আড্ডায় ভাটা চ্যাটে জোয়ার
একটা
সময় বাঙালি আর আড্ডা ছিল একে অন্যের পরিপূরক। সময় আর প্রযুক্তি বদলে
দিয়েছে সব। আড্ডায় এখন ভাটার টান। মানুষ ব্যস্ত ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে
চ্যাটে। এই বদল আর এর পরিণতি নিয়ে নিজেদের ভাবনার কথা বলেছেন, নানা
শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনেরা। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, মানবজমিনের রিপোর্টার-সিরাজুস সালেকিন, উৎপল রায়, ফয়সাল রাব্বিকীন, কামরুজ্জামান মিলু, হাফিজ মুহাম্মদ এবং এন আই বুলবুল।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, আমাদের সময় ফেসবুকের যুগ না থাকায় আমরা সামনাসামনিই বেশি যোগাযোগ করতাম। এখন আড্ডার ধরনটা বদলেছে কিন্তু যোগাযোগের পেছনে যে অন্তর্নিহিত মনোভাব সেটি এখনো বদলায়নি। তিনি বলেন, আগের যে আড্ডা, তারও ভালো- খারাপ দিক ছিল। এখন যে আড্ডা তারও ভালো-খারাপ দিক আছে। তবে, আমার মনে হয় মুখোমুখি বসে যে আড্ডা দেয়া সেটা এখনো কমেনি। তিনি বলেন, এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখি ছেলেমেয়েরা বসে গল্প করছে। টিএসসিতে গেলেই দেখা যায় এত ছেলেমেয়ে গল্প করছে যে, চলাচলই অনেক সময় মুশকিল হয়ে পড়ে। ওই আড্ডাটা বোধহয় একেবারেই বন্ধ হয়নি।
ড. কামাল হোসেন
সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, সমাজের পরিবেশ অনেকটা বদলানো হয়েছে। এক হচ্ছে রাজনীতির যে ভূমিকা মানুষকে একে অন্যের কাছে আনা, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এখন আমরা লক্ষ্য করছি রাজনীতি মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করছে। মানুষ মানুষের মধ্যে দূরত্ব। কেউ কারও প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে চায় বিতর্কিত হোক। এটা একটা রোগ যে অন্যকে বিতর্কিত করে দাও। আমরা লক্ষ্য করছি যে, রুগ্ণ রাজনীতির ফল। রুগ্ণ রাজনীতি খারাপের দিকে নেয়। রাজনীতিবিদরা ঐক্যের কথা বলেন কিন্তু করেন উল্টো কাজ। যদি সত্যিই ঐক্যের পরিবেশ থাকতো তবে ঐক্যেই হতো।
নূরে-আলম সিদ্দিকী
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরে-আলম সিদ্দিকী বলেন, আমাদের যৌবনের সময় সামনাসামনি আড্ডাটা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিকনির্ভর। রাজনীতির কারণে সেসময় বিভিন্ন স্থানে আড্ডা দিতাম আর তা থাকতো আলোচনা, চর্চা ও পর্যালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তখন যে যেই ছিল সে সেইভাবে আড্ডার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানের প্রসারতার কারণে মানুষের চিন্তাও দিগন্ত বিস্মৃত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আত্মকেন্দ্রিকও হয়ে যাচ্ছে। তাই বিজ্ঞানভিত্তিক ও আত্মকেন্দ্রিকতার সংমিশ্রণে অনেকে এক সঙ্গে বসে আড্ডা দেয় না। বরং তাদের চিন্তা ও মননশীলতার যাদের সঙ্গে মিল রয়েছে তাদের সঙ্গেই ইন্টারনেট ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে আড্ডা দিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি আড্ডাটা দেয়ার প্রবণতা এখন একবারেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এখন দেখা যায় মানুষ দূর দেশে অপরিচিত একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করছে অথচ পাশের বাসার প্রতিবেশী সম্বন্ধে ধারণা রাখছে না। এমনটা আমাদের সময় কখনো দেখা যেত না।
কামাল লোহানী
ভাষা সংগ্রামী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে। এসবের কারণে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। সময়ের পরিবর্তন যখন হয় তখন সঙ্গে সঙ্গে অন্য উপাচারগুলোর পরিবর্তন হতে থাকে। একারণেই নতুন কিছু আবির্ভাবের সঙ্গে ব্যবহারিক জীবন বা প্রায়োগিক জীবনের পদ্ধতিও পাল্টে যায়। তিনি বলেন, বাঙালি সমাজের যে সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল আড্ডা। আগে পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা হতো, চা-খানায় আড্ডা হতো, ঘরে বসে আড্ডা হতো। এখন সেগুলো নেই বললেই চলে। কামাল লোহানী বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে জিনিসটা হচ্ছে সেটির একদিকে যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি খারাপ দিকও আছে। ভালোর দিকটা যেটা হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই যোগাযোগ করা যায়। মুক্ত মনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা যায়। আর অসুবিধে যেটা হচ্ছে আমাদের চিন্তা- ভাবনার বিরুদ্ধে কিছু জিনিস আছে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছু ব্লগ আছে। সেখানে যা ইচ্ছা লেখা হচ্ছে। এগুলো লেখার সাহস যারা পায়, সরকার কি এগুলো দেখে না? আর যেসব ব্লগার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, জনগণের পক্ষে লেখে তাদেরকে মামলায় জড়িয়ে পড়তে হয়, গ্রেপ্তার হতে হয়।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, মুখোমুখি আড্ডায় যে একটা মানবিক স্পর্শ ছিল সেটা এখন উঠে গেছে। ফেসবুকের মাধ্যমে আড্ডা দিতে গিয়ে মানুষের নৈকট্যভিত্তিক যে আন্তঃমানবীয় সম্পর্ক সেটা কিন্তু বিঘ্নিত হচ্ছে। আর তার কারণটা হচ্ছে এখন জীবনযাপন, চলাচল অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকটা সময় অযথা ব্যয় করতে হয়। এর বিকল্প হিসেবে ফেসবুক প্রযুক্তি অনেকটা সহায়ক প্রযুক্তি হিসেবে কাজ করে। তিনি বলেন, মানুষের জন্য আন্তঃমানবীয় সংযোগ সবসময়ই প্রয়োজন রয়েছে। কারণ আন্তঃমানবীয় সংযোগের মধ্য দিয়ে আন্তঃমানবীয় কর্মকাণ্ড উৎসারিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভালো দিক হচ্ছে প্রযুক্তিভিত্তিক মানবীয় আন্তঃসম্পর্ক অনেকটা সহজ হয়েছে। আর আজকাল তো চলাচল করা বেশ কঠিন। পথেই অনেকটা সময় কেটে যায়। কাজেই আড্ডা দিতে হলে বা সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে ফেসবুক অনেকটা সহায়ক প্রযুক্তি হিসেবে কাজ করে। সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, যেকোনো প্রযুক্তি ব্যবহারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আছে। ইদানীংকালে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাত্রাটি সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব বেশ প্রকট হয়ে ওঠছে। এটি এখন আসক্তি পর্যায়ে চলে গেছে। সামাজিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাবও এখন দৃশ্যমান। আর দীর্ঘ সময় ধরে ফেসবুক ব্যবহার বিভিন্ন মানবিক রোগের কারণ। তাই অতিমাত্রায় কোনো কিছুই ভালো নয়। প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে রয়ে সয়ে।
গোলাম সারওয়ার
সমকাল পত্রিকার সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, আমরা আগে দিনে আড্ডা মারতাম, সবাই এক সঙ্গে বসে কথা বলতাম, নিকটজনের সঙ্গে ফুর্তি করতাম এটা এখন একেবারে শেষ হয়ে গেছে। নাতি-নাতনীদের সঙ্গেও আগে সামনে বসে কথা বলতাম, কোলে তুলে নিতাম সেটাও শেষ হওয়ার পথে। আমি আমার নাতিদের কথাই বলি তারা আমেরিকাতে থাকে। দেখা যায় এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে তারা এসএমএস দেয়। তারা দোতলায় থেকে বলে আমার জন্য এক গ্লাস পানি পাঠিয়ে দেও। একজনের সঙ্গে অন্য কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। পারস্পরিক সম্পর্কটা একেবারে শিথিল হয়ে গেছে। এটা আমাদের বয়স্কদের মেনে নিতে একটু কষ্ট হয়। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। আমরা চাইলেই তো আর এটা পরিবর্তন করতে পারবো না। তবে এখন সবাই বলছে তোমরা আইকনের দিকে চোখ না রেখে তোমাদের সামনে চোখ রাখো কিংবা প্রিয়জনের দিকে তাকাও। তবে এ অবস্থার এক সময় পরিবর্তন আসবেই।
আফসান চৌধুরী
কলামিষ্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী বলেন, মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আড্ডা অনেক বেশি দেয়। সামনাসামনি হয়তো আড্ডা কমে গেছে। ফেসবুক এখন আড্ডার জায়গা। যাদের সঙ্গে কখনো কথা হবে না, দেখা হবে না তাদের সঙ্গেও আড্ডা দেয়া হচ্ছে। আমি ফেসবুকের মাধ্যমে যেটি অর্জন করতে পারি সেটা তো সামনাসামনি আড্ডায় সম্ভব নয়। এখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে আড্ডা দেয়া হয়। যেটি আগে সম্ভব হতো না। আগে আড্ডা দিতো চার জন/ পাঁচজন। কিন্তু এখন তো ১০ রকম মানুষের সঙ্গে ফেসবুক টুইটারে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আগে সীমিত কয়েকজনের সঙ্গে সামনাসামনি আড্ডা হতো। কিন্তু এখন আড্ডার পরিসর অনেক বেড়েছে। যেটা হয় না সেটি হচ্ছে সামনাসামনি দেখা কম হচ্ছে। এটি সময়ের বাস্তবতা। আমাদের সবকিছুই এখন পাল্টে গেছে। তিনি বলেন, ১৯ শতকের আড্ডা আর ২০১৮ সালের আড্ডা কিভাবে একরকম হবে? অনেকে বলে ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। কিন্তু কিভাবে দিন কাটাইতাম সেটাতো বলেন না। আগে তো মানুষ খেতে পারতো না, পড়তে পারতো না, অসুখে মারা যেতো। সেগুলো কি সুন্দর দিন কাটানো। আফসান চৌধুরী বলেন, আমার ১০ ঘণ্টার আড্ডার দরকার নেই। প্রযুক্তির কল্যাণে আমার ১০ হাজার মানুষ আছে আড্ডা দেয়ার।
তারেক শামসুর রেহমান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, মানুষের যে সনাতন আড্ডা তা এখন আর নাই। এটা দখল করে নিয়েছে ফেসবুক টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভালো প্রভাব ফেলছে। সেটা একধরনের নেতিবাচক প্রভাবে ফেলছে। গণমাধ্যমে যে ধরনের সংবাদ বা ছবি প্রকাশ হচ্ছে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে যেকোনো সংবাদ বা ছবি পোস্ট করে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, উত্তেজনা বাড়াতে পারে বা এটা খারাপ দিকটাকে তুলে ধরে সেই সঙ্গে এটাও সত্য একুশ শতকে দাঁড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারবো না। আমাদের সামাজিক গণমাধ্যমের প্রয়োজন আছে। তার বড় উদাহরণ হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট ব্যবহার করেন। তার দেখাদেখি আমাদের রাজনীতিবিদরাও টুইট ব্যবহার করছেন। মোদ্দাকথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভালো দিকগুলো আমরা ব্যবহার করছি কম। ফলে নেতিবাচক দিকগুলোই আমাদের সমাজে প্রভাব ফেলে। এক সময়কার বন্ধুদের মধ্যে আড্ডা এবং জড়ো হওয়ার প্রবণতা কমে গেছে।
আসিফ নজরুল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল বলেন, যখন জীবিত মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক কমে যায় তখন সম্ভবত মানবিকতা কমে যায়। বাস্তবতা থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড কিন্তু রিয়েলিটি না। সেখানে সোর্স অব ইনফরমেশন, যে প্যাশন, একজন আরেকজনকে যে ফিলিংস, সহমর্মিতা দেখায় এটা খুব জেনুইন হওয়ার কথা না। একজন আরেকজনের সঙ্গে যখন মুখোমুখি ইন্টার্যাক্ট করে তখন যেই সৎভাবে ফিলিংস এক্সপ্রেস করে ভার্চুয়ালভাবে সেভাবে সম্ভব না। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে যোগাযোগ হয় অনেকক্ষেত্রেই চিন্তা-ভাবনা, প্রেক্ষাপট ছাড়া। যখন জেনুইন ইন্টার্যাকশন হয় তখন সেটার একটা প্রেক্ষাপট থাকে। সরাসরি বিষয় সম্পর্কিত হয়। আবার ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে সীমাবদ্ধতা থাকে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড মানুষের প্রকাশ ভঙ্গি, আবেগ, পারস্পরিক ইন্টার্যাকশন, মানবিকতা প্রকাশের সুযোগ অনেক কম। সেখানে মানুষ অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে। ফলে জটিলতা বেড়ে যায়। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে তথ্য অসংখ্য এবং অনেক রকম। ফলে আপনার বাস্তব ওয়ার্ল্ডে তথ্য যেভাবে ডিল করতে পারে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে তথ্য সেভাবে ডিল করতে পারে না। ফলে অনেক রং এক্সপ্রেশন আসতে পারে। ইমোশন ও প্রকাশ ভঙ্গির সততা কমে যায়।
রাজনীতিতে এটার প্রভাব অবশ্যই পড়ছে। একটা জিনিস আপনি পছন্দ করেন না কিংবা আপনি দেশপ্রেম দেখাতে চান তবে ফিজিক্যালি উপস্থিত হয়ে আপনাকে দেখাতে হবে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে আপনি দেশপ্রেম এক ক্লিকেই প্রকাশ করছেন। মনে হচ্ছে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলছেন। বেশিরভাগ মানুষ দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে হোক বা তার ভালোবাসা বা ঘৃণা প্রকাশ এতই ইজিলি এক্সপ্রেস করে সেটার জন্য তাকে কোনো রকম আত্মত্যাগের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তাকে ফিজিক্যাল যে কষ্ট বা ত্যাগ স্বীকার করতে হয় না। ফলে পলিটিক্সে মানুষের অংশগ্রহণ বা ক্ষোভে অংশগ্রহণ, প্রতিবাদে অংশগ্রহণের ফিজিক্যাল মাত্রাকে কমিয়ে দিয়েছে। আবার যোগাযোগ মাধ্যমে খুব দ্রুত তথ্য প্রেরণ সম্ভব হয় বলে ওইখানে সীমিত পরিসরে হলেও নতুন প্রতিবাদের জায়গা তৈরি হয়েছে। ফলে প্রতিবাদ করার ঝোঁকটা কমে যেতে পারে। একটা জিনিসের প্রতি প্রচণ্ড আপত্তি অনুভব করি, ঘৃণা করি। গুমের বিরুদ্ধে একটা সমাবেশে যাওয়ার যে তাড়না অনুভব করি তার চেয়ে ফেসবুকে পাঁচ-দশটা লাইভ দিয়ে ওই তাড়না মোচন করি তবে সেখানে যাওয়ার আগ্রহ থাকে না। এভাবে হয়তো সমাজে প্রভাব ফেলছে।
আমেনা মোহসিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আমেনা মোহসিন বলেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে আসক্ত হওয়ার কারণে মানুষ খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম হলো ইন্টার্যাকশন। মানুষের প্রতি মানুষের দয়া মায়া বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা এবং পরিবারের মধ্যে যে বন্ধনগুলো এসব কমে যাচ্ছে। মানুষের কতগুলো মৌলিক মানবীয় ব্যাপার আছে যেমন মেলামেশা সেটা যদি ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে চলে যায় তখন কিন্তু ডাইমেনশনগুলো অন্যরকম হয়ে যায়। আমরা বলছি যে, র্যাডিক্যালাইজেশন বা সংকীর্ণতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং মানুষ বেশি অন্তর্মুখী ও চরমপন্থি হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনলাইন র্যাডিক্যালাইজেশন হচ্ছে।
তৌহিদুল হক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, একটা সময় বাঙালি সম্পর্কের অন্যতম ধরন ছিল বিভিন্ন বয়সের সবাই মিলে বিভিন্ন বিষয়ে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি বিষয়ে পারস্পরিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সংস্কৃতি ছিল। সেই বিষয়টি একবারে উঠে গেছে তা নয়। সামাজিক মিডিয়া নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে। সামাজিক মিডিয়ার দাপট বেশি আগের পারস্পরিক আড্ডার। তবে আড্ডা দিলেও মিডিয়া এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে আড্ডা দিতে পারে। এক জায়গায় তারা একত্রিত না হলেও হয়। এটার পজিটিভ দিক হলো মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, পারস্পরিক যোগাযোগ হচ্ছে সেটা অসুবিধার কিছু না। যে জায়গাটিতে আমাদের সতর্ক হওয়ার সুযোগ আছে সেটি হচ্ছে আমরা বাঙালিরা যে ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করে তার সঙ্গে এই ধরনের প্রক্রিয়াটার সম্পর্কটা অপেক্ষাকৃত কম। প্রতিটি দেশের মানুষের যে সামাজিকীকরণ নিজ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে পরিচালিত হয়। তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি যখন বিভিন্ন বয়সের মানুষ যখন এক সঙ্গে আড্ডায় বসবে তখন পারস্পরিক সম্প্রীতি বাড়বে, মুখোমুখি সময় কাটানোর মধ্য দিয়ে দুঃখবোধ বা সুখ ভাগাভাগির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাড়ে। অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বৃহৎ পরিসরে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করার উদ্দীপনা কিংবা চিন্তা আড্ডা থেকে এসেছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সৃষ্টিশীল কিংবা নতুন কিছু উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। মুখোমুখি আড্ডার মধ্য দিয়ে সম্প্রীতি তৈরি হয়, এর মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সৃষ্টি হয়। সমাজ জীবনের বৈশিষ্ট্যে আড্ডার যে ভূমিকা তাতে সামাজিক যোগাযোগে আড্ডার পরিবর্তে মুখোমুখি আড্ডাকে বেশি উৎসাহিত করা উচিত।
মাহমুদুর রহমান
আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, মানুষ এখন এক সঙ্গে বসে আড্ডা না দেয়ার একটা কারণ হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। এখন গুমের সংখ্যা এত বেড়েছে যে, তারা এখন এক জায়গায় বসাকে নিরাপদ মনে করছেন না। একসঙ্গে বসে আড্ডা দিলে সেখান থেকে তারা নিরাপদে ফেরত যেতে পারবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে মানুষ এখন ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ছাত্রজীবনে আমাদের সামনাসামনি অথবা বিভিন্ন জায়গায় বসে যে আড্ডাটা ছিল সেটা এখন তারা ফেসবুকে দিচ্ছে। সোশ্যাল মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়িয়ে সেসব আড্ডার কাজটা সেরে ফেলছে। মোট কথা আমি মনে করি নিরাপত্তা আর ফেসবুক আসক্তি হচ্ছে সামনাসামনি আড্ডা না দেয়ার কারণ।
আ.স.ম আবদুর রব
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) রব এর প্রধান আ.স.ম আবদুর রব বলেন, আগে মানুষ একজন আরেকজনকে দেখলে দাঁড়িয়ে কথা বলতো কিংবা এক সঙ্গে বসে আড্ডা দিতো। তখন মানুষ অধিকাংশ ছিল বেকার। তাদের কাজকর্ম তেমন ছিল না। এখন তাদের সময়ের খুব অভাব। আগে এত কর্মসংস্থান, ইন্টারন্যাশনাল প্রফেশনাল ছিল না। এখন সরকারি-বেসরকারি বহু প্রফেশন হয়ে গেছে। এখন সবাই তার নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার কিংবা অপ্রয়োজনীয় সময় তাদের নেই। তারা স্কুল-ভার্সিটিতে এসেও একসঙ্গে বসে খুব একটা আড্ডা দেয় না। দূর থেকে হাত জাগিয়ে হায়- হ্যালো বলেই চলে যায়। আমি বলবো মানুষ তার প্রফেশনের দিকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে সামনাসামনি আড্ডাটা কমিয়ে দিয়েছে।
আনু মুহাম্মদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সাক্ষাতে আড্ডাটা কমে গেছে বলে আমি মনে করি না। আমার পাড়ায় তো দেখেছি ছেলেমেয়ে প্রতিনিয়ত আড্ডা দিচ্ছে। সাক্ষাৎ করছে। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভার্চুয়াল মাধ্যমেও তারা যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে ইন্টারনেটে যোগাযোগের কারণে সাক্ষাৎ কমেনি।
ড. শাহদীন মালিক
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ইন্টারনেটে সময় কাটানো- এটি সারা দুনিয়াতেই হচ্ছে। আর আমাদের এখানে বিশেষ করে ঢাকার মতো বড় শহরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটানো বেশি হচ্ছে- এর কারণ উন্মুক্ত পরিসরের অভাব। এই শহরে বহু মানুষ বিশেষ করে তরুণসমাজ মেসে থাকে। কিছু মানুষ ফ্ল্যাটে থাকলেও ছোট জায়গায়, ছোট পরিসরে থাকে। আড্ডা দেয়ার জন্য উন্মুক্ত স্থান কমে গেছে। আর বন্ধু বা আত্মীয়র বাসায় যাতায়াতও একটি বড় সমস্যা। এসব কারণে মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হতে বাধ্য হয়েছে। আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে ইন্টারনেটের প্রচলন বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে, সার্বিকভাবে এটি সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নয়। কারণ, এতে করে আমাদের সামাজিক বন্ধনটা নিবিড় হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক অপরাধমূলক, অশ্লীল, অপ্রয়োজনীয় ও নোংরা বিনোদন বেড়ে গেছে। যার প্রভাবও সুখকর হবে না। ড. শাহদীন মালিক বলেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্যান্য দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে চর্চা হয়, আমাদের তরুণ সমাজে সেটি নেই বললেই চলে। ফলে, ইন্টারনেট বা তথ্যপ্রযুক্তির ভালো দিকটার সুফল আমরা পাচ্ছি না। আমাদের তরুণ সমাজও ভালো দিকটার সুফল গ্রহণ করতে পারছে না। এটি উদ্বেগের বিষয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান
টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সামাজিকতা, আড্ডার মধ্যে নির্মোহ আনন্দ উৎসাহ পাওয়া যায়। আড্ডার মাধ্যমে মানুষ নিজেদের মধ্যে জ্ঞানের ভাণ্ডার বিস্তৃত করার সুযোগ পায়। একই সঙ্গে সৃষ্টিশীল কাজেও আড্ডা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে আড্ডা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো বিবেচনায় নিলে আড্ডা এখন উঠেই গেছে বলা যায়। এটি অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এতে করে আমরা সৃষ্টিশীলতা হারাচ্ছি। আমাদের সামাজিক বন্ধন কমে যাচ্ছে। এখন সামাজিক বন্ধন যদি না থাকে তাহলে মানুষের নৈতিক মানবিক গুণাবলী কমে যায় এবং জ্ঞানের যে বিস্তৃতি বা ভাণ্ডার, সেটিও কমে আসে। তিনি বলেন, প্রযুক্তির অনেক ইতিবাচক দিক আছে। পাশাপাশি এর নেতিবাচক দিকও আছে। নেতিবাচক দিকের কারণে শুধু আড্ডাই নয় পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেখা গেছে একই পরিবারের তিনজন পাশাপাশি বসে আছি। কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছি না। যার যার ফোন বা অন্য কোনো প্রযুক্তিতে ব্যস্ত আছে। এই প্রবণতা তরুণ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটি নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া প্রযুক্তিতে কেউ কেউ এমনভাবে আসক্ত হয় যে আড্ডার বিষয়টি শুধু যে চাপা পড়ে যায় তা-ই না, বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করে। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রযুক্তির একটি ব্যালেন্স বা সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার যারা করতে পেরেছে বা পারছে, তারাই এটার সম্পূর্ণ ইতিবাচক ফল পাচ্ছে। আর যারা পারছে না তারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিচ্যুত হচ্ছে।
গোলাম মোর্তুজা
সাংবাদিক গোলাম মোর্তুজা বলেন, স্বাভাবিকভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনের জায়গাটাতে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে সবকিছু প্রযুক্তি কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বাংলাদেশও এখন সেই ধারাতেই আছে। বাচ্চারা এখন কম্পিউটার, ট্যাবে ফুটবল খেলে। এখন এটার খারাপ দিক হচ্ছে মানুষে মানুষে যে একটা সংযোগ হওয়া, মানুষের সম্পর্কে জানা-বোঝা- এ জিনিসগুলো এখন কমে গেছে। এখন সবকিছু হয়ে গেছে ভার্চুয়াল জগতকেন্দ্রিক। তিনি বলেন, ভার্চুয়াল জগত একটি আলাদা জগত। এ জগৎ থেকে বাস্তব জগত একটু আলাদা। ভার্চুয়ালের সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক একটু কম থাকে। আর এই দিকটি ভালো কি খারাপ, এটা আসলে এক বাক্যে বলা সম্ভবও নয় যে, আগেরটা ভালো এখনকারটা খারাপ। তবে, আগে মানুষের মধ্যে একধরনের সম্পর্ক তৈরি হতো। মানুষে মানুষে চিনত-জানতো। এখন সেই জায়গাগুলো কিছুটা কমে এসেছে।
তিনি বলেন, ভার্চুয়াল জগতের কিছু ইতিবাচক দিক আছে। যেমন অনেক গ্রুপ তৈরি হয়। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হয় না। কিন্তু একজন আরেকজনকে জানে, অনলাইন থেকে। বিভিন্ন
সময়ে তারা ইতিবাচক সামাজিক কাজ করে। একজনের বিপদে আরেকজন সহায়তা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই যোগাযোগটা বা মানুষের জন্য কিছু করা- এটাও ভার্চুয়াল জগতের কারণে অনেক বেড়ে গেছে। একটা সময় কারো রক্তের প্রয়োজন হলে পারিবারিকভাবে যোগযোগ করা হতো। এখন পাঁচ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হলে ফেসবুকে এটি প্রচার করলে ব্যক্তিগত বন্ধু, বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে এবং রক্ত পাওয়া যাবে। গোলাম মর্তুজা বলেন, সামগ্রিকভাবে ভার্চুয়াল জগতের কারণে আড্ডার জায়গাটা বা আমাদের যে সংস্কৃতি ছিল সেটি যেহেতু এখন কমে গেছে, সেহেতু আমাদের মধ্যে একধরনের হা-হুতাশ আছে যে আড্ডা থাকলো না, মানুষে মানুষে সম্পৃক্ততা থাকলো না। তবে, আমি মনে করি এটা নিয়ে ওইভাবে হা-হুতাশের কিছু নেই। এটি সময়ের দাবি। প্রযুক্তি বাদ দিয়ে চিন্তা করার সুযোগ নেই। আমাদের প্রযুক্তির মধ্যেই থাকতে হবে। আর এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় যেহেতু নেই, তাই কী করে প্রযুক্তিকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়, ব্যবহার করা যায়- সেই ব্যবস্থাই করা দরকার।
গোলাম মওলা রনি
সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মওরা রনি বলেন, ভার্চুয়াল জগতে আমরা যে কাজ করছি- সেটি হলো রুঢ় বাস্তবতা। এই মুহূর্তে ঢাকা শহরের যে সমস্যা, তাতে আড্ডা দেয়ার জন্য ৫০ জন লোককে জড়ো করতে হলে, ৮-১০ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। কিন্তু ফেসবুকে চ্যাটিং করলে কিছুই করতে হবে না। শুধু বলবো, আমি অনলাইনে আছি, কে কোথায় আছো। তিনি বলেন, বর্তমান ব্যস্ত নগরজীবনে ভার্চয়াল আড্ডা বাস্তবতা। কিন্তু এটার খারাপ দিক হলো, এটি মানুষকে দিনের পর দিন পাষাণ করে দিচ্ছে, দিনের পর দিন মানুষকে বন্ধনহীন করে তুলছে, মানুষের চিন্তা-চেতনার যে মৌলিকত্ব সেটি নষ্ট করে দিচ্ছে। কিছু মানুষকে বাস্তবতা বিমুখ করে হিংস্র ও রক্ষণাত্মক বানিয়ে ফেলছে। গোলাম মওলা রনি বলেন, মুখোমুখি আড্ডার যে সুবিধা তাতে আন্তরিকতা বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে। আড্ডার মাধ্যমে শিল্প সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। আড্ডা না থাকলে সৃষ্টিশীলতা আসে না। কারো প্রতি আন্তরিকতা শ্রদ্ধাবোধ আসে না। একে অপরকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হয় না।
শামা ওবায়েদ
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শুধু দেশেই নয়, সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেই কিন্তু বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছে। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সামনাসামনি যোগাযোগও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী লোকের সংখ্যা হয়তো বেড়েছে। কিন্তু এখনো গ্রামে-গঞ্জে সামাজিকভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগই কিন্তু বেশি কাজে লাগে। আর আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংগঠনকে ছোট করা বা অপমান করার জন্য ব্যবহার করা না হয়।
সৈয়দ আবদুল হাদি
প্রতিটি বিষয়ের ভালো ও খারাপ দিক রয়েছে। এখন দিন বদলেছে। সময় বদলেছে। প্রযুক্তি ভর করেছে। এটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে খারাপ না। কিন্তু ল্যাপটপ ও মোবাইলে ফেসবুক চ্যাটিংয়ের যে ব্যাপারটা এটা কিন্তু মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আমি ফেসবুকের বিপক্ষে নই। কিন্তু সব কিছুর একটা মাত্রা থাকা দরকার। এখানে আমরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করছি। অথচ সীমিত প্রযুক্তির ব্যবহার কিন্তু আমাদের আরো ভালোর দিকে নিয়ে যেতে পারে। পাড়া-মহল্লার আড্ডা কিংবা চায়ের টেবিলের আড্ডা কিংবা আলোচনা থেকে কিন্তু অনেক ভালো কিছু উঠে আসতে পারে। পারস্পরিক সম্পর্ককে মজবুত করে। কিন্তু এখন তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বাস করছে ভার্চুয়াল জগতে। যার ফলে তারা বাস্তবতা ও ভার্চুয়াল জগতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। এর ফলে জীবনবোধ, মানবিকতাবোধ, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা সব কিছুই কমছে। তাই বলে প্রযুক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। চ্যাটিংও চলতে পারে। সেটা একটা লিমিটেডের মধ্যে। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো ফল বয়ে আনে না।
ফেরদৌসী রহমান
আসলে এক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষাটা খুব জরুরি। আমি কখনই প্রযুক্তি কিংবা ফেসবুকের বিপক্ষে নই। কারণ এগুলোর দরকার আছে। ফেসবুক ও টুইটার হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমি নিজেও ফেসবুক ব্যবহার করি। এর মাধ্যমে যদি বন্ধন দৃঢ় হয় সেটা ভালো। কিন্তু ফেসবুক কিংবা চ্যাটিংকে যদি কেউ নেশায় পরিণত করে তা নিয়ে অবশ্যই আপত্তি রয়েছে। এই প্রজন্মের মধ্যে এমনটা বেশি হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে অবশ্যই বাবা-মা কিংবা অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। তাদের এ বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে, বোঝাতে হবে। স্কুল ও কলেজের শিক্ষকরাও এসব বিষয়ে সচেতন করতে পারেন। ছোটবেলা থেকেই যদি সচেতন করা যায় তাহলে একজন ছেলে বা মেয়ে সেই মানসিকতা নিয়েই গড়ে ওঠে। কারণ যে কোনো নেশাই খারাপ। ফেসবুক যদি নেশা হয়ে যায় সেটাও ভয়াবহতা ডেকে আনতে পারে। ভার্চুয়াল দুনিয়া আর বাস্তব দুনিয়া এক নয়। আগের মতো আড্ডা এখন হয় না এটা একদম বাস্তব সত্যি। আর এর কারণে বন্ধুত্বও গড়ে উঠছে না। গড়ে উঠছে ফেসবুক বন্ধুত্ব। শুধুমাত্র ফেসবুক বন্ধুত্ব নির্ভরতার প্রতীক হতে পারে না। সুতরাং এ বিষয়ে নিজেদেরও সচেতন হতে হবে।
ড. ইনামুল হক
আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। কোনো কিছুতে তারা স্থির নয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে তরুণ সমাজের অস্থিরতা সহজেই দেখা যায়। আমি মনে করি তাদের ফেরানোর জন্য সংস্কৃতিমুখী করতে হবে। এছাড়া বই পড়ার অভ্যাস করাতে হবে। পাশাপাশি খেলাধুলায় তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন। এসব কাজে যুক্ত থাকলে তারা ফেসবুকের আসক্তি থেকে ফিরে আসবে। পরিবার থেকে শিশু প্রথম শিক্ষা নেয়। কিন্তু আজকাল অনেক পরিবারে দেখা যায় বাবা-মা দুজনের কেউ সৃজনশীল কোনো কাজের সঙ্গে নেই। ফলে তাদের সন্তান এক ধরনের হীনমন্যতায় বড় হয়। আমাদের সন্তানেরা সৃজনশীল কোনো কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে না বলেই ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহার করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এটির অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কিশোর-কিশোরীদের মেধাহীন করছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্যচ্যুত করছে বলেও আমার মনে হয়। অভিভাবকদের সন্তানদের প্রতি সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া তাদের হাতে মোবাইল দেয়াও বন্ধ করতে হবে। তরুণদের জন্য বলতে চাই ফেসবুকে সময় না দিয়ে তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকা প্রয়োজন। না হলে নিজেদের সর্বনাশের জন্য নিজেরাই দায়ী থাকতে হবে।
আবুল হায়াত
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুক। কিন্তু এই মাধ্যমকে আমি এখন কাজের চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মনে করি। এই যন্ত্রণার কারণে এখন আমি সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমের সঙ্গে আর নেই। ফেসবুকে আমি নেই তবুও আমাকে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। আমার নামে অনেকগুলো ফেইক আইডি রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দেয়া হচ্ছে সেসব আইডিগুলো থেকে। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাইনি। সত্যি বলতে আমাদের কিছু মানুষ ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এই আসক্তি অনেক বেশি। রাত জেগে তারা ফেসবুকে পড়ে থাকে। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সেখানেও এটিতে মগ্ন থাকে। এটিকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর মনে হচ্ছে। এটি আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা বলেও আমি মনে করি। ভালো একটি মাধ্যমকে আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। আমি মনে করি চীনের মতো আমাদের এটি বন্ধ করে যোগাযোগের জন্য বিকল্প কিছু করতে হবে। না হলে কিশোর-কিশোরীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট হবার প্রবণতা ক্রমেই বাড়বে।
সোহেল রানা
প্রযুক্তির ব্যবহার (নেট চ্যাটিং, ফেসবুক, টুইটার) এখন অনেক তরুণ-তরুণীই বেশ উপভোগ করছে। আগে আমরা টেলিভিশন দেখতাম সাদা-কালো, এখন দেখি রঙিন। আগে একরকম জিনিস ভালো লাগত, আর এখন অন্য কিছু হয়তো তরুণ-তরুণীদের চোখে ভালো লাগে। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের টেকনোলজির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের উন্নতিও হয়েছে। টেকেনোলজির দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে তীব্র গতিতে উন্নতির দিকে যাচ্ছে এখনকার তরুণ-তরুণীরা। যারা বলে টেকনোলজির ব্যবহারের ফলে অনেক ব্যাড ইফেক্ট আছে, তাদের ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই ব্যাড বা সাইড ইফেক্ট আগেও ছিল, এখনো আছে। জেনারেশন টু জেনারেশন সবসময়ই পরিবর্তন হবে-এটাই স্বাভাবিক। টেকনোলজির সুবাদে খারাপের চেয়ে আমি মনে করি ভালোর দিক বেশি। আর তরুণ-তরুণীরা দিনের পর দিন এর ব্যবহারের কল্যাণে অনেক ভালো ভালো কাজ আজ চারপাশে করছে। চলচ্চিত্রে রিলের ব্যবহার এখন নেই, ছোট্ট একটি চিপসের মাধ্যমে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ছবি দেখছে। টেকনোলজির জন্য আমাদের অনেক উন্নতি হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে দ্রুত সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। আড্ডা ভুলে মোবাইল এসএমএস বা চ্যাটিংয়ে মেতে থাকা তেমনই একটি পরিবর্তন। আর এসব পরিবর্তন সবসময়ই ভালো কিছুর জন্য হোক এটাই আমার চাওয়া থাকবে।
সুবীর নন্দী
এটা কঠিন বাস্তবতা। আগে পাড়া-মহল্লার আড্ডা কিংবা চায়ের চুমুকে টং দোকানের সেই আড্ডা আর দেখা যায় না। এমনকি গ্রামেও সেই আড্ডা এখন কম। সবাই যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আর এটা হয়েছে প্রযুক্তির ফলেই। মোবাইলের বাটন চাপলেই সারা বিশ্ব এখন হাতে। তাই এখনকার যুব সমাজ সেই ভার্চুয়াল বিশ্বেই আনন্দ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করে। ফেসবুক কিংবা টুইটার-আমি এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে নই। তবে সারাদিন চ্যাটিংয়ে পড়ে থাকার মধ্যে ভয়াবহতা লুকিয়ে আছে। সরাসরি বসে কথা বলা আর মোবাইলে কথা বলা কিন্তু এক বিষয় নয়। ঢাকায় থেকে মোবাইলে বলে দেয়া যায় আমি বরিশাল! এটা কিন্তু অহরহই হচ্ছে। ঠিক তেমনই আড্ডার মধ্যে দিয়ে যেমন সুন্দর সুন্দর আলোচনা হতে পারে। সংস্কৃতির চর্চা হতে পারে সেটা ভার্চুয়াল জগতে কই! অনেক সময় শুনি সারাদিন কিংবা সারারাত ফেসবুকে কাটিয়ে দিচ্ছে কেউ কেউ। এটা মর্মাহত করে আমাকে। শুধু পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করছে না, মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। কেউ যদি সারারাত ফেসবুক চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত থাকে সে কি করে সময়মতো সকালে উঠবে! সুতরাং সে কাজও সময়মতো শুরু করতে পারবে না। সে ছাত্রজীবন, ক্যারিয়ার কিংবা জীবনেও পিছিয়ে পড়বে। তাই আমি অনুরোধ করবো বিষয়টিতে সচেতন হতে। সময়ের মূল্য দিতে হবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বাস্তবতাটাকে বুঝতে হবে।
খুরশিদ আলম
প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে অনেক, কেড়েছে তার থেকে বেশি। বিষয়টি কিন্তু একদম সতি। কিন্তু এটা প্রযুক্তির দোষ নয়। এটা আমাদের নিজেদের দুর্বলতা। পৃথিবীর অন্য দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন তারা কিন্তু প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করছে। সারাদিন চ্যাটিংয়ে ডুবে থাকার সময় তাদের নেই। আগে আমাদের সারা দুনিয়ায় খ্যাতি ছিলো পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য। কিন্তু এখন তার উল্টো। আমি যদি সারাদিন কিংবা রাত চ্যাটিংয়ে ডুবে থাকি তাহলে পড়াশোনা করবো কখন? সংস্কৃতি কিংবা গান চর্চা করবো কখন? পরিবার কিংবা বন্ধুদের সময় দিবো কখন? তাহলে কি হচ্ছে? আমরা কিন্তু পিছিয়ে যাচ্ছি অনবরত। একদিকে আমরা যেমন পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি তেমনি নিজেরাও পিছিয়ে পড়ছি প্রতিটি ক্ষেত্রে। আমি ফেসবুকের বিরুদ্ধে নই। ফেসবুক ব্যবহার সারা বিশ্বেই হচ্ছে। কিন্তু সবসময় এটা নিয়ে থাকতে হবে কেন? এটা করতে করতে কিন্তু অনেক ক্ষতি করে ফেলছি আমরা। আর যখন অনুধাবন হবে তখন সময় আর হাতে থাকবে না। সুতরাং এগিয়ে যেতে হলে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে হবে, এটাকে নেশায় পরিণত করলে চলবে না।
ফেরদৌস ওয়াহিদ
আমি নিজেও ফেসবুক ব্যবহার করি। চ্যাটিংও করি। কিন্তু সেটা মাত্রাতিরিক্ত নয়। কারণ সীমা লঙ্ঘন করা ঠিক নয়। আমি মনে করি প্রযুক্তি সৃষ্টিকর্তার একটি দান। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। আমি ফেসবুক চালাবো। কিন্তু সেটাকে নেশায় পরিণত করবো না। এমন মনোভাব থাকতে হবে। সত্যিইতো এখন সবাই ইন্টারনেট নিয়ে পড়ে থাকে। সরাসরি বন্ধুত্বও এখন কম। ফেসবুক বন্ধু আর স্কুল, কলেজ কিংবা কর্মস্থলের বন্ধু কিন্তু এক নয়। যে কাছে আসবে না, মিশবে না, জানবে না, আনন্দ-কষ্ট ভাগাভাগি করবে না সেই বন্ধুত্ব আসলে বন্ধুত্ব নয়। সুতরাং আমি তরুণ প্রজন্মকে বলবো ফেসবুক চালাও, তবে সেটা সীমার মধ্যে থেকে। আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াও, আড্ডা দাও। দেখবে সেখান থেকে উঠে আসবে অনেক শিক্ষামূলক বিষয়ও, যেটা কাজে লাগবে পরবর্তী জীবনে।
ববিতা
এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লাগে না। কারণ আমার কাছে মনে হয় এই প্রযুক্তির ফলে তারা ভিন্ন জগতে প্রবেশ করছে। প্রতিনিয়ত পরিবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলছে। একটা উদাহরণ দিয়ে বললে ভালো হবে। যেমন ওদেরকে (ছেলে-মেয়েদের) কোনো বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাবার আগে প্রথমেই প্রশ্ন করে, ওখানে ইন্টারনেট কানেকশনটা কেমন, সিগন্যাল ঠিকমতো থাকবে কিনা। সব ঠিক থাকলে তারা যেতে চাইবে না হলে বলবে ওখানে গিয়ে আমরা কি করবো ? শুধু তাই না, আগে বন্ধু-বান্ধব, বাচ্চা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য মিলে যে আড্ডা হতো সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ের ছেলে মেয়েরা বিয়ে করছে ঠিকই, কিন্তু মেয়েরা অনেক সময় পরিবার অর্থাৎ তার স্বামীকেও ঠিকমতো সময় দিচ্ছে না। টেকনোলজি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলে চারপাশ যতটা উন্নত হয়েছে তেমনই আবার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে প্রতিনিয়ত বেশ ক্ষতিও আমরা দেখতে পাচ্ছি। তাই এটাকে আমি সাপোর্ট করি না।
আবিদা সুলতানা
এখন আড্ডা নেই, প্রকৃত বন্ধুত্বও নেই। দিন দিন আমরা কেবল যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করেছে ঠিক, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে পারস্পরিক বন্ধন। এখন এক বাড়িতে থেকেও পাশের ফ্ল্যাটের মানুষের খবরই কেউ রাখছেন না। অথচ আগে এমনটা ছিলো না। এখন মানুষ বন্দি জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর তার জন্য প্রযুক্তিকে বেছে নিয়েছে। ল্যাপটপ, মোবাইলের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে সে দেখছে নিজের মতো করে। আমার আশেপাশেই তো দেখি প্রযুক্তি কিভাবে গিলে খেয়েছে সহজ-সরলতাকে, বন্ধুত্বকে, পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধকে। ফেসবুক কোনো খারাপ বিষয় নয়, কিন্তু এটাকে নেশায় পরিণত করলে হবে না। আমি মনে করি পারিবারিক শিক্ষাই এখান থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে। পুরো জেনারেশন যদি ফেসবুক-মেসেঞ্জারে বুদ হয়ে থাকে, তবে ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
সারা যাকের
আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম শুধু ফেসবুক এটি আমি মনে করি না। ফেসবুক ছাড়াও যোগাযোগের আরো অনেক মাধ্যম রয়েছে। ফেসবুকে কেউ আসল জগৎ প্রকাশ করে না। তার কল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় বলে আমার মনে হয়। এটি না ব্যবহার করলে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে তারো কোনো আশঙ্কা নেই। অনেকেই বলে ফেসবুকে নাকি অনেক কিছু জানা যায়। আমি যখন আমার কোনো একটি লেখার লিংক শেয়ার করি সেটি অল্প কয়েকজন পড়ে। তাহলে কিশোর-কিশোরীরা কিংবা তরুণ সমাজ ফেসবুকে কি পড়ছে? ফেসবুকের চেয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে অনেক বেশি অজানা তথ্য জানা যায়। এই সময়ে এসে আমি উপলব্ধি করেছি আঠারো বছরের কম বয়সীদের ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাবা-মাকে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এর জন্য উদ্যোগ নেয়া যায়। রাষ্ট্র ও পরিবার থেকে যদি কোনো সঠিক উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে কিশোর-কিশোরীদের এবং তরুণ সমাজের ফেসবুকের এই আসক্তি কমবে। অন্যথায় সামাজিক যোগাযোগ শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
ডলি জহুর
ফেসবুক আমাদের মধ্যে ব্যাধির মতো হয়ে গেছে। যেখানে-সেখানে আমাদের অনেকেই এখন এটিতে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে। দেখা যায় কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছে, সেখানেও যে যার মতো ফেসবুকে চ্যাটিং করছে। এর মধ্য দিয়ে সাময়িক লাভবান হলেও একটা সময় একাকীত্বে ভুগতে হয়। মাধ্যমটা এমন হয়ে গেছে অনেকে এটিকে ছাড়া নিজকে ভাবতে পারে না। সত্যি বলতে প্রযুক্তি মানুষকে যেমন অনেক দূর নিয়ে যায় তেমনি অবক্ষয়ও করে। ফেসবুক তার জ্বলন্ত উদাহরণ আমি বলতে পারি। আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার জানতে হবে। নতুন প্রজন্মকেও প্রযুক্তির ব্যবহার শেখাতে হবে। কখন কোথায় কিভাবে এটিকে ব্যবহার করতে হবে সেটি তারা জানতে না পারলে ক্ষতির প্রভাবটি বাড়তে থাকবে। এদিকে এখন অনেক পরিবারে দেখি অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের মোবাইল কিনে দিচ্ছে বাবা-মা। পড়ালেখায় সময় না দিয়ে তারা মোবাইলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সময় ব্যয় করে। আমার মনে হয় এই বিষয়ে বাবা-মাকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। তবে অস্বীকার করার কিছু নেই সময়ের দাবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুকের কল্যাণে আজকাল অনেক কিছু সহজে জানা যায়।
চিত্রলেখা গুহ
প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। অনেক সময় জেনে না জেনেই এটির ব্যবহার করি। ফেসবুক আমাদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। এটি থেকে কাউকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়াও অনেকেই এটিতে সময় দিয়ে থাকে। একটি মাধ্যম যদি কাজের চেয়ে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেটি ব্যবহার না করা ভালো মনে করি। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আমি ফেসবুকে আসি না। সারা দিন ফেসবুকে সময় দিলে অন্য কাজ করার সময় কোথায়? এই বিষয়টি আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে। আজকাল তরুণ-তরুণীদের বাইরে অনেক বয়স্ক মানুষও ফেসবুকে অধিক সময় দিচ্ছেন। ফেসবুক ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ফেইক আইডি বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অধিকাংশ তরুণ-তরুণীকে একের অধিক আইডি ব্যবহার করতে দেখা যায়। রাত জেগে স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা চ্যাটিং করে। এ কারণে তাদের অনেকেই আবার পরদিন স্কুল কলেজে অনুপস্থিত থাকে। পরিবারের বাবা-মাকে এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। রাত জেগে তার সন্তান কি করছে সেটি দেখতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও তার ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন।
ইলিয়াস কাঞ্চন
বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের সুবাদে চ্যাটিংয়ে এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে সময় দিচ্ছে। আর আগে আমরা যখন আড্ডা দিতাম তখন অনেকজন থাকতো তাতে। অনেক বিষয়ে কথা হতো। আগে একান্নবর্তী পরিবারের যে বন্ধন ছিল সেটা তো একদমই এখন নেই, বলতে গেলে এককথায় ভেঙে গেছে। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের অনেকে নেশায়ও আসক্ত হচ্ছে। আর এ বিষয়গুলো পরিবারের লোকজনরাও অনেক সময় জানতে পারছে না। কারণ দরজা বন্ধ করে ছেলে-মেয়েরা চ্যাটিং করছে। অনেকে ড্রাইভিং সিটে বসে ফোনে কথা বলার পাশাপাশি চ্যাটিং করছে। যেখানে ড্রাইভিং সিটে বসে ফোন ব্যবহার করাটাই নিষেধ, সেখানে চ্যাটিং করা বা ফোনে কথা বলা- এসব তো বলতে গেলে জেনে শুনে মৃত্যুকে ডেকে আনা। তাই টেকনোলজির ব্যবহারে সতর্ক হওয়া উচিত।
মিশা সওদাগর
আমি চলচ্চিত্রের মানুষ। তাই চলচ্চিত্রের প্রমোশনের উদাহরণ দিয়ে এ বিষয়ে একটা কথা বলতে চাই। সেটা হচ্ছে এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা নেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক বেশি ব্যবহার করছে। হয়তো এজন্যই অনেক সিনেমার প্রমোশনে এখন ব্যবহার হচ্ছে এটি। তবে আমার কাছে মনে হয় এভাবে প্রমোশনের নামে সিনেমার ডিমোশন হচ্ছে। আমরা আগে একটা সময় সিনিয়র জুনিয়র মিলে গল্প করতাম। শুটিং সেটে বা ব্যক্তিগত জীবনে পরিবারের সকলের কাছে কিছু শেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন তো এটা দেখি না। সবাই নেট চ্যাটিংয়ে এতটাই ব্যস্ত যে সামনা সামনি আইডিয়া শেয়ারিং বা কোনো বিষয়ে আলোচনা তেমন হয় না বললেই চলে। আর চলচ্চিত্রের যারা প্রমোশন করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে তাদের ক্ষেত্রে বলতে চাই সিনেমা সর্বপ্রথম হলের জন্য, নেটের জন্য না। নেটে তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করে সিনেমা হলে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। আর খুব বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ফলে সাইড ইফেক্টও আছে অনেক। সেটা একটা ছেলে বা মেয়ের মানসিক বিকাশে প্রতিনিয়ত ক্ষতি করছে। কিন্তু সেই ছেলে বা মেয়েটি নিজে সেটা বুঝতে পারছে না।
শাবনূর
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আড্ডার চেয়ে সামনা সামনি দেখা ও কথা বলে আড্ডা দিতে আমি ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু এই প্রজন্মের আড্ডাটা ভিন্ন ধরনের। আগে একটা সময় আড্ডার মাধ্যমে ভালো কিছু উঠে আসত। এখন তো ফোনে বা নেটে সব সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। দেখা করতে হয় না। ছবি ভেসে ওঠে ফোনে। সবই টেকনোলজির কল্যাণে হয়েছে। তবে এর ফলে ভালোর পাশাপাশি খারাপ অনেক কিছুই ঘটছে। তাই আমি চাইবো সবাই এটার সুন্দর দিকগুলো ব্যবহার করুক, আর খারাপগুলো বর্জন করুক। এর বেশি কিছু বলার নেই আমার।
গ্রন্থনা: ফয়সাল রাব্বিকীন, কামরুজ্জামান মিলু ও এন আই বুলবুল
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, আমাদের সময় ফেসবুকের যুগ না থাকায় আমরা সামনাসামনিই বেশি যোগাযোগ করতাম। এখন আড্ডার ধরনটা বদলেছে কিন্তু যোগাযোগের পেছনে যে অন্তর্নিহিত মনোভাব সেটি এখনো বদলায়নি। তিনি বলেন, আগের যে আড্ডা, তারও ভালো- খারাপ দিক ছিল। এখন যে আড্ডা তারও ভালো-খারাপ দিক আছে। তবে, আমার মনে হয় মুখোমুখি বসে যে আড্ডা দেয়া সেটা এখনো কমেনি। তিনি বলেন, এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখি ছেলেমেয়েরা বসে গল্প করছে। টিএসসিতে গেলেই দেখা যায় এত ছেলেমেয়ে গল্প করছে যে, চলাচলই অনেক সময় মুশকিল হয়ে পড়ে। ওই আড্ডাটা বোধহয় একেবারেই বন্ধ হয়নি।
ড. কামাল হোসেন
সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, সমাজের পরিবেশ অনেকটা বদলানো হয়েছে। এক হচ্ছে রাজনীতির যে ভূমিকা মানুষকে একে অন্যের কাছে আনা, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এখন আমরা লক্ষ্য করছি রাজনীতি মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করছে। মানুষ মানুষের মধ্যে দূরত্ব। কেউ কারও প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে চায় বিতর্কিত হোক। এটা একটা রোগ যে অন্যকে বিতর্কিত করে দাও। আমরা লক্ষ্য করছি যে, রুগ্ণ রাজনীতির ফল। রুগ্ণ রাজনীতি খারাপের দিকে নেয়। রাজনীতিবিদরা ঐক্যের কথা বলেন কিন্তু করেন উল্টো কাজ। যদি সত্যিই ঐক্যের পরিবেশ থাকতো তবে ঐক্যেই হতো।
নূরে-আলম সিদ্দিকী
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরে-আলম সিদ্দিকী বলেন, আমাদের যৌবনের সময় সামনাসামনি আড্ডাটা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিকনির্ভর। রাজনীতির কারণে সেসময় বিভিন্ন স্থানে আড্ডা দিতাম আর তা থাকতো আলোচনা, চর্চা ও পর্যালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তখন যে যেই ছিল সে সেইভাবে আড্ডার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানের প্রসারতার কারণে মানুষের চিন্তাও দিগন্ত বিস্মৃত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আত্মকেন্দ্রিকও হয়ে যাচ্ছে। তাই বিজ্ঞানভিত্তিক ও আত্মকেন্দ্রিকতার সংমিশ্রণে অনেকে এক সঙ্গে বসে আড্ডা দেয় না। বরং তাদের চিন্তা ও মননশীলতার যাদের সঙ্গে মিল রয়েছে তাদের সঙ্গেই ইন্টারনেট ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে আড্ডা দিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি আড্ডাটা দেয়ার প্রবণতা এখন একবারেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এখন দেখা যায় মানুষ দূর দেশে অপরিচিত একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করছে অথচ পাশের বাসার প্রতিবেশী সম্বন্ধে ধারণা রাখছে না। এমনটা আমাদের সময় কখনো দেখা যেত না।
কামাল লোহানী
ভাষা সংগ্রামী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে। এসবের কারণে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। সময়ের পরিবর্তন যখন হয় তখন সঙ্গে সঙ্গে অন্য উপাচারগুলোর পরিবর্তন হতে থাকে। একারণেই নতুন কিছু আবির্ভাবের সঙ্গে ব্যবহারিক জীবন বা প্রায়োগিক জীবনের পদ্ধতিও পাল্টে যায়। তিনি বলেন, বাঙালি সমাজের যে সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল আড্ডা। আগে পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা হতো, চা-খানায় আড্ডা হতো, ঘরে বসে আড্ডা হতো। এখন সেগুলো নেই বললেই চলে। কামাল লোহানী বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে জিনিসটা হচ্ছে সেটির একদিকে যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি খারাপ দিকও আছে। ভালোর দিকটা যেটা হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই যোগাযোগ করা যায়। মুক্ত মনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা যায়। আর অসুবিধে যেটা হচ্ছে আমাদের চিন্তা- ভাবনার বিরুদ্ধে কিছু জিনিস আছে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছু ব্লগ আছে। সেখানে যা ইচ্ছা লেখা হচ্ছে। এগুলো লেখার সাহস যারা পায়, সরকার কি এগুলো দেখে না? আর যেসব ব্লগার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, জনগণের পক্ষে লেখে তাদেরকে মামলায় জড়িয়ে পড়তে হয়, গ্রেপ্তার হতে হয়।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, মুখোমুখি আড্ডায় যে একটা মানবিক স্পর্শ ছিল সেটা এখন উঠে গেছে। ফেসবুকের মাধ্যমে আড্ডা দিতে গিয়ে মানুষের নৈকট্যভিত্তিক যে আন্তঃমানবীয় সম্পর্ক সেটা কিন্তু বিঘ্নিত হচ্ছে। আর তার কারণটা হচ্ছে এখন জীবনযাপন, চলাচল অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকটা সময় অযথা ব্যয় করতে হয়। এর বিকল্প হিসেবে ফেসবুক প্রযুক্তি অনেকটা সহায়ক প্রযুক্তি হিসেবে কাজ করে। তিনি বলেন, মানুষের জন্য আন্তঃমানবীয় সংযোগ সবসময়ই প্রয়োজন রয়েছে। কারণ আন্তঃমানবীয় সংযোগের মধ্য দিয়ে আন্তঃমানবীয় কর্মকাণ্ড উৎসারিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভালো দিক হচ্ছে প্রযুক্তিভিত্তিক মানবীয় আন্তঃসম্পর্ক অনেকটা সহজ হয়েছে। আর আজকাল তো চলাচল করা বেশ কঠিন। পথেই অনেকটা সময় কেটে যায়। কাজেই আড্ডা দিতে হলে বা সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে ফেসবুক অনেকটা সহায়ক প্রযুক্তি হিসেবে কাজ করে। সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, যেকোনো প্রযুক্তি ব্যবহারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আছে। ইদানীংকালে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাত্রাটি সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব বেশ প্রকট হয়ে ওঠছে। এটি এখন আসক্তি পর্যায়ে চলে গেছে। সামাজিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাবও এখন দৃশ্যমান। আর দীর্ঘ সময় ধরে ফেসবুক ব্যবহার বিভিন্ন মানবিক রোগের কারণ। তাই অতিমাত্রায় কোনো কিছুই ভালো নয়। প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে রয়ে সয়ে।
গোলাম সারওয়ার
সমকাল পত্রিকার সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, আমরা আগে দিনে আড্ডা মারতাম, সবাই এক সঙ্গে বসে কথা বলতাম, নিকটজনের সঙ্গে ফুর্তি করতাম এটা এখন একেবারে শেষ হয়ে গেছে। নাতি-নাতনীদের সঙ্গেও আগে সামনে বসে কথা বলতাম, কোলে তুলে নিতাম সেটাও শেষ হওয়ার পথে। আমি আমার নাতিদের কথাই বলি তারা আমেরিকাতে থাকে। দেখা যায় এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে তারা এসএমএস দেয়। তারা দোতলায় থেকে বলে আমার জন্য এক গ্লাস পানি পাঠিয়ে দেও। একজনের সঙ্গে অন্য কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। পারস্পরিক সম্পর্কটা একেবারে শিথিল হয়ে গেছে। এটা আমাদের বয়স্কদের মেনে নিতে একটু কষ্ট হয়। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। আমরা চাইলেই তো আর এটা পরিবর্তন করতে পারবো না। তবে এখন সবাই বলছে তোমরা আইকনের দিকে চোখ না রেখে তোমাদের সামনে চোখ রাখো কিংবা প্রিয়জনের দিকে তাকাও। তবে এ অবস্থার এক সময় পরিবর্তন আসবেই।
আফসান চৌধুরী
কলামিষ্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী বলেন, মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আড্ডা অনেক বেশি দেয়। সামনাসামনি হয়তো আড্ডা কমে গেছে। ফেসবুক এখন আড্ডার জায়গা। যাদের সঙ্গে কখনো কথা হবে না, দেখা হবে না তাদের সঙ্গেও আড্ডা দেয়া হচ্ছে। আমি ফেসবুকের মাধ্যমে যেটি অর্জন করতে পারি সেটা তো সামনাসামনি আড্ডায় সম্ভব নয়। এখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে আড্ডা দেয়া হয়। যেটি আগে সম্ভব হতো না। আগে আড্ডা দিতো চার জন/ পাঁচজন। কিন্তু এখন তো ১০ রকম মানুষের সঙ্গে ফেসবুক টুইটারে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আগে সীমিত কয়েকজনের সঙ্গে সামনাসামনি আড্ডা হতো। কিন্তু এখন আড্ডার পরিসর অনেক বেড়েছে। যেটা হয় না সেটি হচ্ছে সামনাসামনি দেখা কম হচ্ছে। এটি সময়ের বাস্তবতা। আমাদের সবকিছুই এখন পাল্টে গেছে। তিনি বলেন, ১৯ শতকের আড্ডা আর ২০১৮ সালের আড্ডা কিভাবে একরকম হবে? অনেকে বলে ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। কিন্তু কিভাবে দিন কাটাইতাম সেটাতো বলেন না। আগে তো মানুষ খেতে পারতো না, পড়তে পারতো না, অসুখে মারা যেতো। সেগুলো কি সুন্দর দিন কাটানো। আফসান চৌধুরী বলেন, আমার ১০ ঘণ্টার আড্ডার দরকার নেই। প্রযুক্তির কল্যাণে আমার ১০ হাজার মানুষ আছে আড্ডা দেয়ার।
তারেক শামসুর রেহমান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, মানুষের যে সনাতন আড্ডা তা এখন আর নাই। এটা দখল করে নিয়েছে ফেসবুক টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভালো প্রভাব ফেলছে। সেটা একধরনের নেতিবাচক প্রভাবে ফেলছে। গণমাধ্যমে যে ধরনের সংবাদ বা ছবি প্রকাশ হচ্ছে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে যেকোনো সংবাদ বা ছবি পোস্ট করে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, উত্তেজনা বাড়াতে পারে বা এটা খারাপ দিকটাকে তুলে ধরে সেই সঙ্গে এটাও সত্য একুশ শতকে দাঁড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারবো না। আমাদের সামাজিক গণমাধ্যমের প্রয়োজন আছে। তার বড় উদাহরণ হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট ব্যবহার করেন। তার দেখাদেখি আমাদের রাজনীতিবিদরাও টুইট ব্যবহার করছেন। মোদ্দাকথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভালো দিকগুলো আমরা ব্যবহার করছি কম। ফলে নেতিবাচক দিকগুলোই আমাদের সমাজে প্রভাব ফেলে। এক সময়কার বন্ধুদের মধ্যে আড্ডা এবং জড়ো হওয়ার প্রবণতা কমে গেছে।
আসিফ নজরুল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল বলেন, যখন জীবিত মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক কমে যায় তখন সম্ভবত মানবিকতা কমে যায়। বাস্তবতা থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড কিন্তু রিয়েলিটি না। সেখানে সোর্স অব ইনফরমেশন, যে প্যাশন, একজন আরেকজনকে যে ফিলিংস, সহমর্মিতা দেখায় এটা খুব জেনুইন হওয়ার কথা না। একজন আরেকজনের সঙ্গে যখন মুখোমুখি ইন্টার্যাক্ট করে তখন যেই সৎভাবে ফিলিংস এক্সপ্রেস করে ভার্চুয়ালভাবে সেভাবে সম্ভব না। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে যোগাযোগ হয় অনেকক্ষেত্রেই চিন্তা-ভাবনা, প্রেক্ষাপট ছাড়া। যখন জেনুইন ইন্টার্যাকশন হয় তখন সেটার একটা প্রেক্ষাপট থাকে। সরাসরি বিষয় সম্পর্কিত হয়। আবার ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে সীমাবদ্ধতা থাকে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড মানুষের প্রকাশ ভঙ্গি, আবেগ, পারস্পরিক ইন্টার্যাকশন, মানবিকতা প্রকাশের সুযোগ অনেক কম। সেখানে মানুষ অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে। ফলে জটিলতা বেড়ে যায়। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে তথ্য অসংখ্য এবং অনেক রকম। ফলে আপনার বাস্তব ওয়ার্ল্ডে তথ্য যেভাবে ডিল করতে পারে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে তথ্য সেভাবে ডিল করতে পারে না। ফলে অনেক রং এক্সপ্রেশন আসতে পারে। ইমোশন ও প্রকাশ ভঙ্গির সততা কমে যায়।
রাজনীতিতে এটার প্রভাব অবশ্যই পড়ছে। একটা জিনিস আপনি পছন্দ করেন না কিংবা আপনি দেশপ্রেম দেখাতে চান তবে ফিজিক্যালি উপস্থিত হয়ে আপনাকে দেখাতে হবে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে আপনি দেশপ্রেম এক ক্লিকেই প্রকাশ করছেন। মনে হচ্ছে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলছেন। বেশিরভাগ মানুষ দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে হোক বা তার ভালোবাসা বা ঘৃণা প্রকাশ এতই ইজিলি এক্সপ্রেস করে সেটার জন্য তাকে কোনো রকম আত্মত্যাগের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তাকে ফিজিক্যাল যে কষ্ট বা ত্যাগ স্বীকার করতে হয় না। ফলে পলিটিক্সে মানুষের অংশগ্রহণ বা ক্ষোভে অংশগ্রহণ, প্রতিবাদে অংশগ্রহণের ফিজিক্যাল মাত্রাকে কমিয়ে দিয়েছে। আবার যোগাযোগ মাধ্যমে খুব দ্রুত তথ্য প্রেরণ সম্ভব হয় বলে ওইখানে সীমিত পরিসরে হলেও নতুন প্রতিবাদের জায়গা তৈরি হয়েছে। ফলে প্রতিবাদ করার ঝোঁকটা কমে যেতে পারে। একটা জিনিসের প্রতি প্রচণ্ড আপত্তি অনুভব করি, ঘৃণা করি। গুমের বিরুদ্ধে একটা সমাবেশে যাওয়ার যে তাড়না অনুভব করি তার চেয়ে ফেসবুকে পাঁচ-দশটা লাইভ দিয়ে ওই তাড়না মোচন করি তবে সেখানে যাওয়ার আগ্রহ থাকে না। এভাবে হয়তো সমাজে প্রভাব ফেলছে।
আমেনা মোহসিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আমেনা মোহসিন বলেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে আসক্ত হওয়ার কারণে মানুষ খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম হলো ইন্টার্যাকশন। মানুষের প্রতি মানুষের দয়া মায়া বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা এবং পরিবারের মধ্যে যে বন্ধনগুলো এসব কমে যাচ্ছে। মানুষের কতগুলো মৌলিক মানবীয় ব্যাপার আছে যেমন মেলামেশা সেটা যদি ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে চলে যায় তখন কিন্তু ডাইমেনশনগুলো অন্যরকম হয়ে যায়। আমরা বলছি যে, র্যাডিক্যালাইজেশন বা সংকীর্ণতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং মানুষ বেশি অন্তর্মুখী ও চরমপন্থি হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনলাইন র্যাডিক্যালাইজেশন হচ্ছে।
তৌহিদুল হক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, একটা সময় বাঙালি সম্পর্কের অন্যতম ধরন ছিল বিভিন্ন বয়সের সবাই মিলে বিভিন্ন বিষয়ে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি বিষয়ে পারস্পরিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সংস্কৃতি ছিল। সেই বিষয়টি একবারে উঠে গেছে তা নয়। সামাজিক মিডিয়া নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে। সামাজিক মিডিয়ার দাপট বেশি আগের পারস্পরিক আড্ডার। তবে আড্ডা দিলেও মিডিয়া এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে আড্ডা দিতে পারে। এক জায়গায় তারা একত্রিত না হলেও হয়। এটার পজিটিভ দিক হলো মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, পারস্পরিক যোগাযোগ হচ্ছে সেটা অসুবিধার কিছু না। যে জায়গাটিতে আমাদের সতর্ক হওয়ার সুযোগ আছে সেটি হচ্ছে আমরা বাঙালিরা যে ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করে তার সঙ্গে এই ধরনের প্রক্রিয়াটার সম্পর্কটা অপেক্ষাকৃত কম। প্রতিটি দেশের মানুষের যে সামাজিকীকরণ নিজ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে পরিচালিত হয়। তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি যখন বিভিন্ন বয়সের মানুষ যখন এক সঙ্গে আড্ডায় বসবে তখন পারস্পরিক সম্প্রীতি বাড়বে, মুখোমুখি সময় কাটানোর মধ্য দিয়ে দুঃখবোধ বা সুখ ভাগাভাগির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাড়ে। অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বৃহৎ পরিসরে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করার উদ্দীপনা কিংবা চিন্তা আড্ডা থেকে এসেছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সৃষ্টিশীল কিংবা নতুন কিছু উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। মুখোমুখি আড্ডার মধ্য দিয়ে সম্প্রীতি তৈরি হয়, এর মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সৃষ্টি হয়। সমাজ জীবনের বৈশিষ্ট্যে আড্ডার যে ভূমিকা তাতে সামাজিক যোগাযোগে আড্ডার পরিবর্তে মুখোমুখি আড্ডাকে বেশি উৎসাহিত করা উচিত।
মাহমুদুর রহমান
আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, মানুষ এখন এক সঙ্গে বসে আড্ডা না দেয়ার একটা কারণ হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। এখন গুমের সংখ্যা এত বেড়েছে যে, তারা এখন এক জায়গায় বসাকে নিরাপদ মনে করছেন না। একসঙ্গে বসে আড্ডা দিলে সেখান থেকে তারা নিরাপদে ফেরত যেতে পারবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে মানুষ এখন ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ছাত্রজীবনে আমাদের সামনাসামনি অথবা বিভিন্ন জায়গায় বসে যে আড্ডাটা ছিল সেটা এখন তারা ফেসবুকে দিচ্ছে। সোশ্যাল মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়িয়ে সেসব আড্ডার কাজটা সেরে ফেলছে। মোট কথা আমি মনে করি নিরাপত্তা আর ফেসবুক আসক্তি হচ্ছে সামনাসামনি আড্ডা না দেয়ার কারণ।
আ.স.ম আবদুর রব
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) রব এর প্রধান আ.স.ম আবদুর রব বলেন, আগে মানুষ একজন আরেকজনকে দেখলে দাঁড়িয়ে কথা বলতো কিংবা এক সঙ্গে বসে আড্ডা দিতো। তখন মানুষ অধিকাংশ ছিল বেকার। তাদের কাজকর্ম তেমন ছিল না। এখন তাদের সময়ের খুব অভাব। আগে এত কর্মসংস্থান, ইন্টারন্যাশনাল প্রফেশনাল ছিল না। এখন সরকারি-বেসরকারি বহু প্রফেশন হয়ে গেছে। এখন সবাই তার নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার কিংবা অপ্রয়োজনীয় সময় তাদের নেই। তারা স্কুল-ভার্সিটিতে এসেও একসঙ্গে বসে খুব একটা আড্ডা দেয় না। দূর থেকে হাত জাগিয়ে হায়- হ্যালো বলেই চলে যায়। আমি বলবো মানুষ তার প্রফেশনের দিকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে সামনাসামনি আড্ডাটা কমিয়ে দিয়েছে।
আনু মুহাম্মদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সাক্ষাতে আড্ডাটা কমে গেছে বলে আমি মনে করি না। আমার পাড়ায় তো দেখেছি ছেলেমেয়ে প্রতিনিয়ত আড্ডা দিচ্ছে। সাক্ষাৎ করছে। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভার্চুয়াল মাধ্যমেও তারা যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে ইন্টারনেটে যোগাযোগের কারণে সাক্ষাৎ কমেনি।
ড. শাহদীন মালিক
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ইন্টারনেটে সময় কাটানো- এটি সারা দুনিয়াতেই হচ্ছে। আর আমাদের এখানে বিশেষ করে ঢাকার মতো বড় শহরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটানো বেশি হচ্ছে- এর কারণ উন্মুক্ত পরিসরের অভাব। এই শহরে বহু মানুষ বিশেষ করে তরুণসমাজ মেসে থাকে। কিছু মানুষ ফ্ল্যাটে থাকলেও ছোট জায়গায়, ছোট পরিসরে থাকে। আড্ডা দেয়ার জন্য উন্মুক্ত স্থান কমে গেছে। আর বন্ধু বা আত্মীয়র বাসায় যাতায়াতও একটি বড় সমস্যা। এসব কারণে মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হতে বাধ্য হয়েছে। আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে ইন্টারনেটের প্রচলন বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে, সার্বিকভাবে এটি সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নয়। কারণ, এতে করে আমাদের সামাজিক বন্ধনটা নিবিড় হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক অপরাধমূলক, অশ্লীল, অপ্রয়োজনীয় ও নোংরা বিনোদন বেড়ে গেছে। যার প্রভাবও সুখকর হবে না। ড. শাহদীন মালিক বলেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্যান্য দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে চর্চা হয়, আমাদের তরুণ সমাজে সেটি নেই বললেই চলে। ফলে, ইন্টারনেট বা তথ্যপ্রযুক্তির ভালো দিকটার সুফল আমরা পাচ্ছি না। আমাদের তরুণ সমাজও ভালো দিকটার সুফল গ্রহণ করতে পারছে না। এটি উদ্বেগের বিষয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান
টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সামাজিকতা, আড্ডার মধ্যে নির্মোহ আনন্দ উৎসাহ পাওয়া যায়। আড্ডার মাধ্যমে মানুষ নিজেদের মধ্যে জ্ঞানের ভাণ্ডার বিস্তৃত করার সুযোগ পায়। একই সঙ্গে সৃষ্টিশীল কাজেও আড্ডা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে আড্ডা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো বিবেচনায় নিলে আড্ডা এখন উঠেই গেছে বলা যায়। এটি অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এতে করে আমরা সৃষ্টিশীলতা হারাচ্ছি। আমাদের সামাজিক বন্ধন কমে যাচ্ছে। এখন সামাজিক বন্ধন যদি না থাকে তাহলে মানুষের নৈতিক মানবিক গুণাবলী কমে যায় এবং জ্ঞানের যে বিস্তৃতি বা ভাণ্ডার, সেটিও কমে আসে। তিনি বলেন, প্রযুক্তির অনেক ইতিবাচক দিক আছে। পাশাপাশি এর নেতিবাচক দিকও আছে। নেতিবাচক দিকের কারণে শুধু আড্ডাই নয় পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেখা গেছে একই পরিবারের তিনজন পাশাপাশি বসে আছি। কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছি না। যার যার ফোন বা অন্য কোনো প্রযুক্তিতে ব্যস্ত আছে। এই প্রবণতা তরুণ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটি নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া প্রযুক্তিতে কেউ কেউ এমনভাবে আসক্ত হয় যে আড্ডার বিষয়টি শুধু যে চাপা পড়ে যায় তা-ই না, বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করে। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রযুক্তির একটি ব্যালেন্স বা সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার যারা করতে পেরেছে বা পারছে, তারাই এটার সম্পূর্ণ ইতিবাচক ফল পাচ্ছে। আর যারা পারছে না তারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিচ্যুত হচ্ছে।
গোলাম মোর্তুজা
সাংবাদিক গোলাম মোর্তুজা বলেন, স্বাভাবিকভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনের জায়গাটাতে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে সবকিছু প্রযুক্তি কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বাংলাদেশও এখন সেই ধারাতেই আছে। বাচ্চারা এখন কম্পিউটার, ট্যাবে ফুটবল খেলে। এখন এটার খারাপ দিক হচ্ছে মানুষে মানুষে যে একটা সংযোগ হওয়া, মানুষের সম্পর্কে জানা-বোঝা- এ জিনিসগুলো এখন কমে গেছে। এখন সবকিছু হয়ে গেছে ভার্চুয়াল জগতকেন্দ্রিক। তিনি বলেন, ভার্চুয়াল জগত একটি আলাদা জগত। এ জগৎ থেকে বাস্তব জগত একটু আলাদা। ভার্চুয়ালের সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক একটু কম থাকে। আর এই দিকটি ভালো কি খারাপ, এটা আসলে এক বাক্যে বলা সম্ভবও নয় যে, আগেরটা ভালো এখনকারটা খারাপ। তবে, আগে মানুষের মধ্যে একধরনের সম্পর্ক তৈরি হতো। মানুষে মানুষে চিনত-জানতো। এখন সেই জায়গাগুলো কিছুটা কমে এসেছে।
তিনি বলেন, ভার্চুয়াল জগতের কিছু ইতিবাচক দিক আছে। যেমন অনেক গ্রুপ তৈরি হয়। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হয় না। কিন্তু একজন আরেকজনকে জানে, অনলাইন থেকে। বিভিন্ন
সময়ে তারা ইতিবাচক সামাজিক কাজ করে। একজনের বিপদে আরেকজন সহায়তা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই যোগাযোগটা বা মানুষের জন্য কিছু করা- এটাও ভার্চুয়াল জগতের কারণে অনেক বেড়ে গেছে। একটা সময় কারো রক্তের প্রয়োজন হলে পারিবারিকভাবে যোগযোগ করা হতো। এখন পাঁচ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হলে ফেসবুকে এটি প্রচার করলে ব্যক্তিগত বন্ধু, বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে এবং রক্ত পাওয়া যাবে। গোলাম মর্তুজা বলেন, সামগ্রিকভাবে ভার্চুয়াল জগতের কারণে আড্ডার জায়গাটা বা আমাদের যে সংস্কৃতি ছিল সেটি যেহেতু এখন কমে গেছে, সেহেতু আমাদের মধ্যে একধরনের হা-হুতাশ আছে যে আড্ডা থাকলো না, মানুষে মানুষে সম্পৃক্ততা থাকলো না। তবে, আমি মনে করি এটা নিয়ে ওইভাবে হা-হুতাশের কিছু নেই। এটি সময়ের দাবি। প্রযুক্তি বাদ দিয়ে চিন্তা করার সুযোগ নেই। আমাদের প্রযুক্তির মধ্যেই থাকতে হবে। আর এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় যেহেতু নেই, তাই কী করে প্রযুক্তিকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়, ব্যবহার করা যায়- সেই ব্যবস্থাই করা দরকার।
গোলাম মওলা রনি
সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মওরা রনি বলেন, ভার্চুয়াল জগতে আমরা যে কাজ করছি- সেটি হলো রুঢ় বাস্তবতা। এই মুহূর্তে ঢাকা শহরের যে সমস্যা, তাতে আড্ডা দেয়ার জন্য ৫০ জন লোককে জড়ো করতে হলে, ৮-১০ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। কিন্তু ফেসবুকে চ্যাটিং করলে কিছুই করতে হবে না। শুধু বলবো, আমি অনলাইনে আছি, কে কোথায় আছো। তিনি বলেন, বর্তমান ব্যস্ত নগরজীবনে ভার্চয়াল আড্ডা বাস্তবতা। কিন্তু এটার খারাপ দিক হলো, এটি মানুষকে দিনের পর দিন পাষাণ করে দিচ্ছে, দিনের পর দিন মানুষকে বন্ধনহীন করে তুলছে, মানুষের চিন্তা-চেতনার যে মৌলিকত্ব সেটি নষ্ট করে দিচ্ছে। কিছু মানুষকে বাস্তবতা বিমুখ করে হিংস্র ও রক্ষণাত্মক বানিয়ে ফেলছে। গোলাম মওলা রনি বলেন, মুখোমুখি আড্ডার যে সুবিধা তাতে আন্তরিকতা বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে। আড্ডার মাধ্যমে শিল্প সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। আড্ডা না থাকলে সৃষ্টিশীলতা আসে না। কারো প্রতি আন্তরিকতা শ্রদ্ধাবোধ আসে না। একে অপরকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হয় না।
শামা ওবায়েদ
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শুধু দেশেই নয়, সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেই কিন্তু বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছে। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সামনাসামনি যোগাযোগও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী লোকের সংখ্যা হয়তো বেড়েছে। কিন্তু এখনো গ্রামে-গঞ্জে সামাজিকভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগই কিন্তু বেশি কাজে লাগে। আর আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংগঠনকে ছোট করা বা অপমান করার জন্য ব্যবহার করা না হয়।
সৈয়দ আবদুল হাদি
প্রতিটি বিষয়ের ভালো ও খারাপ দিক রয়েছে। এখন দিন বদলেছে। সময় বদলেছে। প্রযুক্তি ভর করেছে। এটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে খারাপ না। কিন্তু ল্যাপটপ ও মোবাইলে ফেসবুক চ্যাটিংয়ের যে ব্যাপারটা এটা কিন্তু মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আমি ফেসবুকের বিপক্ষে নই। কিন্তু সব কিছুর একটা মাত্রা থাকা দরকার। এখানে আমরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করছি। অথচ সীমিত প্রযুক্তির ব্যবহার কিন্তু আমাদের আরো ভালোর দিকে নিয়ে যেতে পারে। পাড়া-মহল্লার আড্ডা কিংবা চায়ের টেবিলের আড্ডা কিংবা আলোচনা থেকে কিন্তু অনেক ভালো কিছু উঠে আসতে পারে। পারস্পরিক সম্পর্ককে মজবুত করে। কিন্তু এখন তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বাস করছে ভার্চুয়াল জগতে। যার ফলে তারা বাস্তবতা ও ভার্চুয়াল জগতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। এর ফলে জীবনবোধ, মানবিকতাবোধ, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা সব কিছুই কমছে। তাই বলে প্রযুক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। চ্যাটিংও চলতে পারে। সেটা একটা লিমিটেডের মধ্যে। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো ফল বয়ে আনে না।
ফেরদৌসী রহমান
আসলে এক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষাটা খুব জরুরি। আমি কখনই প্রযুক্তি কিংবা ফেসবুকের বিপক্ষে নই। কারণ এগুলোর দরকার আছে। ফেসবুক ও টুইটার হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমি নিজেও ফেসবুক ব্যবহার করি। এর মাধ্যমে যদি বন্ধন দৃঢ় হয় সেটা ভালো। কিন্তু ফেসবুক কিংবা চ্যাটিংকে যদি কেউ নেশায় পরিণত করে তা নিয়ে অবশ্যই আপত্তি রয়েছে। এই প্রজন্মের মধ্যে এমনটা বেশি হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে অবশ্যই বাবা-মা কিংবা অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। তাদের এ বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে, বোঝাতে হবে। স্কুল ও কলেজের শিক্ষকরাও এসব বিষয়ে সচেতন করতে পারেন। ছোটবেলা থেকেই যদি সচেতন করা যায় তাহলে একজন ছেলে বা মেয়ে সেই মানসিকতা নিয়েই গড়ে ওঠে। কারণ যে কোনো নেশাই খারাপ। ফেসবুক যদি নেশা হয়ে যায় সেটাও ভয়াবহতা ডেকে আনতে পারে। ভার্চুয়াল দুনিয়া আর বাস্তব দুনিয়া এক নয়। আগের মতো আড্ডা এখন হয় না এটা একদম বাস্তব সত্যি। আর এর কারণে বন্ধুত্বও গড়ে উঠছে না। গড়ে উঠছে ফেসবুক বন্ধুত্ব। শুধুমাত্র ফেসবুক বন্ধুত্ব নির্ভরতার প্রতীক হতে পারে না। সুতরাং এ বিষয়ে নিজেদেরও সচেতন হতে হবে।
ড. ইনামুল হক
আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। কোনো কিছুতে তারা স্থির নয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে তরুণ সমাজের অস্থিরতা সহজেই দেখা যায়। আমি মনে করি তাদের ফেরানোর জন্য সংস্কৃতিমুখী করতে হবে। এছাড়া বই পড়ার অভ্যাস করাতে হবে। পাশাপাশি খেলাধুলায় তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন। এসব কাজে যুক্ত থাকলে তারা ফেসবুকের আসক্তি থেকে ফিরে আসবে। পরিবার থেকে শিশু প্রথম শিক্ষা নেয়। কিন্তু আজকাল অনেক পরিবারে দেখা যায় বাবা-মা দুজনের কেউ সৃজনশীল কোনো কাজের সঙ্গে নেই। ফলে তাদের সন্তান এক ধরনের হীনমন্যতায় বড় হয়। আমাদের সন্তানেরা সৃজনশীল কোনো কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে না বলেই ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহার করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এটির অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কিশোর-কিশোরীদের মেধাহীন করছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্যচ্যুত করছে বলেও আমার মনে হয়। অভিভাবকদের সন্তানদের প্রতি সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া তাদের হাতে মোবাইল দেয়াও বন্ধ করতে হবে। তরুণদের জন্য বলতে চাই ফেসবুকে সময় না দিয়ে তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকা প্রয়োজন। না হলে নিজেদের সর্বনাশের জন্য নিজেরাই দায়ী থাকতে হবে।
আবুল হায়াত
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুক। কিন্তু এই মাধ্যমকে আমি এখন কাজের চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মনে করি। এই যন্ত্রণার কারণে এখন আমি সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমের সঙ্গে আর নেই। ফেসবুকে আমি নেই তবুও আমাকে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। আমার নামে অনেকগুলো ফেইক আইডি রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দেয়া হচ্ছে সেসব আইডিগুলো থেকে। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাইনি। সত্যি বলতে আমাদের কিছু মানুষ ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এই আসক্তি অনেক বেশি। রাত জেগে তারা ফেসবুকে পড়ে থাকে। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সেখানেও এটিতে মগ্ন থাকে। এটিকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর মনে হচ্ছে। এটি আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা বলেও আমি মনে করি। ভালো একটি মাধ্যমকে আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। আমি মনে করি চীনের মতো আমাদের এটি বন্ধ করে যোগাযোগের জন্য বিকল্প কিছু করতে হবে। না হলে কিশোর-কিশোরীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট হবার প্রবণতা ক্রমেই বাড়বে।
সোহেল রানা
প্রযুক্তির ব্যবহার (নেট চ্যাটিং, ফেসবুক, টুইটার) এখন অনেক তরুণ-তরুণীই বেশ উপভোগ করছে। আগে আমরা টেলিভিশন দেখতাম সাদা-কালো, এখন দেখি রঙিন। আগে একরকম জিনিস ভালো লাগত, আর এখন অন্য কিছু হয়তো তরুণ-তরুণীদের চোখে ভালো লাগে। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের টেকনোলজির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের উন্নতিও হয়েছে। টেকেনোলজির দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে তীব্র গতিতে উন্নতির দিকে যাচ্ছে এখনকার তরুণ-তরুণীরা। যারা বলে টেকনোলজির ব্যবহারের ফলে অনেক ব্যাড ইফেক্ট আছে, তাদের ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই ব্যাড বা সাইড ইফেক্ট আগেও ছিল, এখনো আছে। জেনারেশন টু জেনারেশন সবসময়ই পরিবর্তন হবে-এটাই স্বাভাবিক। টেকনোলজির সুবাদে খারাপের চেয়ে আমি মনে করি ভালোর দিক বেশি। আর তরুণ-তরুণীরা দিনের পর দিন এর ব্যবহারের কল্যাণে অনেক ভালো ভালো কাজ আজ চারপাশে করছে। চলচ্চিত্রে রিলের ব্যবহার এখন নেই, ছোট্ট একটি চিপসের মাধ্যমে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ছবি দেখছে। টেকনোলজির জন্য আমাদের অনেক উন্নতি হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে দ্রুত সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। আড্ডা ভুলে মোবাইল এসএমএস বা চ্যাটিংয়ে মেতে থাকা তেমনই একটি পরিবর্তন। আর এসব পরিবর্তন সবসময়ই ভালো কিছুর জন্য হোক এটাই আমার চাওয়া থাকবে।
সুবীর নন্দী
এটা কঠিন বাস্তবতা। আগে পাড়া-মহল্লার আড্ডা কিংবা চায়ের চুমুকে টং দোকানের সেই আড্ডা আর দেখা যায় না। এমনকি গ্রামেও সেই আড্ডা এখন কম। সবাই যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আর এটা হয়েছে প্রযুক্তির ফলেই। মোবাইলের বাটন চাপলেই সারা বিশ্ব এখন হাতে। তাই এখনকার যুব সমাজ সেই ভার্চুয়াল বিশ্বেই আনন্দ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করে। ফেসবুক কিংবা টুইটার-আমি এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে নই। তবে সারাদিন চ্যাটিংয়ে পড়ে থাকার মধ্যে ভয়াবহতা লুকিয়ে আছে। সরাসরি বসে কথা বলা আর মোবাইলে কথা বলা কিন্তু এক বিষয় নয়। ঢাকায় থেকে মোবাইলে বলে দেয়া যায় আমি বরিশাল! এটা কিন্তু অহরহই হচ্ছে। ঠিক তেমনই আড্ডার মধ্যে দিয়ে যেমন সুন্দর সুন্দর আলোচনা হতে পারে। সংস্কৃতির চর্চা হতে পারে সেটা ভার্চুয়াল জগতে কই! অনেক সময় শুনি সারাদিন কিংবা সারারাত ফেসবুকে কাটিয়ে দিচ্ছে কেউ কেউ। এটা মর্মাহত করে আমাকে। শুধু পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করছে না, মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। কেউ যদি সারারাত ফেসবুক চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত থাকে সে কি করে সময়মতো সকালে উঠবে! সুতরাং সে কাজও সময়মতো শুরু করতে পারবে না। সে ছাত্রজীবন, ক্যারিয়ার কিংবা জীবনেও পিছিয়ে পড়বে। তাই আমি অনুরোধ করবো বিষয়টিতে সচেতন হতে। সময়ের মূল্য দিতে হবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বাস্তবতাটাকে বুঝতে হবে।
খুরশিদ আলম
প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে অনেক, কেড়েছে তার থেকে বেশি। বিষয়টি কিন্তু একদম সতি। কিন্তু এটা প্রযুক্তির দোষ নয়। এটা আমাদের নিজেদের দুর্বলতা। পৃথিবীর অন্য দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন তারা কিন্তু প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করছে। সারাদিন চ্যাটিংয়ে ডুবে থাকার সময় তাদের নেই। আগে আমাদের সারা দুনিয়ায় খ্যাতি ছিলো পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য। কিন্তু এখন তার উল্টো। আমি যদি সারাদিন কিংবা রাত চ্যাটিংয়ে ডুবে থাকি তাহলে পড়াশোনা করবো কখন? সংস্কৃতি কিংবা গান চর্চা করবো কখন? পরিবার কিংবা বন্ধুদের সময় দিবো কখন? তাহলে কি হচ্ছে? আমরা কিন্তু পিছিয়ে যাচ্ছি অনবরত। একদিকে আমরা যেমন পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি তেমনি নিজেরাও পিছিয়ে পড়ছি প্রতিটি ক্ষেত্রে। আমি ফেসবুকের বিরুদ্ধে নই। ফেসবুক ব্যবহার সারা বিশ্বেই হচ্ছে। কিন্তু সবসময় এটা নিয়ে থাকতে হবে কেন? এটা করতে করতে কিন্তু অনেক ক্ষতি করে ফেলছি আমরা। আর যখন অনুধাবন হবে তখন সময় আর হাতে থাকবে না। সুতরাং এগিয়ে যেতে হলে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে হবে, এটাকে নেশায় পরিণত করলে চলবে না।
ফেরদৌস ওয়াহিদ
আমি নিজেও ফেসবুক ব্যবহার করি। চ্যাটিংও করি। কিন্তু সেটা মাত্রাতিরিক্ত নয়। কারণ সীমা লঙ্ঘন করা ঠিক নয়। আমি মনে করি প্রযুক্তি সৃষ্টিকর্তার একটি দান। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। আমি ফেসবুক চালাবো। কিন্তু সেটাকে নেশায় পরিণত করবো না। এমন মনোভাব থাকতে হবে। সত্যিইতো এখন সবাই ইন্টারনেট নিয়ে পড়ে থাকে। সরাসরি বন্ধুত্বও এখন কম। ফেসবুক বন্ধু আর স্কুল, কলেজ কিংবা কর্মস্থলের বন্ধু কিন্তু এক নয়। যে কাছে আসবে না, মিশবে না, জানবে না, আনন্দ-কষ্ট ভাগাভাগি করবে না সেই বন্ধুত্ব আসলে বন্ধুত্ব নয়। সুতরাং আমি তরুণ প্রজন্মকে বলবো ফেসবুক চালাও, তবে সেটা সীমার মধ্যে থেকে। আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াও, আড্ডা দাও। দেখবে সেখান থেকে উঠে আসবে অনেক শিক্ষামূলক বিষয়ও, যেটা কাজে লাগবে পরবর্তী জীবনে।
ববিতা
এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লাগে না। কারণ আমার কাছে মনে হয় এই প্রযুক্তির ফলে তারা ভিন্ন জগতে প্রবেশ করছে। প্রতিনিয়ত পরিবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলছে। একটা উদাহরণ দিয়ে বললে ভালো হবে। যেমন ওদেরকে (ছেলে-মেয়েদের) কোনো বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাবার আগে প্রথমেই প্রশ্ন করে, ওখানে ইন্টারনেট কানেকশনটা কেমন, সিগন্যাল ঠিকমতো থাকবে কিনা। সব ঠিক থাকলে তারা যেতে চাইবে না হলে বলবে ওখানে গিয়ে আমরা কি করবো ? শুধু তাই না, আগে বন্ধু-বান্ধব, বাচ্চা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য মিলে যে আড্ডা হতো সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ের ছেলে মেয়েরা বিয়ে করছে ঠিকই, কিন্তু মেয়েরা অনেক সময় পরিবার অর্থাৎ তার স্বামীকেও ঠিকমতো সময় দিচ্ছে না। টেকনোলজি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলে চারপাশ যতটা উন্নত হয়েছে তেমনই আবার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে প্রতিনিয়ত বেশ ক্ষতিও আমরা দেখতে পাচ্ছি। তাই এটাকে আমি সাপোর্ট করি না।
আবিদা সুলতানা
এখন আড্ডা নেই, প্রকৃত বন্ধুত্বও নেই। দিন দিন আমরা কেবল যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করেছে ঠিক, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে পারস্পরিক বন্ধন। এখন এক বাড়িতে থেকেও পাশের ফ্ল্যাটের মানুষের খবরই কেউ রাখছেন না। অথচ আগে এমনটা ছিলো না। এখন মানুষ বন্দি জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর তার জন্য প্রযুক্তিকে বেছে নিয়েছে। ল্যাপটপ, মোবাইলের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে সে দেখছে নিজের মতো করে। আমার আশেপাশেই তো দেখি প্রযুক্তি কিভাবে গিলে খেয়েছে সহজ-সরলতাকে, বন্ধুত্বকে, পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধকে। ফেসবুক কোনো খারাপ বিষয় নয়, কিন্তু এটাকে নেশায় পরিণত করলে হবে না। আমি মনে করি পারিবারিক শিক্ষাই এখান থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে। পুরো জেনারেশন যদি ফেসবুক-মেসেঞ্জারে বুদ হয়ে থাকে, তবে ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
সারা যাকের
আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম শুধু ফেসবুক এটি আমি মনে করি না। ফেসবুক ছাড়াও যোগাযোগের আরো অনেক মাধ্যম রয়েছে। ফেসবুকে কেউ আসল জগৎ প্রকাশ করে না। তার কল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় বলে আমার মনে হয়। এটি না ব্যবহার করলে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে তারো কোনো আশঙ্কা নেই। অনেকেই বলে ফেসবুকে নাকি অনেক কিছু জানা যায়। আমি যখন আমার কোনো একটি লেখার লিংক শেয়ার করি সেটি অল্প কয়েকজন পড়ে। তাহলে কিশোর-কিশোরীরা কিংবা তরুণ সমাজ ফেসবুকে কি পড়ছে? ফেসবুকের চেয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে অনেক বেশি অজানা তথ্য জানা যায়। এই সময়ে এসে আমি উপলব্ধি করেছি আঠারো বছরের কম বয়সীদের ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাবা-মাকে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এর জন্য উদ্যোগ নেয়া যায়। রাষ্ট্র ও পরিবার থেকে যদি কোনো সঠিক উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে কিশোর-কিশোরীদের এবং তরুণ সমাজের ফেসবুকের এই আসক্তি কমবে। অন্যথায় সামাজিক যোগাযোগ শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
ডলি জহুর
ফেসবুক আমাদের মধ্যে ব্যাধির মতো হয়ে গেছে। যেখানে-সেখানে আমাদের অনেকেই এখন এটিতে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে। দেখা যায় কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছে, সেখানেও যে যার মতো ফেসবুকে চ্যাটিং করছে। এর মধ্য দিয়ে সাময়িক লাভবান হলেও একটা সময় একাকীত্বে ভুগতে হয়। মাধ্যমটা এমন হয়ে গেছে অনেকে এটিকে ছাড়া নিজকে ভাবতে পারে না। সত্যি বলতে প্রযুক্তি মানুষকে যেমন অনেক দূর নিয়ে যায় তেমনি অবক্ষয়ও করে। ফেসবুক তার জ্বলন্ত উদাহরণ আমি বলতে পারি। আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার জানতে হবে। নতুন প্রজন্মকেও প্রযুক্তির ব্যবহার শেখাতে হবে। কখন কোথায় কিভাবে এটিকে ব্যবহার করতে হবে সেটি তারা জানতে না পারলে ক্ষতির প্রভাবটি বাড়তে থাকবে। এদিকে এখন অনেক পরিবারে দেখি অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের মোবাইল কিনে দিচ্ছে বাবা-মা। পড়ালেখায় সময় না দিয়ে তারা মোবাইলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সময় ব্যয় করে। আমার মনে হয় এই বিষয়ে বাবা-মাকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। তবে অস্বীকার করার কিছু নেই সময়ের দাবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুকের কল্যাণে আজকাল অনেক কিছু সহজে জানা যায়।
চিত্রলেখা গুহ
প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। অনেক সময় জেনে না জেনেই এটির ব্যবহার করি। ফেসবুক আমাদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। এটি থেকে কাউকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়াও অনেকেই এটিতে সময় দিয়ে থাকে। একটি মাধ্যম যদি কাজের চেয়ে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেটি ব্যবহার না করা ভালো মনে করি। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আমি ফেসবুকে আসি না। সারা দিন ফেসবুকে সময় দিলে অন্য কাজ করার সময় কোথায়? এই বিষয়টি আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে। আজকাল তরুণ-তরুণীদের বাইরে অনেক বয়স্ক মানুষও ফেসবুকে অধিক সময় দিচ্ছেন। ফেসবুক ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ফেইক আইডি বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অধিকাংশ তরুণ-তরুণীকে একের অধিক আইডি ব্যবহার করতে দেখা যায়। রাত জেগে স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা চ্যাটিং করে। এ কারণে তাদের অনেকেই আবার পরদিন স্কুল কলেজে অনুপস্থিত থাকে। পরিবারের বাবা-মাকে এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। রাত জেগে তার সন্তান কি করছে সেটি দেখতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও তার ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন।
ইলিয়াস কাঞ্চন
বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের সুবাদে চ্যাটিংয়ে এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে সময় দিচ্ছে। আর আগে আমরা যখন আড্ডা দিতাম তখন অনেকজন থাকতো তাতে। অনেক বিষয়ে কথা হতো। আগে একান্নবর্তী পরিবারের যে বন্ধন ছিল সেটা তো একদমই এখন নেই, বলতে গেলে এককথায় ভেঙে গেছে। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের অনেকে নেশায়ও আসক্ত হচ্ছে। আর এ বিষয়গুলো পরিবারের লোকজনরাও অনেক সময় জানতে পারছে না। কারণ দরজা বন্ধ করে ছেলে-মেয়েরা চ্যাটিং করছে। অনেকে ড্রাইভিং সিটে বসে ফোনে কথা বলার পাশাপাশি চ্যাটিং করছে। যেখানে ড্রাইভিং সিটে বসে ফোন ব্যবহার করাটাই নিষেধ, সেখানে চ্যাটিং করা বা ফোনে কথা বলা- এসব তো বলতে গেলে জেনে শুনে মৃত্যুকে ডেকে আনা। তাই টেকনোলজির ব্যবহারে সতর্ক হওয়া উচিত।
মিশা সওদাগর
আমি চলচ্চিত্রের মানুষ। তাই চলচ্চিত্রের প্রমোশনের উদাহরণ দিয়ে এ বিষয়ে একটা কথা বলতে চাই। সেটা হচ্ছে এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা নেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক বেশি ব্যবহার করছে। হয়তো এজন্যই অনেক সিনেমার প্রমোশনে এখন ব্যবহার হচ্ছে এটি। তবে আমার কাছে মনে হয় এভাবে প্রমোশনের নামে সিনেমার ডিমোশন হচ্ছে। আমরা আগে একটা সময় সিনিয়র জুনিয়র মিলে গল্প করতাম। শুটিং সেটে বা ব্যক্তিগত জীবনে পরিবারের সকলের কাছে কিছু শেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন তো এটা দেখি না। সবাই নেট চ্যাটিংয়ে এতটাই ব্যস্ত যে সামনা সামনি আইডিয়া শেয়ারিং বা কোনো বিষয়ে আলোচনা তেমন হয় না বললেই চলে। আর চলচ্চিত্রের যারা প্রমোশন করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে তাদের ক্ষেত্রে বলতে চাই সিনেমা সর্বপ্রথম হলের জন্য, নেটের জন্য না। নেটে তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করে সিনেমা হলে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। আর খুব বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ফলে সাইড ইফেক্টও আছে অনেক। সেটা একটা ছেলে বা মেয়ের মানসিক বিকাশে প্রতিনিয়ত ক্ষতি করছে। কিন্তু সেই ছেলে বা মেয়েটি নিজে সেটা বুঝতে পারছে না।
শাবনূর
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আড্ডার চেয়ে সামনা সামনি দেখা ও কথা বলে আড্ডা দিতে আমি ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু এই প্রজন্মের আড্ডাটা ভিন্ন ধরনের। আগে একটা সময় আড্ডার মাধ্যমে ভালো কিছু উঠে আসত। এখন তো ফোনে বা নেটে সব সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। দেখা করতে হয় না। ছবি ভেসে ওঠে ফোনে। সবই টেকনোলজির কল্যাণে হয়েছে। তবে এর ফলে ভালোর পাশাপাশি খারাপ অনেক কিছুই ঘটছে। তাই আমি চাইবো সবাই এটার সুন্দর দিকগুলো ব্যবহার করুক, আর খারাপগুলো বর্জন করুক। এর বেশি কিছু বলার নেই আমার।
গ্রন্থনা: ফয়সাল রাব্বিকীন, কামরুজ্জামান মিলু ও এন আই বুলবুল
No comments