লুসি হল্টকে একটা দেশ দিন by ফারুক ওয়াসিফ

ইংরেজি হোম শব্দের বাংলা গৃহ বা আবাসও হয় আবার স্বদেশও হয়। ইংরেজ মিশনারি লুসি হল্টের ভাঙাচোরা হলেও একটা আবাস আছে, কিন্তু দেশ নেই। যে দেশটাকে তিনি ৫৭ বছর যাবৎ আবাস বানিয়ে বসবাস করেছেন, তিনি সেই দেশের হয়ে গেলেও সেটা তাঁর দেশ হয়নি। বাংলা বলেন, বাঙালিদের মতো শাড়ি পড়েন, বাঙালিদের সেবা করে যান, বাংলাদেশময় জীবন তাঁর, তবু তিনি ভিসাধারী বিদেশিনী। তাঁর শেষ ইচ্ছা বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে বাংলার মাটিতে সমাধি নেবেন—চিরকালের মতো মিশে যাবেন বাংলার প্রকৃতিতে। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের ভাষায়, ‘বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক। আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।’ লুসি হল্টের জন্মতারিখ আর বাংলাদেশের বিজয়ের তারিখ একই—১৬ ডিসেম্বর। কী সুন্দর কাকতাল! কিন্তু এ যেন তার চেয়েও বেশি। পৃথিবীতে তো অনেকেরই জন্ম হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর তারিখে, এমন কোনো বিদেশির কই পাব, যিনি ১৬ ডিসেম্বরের জাতক দেশটিকেই নিজের করে নিয়েছেন! শনিবারের প্রথম আলোয় এক মানবদরদির শেষ ইচ্ছা পড়ে যেকোনো বাংলাদেশির মন একই সঙ্গে বিষণ্ন ও আনন্দিত হওয়ার কথা। এক দেশহীন মানুষের জন্য মন তো খারাপ হবেই, আবার সেই মানুষটা যে বাংলাদেশকে কত ভালোবাসেন, তা জেনে যেকোনো দেশদরদির মন আনন্দে ভরে উঠবে। স্বাধীনতার সেই রক্ত-অশ্রু-গৌরবের দিনগুলোয় তাঁকে দেখা যায় যশোরের এক হাসপাতালে অসহায় নারী-পুরুষের সেবা করে যেতে। মিশনারি সিস্টার হিসেবে থাকতেন যশোরের ক্যাথলিক চার্চে। মিশনের সবাই যখন জীবনের ভয়ে পেছন ফিরে পালাচ্ছে, তখন তিনি সামনে ঘুরে দুস্থ মানুষের দিকে গেলেন, হাত ধরলেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে লুসিকে সম্মাননা দেয় বরিশাল মহানগর পুলিশ। সেই ১৯৬০ সালে ৩০ বছরের যে তরুণী মানুষটি এ দেশে এসেছিলেন, সেই লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্টের বয়স এখন ৮৭ বছর। মাঝখানে চলে গেছে ৫৭টি বছর! মানবপ্রেমই বলি আর রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের কথাই বলি তার আর কত প্রমাণ দেবেন তিনি? নাগরিকের জন্য যে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের শর্ত বহাল আছে, ৫৭টি দীর্ঘ বছরও কি তা প্রমাণে যথেষ্ট নয়? এখনো কি বাংলার মুখ হয়ে ওঠেননি তিনি? তাহলে ৫৭ বছর ধরে প্রতিবছর ভিসার মেয়াদ যেভাবে বাড়াতে গিয়ে তাঁকে অর্থ ও শ্রম খরচ করতে হয়েছে, তা থেকে তাঁকে রেহাই দেওয়া হোক। অবসরভাতাভোগী এই দরিদ্র মানুষটিকে আর পেরেশানি দেওয়া যাবে না। একজনের প্রাপ্য শোধ করলে অন্য প্রত্যাশীদের কমও পড়বে না। লুসি হল্টের দেশ ব্রিটেনের ওয়েলশ ভাষায় ‘হিরায়েথ’ (hiraeth) নামে একটা শব্দ আছে। ইংরেজিতে এর অনুবাদ হয় না। বাংলায় বললে হয়তো লম্বা করে বলা যায়, ‘দেশের জন্য মন পোড়ানি’।
এই দেশ কেবল রাষ্ট্র নয়, মানচিত্র নয়, ভূমি নয়, এই দেশ হলো ‘হোম’। হোম তাকেই বলে, যার মাটি-মানুষ-পরিবেশকে আপন ভাবা যায়। লুসি হল্টের যে দেশের জন্য মন পোড়ায়, সেটা তাঁর মাতৃভূমি ইংল্যান্ড নয়, সেটা এই বাংলাদেশ। হিরায়েথ কথাটায় একটা হতাশাও আছে। সেটা এমন এক দেশ বা হোমের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা, যা কখনো নিজের ছিল না। বাস্তবেও তাঁর ঘর নেই। শনিবারের প্রথম আলোয় বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক এম জসীম উদ্দীন লিখেছেন, ‘বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনের দক্ষিণ দিকটায় টিনের ছোট্ট ঘর, জরাজীর্ণ। বারান্দার এক অংশে লুসির থাকার ব্যবস্থা। সেখানে ছোট্ট একটি কাঠের চৌকি, কাঠের দুটি টেবিল। শোয়ার চৌকিতে পাতলা তোশক বিছানো, একটি বালিশ আর কম দামের কম্বল। পাশে শেলফে কিছু বই ও পুরোনো ডায়েরি।’ এই দারিদ্র্যের মধ্যে এসেছে হাড় কামড়ানো শীত! ব্রিটেনে ফিরে গেলে তিনি নিশ্চয়ই আরও উন্নত জীবনই পাবেন। সেখানে তাঁর এক বোন আছেন। পারিবারিক বাড়ি আছে। তবু এই দারিদ্র্যের মধ্যে কিসের টানে তিনি থাকেন? কী সেই শক্তি, যা তাঁকে চুম্বকের মতো টেনে আটকে রাখে বাংলাদেশের মাটিতে? সেটা মায়া, যাঁদের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছেন, যে নদী-গাছ-মানুষকে জীবনে জড়িয়ে নিয়েছেন, সেসবের প্রতি মায়া। লুসি হল্টের হিরায়েথ অনুভূতিতে আটকে না থাকুন, একটা দেশ হোক তাঁর। যে দেশটা তাঁর ছিল না, কিন্তু ৫৭ বছরের মানবসেবা দিয়ে যে দেশটাকে তিনি নিজের করে নিয়েছেন, সেই দেশটা এবার তাঁকে নাগরিকত্বের সম্মান দিয়ে নিজের করে নিক। আমরা যত দূর জানি, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন এর বাধা নয়, কোনো কিছুই বাধা নয়। বাধা কেবল অবহেলা—লুসি হল্টের শেষ ইচ্ছাকে অবহেলা করে নিজেদেরই যেন আমরা অসম্মানিত না করি। যিনি আমাদের সঙ্গে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে আছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত তাঁকেও ‘মায়া’ করা। লুসি হল্ট শিখিয়েছেন, দেশ মানে কেবল জন্মভূমি না, নাগরিকত্বের কাগজ না, মালিকানা না, দেশ মানে মায়ার বাঁধন—সেটাই যদি না থাকে, তাহলে নাগরিকত্ব, মালিকানা, ইতিহাস সবই ফাঁপা ও অসার হয়ে যায়। লুসি হল্টের সবই আছে, নাগরিকত্বের স্বীকৃতিটুকুই শুধুই নেই! লুসি হল্টের এই মায়ার সৌন্দর্য এখানেই, তাঁর চোখ দিয়ে, তাঁর ভালোবাসার আয়না দিয়ে বাংলাদেশটাকে আমরা দেখে নিতে পারি—কারও যদি দেশ ও মানুষের প্রতি মায়ার ঘাটতি থাকে, এই মায়াবতী নারী তাঁকে পথ দেখাতে পারেন।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.