দেশে নতুন রোগ বিদেশ থেকে আসছে ভাইরাস by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
দেশে
গত প্রায় তিন যুগে মোট আটটি রোগ ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। এডিস মশা থেকে যে
তিনটি রোগ ছড়ায় তার সব কটিই বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও
জিকা শনাক্ত হয় কয়েক বছরে। ১৯৯৯ সালে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ঢাকায়। ২০০৮
সালে চিকুনগুনিয়া রাজশাহীতে এবং ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে জিকা শনাক্ত হয়। এই
তিনটি রোগসহ দেশে মোট আটটি নতুন রোগ শনাক্ত হয়েছে।
নির্মূল হওয়ার প্রায় তিন যুগের মাথায় ডিপথেরিয়া ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। বাকি চারটি হলো এইচআইভি/এইডস, নিপাহ, বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সোয়াইন ফ্লু। যেসব রোগ কখনোই মানুষের ছিল না এবং তা যদি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়, তখন তাকে নতুন রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বেশিরভাগ রোগ আফ্রিকা মহাদেশেই প্রথম শনাক্ত হয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। শঙ্কা তৈরি করা নতুন রোগের ভাইরাস দেশে আসছে কোনো-না-কোনোভাবে বিদেশ থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে এমন রোগ স্বাস্থ্য অর্থনীতিতে একটা বড় চাপ সৃষ্টি করছে।
চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। ২০০০ সালে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর এর ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা নিয়ে হিমশিম খান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চিকিৎসকরা। রোগের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা বুঝে ওঠার আগেই অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটে। ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত রোগ শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসা-পদ্ধতি প্রয়োগের পর ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে থাকে। তবে এখনো এই রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০১৬ সালে আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৬০ জন এবং ১৪ জন মারা গেছে। গত বছর আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৭৬৭ জন এবং মারা গেছেন ৮ জন মারা গেছে। এই জ্বর এশিয়ার দেশ চীন থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। গত এপ্রিল-মে থেকে ঢাকা শহরে চিকুনগুনিয়া ঘরে ঘনে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালে রাজশাহীতে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হওয়ার পর ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে ঢাকা শহরের কাঁঠালবাগান এলাকায় ৩০ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে প্রথম দেখা পাওয়া এই জ্বর রাজধানীসহ সারা দেশেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। ১৯৪৭ সালে আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডায় প্রথম শনাক্ত হওয়া জিকা সমপ্রতি বছরগুলোতে ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লেও বাংলাদেশে এখনো তেমন কোনো নজির দেখা যায়নি। চট্টগামের একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২০১৪ সালে। এটা শনাক্ত করেছিল আইইডিসিআর। তবে ওই ব্যক্তি কোথায় কীভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে রোগটি নিয়ে সরকার সতর্ক আছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া বা জিকাই শুধু নতুন রোগ নয়। ২০০১ সালে নিপাহ, ২০০৭ সালে বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত মানুষ প্রথম শনাক্ত হয়। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মাঝেমধ্যে দু-একজনের মৃত্যু হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে আইইডিসিআর। ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় নিপাহর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর লালমনিরহাট, রাজবাড়ী এবং ফরিদপুর জেলায় এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বাদুড় খেজুরের রসে মুখ দিয়ে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়, সেই রস মানুষ খেলে এতে আক্রান্ত হয়। বার্ড ফ্লু নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল প্রথমত পোলট্রি শিল্পের মালিকদের। অনেক খামারে এই রোগ দেখা দেয়। সরকার এই শিল্পকে বাঁচাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এই রোগ একসময় মানুষের মধ্যেও ছড়ায়। একাধিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। দেশে বড় ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের পর। এ রোগটিও দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে এ পর্যন্ত ছয়জন মারা গেছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর সূত্র। এই রোগ চিকিৎসার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ ওষুধ দেয়া হয়েছিল।
তবে বাইরে থেকে আসা রোগের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে এইচআইভি/এইডস নিয়ে। ১৯৮৯ সালে একজন বিদেশি এবং ১৯৯০ সালে দুজন দেশি এইডস রোগী শনাক্ত হয়। প্রতিবছর এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬ সালে এই রোগে ১৪১ জন মারা গেছে। দেশে এই পর্যন্ত ১১ হাজার ৭০০ জন এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। ৭৯৯ জন মারা গেছেন। সূত্র জানায়, দেশে ২০১৭ সালে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তর সংখ্যা ৫ শতাধিক। মারা গেছে শতাধিক। শিরায় মাদক নেয় এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রোগের প্রকোপ অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এই রোগীটি শুরুতে আফ্রিকা মহাদেশ ও পরে আমেরিকায় চিহ্নিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ২০০৫ সালের এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেছিল, ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি আট মাসে একটি নতুন রোগ মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ১৯৮০ সালকে বেছে নেয়া হয়েছিল এই কারণে যে ওই বছর পৃথিবীকে গুটি বসন্তমুক্ত ঘোষণা করেছিল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বলছে, বর্তমানে নতুন যেসব রোগ দেখা যাচ্ছে, তার ৭০ শতাংশ পশুপাখি থেকে আসছে। সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, নিপাহ ভাইরাস আসে পশুপাখি থেকে। মানুষ, প্রাণী ও প্রতিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার কারণে এসবের উৎপত্তি হচ্ছে। একই সঙ্গে মানুষ ও পশুপাখির ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসব রোগের বিস্তার বেশি।
মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে ‘অজ্ঞাত রোগে’ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এমন খবর বের হয়। কিছু ক্ষেত্রে রোগ শনাক্ত করতে বিলম্ব হয়। যেমন গত বছর হামে আক্রান্ত হয়ে সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরাপাড়ায় ৯ শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং ৮৫টি শিশু হাসপাতালে ভর্তি ছিল। প্রথমে বলা হয়েছিল, এরা ‘অজ্ঞাত রোগে’ আক্রান্ত। কিছু ক্ষেত্রে গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত এক ব্যক্তি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি, এমন কথা শোনা গিয়েছিল। একই বছর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মার্স করোনারি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ভর্তি আছে, এমন শোনা যায়। দুটি ঘটনাই অনুসন্ধান করে আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, দুটিই ছিল গুজব। আবার পুরনো কিছু রোগ নতুনভাবেও দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স একটি। ২০০৯ সাল থেকে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় মানুষ নিয়মিতভাবে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হচ্ছে। নির্মূল হওয়ার প্রায় তিন যুগের মাথায় ডিপথেরিয়া ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই রোগ ধরা পড়েছে সমপ্রতি। বাংলাদেশ থেকে ৩৫ বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছিল এই রোগ। গত বছরের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ানো রোগ ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত ২ দুই হাজার ৭৫৬ জন রোহিঙ্গাকে সনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সংক্রামক এই রোগে এ পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে জেলা স্বাস্থ্য অফিস।
নতুন নতুন রোগ দেখা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ ও পশুপাখির স্বাস্থ্যকে আর আলাদা করে দেখার প্রয়োজন নেই বলে অনেকেই মনে করছেন। ‘এক স্বাস্থ্য’ নামে আন্দোলন বা ধারণাকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্বব্যাপী এগিয়ে নিচ্ছে। সংস্থা দুটির যৌথ কার্যক্রম হলো ‘ওয়ান হেলথ’। আইইডিসিআরে এ বিষয়ে গবেষণাগার আছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগের ওপর নজরদারির ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। জনস্বাস্থ্যবিদ, পশুস্বাস্থ্যবিদ, কৃষিবিদ, পরিবেশবিদ একসঙ্গে নজরদারিতে অংশ নিতে হবে। স্বাস্থ্য এখন শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ডিপথেরিয়া আবার ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। এটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ১৫ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের একটা করে ইনজাকশন দিতে হবে। আর ক্যাম্পের আশপাশের থানাগুলোতেও ভ্যাকসিন দিতে হবে। চিকুনগুনিয়া এবার আতঙ্ক তৈরি করেছে। এই রোগের মশা মারার ওষুধ দিতে। জিকার বিষয়ে ফলোআপ করতে হবে। অন্য কোনো দেশ থেকে রোগ আসার আশঙ্কা থাকলে আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে রোগ শনাক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। জিকার বিষয়ে সেই ধরনের ল্যাব বাংলাদেশে নেই। দেশের মধ্যে রোগ শনাক্ত হলে রোগের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্রুত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে। এইডস বিষয়ে তিনি বলেন, মাদকসেবীদের মাধ্যমে এটা ২৬ শতাংশ ছড়াছে। যা অশনি সংকেত।
আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, সারা বছর সার্ভিলেন্স সিস্টেম চালু থাকে। আবার আউটব্র্যাক হলে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নিপাহ ভাইরাসের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এটা সিজনে হওয়ার কারণে ওই সময়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। জিকার বিষয়ে বছরজুড়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা উল্লেথ করেন তিনি। নতুন রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলে বন্দরগুলোতে রোগ শনাক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। নতুন রোগ শনাক্ত হলে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতার উদ্যোগ নেয়া হয়।
নির্মূল হওয়ার প্রায় তিন যুগের মাথায় ডিপথেরিয়া ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। বাকি চারটি হলো এইচআইভি/এইডস, নিপাহ, বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সোয়াইন ফ্লু। যেসব রোগ কখনোই মানুষের ছিল না এবং তা যদি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়, তখন তাকে নতুন রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বেশিরভাগ রোগ আফ্রিকা মহাদেশেই প্রথম শনাক্ত হয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। শঙ্কা তৈরি করা নতুন রোগের ভাইরাস দেশে আসছে কোনো-না-কোনোভাবে বিদেশ থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে এমন রোগ স্বাস্থ্য অর্থনীতিতে একটা বড় চাপ সৃষ্টি করছে।
চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। ২০০০ সালে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর এর ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা নিয়ে হিমশিম খান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চিকিৎসকরা। রোগের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা বুঝে ওঠার আগেই অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটে। ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত রোগ শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসা-পদ্ধতি প্রয়োগের পর ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে থাকে। তবে এখনো এই রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০১৬ সালে আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৬০ জন এবং ১৪ জন মারা গেছে। গত বছর আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৭৬৭ জন এবং মারা গেছেন ৮ জন মারা গেছে। এই জ্বর এশিয়ার দেশ চীন থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। গত এপ্রিল-মে থেকে ঢাকা শহরে চিকুনগুনিয়া ঘরে ঘনে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালে রাজশাহীতে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হওয়ার পর ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে ঢাকা শহরের কাঁঠালবাগান এলাকায় ৩০ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে প্রথম দেখা পাওয়া এই জ্বর রাজধানীসহ সারা দেশেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। ১৯৪৭ সালে আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডায় প্রথম শনাক্ত হওয়া জিকা সমপ্রতি বছরগুলোতে ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লেও বাংলাদেশে এখনো তেমন কোনো নজির দেখা যায়নি। চট্টগামের একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২০১৪ সালে। এটা শনাক্ত করেছিল আইইডিসিআর। তবে ওই ব্যক্তি কোথায় কীভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে রোগটি নিয়ে সরকার সতর্ক আছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া বা জিকাই শুধু নতুন রোগ নয়। ২০০১ সালে নিপাহ, ২০০৭ সালে বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত মানুষ প্রথম শনাক্ত হয়। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মাঝেমধ্যে দু-একজনের মৃত্যু হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে আইইডিসিআর। ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় নিপাহর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর লালমনিরহাট, রাজবাড়ী এবং ফরিদপুর জেলায় এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বাদুড় খেজুরের রসে মুখ দিয়ে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়, সেই রস মানুষ খেলে এতে আক্রান্ত হয়। বার্ড ফ্লু নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল প্রথমত পোলট্রি শিল্পের মালিকদের। অনেক খামারে এই রোগ দেখা দেয়। সরকার এই শিল্পকে বাঁচাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এই রোগ একসময় মানুষের মধ্যেও ছড়ায়। একাধিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। দেশে বড় ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের পর। এ রোগটিও দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে এ পর্যন্ত ছয়জন মারা গেছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর সূত্র। এই রোগ চিকিৎসার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ ওষুধ দেয়া হয়েছিল।
তবে বাইরে থেকে আসা রোগের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে এইচআইভি/এইডস নিয়ে। ১৯৮৯ সালে একজন বিদেশি এবং ১৯৯০ সালে দুজন দেশি এইডস রোগী শনাক্ত হয়। প্রতিবছর এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬ সালে এই রোগে ১৪১ জন মারা গেছে। দেশে এই পর্যন্ত ১১ হাজার ৭০০ জন এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। ৭৯৯ জন মারা গেছেন। সূত্র জানায়, দেশে ২০১৭ সালে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তর সংখ্যা ৫ শতাধিক। মারা গেছে শতাধিক। শিরায় মাদক নেয় এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রোগের প্রকোপ অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এই রোগীটি শুরুতে আফ্রিকা মহাদেশ ও পরে আমেরিকায় চিহ্নিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ২০০৫ সালের এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেছিল, ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি আট মাসে একটি নতুন রোগ মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ১৯৮০ সালকে বেছে নেয়া হয়েছিল এই কারণে যে ওই বছর পৃথিবীকে গুটি বসন্তমুক্ত ঘোষণা করেছিল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বলছে, বর্তমানে নতুন যেসব রোগ দেখা যাচ্ছে, তার ৭০ শতাংশ পশুপাখি থেকে আসছে। সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, নিপাহ ভাইরাস আসে পশুপাখি থেকে। মানুষ, প্রাণী ও প্রতিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার কারণে এসবের উৎপত্তি হচ্ছে। একই সঙ্গে মানুষ ও পশুপাখির ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসব রোগের বিস্তার বেশি।
মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে ‘অজ্ঞাত রোগে’ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এমন খবর বের হয়। কিছু ক্ষেত্রে রোগ শনাক্ত করতে বিলম্ব হয়। যেমন গত বছর হামে আক্রান্ত হয়ে সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরাপাড়ায় ৯ শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং ৮৫টি শিশু হাসপাতালে ভর্তি ছিল। প্রথমে বলা হয়েছিল, এরা ‘অজ্ঞাত রোগে’ আক্রান্ত। কিছু ক্ষেত্রে গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত এক ব্যক্তি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি, এমন কথা শোনা গিয়েছিল। একই বছর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মার্স করোনারি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ভর্তি আছে, এমন শোনা যায়। দুটি ঘটনাই অনুসন্ধান করে আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, দুটিই ছিল গুজব। আবার পুরনো কিছু রোগ নতুনভাবেও দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স একটি। ২০০৯ সাল থেকে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় মানুষ নিয়মিতভাবে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হচ্ছে। নির্মূল হওয়ার প্রায় তিন যুগের মাথায় ডিপথেরিয়া ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই রোগ ধরা পড়েছে সমপ্রতি। বাংলাদেশ থেকে ৩৫ বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছিল এই রোগ। গত বছরের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ানো রোগ ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত ২ দুই হাজার ৭৫৬ জন রোহিঙ্গাকে সনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সংক্রামক এই রোগে এ পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে জেলা স্বাস্থ্য অফিস।
নতুন নতুন রোগ দেখা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ ও পশুপাখির স্বাস্থ্যকে আর আলাদা করে দেখার প্রয়োজন নেই বলে অনেকেই মনে করছেন। ‘এক স্বাস্থ্য’ নামে আন্দোলন বা ধারণাকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্বব্যাপী এগিয়ে নিচ্ছে। সংস্থা দুটির যৌথ কার্যক্রম হলো ‘ওয়ান হেলথ’। আইইডিসিআরে এ বিষয়ে গবেষণাগার আছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগের ওপর নজরদারির ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। জনস্বাস্থ্যবিদ, পশুস্বাস্থ্যবিদ, কৃষিবিদ, পরিবেশবিদ একসঙ্গে নজরদারিতে অংশ নিতে হবে। স্বাস্থ্য এখন শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ডিপথেরিয়া আবার ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। এটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ১৫ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের একটা করে ইনজাকশন দিতে হবে। আর ক্যাম্পের আশপাশের থানাগুলোতেও ভ্যাকসিন দিতে হবে। চিকুনগুনিয়া এবার আতঙ্ক তৈরি করেছে। এই রোগের মশা মারার ওষুধ দিতে। জিকার বিষয়ে ফলোআপ করতে হবে। অন্য কোনো দেশ থেকে রোগ আসার আশঙ্কা থাকলে আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে রোগ শনাক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। জিকার বিষয়ে সেই ধরনের ল্যাব বাংলাদেশে নেই। দেশের মধ্যে রোগ শনাক্ত হলে রোগের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্রুত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে। এইডস বিষয়ে তিনি বলেন, মাদকসেবীদের মাধ্যমে এটা ২৬ শতাংশ ছড়াছে। যা অশনি সংকেত।
আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, সারা বছর সার্ভিলেন্স সিস্টেম চালু থাকে। আবার আউটব্র্যাক হলে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নিপাহ ভাইরাসের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এটা সিজনে হওয়ার কারণে ওই সময়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। জিকার বিষয়ে বছরজুড়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা উল্লেথ করেন তিনি। নতুন রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলে বন্দরগুলোতে রোগ শনাক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। নতুন রোগ শনাক্ত হলে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতার উদ্যোগ নেয়া হয়।
No comments