গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান নিয়ে কমিশন

গ্রামীণ ব্যাংক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে একটি কমিশন গঠন করেছে সরকার। প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যতে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়ন করবে এ কমিশন। আগামী তিন মাসের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবে কমিশন।


অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গতকাল বুধবার এ-সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। সাবেক সচিব মো. মামুনুর রশিদকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের এই কমিশনের সদস্যসচিব পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক এম এ কামাল। অপর দুই সদস্য হলেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি এবং মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ এফসিএ। কমিশনকে অফিস, জনবল, যাতায়াতসহ সব ধরনের সাচিবিক সহায়তা দেবে গ্রামীণ ব্যাংক।
কার্যপরিধি: কমিশনের কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, কমিশন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এর প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, দুর্বলতা ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করবে। গ্রামীণ ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করা, বিশেষ করে ব্যবস্থাপনাগত জবাবদিহি এবং পরিচালনগত স্বচ্ছতা বিষয়েও উপায় বের করার সুপারিশ করবে এ কমিশন।
এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে এযাবৎ যেসব প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি ও এন্টারপ্রাইজ গঠিত হয়েছে, সেগুলোর উদ্দেশ্য, আইনি প্রক্রিয়া এবং পরিচালনা বিষয়ে পর্যালোচনা করবে কমিশন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: শুরুর দিকে কেন এগুলো গঠন করা হয়েছিল এবং গঠনের উদ্দেশ্য কী এরা সম্পন্ন করেছে। আইনগত বা অন্য কোনোভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কযুক্ত। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে এদের আর্থিক সম্পর্ক কী। গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে অবদান রাখছে। এদের সাংগঠনিক, ব্যবস্থাপনাগত ও আর্থিক কাঠামো কী। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার নির্ধারণের বিধি কী।
কার্যপরিধিতে আরও বলা হয়েছে, উল্লিখিত পর্যালোচনার ভিত্তিতে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করে একটি কর্মসূচি (স্কিম) তৈরির ব্যাপারে সুপারিশ করবে এ কমিশন। গ্রামীণ ব্যাংকের অধিকার ও সুবিধা নিশ্চিত করবে এ কর্মসূচি। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা এবং এদের ব্যবস্থাপনা ও মালিকানার উত্তরাধিকার নির্ধারণে এ কর্মসূচিতে একটি সময়সীমা দেওয়া থাকবে।
কার্যপরিধিতে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই কর্মসূচি গ্রামীণ ব্যাংকের সামাজিক বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করবে।
কার্যপরিধিতে আরও বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা, এর পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং এর পর্ষদের সদস্যদের যোগ্যতার বিষয়ে মন্তব্য করবে এ কমিশন। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংককে কীভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যায়, সে ব্যাপারে পর্যালোচনা করে সুপারিশ করার কথা বলা হয়েছে কমিশনকে।
ভিন্নমত: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলি খান এই কমিশন গঠনকে ‘অনভিপ্রেত’ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক শুরুর দিকে ছোট থাকলেও এখন অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। এর ৯০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা। সুতরাং কী করতে হবে, তা তাঁদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের মালিকানা যেহেতু কম, তাই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার পড়লে বেশির ভাগ মালিকই সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। সেটাই হতো গণতান্ত্রিক রীতিনীতিসম্মত। আকবর আলি খান বলেন, বেশির ভাগ শেয়ারের মালিক তো আছেনই, তা ছাড়া রয়েছে নির্বাচিত পর্ষদ। সেই পর্ষদও যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমি মনে করি, গ্রামীণের ব্যাপারে সরকার যা করেছে, তা অনভিপ্রেত।’
গ্রামীণের ৫৪টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচ-ছয়টি ছাড়া অন্যগুলোতে গ্রামীণের কোনো সম্পর্ক নেই, রয়েছে শুধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের—অর্থমন্ত্রীর এমন এক মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আকবর আলি খান বলেন, কোম্পানি গঠিত হয় দুইভাবে—পুঁজি ও গ্যারান্টি দিয়ে। এদের বেশির ভাগই হয়েছে গ্যারান্টি দিয়ে। অর্থাৎ গ্রামীণ থেকে পুঁজি দিতে হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলো কোম্পানি আইন মেনেই হয়েছে বলে তিনি জানেন।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে নরওয়ের একটি টেলিভিশনে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। এরপর ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে তদন্ত করতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে মনোয়ার উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটি গ্রামীণ ব্যাংকের সার্বিক কর্মকাণ্ডের ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেয়। ২০১১ সালের মার্চে অনুমোদন না নিয়ে পদে রয়েছেন কারণ দেখিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ থেকে অব্যাহতি দেয় সরকার। এর বিরুদ্ধে ড. ইউনূস আদালতে আপিল করলে আদালত তা খারিজ করে দেন।
এর পর থেকে মাঝে মাঝেই গ্রামীণ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিরা কথা বলতে থাকেন। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি তিনি সমর্থন ব্যক্ত করেন। এর পরই কমিশন গঠন করল সরকার।

No comments

Powered by Blogger.