ত্বকীর কাছে আমাদের দায় by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
তানভীর
মুহাম্মদ ত্বকী নামটা এখন সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত। তার
নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে দেশবাসী গত ৫ বছর ধরে সংগ্রাম
করছে। দেশের ক্ষমতাসীন শক্তির ঘনিষ্ঠ ও মদদপুষ্ট খুবই প্রভাবশালী একটি মহল
এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সে কারণেই হত্যাকাণ্ডের
বিচার বিলম্বিত হচ্ছে বলে দেশবাসীর বিশ্বাস। এসব কারণে ত্বকী হত্যাকাণ্ড
একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা হিসেবে সবাইকে আলোড়িত করে চলেছে। সাড়া জাগানো এই
আন্দোলনকে জাগিয়ে রাখতে হবে ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না ত্বকী হত্যাকাণ্ডের
বিচার সুসম্পন্ন হয়। মেধাবী ও স্বপ্নবান কিশোর ত্বকীর মৃত্যুর চেয়ে তার
স্বল্পকালের জীবন কম চাঞ্চল্যকর ও সম্ভাবনাময় ছিল না। ধারণা করা অমূলক নয়
যে, তার চাঞ্চল্যকর অকালমৃত্যুর মধ্য দিয়ে নয়, তার জীবনের জন্যই একসময় সে
সারাদেশে অবশ্যই পরিচিতি পেত। কিন্তু প্রস্টম্ফুটিত হওয়ার আগেই ফুলটা ঝরে
গেল! একটা সম্ভাবনাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। ১৭ বছরের এই দুর্দান্ত
কিশোর সমাজ ও রাষ্ট্রকে কতক গুরুতর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
তার এভাবে চলে যাওয়ার দায় আমরা কিছুতেই এড়াতে পারি না। প্রগতিশীল
সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কর্মী ত্বকীর জীবন-ভাবনা ছিল বেশ
স্পষ্ট। তার লেখায়, কবিতায় তার প্রগতিশীল চিন্তা ফুটে ওঠে। সাম্যের সমাজের
স্বপ্ন দেখত সে। 'সাম্য' কবিতায় সে লিখেছে, 'ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে/
জ্ঞান-প্রীতির আলো,/ থাকবে না হিংসা বিদ্বেষ/ মানুষে সাম্য হবে/ সকলেই এক
হবে/সকলের জ্ঞান হবে/ আকাশ চূড়ায়।' শান্ত ও অনেকটা অন্তর্মুখী স্বভাবের
ত্বকী ছবি আঁকত, গান গাইত। বই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। মৃত্যুর পর মেধাবী এই
তরুণের 'এ' লেভেল পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। পদার্থবিদ্যায় বিশ্বের মধ্যে
সর্বোচ্চ নম্বর ও রসায়নে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পায় সে। কিন্তু
পাঠ্যবইয়ে ডুব দিয়ে থাকেনি সে, প্রগতিশীল সাহিত্যের সঙ্গে ছিল তার দৈনন্দিন
যোগাযোগ। সত্যিকারের মানুষ হতে চেয়েছিল সে। আত্মসর্বস্ব প্রতিষ্ঠা নয়,
সবাইকে নিয়ে উন্নত, মানবিক সমাজ গড়তে চেয়েছে। সে তার কবিতায় মাথা উঁচু করে
দাঁড়ানোর কথা বলেছে। সত্যিকারের মানুষ হতে সে নিয়মিত নারায়ণগঞ্জের সুধীজন
পাঠাগারে যেত। সন্ত্রাসীরা যখন তাকে অপহরণ করে, তখন সে সুধীজন পাঠাগারে
যাচ্ছিল। ত্বকীর হত্যাকাণ্ড ছিল নির্মম, বীভৎস। তার সুন্দর চোখ দুটি থেঁতলে
দেওয়া হয়েছিল, আঘাত করা হয়েছিল মাথায়। শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা
হয়েছিল। তারপর তার দেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে।
দু'দিন পর
ত্বকীর দেহ পাওয়া গিয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে। ১৭ বছরের এক কিশোরকে হত্যা
করতে ঘাতকরা তাদের আয়োজনে কোনো ফাঁক রাখেনি। নিষ্পাপ এই কিশোরের কথা মনে
পড়লেই তার নিষ্পাপ চোখ দুটি ভেসে ওঠে। ত্বকীকে কেন ঘাতকদের টার্গেট হতে
হলো? কারণ হয়তো এই যে, স্পর্ধাকে ঘাতকরা সহ্য করতে পারে না, স্পর্ধাকে ওরা
ভয় পায়। কবি সুকান্ত লিখেছিলেন, 'এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।' ত্বকী যেন
তার মায়াবী মুখ আর দুর্দান্ত সাহস নিয়ে নেমে এসেছিল নারায়ণগঞ্জের বুকে- এ
দেশের বুকে। ঘাতকরা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে সেই সাহসী আগমনকে রুখতে চেয়েছিল।
কিন্তু মৃত্যুর পর সে এখন অনেক বেশি জীবন্ত। ত্বকী এক দ্বিধাহীন কিশোর। সে
লিখেছে, 'ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে'। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে বুঝিয়ে
দিয়ে গেছে যে, সে কতটা দ্বিধাহীন ও ভয়মুক্ত। ত্বকী চলে গেছে; কিন্তু
মানুষকে জাগিয়ে দিয়ে গেছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে
ত্বকী এখন ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ত্বকী যেন একালের প্রমিথিউস। গ্রিক
পুরাণের দেবতা প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মানুষকে দিয়েছিল। আগুন
পেয়ে মানুষের সভ্যতা অনেক অগ্রসর হয়েছিল। এর জন্য প্রমিথিউসকে নির্মম
শাস্তি পেতে হয়েছিল। ত্বকী যেন ঠিক তেমনি নারায়ণগঞ্জকে মানুষের বাসযোগ্য
করার জন্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আর তার বিনিময়ে
তাকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে মৃত্যুকে। নারায়ণগঞ্জ সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে
পরিচিত। নারায়ণগঞ্জবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে একটি পরিবার এখানে
সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এই পরিবার একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে
যাচ্ছে। তাদের 'টর্চার সেল' এক মহাআতঙ্কের নাম। কত মানুষকে যে এই 'টর্চার
সেলে'র মুখোমুখি হতে হয়েছে তার হিসাব নেই। সরকার এই পরিবারকে পৃষ্ঠপোষকতা
দিয়ে যাচ্ছে। ত্বকীর খুনিরা চিহ্নিত। সবাই তাদের চেনে, জানে। আদালতে
আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা আছে। সে কথা প্রকাশিতও
হয়েছে। এমন জবানবন্দির পরেও পাঁচ বছর অতিবাহিত হলো; কিন্তু ত্বকী হত্যার
বিচার হচ্ছে না। সরকার খুনিদের রক্ষা করে চলছে। ত্বকীর কথা বলতে গেলে তার
বাবা রফিউর রাব্বির কথা বলতেই হয়। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা রাব্বি
নারায়ণগঞ্জের প্রগতিশীল আন্দোলনের পরিচিত মুখ। জাতীয় সম্পদ রক্ষার
আন্দোলনে, নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, নাগরিক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব
দিচ্ছেন। তার এই সাহসীপনা সন্ত্রাসী-গডফাদারদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত
করেছে। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ অনেক ভারী। তাঁর পুত্রকে হত্যা করে সেই বীর
পিতার ঔদ্ধত্যকে স্তব্ধ করা যাবে- এ কথা মনে করে রফিউর রাব্বির পুত্র
ত্বকীকে ঘাতকরা হত্যা করেছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ডের ফলাফল হয়েছিল
উল্টো। কিশোর পুত্রের হত্যায় রফিউর রাব্বি মুষড়ে পড়েননি। শোককে তিনি
শক্তিতে পরিণত করেছেন। 'সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ' গঠন করে অন্ধকারের
শক্তির প্রতি তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। সব বাধা, সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা
করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছেন। এমন ত্বকী, এমন বাবার সংখ্যা যত
বেশি হবে, সমাজ ততই অগ্রসর হবে। ত্বকীকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। ত্বকীদের
আমরা নিরাপদ আশ্রয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারিনি। বর্তমানের এবং আগামী দিনের
ত্বকীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় আমাদের তৈরি করতে হবে। তার জন্য চলমান লড়াইকে
জোরদার করতে হবে। ত্বকীর কাছে এ হলো আমার-আপনার দায়।
সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
No comments