ত্বকী হত্যার বিচার হতেই হবে by আনু মুহাম্মদ
আমি প্রস্তর হয়ে মরলাম উদ্ভিদ হতে
উদ্ভিদ হয়ে মরি, তো উত্থিত প্রাণে
মানুষ হয়ে উঠলাম পরে, যখন সত্য উদ্ভাসিত হলো
ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে?
-তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী
চার দশক আগে নির্মল সেন দাবি জানিয়েছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।’ এত বছর পরেও এই দাবি পূরণ হয়নি। সড়ক-নৌপথে ‘দুর্ঘটনায়’, কারখানায়-বস্তিতে আগুন লেগে, দখল করা জমিতে ভবন ধসে, দূষিত পানি বা খাবার খেয়ে, কাজের খোঁজে বেপরোয়া হয়ে বিদেশে যাওয়ার পথে, হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায়, নিরাপত্তাহীন নির্মাণকাজে মানুষ মরছে, ফিটনেস ছাড়া বাস-ট্রাক দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু তো চলছেই। আর ধর্ষণ-হত্যারও বিরতি নেই। পোশাক শ্রমিকদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। পাচার হওয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষ সমুদ্রে ভয়ংকর নির্যাতন আর গণহত্যার শিকার। গরিব, প্রান্তিক, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ আসছে বারবার। কিশোর বয়সেই তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী (৫ অক্টোবর ১৯৯৫-৬ মার্চ ২০১৩) এই বাংলাদেশকে পরিবর্তন করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিল তার কবিতা, ছবি আঁকা, গদ্যে। ঘাতক রাজত্বে ও টিকতে পারেনি। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জে লাইব্রেরিতে পড়তে যাওয়ার সময় স্কুলছাত্র, কবি, শিল্পী এই ত্বকীকে অপহরণ করা হয়। পরে শীতলক্ষ্যা নদীতে তার লাশ পাওয়া যায়। একজন মেধাবী কিশোর, যে নিজের দিবারাত্রির মনোযোগী পাঠ, সৃজনশীলতা, শৃঙ্খলা, দেশ ও দশের প্রতি অসাধারণ সংবেদনশীলতা আর দায়িত্ববোধ দিয়ে বড় হচ্ছিল, সে শুধু তার মা-বাবার জন্য গৌরব ছিল না, সে হয়ে উঠছিল দেশের জন্য, সর্বজনের জন্য ভরসার মানুষ। এই ত্বকীকে যারা খুন করেছে, তাদের কাছে এই অসাধারণ হয়ে ওঠার কোনো মূল্য নেই, বরং তারা বাংলাদেশের মধ্যে মানুষের এই সৃজনশীল মেধাবী বিকাশে ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। সে জন্য সব সময়ই এ ধরনের প্রাণের বিকাশ তারা কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো আইনি মারপ্যাঁচে, কখনো পাহাড়সমান প্রতিবন্ধকতা দিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করে। না পারলে চেষ্টা করে হিংস্রভাবে নির্মূল করতে। যাদের মধ্যে সর্বজনের প্রতি দায় থাকে, সৃজনশীলতার শক্তি থাকে, তারাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে।
উদ্ভিদ হয়ে মরি, তো উত্থিত প্রাণে
মানুষ হয়ে উঠলাম পরে, যখন সত্য উদ্ভাসিত হলো
ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে?
-তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী
চার দশক আগে নির্মল সেন দাবি জানিয়েছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।’ এত বছর পরেও এই দাবি পূরণ হয়নি। সড়ক-নৌপথে ‘দুর্ঘটনায়’, কারখানায়-বস্তিতে আগুন লেগে, দখল করা জমিতে ভবন ধসে, দূষিত পানি বা খাবার খেয়ে, কাজের খোঁজে বেপরোয়া হয়ে বিদেশে যাওয়ার পথে, হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায়, নিরাপত্তাহীন নির্মাণকাজে মানুষ মরছে, ফিটনেস ছাড়া বাস-ট্রাক দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু তো চলছেই। আর ধর্ষণ-হত্যারও বিরতি নেই। পোশাক শ্রমিকদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। পাচার হওয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষ সমুদ্রে ভয়ংকর নির্যাতন আর গণহত্যার শিকার। গরিব, প্রান্তিক, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ আসছে বারবার। কিশোর বয়সেই তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী (৫ অক্টোবর ১৯৯৫-৬ মার্চ ২০১৩) এই বাংলাদেশকে পরিবর্তন করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিল তার কবিতা, ছবি আঁকা, গদ্যে। ঘাতক রাজত্বে ও টিকতে পারেনি। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জে লাইব্রেরিতে পড়তে যাওয়ার সময় স্কুলছাত্র, কবি, শিল্পী এই ত্বকীকে অপহরণ করা হয়। পরে শীতলক্ষ্যা নদীতে তার লাশ পাওয়া যায়। একজন মেধাবী কিশোর, যে নিজের দিবারাত্রির মনোযোগী পাঠ, সৃজনশীলতা, শৃঙ্খলা, দেশ ও দশের প্রতি অসাধারণ সংবেদনশীলতা আর দায়িত্ববোধ দিয়ে বড় হচ্ছিল, সে শুধু তার মা-বাবার জন্য গৌরব ছিল না, সে হয়ে উঠছিল দেশের জন্য, সর্বজনের জন্য ভরসার মানুষ। এই ত্বকীকে যারা খুন করেছে, তাদের কাছে এই অসাধারণ হয়ে ওঠার কোনো মূল্য নেই, বরং তারা বাংলাদেশের মধ্যে মানুষের এই সৃজনশীল মেধাবী বিকাশে ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। সে জন্য সব সময়ই এ ধরনের প্রাণের বিকাশ তারা কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো আইনি মারপ্যাঁচে, কখনো পাহাড়সমান প্রতিবন্ধকতা দিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করে। না পারলে চেষ্টা করে হিংস্রভাবে নির্মূল করতে। যাদের মধ্যে সর্বজনের প্রতি দায় থাকে, সৃজনশীলতার শক্তি থাকে, তারাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে।
ত্বকী বেড়ে উঠেছিল সে রকম একটি পরিবেশে। তার পিতা সক্রিয়
ছিলেন এবং এখনো আছেন সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত
করতে, অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে। পিতার এই সাহসী
ভূমিকায় দানবেরা প্রতিহিংসা দেখিয়েছে তাঁর সন্তানকে হত্যা করে। তাদের
ধারণা, এ রকম নৃশংসতা করে ভয় দেখিয়ে তারা মানুষকে থামাতে পারবে, মানুষের
অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারবে। তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ত্বকীর পিতা রফিউর
রাব্বিসহ নারায়ণগঞ্জের সজাগ মানুষেরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে অনড় আছেন।
তাঁদের কর্মসূচিতে এখন যোগ হয়েছে ত্বকীসহ বহু মানুষ হত্যাকারীদের বিচার
আন্দোলন। এই বিচার আন্দোলন এই জনপদে মানুষের জীবন ও সম্পদের শত্রুদের
বিরুদ্ধে সর্বজনের লড়াই। মাফিয়াদের ওপর ভর করে দেশ চালালে সরকারের কাছে
মানুষের গুরুত্ব থাকবে কেন? ত্বকী হত্যার বিচার আটকে আছে। মানুষের চোখে
খুনি আর তার পৃষ্ঠপোষকদের নাম-ঠিকানা নিয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই। রাষ্ট্রের
বিধি অনুযায়ী তদন্তপ্রক্রিয়াতেও খুনিদের শনাক্ত করা হয়েছে। এই শনাক্ত করার
পরই আটকে গেছে বিচার। পাঁচ বছর পার হচ্ছে, আটকে থাকা বিচারের মুক্তির লক্ষণ
নেই। কেন, এই প্রশ্ন সবার। উত্তরও হয়তো অনেকের জানা। আমরা যখন ত্বকীর কথা
ভাবি, তখন সারি বেঁধে আসে আরও অনেকের মুখ। মেধাবী সংস্কৃতিকর্মী তনু,
সাংবাদিক লেখক সাগর-রুনি দম্পতি। আসে অভিজিৎ, দীপনসহ আরও অনেকের নাম। কেউ
লেখার জন্য, কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য, কেউ সৃজনশীলতার জন্য, কেউ নারী
হওয়ার কারণে খুন হয়েছে। এগুলোর কার্যকর তদন্তকাজে, খুনিদের শনাক্ত করার
ব্যাপারে, বিচার শেষ করার কাজে সরকারের অনাগ্রহ বা শৈথিল্য নিয়ে কোনো
সন্দেহ নেই। দেশে খুনের বিচার একদম হয় না, তা নয়। হয়। তবে দৃষ্টান্ত বলে,
আইন ও আইনের প্রয়োগ ভয়াবহভাবে অসম এবং ক্ষমতাবানদের ইচ্ছা ও ক্ষমতাধীন।
খুনি যদি ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাহলে সেখানে আইন অচল। তবে
ক্ষমতাবানদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও বিচারকাজ অনেক দূর যেতে পারে। যেমন বিশ্বজিৎ
হত্যাকাণ্ডের পর সরকারপক্ষ থেকে দায় অস্বীকারের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু
ভিডিও চিত্রে সরকারি ছাত্র সংগঠনের চেহারা স্পষ্ট ছিল যে এ চেষ্টা সফল
হয়নি। তারপরও খুনে অভিযুক্ত ও দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন এখনো পলাতক। নারায়ণগঞ্জে
সাত খুনের ঘটনার সঙ্গে মন্ত্রীর জামাই ও র্যাবের কর্মকর্তারা জড়িত থাকার
পরও বিচারকাজ চলেছে।
এর প্রধান কারণ ওই ব্যক্তিদের লাশ ভেসে ওঠা এবং তা
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে যাওয়া। তবে কোর্টে শুনানির সময় খুনের আসামি
পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। খুনের অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ঘটনা ঘটে! ক্ষমতার এত ক্ষমতা!! বাংলাদেশে সবকিছুর
মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মানুষ ত্রস্ত, সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে সব
জিনিসের দাম বৃদ্ধিতে আরও গতি দিচ্ছে। এগুলোর মাধ্যমে সর্বজনের বোঝা তৈরি
হলেও কিছু দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর পকেট ভারী হওয়ার পথ তৈরিতে সরকার
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সুন্দরবন বিনাশ করে হলেও রামপাল প্রকল্প, দেশকে বিপদের মধ্যে
ফেলে হলেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে সরকার বেপরোয়া। অথচ
প্রতিদিন মানুষের অকাল, অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে তার নমনীয়তার শেষ নেই। সড়ক
দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে পিটিয়ে হত্যা-এসব অনাচার রোধে সরকার অকার্যকর। তাই
শুধু মানুষের জীবনের দাম ক্রমাগত কমছে। অনেক কম বয়সেই ত্বকী এই অমানবিক জগৎ
নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, তার স্বপ্নে এক মানবিক সৃষ্টিশীল জগৎ বাসা বেঁধেছিল।
মানুষ সেখানে প্রাণে প্রাণে অনেক বড়, প্রাণ প্রকৃতির উদার সেই জগতে
দানবদের স্থান নেই। সেই প্রশ্ন আর স্বপ্ন থেকে অযুত তরুণ তৈরি হচ্ছে, হবে।
ত্বকী তাই ফিরে ফিরে আসবে। ত্বকীর ঘাতক আর তার পৃষ্ঠপোষকদের বিচার হবেই,
হতেই হবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
No comments