১৮ দলীয় জোটের নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর মামলা-শীর্ষস্থানীয় ৩৩ নেতা কারাগারে
গাড়ি পোড়ানোর মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের ৩৩ জন নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ২৯ জন এবং শরিক চারটি দলের চার শীর্ষনেতা রয়েছেন।
এসব নেতা গতকাল বুধবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। মহানগর হাকিম এরফান উল্লাহ জামিনের আবেদন নাকচ করে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে ৩৪ জনের পক্ষে জামিনের আবেদন করা হলেও তাঁদের একজন আদালতে হাজির ছিলেন না।
বিরোধী দলের নেতাদের আত্মসমর্পণকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকেই পুরো আদালত এলাকায় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। সকালেই পুলিশ ও র্যাব আদালত এলাকায় অবস্থান নিয়ে সব কটি প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়।
শুধু আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়া ও সবার দেহ তল্লাশি করা হয়। এমনকি এজলাসকক্ষে প্রবেশ করার সময় আত্মসমর্পণকারী কোনো কোনো নেতা ও আইনজীবীকেও বাধা দেওয়া হয়। এ রকম বাধার মুখে জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান পুলিশকে বলেন, ‘এ কেমন গণতন্ত্র, আসামিদের আদালতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।’ এরপর তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আদালত এলাকায় দিনভর বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় ধাক্কাধাক্কি হয়। আদেশের পর বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীরা বিক্ষোভ মিছিল করতে গেলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। সকাল থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত আদালত এলাকা থেকে বিএনপির কর্মী ও সাধারণ পথচারীসহ শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। অবশ্য তাঁদের সবাইকে সন্ধ্যায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
আদালতে শুনানি: গতকাল বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে বিরোধী দলের ৩৩ নেতা আদালতকক্ষে উপস্থিত হন। উপস্থিত ছিলেন বিপুলসংখ্যক আইনজীবী। দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে মহানগর হাকিম এরফান উল্লাহ এজলাসে ওঠেন। এর পরপরই বিএনপির নেতাদের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতকে বলেন, তাঁরা প্রথমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের জামিনের আবেদন শুনানি করতে চান।
আদালত বলেন, ‘কারা কারা জামিনের আবেদন করেছেন, তাঁদের নাম ডাকা হবে।’ এরপর আদালত জামিন আবেদনকারীদের নাম ধরে ডাকেন। ৩৪ জনের নাম ডাকা হয়। তাঁদের মধ্যে ওবায়দুল হক নাছির নামে বিএনপির মহানগরের এক নেতা উপস্থিত ছিলেন না।
আসামিপক্ষে শুনানির জন্য দাঁড়িয়ে আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, শুনানি করার জন্য তিনি ছাড়াও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আমিনুল হক, এ জে মোহাম্মদ আলী, নিতাই রায় চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, গোলাম মোস্তফা খান, বোরহান উদ্দিনসহ শতাধিক আইনজীবী আদালতের ভেতরে ও বাইরে উপস্থিত আছেন।
শুনানিতে মওদুদ আহমদ বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে ও শুধু বিরোধী দলকে নাজেহাল করতে মামলাটি করা হয়েছে। অন্য কোনো দেশে এ ধরনের ঘটনায় মামলা হলে তা গ্রাহ্য করা হতো না। অভিযোগপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো যাচাই-বাছাই করা হয়নি।
মওদুদ আহমদ বলেন, ২৯ এপ্রিল পুলিশ এ মামলাটি করে। এজাহারে বলা হয়, সাতটি মাইক্রোবাসে করে আসামিরা ফ্যালকন টাওয়ারের সামনে গিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন। তিনি এম কে আনোয়ার, কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে দেখিয়ে বলেন, ঘটনার দিন এই আসামিরা ঢাকাতেই ছিলেন না। অলি আহমদ ছিলেন কক্সবাজারে, শফিউল আলম প্রধান ছিলেন পঞ্চগড়ে, এম কে আনোয়ার ও আন্দালিব রহমানও ঢাকায় ছিলেন না। এতে বোঝা যায়, মামলাটি হয়রানিমূলক। বিএনপির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে এটি করা হয়েছে।
মওদুদ বলেন, মামলার অভিযোগে বলা হয়নি, কে গাড়ি ভাঙচুর করেছে ও কে আগুন দিয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন আসামি নাকি মির্জা ফখরুল ইসলামসহ আটজন সম্পর্কে পুলিশকে বলেছেন। এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। মির্জা ফখরুল জামিন পেতে পারেন। তিনি জামিন পেলে পালাবেন না। আদালত যখন বলবেন তখন হাজির হবেন। মওদুদ একই যুক্তি উপস্থাপন করে বাকি সব আসামির জামিন চান।
মওদুদ আহমদ বলেন, এই মামলায় এর আগে হাইকোর্টে আগাম জামিনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পুলিশ দিয়ে হাইকোর্ট ঘিরে রাখা হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে এই আসামিদের ঢুকতে দেওয়া হয়। হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ আগাম জামিনের বিষয়ে বিভক্তি রায় দেন। এরপর তৃতীয় বেঞ্চে যাওয়া হয়। ১৩ মে বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হকের একক বেঞ্চে শুনানি হয়। পরে আদেশে বলা হয়, মামলায় পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিলের পর আগাম জামিনের সুযোগ নেই। তাই হাইকোর্ট আসামিদের নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে এক আদেশ দেন। ওই আদেশের আলোকে আজ জামিনের আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে এ মামলা করা হয়েছে। যেসব সিনিয়র নেতাকে আসামি করা হয়েছে, তাঁরা জাতির রত্ন। তাঁদের অনেকের বয়স ৭০ বছরের কাছাকাছি। বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বিচার বিভাগ স্বাধীন, ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশা করেন তিনি।
রাষ্ট্রপক্ষে মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু শুনানির জন্য দাঁড়িয়ে বলেন, তিনি ছাড়াও শুনানির জন্য জেলা পিপি খন্দকার আবদুল মান্নান, অতিরিক্ত পিপি শাহ আলম তালুকদার, এ এফ এম রেজাউল করিম, আলী আজগর, সহকারী পিপি মাহফুজুর রহমান, হাফিজুর রহমানসহ রাষ্ট্রপক্ষের শতাধিক কৌঁসুলি আদালতের ভেতরে ও বাইরে উপস্থিত আছেন।
আবদুল্লাহ আবু আসামিদের জামিনের বিরোধিতা করে আদালতকে বলেন, ‘আসামিপক্ষের বিজ্ঞ কৌঁসুলি বলেছেন, তাঁরা গণতন্ত্র ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় বিশ্বাসী। কিন্তু পত্রিকায় এসেছে, আসামিদের আত্মসমর্পণের আগের দিন মঙ্গলবার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এক সভায় বলেছেন, বিএনপির নেতাদের জামিন দেওয়া না হলে কঠোর আন্দোলনে যাবেন। আরও কঠোর হরতাল ডাকা হবে। এটা কি গণতন্ত্রের কথা? কাউকে জামিন দেওয়া না-দেওয়া আদালতের এখতিয়ার। এ ধরনের কথা কি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে না? আবার তাঁরাই বিচার বিভাগ স্বাধীন বলে ন্যায়বিচার চান।’
এর জবাবে মওদুদ আহমদ বলেন, পত্রিকায় কী এসেছে তা আদালতের বিবেচ্য নয়। তা ছাড়া জামিন না দেওয়া হলে হরতাল দেওয়া হবে, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তও তাঁর দল নেয়নি।
মহানগর পিপি আরও বলেন, এই আসামিদের অনেকে হরতালে ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানোর পরিকল্পনা, ইন্ধনদাতা ও অর্থসহায়তাকারী। এসব ঘটনা হরতালের আগে-পরে ঘটেছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনের ৪ ও ৫ ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, তা অজামিনযোগ্য। ২১ মে অভিযোগপত্র গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। এ ছাড়া হাইকোর্টও তাঁদের জামিন দেননি। এ পর্যায়ে জামিন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সরকারপক্ষের আরেক কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান আদালতকে বলেন, জামিন পাওয়ার প্রথম শর্ত আসামি পালাবেন না। এই আসামিদের অনেককেই দেখা গেছে বোরকা পরে বিভিন্ন জায়গায় উপস্থিত হয়েছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা একযোগে সরকারপক্ষের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানালে আদালতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। পরে বিচারকের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
কারাগারে ৩৩ নেতা: উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক আসামিদের জামিনের আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর তাঁদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ছাড়াও অন্য নেতারা হলেন: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, আ স ম হান্নান শাহ ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সহসভাপতি সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক, স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান, সাধারণ সম্পাদক মীর শরাফত আলী, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম, যুবদলের মহানগর উত্তরের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার, দক্ষিণ যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের (দক্ষিণ) সভাপতি ইয়াসিন আলী, ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার, ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের দক্ষিণের আহ্বায়ক হাবিবুর রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আবদুল মতিন, ছাত্রদল উত্তরের সাধারণ সম্পাদক কামাল আনোয়ার আহমেদ, মহানগর বিএনপির নেতা সাবেক কমিশনার মো. আনোয়ারুজ্জামান, সাবেক কমিশনার ইউনুস মৃধা, লুৎফুর রহমান, নবী সোলায়মান এবং লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি অলি আহমদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সভাপতি আন্দালিব রহমান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির সভাপতি শেখ শওকত হোসেন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান।
বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীকে জীবিত ফেরত দেওয়ার দাবিতে গত ২৯ এপ্রিল হরতালের দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে ফ্যালকন টাওয়ারের সামনে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা করে। গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত শেষে ৪৫ জনকে আসামি করে ১০ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল আলম জানান, গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের মধ্যে ১৪ জনকে গুরুত্বপূর্ণ বন্দীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদ।
আগে গ্রেপ্তার সাতজন, একজন জামিনে: এই ৪৫ আসামির মধ্যে সাতজনকে আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। তাঁরা হলেন: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, কামরুজ্জামান রতন, মান্নান হোসেন শাহীন, ইসমাইল খান শাহীন, মানিক রতন এবং ওই বাসের দুই কর্মী (কন্ডাক্টর ও হেলপার) সোহেল ওরফে সোহান মিয়া ও জসিমউদ্দিন। এ ছাড়া আরেক আসামি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও আইনজীবী মাহবুবউদ্দিন খোকন হাইকোর্ট থেকে জামিনে রয়েছেন।
এই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে ৩৪ জনের পক্ষে জামিনের আবেদন করা হলেও তাঁদের একজন আদালতে হাজির ছিলেন না।
বিরোধী দলের নেতাদের আত্মসমর্পণকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকেই পুরো আদালত এলাকায় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। সকালেই পুলিশ ও র্যাব আদালত এলাকায় অবস্থান নিয়ে সব কটি প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়।
শুধু আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়া ও সবার দেহ তল্লাশি করা হয়। এমনকি এজলাসকক্ষে প্রবেশ করার সময় আত্মসমর্পণকারী কোনো কোনো নেতা ও আইনজীবীকেও বাধা দেওয়া হয়। এ রকম বাধার মুখে জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান পুলিশকে বলেন, ‘এ কেমন গণতন্ত্র, আসামিদের আদালতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।’ এরপর তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আদালত এলাকায় দিনভর বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় ধাক্কাধাক্কি হয়। আদেশের পর বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীরা বিক্ষোভ মিছিল করতে গেলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। সকাল থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত আদালত এলাকা থেকে বিএনপির কর্মী ও সাধারণ পথচারীসহ শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। অবশ্য তাঁদের সবাইকে সন্ধ্যায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
আদালতে শুনানি: গতকাল বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে বিরোধী দলের ৩৩ নেতা আদালতকক্ষে উপস্থিত হন। উপস্থিত ছিলেন বিপুলসংখ্যক আইনজীবী। দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে মহানগর হাকিম এরফান উল্লাহ এজলাসে ওঠেন। এর পরপরই বিএনপির নেতাদের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতকে বলেন, তাঁরা প্রথমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের জামিনের আবেদন শুনানি করতে চান।
আদালত বলেন, ‘কারা কারা জামিনের আবেদন করেছেন, তাঁদের নাম ডাকা হবে।’ এরপর আদালত জামিন আবেদনকারীদের নাম ধরে ডাকেন। ৩৪ জনের নাম ডাকা হয়। তাঁদের মধ্যে ওবায়দুল হক নাছির নামে বিএনপির মহানগরের এক নেতা উপস্থিত ছিলেন না।
আসামিপক্ষে শুনানির জন্য দাঁড়িয়ে আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, শুনানি করার জন্য তিনি ছাড়াও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আমিনুল হক, এ জে মোহাম্মদ আলী, নিতাই রায় চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, গোলাম মোস্তফা খান, বোরহান উদ্দিনসহ শতাধিক আইনজীবী আদালতের ভেতরে ও বাইরে উপস্থিত আছেন।
শুনানিতে মওদুদ আহমদ বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে ও শুধু বিরোধী দলকে নাজেহাল করতে মামলাটি করা হয়েছে। অন্য কোনো দেশে এ ধরনের ঘটনায় মামলা হলে তা গ্রাহ্য করা হতো না। অভিযোগপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো যাচাই-বাছাই করা হয়নি।
মওদুদ আহমদ বলেন, ২৯ এপ্রিল পুলিশ এ মামলাটি করে। এজাহারে বলা হয়, সাতটি মাইক্রোবাসে করে আসামিরা ফ্যালকন টাওয়ারের সামনে গিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন। তিনি এম কে আনোয়ার, কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে দেখিয়ে বলেন, ঘটনার দিন এই আসামিরা ঢাকাতেই ছিলেন না। অলি আহমদ ছিলেন কক্সবাজারে, শফিউল আলম প্রধান ছিলেন পঞ্চগড়ে, এম কে আনোয়ার ও আন্দালিব রহমানও ঢাকায় ছিলেন না। এতে বোঝা যায়, মামলাটি হয়রানিমূলক। বিএনপির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে এটি করা হয়েছে।
মওদুদ বলেন, মামলার অভিযোগে বলা হয়নি, কে গাড়ি ভাঙচুর করেছে ও কে আগুন দিয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন আসামি নাকি মির্জা ফখরুল ইসলামসহ আটজন সম্পর্কে পুলিশকে বলেছেন। এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। মির্জা ফখরুল জামিন পেতে পারেন। তিনি জামিন পেলে পালাবেন না। আদালত যখন বলবেন তখন হাজির হবেন। মওদুদ একই যুক্তি উপস্থাপন করে বাকি সব আসামির জামিন চান।
মওদুদ আহমদ বলেন, এই মামলায় এর আগে হাইকোর্টে আগাম জামিনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পুলিশ দিয়ে হাইকোর্ট ঘিরে রাখা হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে এই আসামিদের ঢুকতে দেওয়া হয়। হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ আগাম জামিনের বিষয়ে বিভক্তি রায় দেন। এরপর তৃতীয় বেঞ্চে যাওয়া হয়। ১৩ মে বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হকের একক বেঞ্চে শুনানি হয়। পরে আদেশে বলা হয়, মামলায় পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিলের পর আগাম জামিনের সুযোগ নেই। তাই হাইকোর্ট আসামিদের নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে এক আদেশ দেন। ওই আদেশের আলোকে আজ জামিনের আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে এ মামলা করা হয়েছে। যেসব সিনিয়র নেতাকে আসামি করা হয়েছে, তাঁরা জাতির রত্ন। তাঁদের অনেকের বয়স ৭০ বছরের কাছাকাছি। বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বিচার বিভাগ স্বাধীন, ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশা করেন তিনি।
রাষ্ট্রপক্ষে মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু শুনানির জন্য দাঁড়িয়ে বলেন, তিনি ছাড়াও শুনানির জন্য জেলা পিপি খন্দকার আবদুল মান্নান, অতিরিক্ত পিপি শাহ আলম তালুকদার, এ এফ এম রেজাউল করিম, আলী আজগর, সহকারী পিপি মাহফুজুর রহমান, হাফিজুর রহমানসহ রাষ্ট্রপক্ষের শতাধিক কৌঁসুলি আদালতের ভেতরে ও বাইরে উপস্থিত আছেন।
আবদুল্লাহ আবু আসামিদের জামিনের বিরোধিতা করে আদালতকে বলেন, ‘আসামিপক্ষের বিজ্ঞ কৌঁসুলি বলেছেন, তাঁরা গণতন্ত্র ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় বিশ্বাসী। কিন্তু পত্রিকায় এসেছে, আসামিদের আত্মসমর্পণের আগের দিন মঙ্গলবার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এক সভায় বলেছেন, বিএনপির নেতাদের জামিন দেওয়া না হলে কঠোর আন্দোলনে যাবেন। আরও কঠোর হরতাল ডাকা হবে। এটা কি গণতন্ত্রের কথা? কাউকে জামিন দেওয়া না-দেওয়া আদালতের এখতিয়ার। এ ধরনের কথা কি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে না? আবার তাঁরাই বিচার বিভাগ স্বাধীন বলে ন্যায়বিচার চান।’
এর জবাবে মওদুদ আহমদ বলেন, পত্রিকায় কী এসেছে তা আদালতের বিবেচ্য নয়। তা ছাড়া জামিন না দেওয়া হলে হরতাল দেওয়া হবে, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তও তাঁর দল নেয়নি।
মহানগর পিপি আরও বলেন, এই আসামিদের অনেকে হরতালে ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানোর পরিকল্পনা, ইন্ধনদাতা ও অর্থসহায়তাকারী। এসব ঘটনা হরতালের আগে-পরে ঘটেছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনের ৪ ও ৫ ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, তা অজামিনযোগ্য। ২১ মে অভিযোগপত্র গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। এ ছাড়া হাইকোর্টও তাঁদের জামিন দেননি। এ পর্যায়ে জামিন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সরকারপক্ষের আরেক কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান আদালতকে বলেন, জামিন পাওয়ার প্রথম শর্ত আসামি পালাবেন না। এই আসামিদের অনেককেই দেখা গেছে বোরকা পরে বিভিন্ন জায়গায় উপস্থিত হয়েছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা একযোগে সরকারপক্ষের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানালে আদালতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। পরে বিচারকের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
কারাগারে ৩৩ নেতা: উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক আসামিদের জামিনের আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর তাঁদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ছাড়াও অন্য নেতারা হলেন: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, আ স ম হান্নান শাহ ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সহসভাপতি সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক, স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান, সাধারণ সম্পাদক মীর শরাফত আলী, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম, যুবদলের মহানগর উত্তরের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার, দক্ষিণ যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের (দক্ষিণ) সভাপতি ইয়াসিন আলী, ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার, ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের দক্ষিণের আহ্বায়ক হাবিবুর রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আবদুল মতিন, ছাত্রদল উত্তরের সাধারণ সম্পাদক কামাল আনোয়ার আহমেদ, মহানগর বিএনপির নেতা সাবেক কমিশনার মো. আনোয়ারুজ্জামান, সাবেক কমিশনার ইউনুস মৃধা, লুৎফুর রহমান, নবী সোলায়মান এবং লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি অলি আহমদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সভাপতি আন্দালিব রহমান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির সভাপতি শেখ শওকত হোসেন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান।
বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীকে জীবিত ফেরত দেওয়ার দাবিতে গত ২৯ এপ্রিল হরতালের দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে ফ্যালকন টাওয়ারের সামনে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা করে। গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত শেষে ৪৫ জনকে আসামি করে ১০ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল আলম জানান, গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের মধ্যে ১৪ জনকে গুরুত্বপূর্ণ বন্দীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদ।
আগে গ্রেপ্তার সাতজন, একজন জামিনে: এই ৪৫ আসামির মধ্যে সাতজনকে আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। তাঁরা হলেন: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, কামরুজ্জামান রতন, মান্নান হোসেন শাহীন, ইসমাইল খান শাহীন, মানিক রতন এবং ওই বাসের দুই কর্মী (কন্ডাক্টর ও হেলপার) সোহেল ওরফে সোহান মিয়া ও জসিমউদ্দিন। এ ছাড়া আরেক আসামি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও আইনজীবী মাহবুবউদ্দিন খোকন হাইকোর্ট থেকে জামিনে রয়েছেন।
No comments