চীন ভ্রমণ by আতাউর রহমান
ইংরেজ
রোমান্টিক কবি কোলরিজ (স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ: ১৭৭২-১৮৩৪) কর্তৃক রচিত
‘কুবলা খান’ শীর্ষক কবিতাটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। আর কবিতাটি রচিত হয়েছিল একটি
মজার পটভূমিকায়: (কবির বর্ণনা অনুসারে) দোর্দণ্ড প্রতাপ নৃপতি কুবলা খানের
রাজকীয় প্রাসাদের জৌলুশের কথা পড়তে পড়তে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এবং ঘুমের
মধ্যে তিনি কবিতাটি স্বপ্নের মাধ্যমে পান। ঘুম থেকে উঠেই তিনি কবিতাটি
লিখতে শুরু করে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, কে একজন আগন্তুক এসে মাঝপথে
তাঁকে বিরক্ত করায় তিনি স্বপ্নের বাকি অংশ ভুলে যান, যে কারণে কবিতাটি শেষ
অবধি অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। যদিও এ কারণে কবিতাটির রসাস্বাদনে অদ্যাবধি
কোনো অসুবিধে হয়নি। সে যাহোক। কবিতাটির কথা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল
সাম্প্রতিক চীন সফর-উত্তর চীনের ইতিহাস পড়তে গিয়ে। কুবলা তথা কুবলাই খান
ছিলেন মধ্যযুগে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত দিগ্বিজয়ী নৃপতি চেঙ্গিস খানের পৌত্র
এবং চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি। ১২৮০ সালে
গোটা চীন সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে কুবলাই খান ইউয়ান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন,
যেটা ১৩৬৮ সাল অবধি একনাগাড়ে চলতে থাকে। আর কাকতালীয়ভাবে চীনের বর্তমান
মুদ্রার নামও হচ্ছে ইউয়ান। তা কুবলাই খান ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক।
ইতিহাসে বিখ্যাত ইতালিয়ান পরিব্রাজক মার্কো পোলো তাঁর অধীনে বেশ কয়েক বছর
কাজ করেছেন এবং তিনি লিখেছেন, (কুবলাই ছিলেন) দ্য গ্রেট লর্ড, আদম থেকে
শুরু করে আমাদের সময় পর্যন্ত সৈন্যসামন্ত, সাম্রাজ্য আর ধনসম্পদের দিক থেকে
পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নৃপতি। আর হ্যাঁ, জ্যোতিষশাস্ত্রে ছিল তাঁর
অগাধ বিশ্বাস। তাঁর রাজদরবারে রাজজ্যোতিষীর সংখ্যা নাকি ছিল পাঁচ হাজারের
মতো এবং তাঁদের একমাত্র কাজই ছিল দৈনন্দিন আবহাওয়া ও ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে
ভবিষ্যদ্বাণী করা। কিন্তু একটুখানি ভুল হলেই তাঁদের চরম শাস্তি ভোগ করতে
হতো। তবে মঙ্গোলীয় শাসকেরা যে নামের পেছনে ‘খান’ লিখতেন, সেটার অর্থ কিন্তু
ছিল ‘প্রিন্স’ অথবা ‘শাসক’। আমাদের অনেকের পূর্ব-পুরুষেরা যেমন অন্য ধর্ম
থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেই নামের সঙ্গে ‘খান’ লাগিয়ে দিতেন, ব্যাপারটা
মোটেই তেমন নয়! অথবা তেমনও নয়, যেমন একজন লোককে যখন টেলিফোনে জিজ্ঞেস করা
হলো ‘আপনি কি খান’, তখন তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি হালাল সবকিছুই খাই।’
স্পষ্টতই তিনি ‘কি’ ও ‘কী’—এই দুইয়ের পার্থক্য বুঝতে পারেননি অথবা বুঝেও না
বোঝার ভান করেছিলেন। যাকগে এসব কথা। চীনাদের সম্পর্কে এ যাবৎ আমার
প্রত্যক্ষ কোনো জ্ঞানই ছিল না।
তবে এটা জানতাম যে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার
প্রায় এক-চতুর্থাংশই চায়নিজ। যে কারণে বলা হয়ে থাকে যে পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া
প্রতি চতুর্থ শিশুটিই হচ্ছে চায়নিজ। আর এটা শুনে এক আইরিশ দম্পতি নাকি
তাঁদের চতুর্থ সন্তান নেওয়া থেকে বিরত হয়েছিলেন এই ভয়ে যে পাছে তাঁদের ঘরে
চায়নিজ শিশু জন্মায়। অবশ্য এটা ইংরেজদের অহেতুক প্রপাগান্ডা হতে পারে।
কেননা, ইংরেজদের চোখে আইরিশরা নাকি নিরেট বোকা আর স্কটিশরা হাড়কেপ্পন। আমি
এটাও জানতাম যে মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে চায়নিজদের অবদান কম নয়। ছাতা,
চা-পাতা, সিল্কের পোশাক, চিনামাটির বাসন, ফুলদানি ইত্যাদির ব্যবহার এবং
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রচলন চীনারাই সর্বাগ্রে করেছে। আর প্রাচীন চায়নিজ
দার্শনিক কনফুসিয়াসের খ্যাতি তো বিশ্বজোড়া। কনফুসিয়াসের সেই বাণী
চিরন্তনী, ‘আমি শুনি, আমি ভুলে যাই; আমি দেখি, আমি স্মরণ রাখি, আমি করি,
আমি বুঝি (আই হিয়ার, আই ফরগেট, আই সি, আই রিমেম্বার, আই ডু, আই
আন্ডারস্ট্যান্ড) বাংলাদেশসহ দুনিয়ার বহু দেশের লোকপ্রশাসন
প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোতে পর্যন্ত শেখানো হয়। তাঁর আরেকটি উক্তিও তো আমাদের
মতো দেশের ক্ষেত্রে সবিশেষ প্রযোজ্য, ‘একজন শাসক তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলির
আদর্শ দ্বারাই জনগণের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারেন, বেশি বেশি আইন প্রণয়ন
দ্বারা নয়।’ চীনের সাংহাইয়ে আত্মজের চাকরির সুবাদেই পরিণত বয়সে আমার চীনে
পদার্পণ, ঘণ্টায় সাড়ে তিন শ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন ট্রেনে চড়ে বেইজিং গমন
এবং আবাল্য লালিত চীনের মহাপ্রাচীর দর্শনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ। বলা হয়ে থাকে,
চাঁদ থেকে একমাত্র মনুষ্যসৃষ্ট যে জিনিসটা দৃশ্যমান হয়, সেটা হচ্ছে চীনের
মহাপ্রাচীর। এটা ‘মিথ’ হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি সুভাষ
মুখোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, আজ বসন্ত; তাঁকে
অনুসরণ করে বলা যেতে পারে—চাঁদ থেকে দেখা যাক আর না যাক, চীনের মহাপ্রাচীর
হচ্ছে মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। হাজার হাজার দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্টের
ভিড়ে মহাপ্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে আমার এ-ও মনে হয়েছে, একদা মঙ্গোলীয় যাযাবর
দস্যুদের তথা শত্রুদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে নির্মিত
মহাপ্রাচীরটি এখন সত্যিকার অর্থেই বিশ্বমানবের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
বিদায় নেওয়ার আগে বলি, ‘হাফ-উইট’ নাসিরুদ্দিনকে আমরা ‘মোল্লা’ বলি আর
‘হোজ্জা’ বলি, চীনের সিনচিয়াং প্রদেশের উইঘুর জাতিসত্তার ঘরে ঘরে তিনি
কিন্তু নাসিরুদ্দিন আফেন্দি নামে পরিচিত। তাঁর মুখে লম্বা দাড়ি। মাথায় মস্ত
বড় একটা পাগড়ি পরে তিনি সব সময় একটা শীর্ণকায় গাধায় চড়ে ঘুরে বেড়ান। তো
চীন সফরকালে ওখানকার শহরাঞ্চলে তকতকে-ঝকঝকে রাস্তাঘাট দেখে আমার প্রায়ই
নাসিরুদ্দিন আফেন্দির একটা গল্প মনে পড়ে যেত: আফেন্দি তাঁর প্রতিবেশীর কাছ
থেকে একটি বড় কড়াই ধার করে নিয়ে এসেছিলেন। কিছুদিন পর তিনি বড় কড়াইয়ের
সঙ্গে একটি ছোট্ট কড়াইও ফেরত দিতে গেলে প্রতিবেশীর প্রশ্নের উত্তরে বললেন,
‘আমার বাড়িতে থাকাকালীন বড় কড়াই ছোট্ট কড়াইটাকে বাচ্চা হিসেবে প্রসব
করেছে।’ প্রতিবেশী আর কোনো প্রশ্ন না করে কড়াই দুটি রেখে দিলেন। পরবর্তী
সময়ে আফেন্দি আবার বড় কড়াইটি ধার নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না দেখে প্রতিবেশী
খোঁজ নিতে গেলে তিনি বললেন, দুর্ভাগ্যবশত কড়াইটা মারা গেছে; এবং
প্রতিবেশীর বিস্ময় প্রকাশ দেখে যোগ করলেন, ‘কড়াই যদি বাচ্চা প্রসব করতে
পারে, তাহলে সেটা মারাও যেতে পারে।’ ঠিক তেমনিভাবে খোদ আমাদের রাজধানী
শহরের কোনো অভিজাত এলাকায়ও যদি কেউ লোক চলাচলের রাস্তার ওপর কিছু
ময়লা-আবর্জনা ফেলে রেখে যায়, তাহলে রাতের অন্ধকারে আরও কিছু লোক সেই স্থানে
ময়লা ফেলে আবর্জনার কলেবর বৃদ্ধি করে দেয়। আমি এটাকে বলি ময়লা বাচ্চা দেয়।
আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷
আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷
No comments