উগ্রপন্থা ও আমাদের রাজনীতি by সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া ও সফিউল আযম
ড.
মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার চিন্তা, মতামত, আদর্শিক অবস্থানের কারণে আক্রান্ত।
বাংলাদেশে কবি-সাহিত্যিক-লেখকদের ওপর গুপ্ত হামলা গত কয়েক দশকের প্রপঞ্চ।
লক্ষণীয়, ’৯০-পরবর্তী এই কয়েক দশক আবার বাংলাদেশের গণতন্ত্রেরও দ্বিতীয়
পর্যায়। কেন, কোন পরিস্থিতিতে একটা গণতন্ত্রে পরমতসহিষ্ণুতার বদলে
চরমপন্থার বিকাশ ঘটেছে তার একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এর আগে অধ্যাপক
হুমায়ুন আজাদ তার নিজ ক্যাম্পাসে প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ
করেন। প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের বাসায় বোমা হামলা হয়েছিল। ড. জাফর ইকবাল
বহুদিন একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রপাগান্ডা, অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন এবং
তার ওপর হামলার একাধিক চেষ্টাও হয়েছে। বর্তমান হামলাটির পেছনেও সেই গোষ্ঠীর
মদদ বা হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করি। দেশে বুদ্ধিজীবী-লেখকরা যেসব হামলার
শিকার হয়েছেন, মোটাদাগে তার একটা প্যাটার্ন আছে। উগ্রবাদী গোষ্ঠীর আক্রোশের
শিকার লিবারেল ঘরানার অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ব্যক্তিরাই এ ধরনের
প্রাণঘাতী হামলার বড় শিকার। আমাদের জানা নেই রক্ষণশীল কোনো লেখক-বুদ্ধিজীবী
গত কয়েক দশকে গুপ্ত হামলার শিকার হয়েছেন কি-না। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও
আদর্শিক অবস্থান, লেখালেখির কারণে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী
ধারাবাহিকভাবে গুপ্ত হামলার শিকার হন, সে ক্ষেত্রে স্পষ্ট যে আমাদের
রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ডে উগ্রপন্থার অবস্থান মূল্যায়ন ও তা মোকাবেলায়
পরিশীলিত চিন্তার ঘাটতি রয়েছে। যারা রক্ষণশীলতার রাজনীতি করেন, তাদেরও
আত্মপর্যালোচনার সময় এসেছে- তাদের রাজনীতির পরতে পরতে যে উগ্রতা ও
সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে এবং এর গর্ভে যে অসহিষ্ণুতার জন্ম হয় তার পরিণতিতেই
কি অনেক গুপ্তঘাতক তৈরি হয়, যাদের কাছে হুমায়ুন আজাদ কিংবা জাফর ইকবালের
মতো লেখকদের জীবন বিপন্ন? বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের গভীরতা বুঝতে
হলে এই উগ্রপন্থার রাজনীতি ও তার ঝুঁকিও বুঝতে হবে। আমাদের ধর্মীয় ও
ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো মডারেশন, আত্মপর্যালোচনা হয়েছে এরূপ নজির
দেখা যায় না। রাজনীতি যখন ধর্ম, উগ্র জাতীয়তাবাদ- এসবের পঙ্কিল আবর্তে পড়ে
তখন মুক্ত স্পেস কমে যায় এবং লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকরাই এর বেশি শিকার হন।
অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, বর্তমান সার্বিক রাজনৈতিক সংকটের পেছনে উগ্রবাদী,
চরমপন্থী রাজনীতি ও তাদের সহিংস কর্মকাণ্ড দায়ী। বাঙালি ও বাংলার রাজনীতির
গত দু’শ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এখানে উগ্রবাদী বা
চরমপন্থী রাজনীতির অস্তিত্ব শুরু থেকেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে
তাদের অবস্থান কখনোই মূলধারায় পর্যবসিত হয়নি, বরং প্রান্তিক হয়ে তারা টিকে
ছিল। এখানে মধ্যপন্থাই মূলধারার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যারা উগ্রবাদ
ও চরমপন্থার রাজনীতি করেন তারা ইতিহাসের এই পাঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের
সংকীর্ণ মত ও পথকে সংশোধন না করলে তারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে। যারা
মধ্যপন্থী রাজনীতি করেন তাদেরও উপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে। যদি কোনো মধ্যপন্থী
দল সাময়িক লাভের আশায় নিজেদের শক্তিমত্তার স্থান ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে
বিবেচনায় না নিয়ে ক্রমশ বামে বা ডানে সরে গিয়ে চরমপন্থী অবস্থান নেন এবং
সাময়িক রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকেন, দিন শেষে তাদের স্থানও ইতিহাসের
আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ডানে বা বাঁয়ে যারাই ঘৃণা চর্চা করে সমাজটাকে
অসহিষ্ণু করে তুলছেন, তাদেরকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মোকাবেলা করা আশু
কর্তব্য। মনে রাখা দরকার, কাজটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বেশি
কিছু এবং কোনো শক্তিশালী বাহিনী দিয়ে এ রোগের নিরাময় সম্ভব নয়। গণমানুষের
প্রতিরোধ ও প্রত্যাখ্যান এর সবচেয়ে বড় দাওয়াই এবং সে লক্ষ্যে মূলধারার সব
রাজনৈতিক পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া : জ্যেষ্ঠ গবেষক ও শিক্ষক, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও সফিউল আযম : এডিটর ইন চিফ, ইয়ুথ জার্নাল
সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া : জ্যেষ্ঠ গবেষক ও শিক্ষক, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও সফিউল আযম : এডিটর ইন চিফ, ইয়ুথ জার্নাল
No comments