স্ত্রীকে নির্যাতন না করেই দেখুন না! by রোকেয়া রহমান
যেকোনো
মানুষের কাছে পরিবার হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার হচ্ছে মানুষের
আশা-ভরসার স্থল ও নিরাপদ আশ্রয়। দিন শেষে সবাই পরিবারের কাছেই ফেরে। কেননা,
এটাই শান্তির ঠিকানা। আর এই পারিবারিক পরিসরেই যদি নির্যাতনের শিকার হতে
হয়, তার চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে? কিন্তু এমনটাই ঘটছে, কম–বেশি সব
দেশে। প্রথম আলোর ১ জানুয়ারির খবর, আমাদের দেশে যত নারী ও কন্যাশিশু
নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তার ৭৭ শতাংশই হয় পারিবারিক পরিসরে। আর বেশির ভাগ
ক্ষেত্রে স্বামীরাই স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন চালান। বেসরকারি সংস্থা
ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির অধীনে গত বছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের
৫৬টি জেলায় পরিচালিত এক সমীক্ষার ফলাফলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। এর আগে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত গবেষণাগুলোর ফলাফলে একই ধরনের তথ্য
পাওয়া গেছে। মূল নির্যাতকের ভূমিকায় স্বামীকেই দেখা যাচ্ছে। এসব গবেষণার
ফলাফল দেখে মনে প্রশ্ন জাগছে, পুরুষেরা বিয়ে করেন কেন? স্ত্রীদের নির্যাতন
করার জন্য কি? তা-ই হবে মনে হয়। তা না হলে তো এত নারীকে নির্যাতনের শিকার
হতে হতো না। বিয়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দুজন নারী-পুরুষের একসঙ্গে সুখে
বসবাস করা। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবেন। তাঁরা পরিবার
গড়ে তুলবেন, সন্তানের জন্ম দেবেন, তাদের লালন-পালন করে বড় করবেন। কিন্তু
আমাদের দেশের পুরুষদের কাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, মূলত নারীদের নির্যাতন করার
জন্যই তাঁরা বিয়ে করেন। সুখে-শান্তিতে ঘরকন্না করা মোটেও তাঁদের উদ্দেশ্য
নয়। বিয়ে করার পরই স্ত্রীরা তাঁদের দুচোখের বিষ হয়ে ওঠেন। স্ত্রীদের কোনো
কিছুই আর তাঁদের পছন্দ হয় না। যত রাগ-ক্ষোভ সব স্ত্রীর ওপর। তাঁকে যেকোনো
প্রকারে হোক নির্যাতন করা চাই।
কেউ শারীরিক নির্যাতন করেন, কেউ মানসিক
নির্যাতন করেন, কেউ আর্থিক নির্যাতন করেন। বিয়ের আগে যে পুরুষটি নিপাট ভালো
মানুষ ছিলেন, বিয়ের পর আবির্ভূত হন অন্য রূপে। কেন তাঁদের মাঝে এই
পরিবর্তন দেখা দেয়? কী চান তাঁরা? নির্যাতনকারী এই পুরুষেরা কি বোঝেন যে
স্ত্রীকে নির্যাতন করার মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজেরাও অসুখী জীবন যাপন করছেন?
ব্র্যাকের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী যৌতুককে কেন্দ্র করে ৩২ শতাংশ
নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এই ২১ শতকে যখন সারা বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি ও
জ্ঞানবিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে, তখনো আমাদের দেশে কিনা যৌতুকের জন্য
নারীদের নির্যাতন করা হচ্ছে! এখনো এ দেশে যৌতুকপ্রথা টিকে আছে, ভাবতে অবাক
লাগে। যৌতুক ছাড়াও আরও নানা কারণে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
তরকারিতে লবণ কম দেওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনায়ও নারীদের নির্যাতন করা হয়। প্রশ্ন
হচ্ছে, আর কত দিন নারীরা এভাবে স্বামীর হাতে পড়ে পড়ে মার খাবেন? যে স্বপ্ন
নিয়ে নারীরা বিয়ের পিঁড়িতে বসেন, বেশির ভাগ নারীর ক্ষেত্রে অচিরেই সেই
স্বপ্ন ভেঙে যায়। স্বপ্ন পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। এ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে
হবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক আইন ও নীতিমালা তো হয়েছে। কিন্তু
নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে কই? আসলে শুধু আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করে এ সমস্যার
সমাধান হবে না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কেননা, এটা একধরনের সামাজিক বৈধতা পেয়ে
গেছে। স্ত্রী নির্যাতনকে আর অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না। তাই সামাজিকভাবে এটি
প্রতিরোধ করতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষকে এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। আর
পুরুষদের উদ্দেশে বলছি, স্ত্রীকে নির্যাতন না করেই দেখুন না, জীবনটা কত
সুখের হয়ে উঠেছে।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক
No comments