদের প্রতিপক্ষ কংগ্রেস।
উপজাতিদের নিজস্ব কিছু দল ছাড়া তৃতীয় কোনো শক্তির উপস্থিতি সেখানে ছিল না।
বিজেপি সেই অর্থে ত্রিপুরায় নিতান্তই আনকোরা। তিন বছর আগে আরএসএসের প্রচারক
সুনীল দেওধরকে বিজেপি যখন ‘মিশন ত্রিপুরা’ সফল করতে আগরতলায় পাঠায়, তখনো
কেউ তাঁর অভিযানকে নেক নজরে নেয়নি। কেনই বা নেবে? পাঁচ বছর আগে তাদের
প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল দেড় শতাংশ! একজন ছাড়া সব প্রার্থীর জামানত জব্দ
হয়েছিল! কোন ভরসায় তাহলে কোমর বেঁধেছিলেন সুনীল দেওধরেরা? তাঁদের ভরসা ছিল
রাজ্যের ৫০ শতাংশ বামবিরোধী ভোট এবং উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত কুড়িটি আসন।
এই বামবিরোধী ভোট, যা কিনা প্রধানত ঘোরাফেরা করত কংগ্রেসের বিভিন্ন গোষ্ঠীর
মধ্যে, যে দলটা সর্বভারতীয় বাধ্যবাধকতার দরুন বামপন্থীদের কখনো প্রতিপক্ষ
বলে ভাবতে পারেনি, বরং তাদের সাহায্য নিয়ে বিজেপিকে তফাতে রাখতে চেয়েছে,
বিজেপি তাদের দিকেই প্রথম হাত বাড়ায়। রাজ্য কংগ্রেসিরা তত দিনে মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হয়ে আশাহত। তৃণমূল কংগ্রেস থেকে তাদের সরিয়ে
বিজেপির দিকে টেনে আনার কাজটা সুনীল দেওধরেরা করে ফেলেন আসামের সাবেক
কংগ্রেসি ও বিজেপির মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে দিয়ে। দেড় শতাংশ থেকে এক
লাফে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার এই যে ৪৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারল, তা
কংগ্রেসেরই দান। এই প্রথম রাজ্যের বামবিরোধী ভোটকে বিজেপি তার
বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়ে একজোট করতে পারল, যা কংগ্রেস তার সর্বভারতীয়
বাধ্যবাধকতার দরুন কখনো করতে পারেনি। উপজাতিদের মধ্যে আরএসএস কাজ করছে
বহুদিন। আর্যাবর্তের রাজ্যে রাজ্যে রয়েছে সেই নিদর্শন।
সুনীল দেওধরদের কাছে
তাই ত্রিপুরার উপজাতিদের মধ্যে মিশে যাওয়াটা ছিল পানির মধ্যে মাছের সাঁতার
কাটার মতো সহজ। তিন বছরের মধ্যেই তিনি উপজাতিদের ‘ককবরক’ ভাষা যেমন রপ্ত
করে ফেললেন, তেমনি শিখে ফেললেন সমতলের ভাষা বাংলা। সেই সঙ্গে তাঁরা খেলে
ফেললেন চমৎকার এক ফাটকা। ত্রিপুরার উপজাতিদের স্বাধীন রাজ্য গঠনের
আকাঙ্ক্ষা এখন নিবু নিবু। বিজেপির ফাটকা সেই মানসিকতা নিয়ে। ‘ইনডিজেনাস
পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা’ বা সংক্ষেপে ‘আইপিএফটি’র সঙ্গে বিজেপি নির্বাচনী
জোট করে ফেলে এটা জেনেই যে তারা স্বাধীন ‘তুইপ্রাল্যান্ড’-এর দাবি থেকে
এখনো সরেনি। এটা ছিল মারাত্মক একটা ঝুঁকি। কেননা, সমতলের বাঙালিদের সঙ্গে
উপজাতিদের বিরোধের মূল কারণই রাজ্যভাগের ওই দাবি। সিপিএমও একটা সময় ধরেই
নিয়েছিল, ওই জোটই তাদের আরও একবার তরিয়ে দেবে। সমতলের বাঙালিদের ভোটে জিতে
তারা গড়বে ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু দেশবাসী অবাক হয়ে দেখল, মোদির
বিজেপি বাঘ-গরুকে এক ঘাটে পানি খাওয়াল। দেখা গেল এক অসাধারণ ব্যালান্সের
খেলা! বিজেপির প্রচারে বড়ভাবে উঠে এসেছিল ‘এক ত্রিপুরা, ঐক্যবদ্ধ
ত্রিপুরা’র স্লোগান। রাজ্যভাগ না করার কথাও তারা বারবার বলে এসেছে। অথচ এ
কথা তারা কখনো বলেনি যে শরিক দলের এই দাবি তারা অগ্রাহ্য করছে। আইপিএফটির
পতাকা, টুপি, টি-শার্ট বা ব্যাজে স্বাধীন তুইপ্রাল্যান্ডের ম্যাপ জ্বলজ্বল
করলেও বিজেপি তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এই অনুচ্চার অবস্থান উপজাতিদের
জন্য সংরক্ষিত আসনগুলোতে সমর্থনের বান বইয়েছে। ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিয়েছে
সিপিএমের এত দিনের আধিপত্য ও অহংকার। পাশাপাশি আদায় করেছে সমতলের বিপুল
সমর্থন। ব্যালান্সের এমন চমৎকার খেলা ত্রিপুরাবাসী আগে দেখেনি। কী করে এই
অসম্ভব সম্ভব হলো? অনেক কারণের একটা হলো সিপিএমের ঢঙেই তাদের মোকাবিলা।
দুটিই ক্যাডার ও সংগঠনভিত্তিক দল। সুনীল দেওধর রাজ্যে এসে গড়ে তোলেন যুব,
ছাত্র, নারী, আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠন। সিপিএমের ‘হোলটাইমার’দের মতোই গোটা
রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সংঘের প্রচারকদের। এমনকি রেল প্রচারকও নিয়োগ করে
তারা, যাদের কাজ ছিল ট্রেনে ট্রেনে প্রচারের মাধ্যমে ভোটারদের ‘ডেটাবেইস’
তৈরি করা। এভাবে ভোটের এক মাস আগে বিজেপি রাজ্যের সর্বত্র ‘বুথ কমিটি’ গড়ে
ফেলে। একটা দিনও এই তিন বছরে কাটেনি, যেদিন রাজ্যের কোথাও না কোথাও কেউ না
কেউ বিজেপি ও মোদি-মাহাত্ম্য প্রচার করেনি। দ্বিতীয় কারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি ও
দরিদ্রদের দুটো স্বপ্ন দেখানো। সোয়া দুই লাখ রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের
জন্য সপ্তম বেতন কমিশন চালু এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের জন্য ১০০
দিনের কাজের মজুরি দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি। চতুর্থ বেতন কমিশন অনুযায়ী
মাইনে পাওয়া রাজ্য সরকারি কর্মীরা এই এক প্রতিশ্রুতিতেই যে বাম শিবির ছেড়ে
বিজেপিকে বরণ করে নিয়েছে, ভোটের ফল বেরোনোর পর তা স্পষ্ট। তৃতীয় কারণ,
তিরিশের নিচে যাঁদের বয়স, তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের উদ্যোগ। গোটা রাজ্যে
বিজেপির সভা-সমাবেশ ও মিছিলে তারুণ্যের যে জোয়ার দেখেছি, তাতে স্পষ্ট,
মানিক সরকারেরা এই প্রজন্মের চাহিদা ও স্বপ্নকে ধরতে পারেননি।
দল ও সরকার
চালানোর বস্তাপচা ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে নিজেদের আধুনিক করে গড়ে তুলতে
পারেননি। গেল নির্বচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৬ শতাংশ ভোট। আসন পেয়েছিল ১০ টি।
বাকি ৫০টি ছিল বামদের। সেই বামেরা এবার চাতক পাখির দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল
কংগ্রেসের দিকে। অবস্থা যে কী করুণ, তা মালুম হয়েছিল ভোটের চার দিন আগে।
আগরতলায় সিপিএমের পার্টি অফিসে বসে দলের শীর্ষ নেতা গৌতম দাস বলেছিলেন,
‘কংগ্রেস কি চার-পাঁচ পার্সেন্ট ভোটও পাবে না? এ-ও হয় নাকি? ওটুকু পেলেই
যথেষ্ট।’ সেদিনই বোঝা গিয়েছিল লাল পার্টির হাল কতটা করুণ। কংগ্রেস পেয়েছে
ঠিক ততটা, পাঁচ বছর আগে যা ছিল বিজেপির ভোট শেয়ার। দেড় শতাংশ!
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী কিংবা চট্টগ্রামের মানুষজনকে বলতে
শুনেছি, আগরতলায় উঁচু মানের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থাকলে তাঁদের কলকাতা
বা দিল্লি কিংবা ভেলোরে যেতে হতো না। ডিমান্ড ও সাপ্লাইয়ের এই সহজ কথাটা
সিপিএম বুঝতে চায়নি। এত চমৎকার এক রাজ্যকে পর্যটন ম্যাপে নিয়ে আসার তেমন
চেষ্টাও তারা করেনি। রাজ্য থেকে প্রতিবছর যে মেয়েরা নার্সিং পাস করে, তাদের
ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় বেঙ্গালুরুতে। কেন ত্রিপুরাতেই সেই প্রশিক্ষণের
বন্দোবস্ত করা যায় না, তার সদুত্তর সিপিএমের নেতারা দিতে পারেননি। কেমন
যেন গয়ংগচ্ছ মনোভাবে গা এলিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল তাঁদের। অথচ সুনীল
দেওধরদের দেখেছিলাম টগবগে! গুজরাট, রাজস্থান ও সদ্য মধ্যপ্রদেশের
উপনির্বাচনের পর চনমনে কংগ্রেস ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়ের ফলে যতটা
হতাশ, ঠিক ততটাই উজ্জীবিত বিজেপি। অমিত শাহ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের রেডারে
এখন জ্বলজ্বল করছে কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ। দুশ্চিন্তার কালো মেঘ দেখতে
পাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পূর্ব প্রান্তে বিজেপির বিজয়রথ ঠেকানোর বড়
দায় এখন তাঁরই। সুনীল দেওধর বলেছেন, ‘ত্রিপুরা আজ থেকে অতীত। নেতাদের বলব,
এবার আমাকে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দেওয়া হোক।’
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি
No comments