ত্বকী হত্যা নয় চাই সুস্থ মানবিক সমাজ by আহমদ রফিক
এক
উজ্জ্বলমুখ মেধাবী কিশোর, নাম তার তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ত্বকী পড়াশোনায়
অসাধারণ, বয়স মাত্র সতেরো, আঠারোতে পা দেবে, কিন্তু সুকান্তর স্পর্ধিত
আঠারোতে পা রাখা হলো না তার। ফাল্গুনের (৬ই মার্চ, ২০১৩) এক বিকালে অপহরণের
শিকার ত্বকী, শেষ পর্যন্ত অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সে রাতেই তার
মৃত্যু। জন্ম যদিও ১৯৯৫-এর ৫ই অক্টোবরে।
ত্বকী এ বয়সেই কবিতা লিখেছে, সমাজ-সচেতন, সমাজ-প্রগতির কবিতা। সুস্থ সমাজ ও সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্নে ভরা প্রাণ নিয়ে। অবিশ্বাস্য মিল খুঁজে পেয়েছেন ত্বকীর শোকে বেদনাহত লেখকগণ অমর ‘কবি কিশোর’ সুকান্তের সঙ্গে। ত্বকীর কবিতা উদ্ধার করে তারা তুলনামূলক বিচারে নিবন্ধ রচনা করেছেন। ত্বকীর পিতা প্রগতিশীল রাজনীতিক রফিউর রাব্বির প্রতি সমবেদনায় কাতর হয়ে এবং ত্বকীর মা রওনক রেহানার গভীর পুত্রশোকে সান্ত্বনার কয়েকটি পাপড়ি ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু এ শোকের কি সান্ত্বনা আছে?
সান্ত্বনা না থাকার অন্তত একটি কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘ত্বকীর জন্মদিনে শুভ কামনা’ শীর্ষক একটি ছোট্ট লেখায়। লেখাটি ত্বকীর মায়ের। শোকাহত মায়ের আক্ষেপ : ‘ত্বকীর মৃত্যুর দেড় বছর অতিবাহিত হলো, অপরাধীরা চিহ্নিত হলো, তারপরও অপরাধীরা ধরা পড়ল না, অভিযোগপত্র দেয়া হলো না, সব কিছু জানার পরও সরকার অপরাধীদের পক্ষ নেয়, এটা কী করে সম্ভব। আমরা কি এমনই রাষ্ট্র চেয়েছিলাম? এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ?’ (প্রথম আলো, ৫.১০.২০১৪)। এ আর্তির কি কোনো সান্ত্বনা হয়?
ত্বকী হত্যার বর্বরতা সমাজকে এতটা স্পর্শ করেছিল যে সংবাদপত্র মহল বিচলিত বোধ করেছিল। নিষ্পাপ এ কিশোরের প্রতি সমবেদনার প্রকাশ ঘটান দেশের একাধিক খ্যাতিমান লেখক। সবাই চেয়েছেন নিরপেক্ষ তদন্ত ও খুনির বিচার এবং যথাযথ শাস্তি। চেয়েছেন নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভি এবং স্থানীয় বিশিষ্টজন অনেকে। রাজধানী ঢাকা থেকেও অনুরূপ প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে।
একটি দৈনিকে এমন শিরোনামও প্রকাশ পেয়েছিল যে ‘বহুল আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের খুনিরা শনাক্ত হয়েছে। ...ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছেন র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত চার্জশিট আদালতে পেশ করা হবে’ (৬.৩.২০১৪)। আমরা তখন লিখেছিলাম: ‘তদন্তের দায়িত্ব শুরুতেই র্যাবের হাতে দেয়া উচিত ছিল। ...আমরা আশা করবো, বাকি প্রক্রিয়া যেন নিয়ম মেনে দ্রুত সম্পন্ন হয়। একজন বেদনার্ত পিতা আর কতদিন সন্তান হত্যার মতো নিষ্ঠুর ঘটনার গুরুভার বুকে বহন করবেন’ (১৩.৩.২০১৪)।
হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। আমরা জানি না এ মামলার সর্বশেষ অবস্থা। সময় এমনই এক শক্তি যা তীব্র আলোড়ন বা আঘাতের প্রতিক্রিয়াও স্তিমিত করে আনে। সান্ত্বনা বা বিস্মৃতির বালি জমা হতে থাকে ঘটনার ওপর। শুধু পিতামাতা বা অতি নিকটজনেই সে ক্ষত ক্রমাগত রক্ত ঝরাতে থাকে। তাদের অপেক্ষা সন্তানের অবর্তমানে তার ওপর সংঘটিত অপরাধের সুবিচার। প্রশ্ন, এজন্য আর কতদিন তাদের অপেক্ষা করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের সুস্থ চিন্তার মানুষ উদ্বিগ্ন এ মামলা নিয়ে, ঘটনা নিয়ে। ত্বকী যদিও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না, তবু রাজনীতির কারণে তাকে প্রাণ দিতে হলো। এমন রাজনীতিকে কি গ্রহণ করা বা মেনে নেয়া যায়? সে রাজনীতির ধারক-বাহক যত বড় মাপের হোক না কেন। এ ক্ষেত্রে দরকার রাজনৈতিক সুবিচার, সুশাসনের সুবিচার। জানি না প্রয়াত ত্বকীর ভাগ্যে কী জুটবে।
আমাদের প্রত্যাশা ত্বকী সুবিচার পাবে। কারণ, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সংঘটিত গুম, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনেক অভিযোগ, অনেক সমালোচনা দেশের শুদ্ধ ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এসব বন্ধের জন্য নতুন আইনি ব্যবস্থা কি নেয়া যায় না? এসব মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো কি একান্তই অসম্ভব? এসব অপরাধের দ্রুত কঠোর শাস্তি হলে নতুন নতুন ত্বকীকে অহেতুক প্রাণ দিতে হতো না, অথবা গুম, হত্যা অনেকাংশে হ্রাস পেতো।
আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের কেউ কেউ তো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে রুল জারি করেছেন। প্রশংসনীয় ছিল সেসব উদ্যোগ। তাদের কেউ কি পারেন না ত্বকী হত্যার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে জনস্বার্থে এ জাতীয় রুল জারি করতে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, নাগরিক স্বার্থে? কারণ এ দেশের সমাজ এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে যে সে তার বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, সুস্থ মানবিক মূল্যবোধ তো অনেক আগেই সমাজ থেকে উধাও হয়ে গেছে।
এ ধরনের দাবির আরেকটি কারণ বাংলাদেশে বেশ কিছু সংখ্যক অপ্রত্যাশিত হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি, বিচার তো পরের কথা। যেমন সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড। অনুদ্ঘাটিত এ হত্যারহস্য নিয়ে সাংবাদিকগণ দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের প্রতিবাদ করেছেন, বলতে হয়, কী না করেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এ ঘটনা নিয়ে এতদিন পরও সংবাদপত্র প্রতিবেদন ছাপছে। যেমন একটির শিরোনাম : ‘গ্রিল না দরজা /কোনটি সত্য?’ (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।
দীর্ঘ এ প্রতিবেদনে সাবেক এক তদন্ত কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বেশ কিছু তথ্য সূত্রের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যাতে মনে হয়, রহস্যজনক এ হত্যাকাণ্ডের সমাধান সম্ভব। সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে এ জোড়া হত্যাকাণ্ডও চরিত্রধর্মে বোধ হয় রাজনৈতিক। তা না হলে আমাদের তুখোড় গোয়েন্দাদের হাতে রহস্য উদ্ঘাটিত হবে না কেন।
এ ঘটনা যদি রাজনৈতিক না হয়, তাহলেও ধরে নিতে হবে এর পেছনে সমাজের এমন প্রভাবশাী মহলের হাত রয়েছে যার ফলে এর সমাধান কোনোদিনই দেখা যাবে না।
এমন একাধিক ঘটনা আমাদের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে রয়েছে; বিশেষ করে একাধিক সাংবাদিক হত্যার ঘটনায়। আর সে মানুষ যদি পরিচিত কেউ হন তাহলে বেদনা বিশেষ মাত্রা যায়। যেমন যশোরের স্বনামখ্যাত সাংবাদিক শামছুর রহমান হত্যাকাণ্ড। চোরাচালানি সমাজবিরোধী চক্রের হাতে প্রাণ দেয়া সত্ত্বেও সে রহস্যের কিনারা হলো না কেন? এটা কি যুক্তিসঙ্গত বলে মেনে নেয়া যাবে? না কি এখানেও নেপথ্যে রয়েছে কোনো প্রবল প্রতাপশালী হাত?
যেমনটি কানাঘুষা ও গুঞ্জন রয়েছে নারায়ণগঞ্জে, সমাজের এক মহলে। একমাত্র সুবিচারই এ ধরনের বর্বরতা ও হত্যাকাণ্ডের রাশ টেনে ধরতে পারে। আমরা চাই না নতুন কোনো ত্বকী হত্যাকাণ্ড, চাই না নতুন কোনো মা-বাবার অসহ মানসিক যন্ত্রণা। সেক্ষেত্রে দক্ষ প্রশাসনই পারে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে।
এজন্য আরো দরকার সামাজটাকে শুদ্ধ, মানবিকবোধসম্পন্ন করে তোলা। আর সেক্ষেত্রে দায় শুধু সরকার ও প্রশাসনেরই নয়, দায় সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিরও। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে উচ্চারিত হওয়া উচিত সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ। কিন্তু আমাদের সমাজ সে মাত্রায় সক্রিয় নয়। কেন নয় সেটি এক মস্তবড় প্রশ্ন।
যে দেশের মানুষ একদা হন্তারকদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যুদ্ধে নামতে দ্বিধা করেনি, সেদেশের সমাজের এমন দুরবস্থা কেন হবে যে সে সত্যের পক্ষে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হবে না? এটাও তো আরো বড় প্রশ্ন। এখানেও কি রাজনৈতিক কারণ ক্রিয়াশীল? না কি নিছক উদাসীনতা। সমাজ সুস্থ না হলে সুস্থ রাজনীতির বিকাশ ঘটে না, আবার এর বিপরীতটাও সমান সত্য।
আমরা এ জাতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। দেখতে চাই না রক্তঝরার প্রক্রিয়া, অনৈতিক অবৈধ কর্মকাণ্ড। দেখতে চাই না বহুকথিত ‘গডফাদার’ পরিচালিত বাংলাদেশের সমাজ। চাই আধুনিক চেতনার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ। সুস্থ সমাজ। মানবিকবোধের সমাজ।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, লেখক ও গবেষক
ত্বকী এ বয়সেই কবিতা লিখেছে, সমাজ-সচেতন, সমাজ-প্রগতির কবিতা। সুস্থ সমাজ ও সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্নে ভরা প্রাণ নিয়ে। অবিশ্বাস্য মিল খুঁজে পেয়েছেন ত্বকীর শোকে বেদনাহত লেখকগণ অমর ‘কবি কিশোর’ সুকান্তের সঙ্গে। ত্বকীর কবিতা উদ্ধার করে তারা তুলনামূলক বিচারে নিবন্ধ রচনা করেছেন। ত্বকীর পিতা প্রগতিশীল রাজনীতিক রফিউর রাব্বির প্রতি সমবেদনায় কাতর হয়ে এবং ত্বকীর মা রওনক রেহানার গভীর পুত্রশোকে সান্ত্বনার কয়েকটি পাপড়ি ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু এ শোকের কি সান্ত্বনা আছে?
সান্ত্বনা না থাকার অন্তত একটি কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘ত্বকীর জন্মদিনে শুভ কামনা’ শীর্ষক একটি ছোট্ট লেখায়। লেখাটি ত্বকীর মায়ের। শোকাহত মায়ের আক্ষেপ : ‘ত্বকীর মৃত্যুর দেড় বছর অতিবাহিত হলো, অপরাধীরা চিহ্নিত হলো, তারপরও অপরাধীরা ধরা পড়ল না, অভিযোগপত্র দেয়া হলো না, সব কিছু জানার পরও সরকার অপরাধীদের পক্ষ নেয়, এটা কী করে সম্ভব। আমরা কি এমনই রাষ্ট্র চেয়েছিলাম? এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ?’ (প্রথম আলো, ৫.১০.২০১৪)। এ আর্তির কি কোনো সান্ত্বনা হয়?
ত্বকী হত্যার বর্বরতা সমাজকে এতটা স্পর্শ করেছিল যে সংবাদপত্র মহল বিচলিত বোধ করেছিল। নিষ্পাপ এ কিশোরের প্রতি সমবেদনার প্রকাশ ঘটান দেশের একাধিক খ্যাতিমান লেখক। সবাই চেয়েছেন নিরপেক্ষ তদন্ত ও খুনির বিচার এবং যথাযথ শাস্তি। চেয়েছেন নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভি এবং স্থানীয় বিশিষ্টজন অনেকে। রাজধানী ঢাকা থেকেও অনুরূপ প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে।
একটি দৈনিকে এমন শিরোনামও প্রকাশ পেয়েছিল যে ‘বহুল আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের খুনিরা শনাক্ত হয়েছে। ...ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছেন র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত চার্জশিট আদালতে পেশ করা হবে’ (৬.৩.২০১৪)। আমরা তখন লিখেছিলাম: ‘তদন্তের দায়িত্ব শুরুতেই র্যাবের হাতে দেয়া উচিত ছিল। ...আমরা আশা করবো, বাকি প্রক্রিয়া যেন নিয়ম মেনে দ্রুত সম্পন্ন হয়। একজন বেদনার্ত পিতা আর কতদিন সন্তান হত্যার মতো নিষ্ঠুর ঘটনার গুরুভার বুকে বহন করবেন’ (১৩.৩.২০১৪)।
হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। আমরা জানি না এ মামলার সর্বশেষ অবস্থা। সময় এমনই এক শক্তি যা তীব্র আলোড়ন বা আঘাতের প্রতিক্রিয়াও স্তিমিত করে আনে। সান্ত্বনা বা বিস্মৃতির বালি জমা হতে থাকে ঘটনার ওপর। শুধু পিতামাতা বা অতি নিকটজনেই সে ক্ষত ক্রমাগত রক্ত ঝরাতে থাকে। তাদের অপেক্ষা সন্তানের অবর্তমানে তার ওপর সংঘটিত অপরাধের সুবিচার। প্রশ্ন, এজন্য আর কতদিন তাদের অপেক্ষা করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের সুস্থ চিন্তার মানুষ উদ্বিগ্ন এ মামলা নিয়ে, ঘটনা নিয়ে। ত্বকী যদিও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না, তবু রাজনীতির কারণে তাকে প্রাণ দিতে হলো। এমন রাজনীতিকে কি গ্রহণ করা বা মেনে নেয়া যায়? সে রাজনীতির ধারক-বাহক যত বড় মাপের হোক না কেন। এ ক্ষেত্রে দরকার রাজনৈতিক সুবিচার, সুশাসনের সুবিচার। জানি না প্রয়াত ত্বকীর ভাগ্যে কী জুটবে।
আমাদের প্রত্যাশা ত্বকী সুবিচার পাবে। কারণ, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সংঘটিত গুম, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনেক অভিযোগ, অনেক সমালোচনা দেশের শুদ্ধ ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এসব বন্ধের জন্য নতুন আইনি ব্যবস্থা কি নেয়া যায় না? এসব মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো কি একান্তই অসম্ভব? এসব অপরাধের দ্রুত কঠোর শাস্তি হলে নতুন নতুন ত্বকীকে অহেতুক প্রাণ দিতে হতো না, অথবা গুম, হত্যা অনেকাংশে হ্রাস পেতো।
আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের কেউ কেউ তো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে রুল জারি করেছেন। প্রশংসনীয় ছিল সেসব উদ্যোগ। তাদের কেউ কি পারেন না ত্বকী হত্যার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে জনস্বার্থে এ জাতীয় রুল জারি করতে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, নাগরিক স্বার্থে? কারণ এ দেশের সমাজ এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে যে সে তার বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, সুস্থ মানবিক মূল্যবোধ তো অনেক আগেই সমাজ থেকে উধাও হয়ে গেছে।
এ ধরনের দাবির আরেকটি কারণ বাংলাদেশে বেশ কিছু সংখ্যক অপ্রত্যাশিত হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি, বিচার তো পরের কথা। যেমন সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড। অনুদ্ঘাটিত এ হত্যারহস্য নিয়ে সাংবাদিকগণ দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের প্রতিবাদ করেছেন, বলতে হয়, কী না করেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এ ঘটনা নিয়ে এতদিন পরও সংবাদপত্র প্রতিবেদন ছাপছে। যেমন একটির শিরোনাম : ‘গ্রিল না দরজা /কোনটি সত্য?’ (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।
দীর্ঘ এ প্রতিবেদনে সাবেক এক তদন্ত কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বেশ কিছু তথ্য সূত্রের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যাতে মনে হয়, রহস্যজনক এ হত্যাকাণ্ডের সমাধান সম্ভব। সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে এ জোড়া হত্যাকাণ্ডও চরিত্রধর্মে বোধ হয় রাজনৈতিক। তা না হলে আমাদের তুখোড় গোয়েন্দাদের হাতে রহস্য উদ্ঘাটিত হবে না কেন।
এ ঘটনা যদি রাজনৈতিক না হয়, তাহলেও ধরে নিতে হবে এর পেছনে সমাজের এমন প্রভাবশাী মহলের হাত রয়েছে যার ফলে এর সমাধান কোনোদিনই দেখা যাবে না।
এমন একাধিক ঘটনা আমাদের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে রয়েছে; বিশেষ করে একাধিক সাংবাদিক হত্যার ঘটনায়। আর সে মানুষ যদি পরিচিত কেউ হন তাহলে বেদনা বিশেষ মাত্রা যায়। যেমন যশোরের স্বনামখ্যাত সাংবাদিক শামছুর রহমান হত্যাকাণ্ড। চোরাচালানি সমাজবিরোধী চক্রের হাতে প্রাণ দেয়া সত্ত্বেও সে রহস্যের কিনারা হলো না কেন? এটা কি যুক্তিসঙ্গত বলে মেনে নেয়া যাবে? না কি এখানেও নেপথ্যে রয়েছে কোনো প্রবল প্রতাপশালী হাত?
যেমনটি কানাঘুষা ও গুঞ্জন রয়েছে নারায়ণগঞ্জে, সমাজের এক মহলে। একমাত্র সুবিচারই এ ধরনের বর্বরতা ও হত্যাকাণ্ডের রাশ টেনে ধরতে পারে। আমরা চাই না নতুন কোনো ত্বকী হত্যাকাণ্ড, চাই না নতুন কোনো মা-বাবার অসহ মানসিক যন্ত্রণা। সেক্ষেত্রে দক্ষ প্রশাসনই পারে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে।
এজন্য আরো দরকার সামাজটাকে শুদ্ধ, মানবিকবোধসম্পন্ন করে তোলা। আর সেক্ষেত্রে দায় শুধু সরকার ও প্রশাসনেরই নয়, দায় সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিরও। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে উচ্চারিত হওয়া উচিত সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ। কিন্তু আমাদের সমাজ সে মাত্রায় সক্রিয় নয়। কেন নয় সেটি এক মস্তবড় প্রশ্ন।
যে দেশের মানুষ একদা হন্তারকদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যুদ্ধে নামতে দ্বিধা করেনি, সেদেশের সমাজের এমন দুরবস্থা কেন হবে যে সে সত্যের পক্ষে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হবে না? এটাও তো আরো বড় প্রশ্ন। এখানেও কি রাজনৈতিক কারণ ক্রিয়াশীল? না কি নিছক উদাসীনতা। সমাজ সুস্থ না হলে সুস্থ রাজনীতির বিকাশ ঘটে না, আবার এর বিপরীতটাও সমান সত্য।
আমরা এ জাতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। দেখতে চাই না রক্তঝরার প্রক্রিয়া, অনৈতিক অবৈধ কর্মকাণ্ড। দেখতে চাই না বহুকথিত ‘গডফাদার’ পরিচালিত বাংলাদেশের সমাজ। চাই আধুনিক চেতনার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ। সুস্থ সমাজ। মানবিকবোধের সমাজ।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, লেখক ও গবেষক
No comments