গতকাল সমকাল-ওবামা ও আফগানিস্তানের হালহকিকত by ফারুক চৌধুরী
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম আলোয় ‘আফগানিস্তানের চোরাবালিতে ওবামা?’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। এখন, তার সাত মাস পর, আফগানিস্তানের অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উপরিউক্ত সেই শিরোনামে প্রশ্নবোধক চিহ্নটি এখনো রয়ে গেছে। গত সাত মাসে প্রেসিডেন্ট ওবামা আফগানিস্তানে বেশ কয়েকটি উদ্যোগই তো নিলেন।
সেনাবাহিনীর সুপারিশে তিনি সেই দেশে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো সেনাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেন, যাতে তারা তালেবানদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে পারে। স্থানীয় আফগানদের মেজাজ খোশ আর ডলারে জেব ভারী করার বিবিধ প্রয়াস তিনি নিচ্ছেন। নির্বাচনের মাধ্যমে কারজাইকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আরও পাঁচ বছরের বৈধতা দিলেন।
দেশটি থেকে ব্যাপক দুর্নীতি হ্রাস করার বাড়তি উদ্যোগ নিয়ে ঝটিকা সফরে কাবুলে গিয়ে সরেজমিনে প্রেসিডেন্ট কারজাইকে ওয়াজ-নসিহত করলেন। সীমান্তের ওপারে পাকিস্তান যাতে তালেবানদের অভয়াশ্রম হয়ে না থাকতে পারে, তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সক্রিয় করালেন। আল-কায়েদাকে নেতাশূন্য করার অভিপ্রায়ে ‘স্টেট অব দি আর্ট’ পাইলটবিহীন ড্রোন বিমান আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন। আফগানিস্তান সম্পর্কে তাঁর কথায় আর কাজে মিলই তো রাখলেন ওবামা। অসীম ধৈর্যে আফগানিস্তান সম্বন্ধে তাঁর ঘোষিত পদক্ষেপ তিনি অনুসরণ করছেন। কিন্তু সবুরে মেওয়া ফলছে না এই আফগানিস্তানে।
গত ফেব্রুয়ারিতে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের মারজা আক্রমণ করল। বলা হলো যে সেই অঞ্চল থেকে তালেবানরা বিতাড়িত হয়েছে। এখন সেই অঞ্চলে আবার তালেবানরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দুই হাতে ডলার বিলিয়ে যাচ্ছে মার্কিনরা। কিন্তু কোন শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যক্তিটি ‘তালেবান’ আর কে ‘জানে মান’ (প্রাণপ্রিয়) তা ঠাহর করা নাকি কঠিন হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ না জেনে অনেক তালেবানের পকেট ভারী করছে মার্কিনরা। অনেক প্রদেশেই নবনির্বাচিত সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাদের সুরক্ষিত অফিসে বসে ঝিমাচ্ছেন; বাইরে বেরোনোর হিম্মত তাঁদের নেই। গেরিলাদের যে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ করানো কঠিন, তা আক্ষরিকভাবেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মার্কিনরা। এদিকে ক্রমবর্ধমান বিভিন্নমুখী চাপে অস্থির হয়ে পড়ছেন কারজাই। সেদিন তো তিনি নাকি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তাঁকে আর বেশি তকলিফ দিলে তিনি নিজেই তালেবান বনে যাবেন। এতে অত্যুক্তি রয়েছে, কারণ রাবণ রাম হয়ে গেলে তো রামায়ণের কিসসাই খতম। এ ছাড়া ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদকে কাবুলে আমন্ত্রণ করে তাঁর মুখে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তা শুনিয়েছেন। চীন সফর করেছেন কারজাই এবং চীনারা মধ্য এশিয়ার নিকটবর্তী আফগানিস্তানে লক্ষাধিক মার্কিন সেনার উপস্থিতিতে উল্লসিত নয়। পাইলটবিহীন ড্রোন আক্রমণে বেশ কজন আল-কায়েদা নেতা নাকি নিহত হয়েছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এও প্রমাণিত হচ্ছে যে আল-কায়েদার ঘাড়ে একাধিক নেতার মাথাই যে শুধু রয়েছে তা-ই নয়, তাদের মধ্যে কারও শিরশ্ছেদ হলে নতুন শির গজাতেও সময় লাগে না। বিজ্ঞানপ্রসূত ড্রোন বিমান এখানে মানুষের সংগঠন শক্তির কাছে পরাভূত।
আফগানিস্তানের মতো জটিল একটি সমস্যার চটজলদি কোনো সমাধান নেই। শুধু তা-ই নয়, ঘটনাপ্রবাহে সমস্যাটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন জটিলতরই হচ্ছে। সমস্যাটি সংগত কারণেই আমাকে দুই ধারার দুজন মানুষের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাঁদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের সময় তারা এখনকার মতো ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেননি। তাঁরা হলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ আর সাংবাদিক হামিদ মির।
সেই সময়ে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মোশাররফকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯৯ সালের ১২ এপ্রিল, করাচির বিচ লাক্সারি হোটেলে একটি আলোচনা সভায়। তালেবানদের ওপর তাঁর মন্তব্য আগ্রহ-উদ্দীপক ছিল বলেই এ সম্পর্কে একাধিকবার লিখে পাঠককে হয়তো বা বিরক্তই করেছি। তিনি তখন বলেছিলেন যে আফগানিস্তানের ৩১টি প্রদেশের (এপ্রিল ১৯৯৯) ২৬টিই তালেবানদের আয়ত্তে। তাঁর অভিমত ছিল, একমাত্র তালেবানরাই আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম, কারণ তারাই হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে সেই দেশের একমাত্র সুসংগঠিত শক্তি। যেহেতু আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে, পাকিস্তানের উচিত তালেবানদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা। তালেবানদের মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতের স্থিতিশীল আফগানিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে পাকিস্তান তালেবানশাসিত সেই দেশকে তার কট্টরবাদী ও চরমপন্থী মনোভাব পরিহারে বাধ্য করতে সক্ষম হবে। সেই বছরের শেষ দিকে এই জেনারেল মোশাররফ কলম্বো থেকে উড়ে এসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদটিতে ক্রমে ক্রমে জুড়ে বসলেন। ৯/১১ হলো। বুশ সাহেব প্রেসিডেন্ট মোশাররফকে বললেন, ‘হয় আপনি আমার সঙ্গে, নাহয় আপনি আমার বিপক্ষে।’ তারপর ক্ষমতার মায়ায় ১৮০ ডিগ্রি ‘অ্যাবাউট টার্ন’ করে মোশাররফ যা করলেন তা এখন ইতিহাস। এখন বুশ সাহেব নেই, ওবামা সাহেব এসেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে আফগানিস্তানে তালেবানরাও বিস্তৃতি লাভ করছে। ‘লাইন অব ফায়ার’ থেকে মোশাররফ সাহেব অন্তত এখনকার ঘটনাবলির জন্য অবান্তর। কিন্তু তিনি ১৯৯৯ সালের ১২ এপ্রিল করাচির বিচ লাক্সারি হোটেলে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা কিন্তু আজও কানে বাজে।
সাংবাদিক হামিদ মির। তিনি এখন এশিয়ার জনপ্রিয় একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। এই সেদিনই তো পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে সার্ক তাঁকে সম্মানজনক স্বীকৃতি প্রদান করল। আমাদের এবারের স্বাধীনতা দিবসে কী চমৎকার একটি বাণী তিনি বাংলাদেশকে পাঠিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ইসলামাবাদে ২০০১ সালের ২০ অক্টোবর। তখন আফগানিস্তানে বুশ সাহেবের বোমাবাজি চলছে। হামিদ মির তখন ইসলামাবাদের উর্দু দৈনিক আওসাফ-এর সম্পাদক; ওসামা বিন লাদেন আর মোল্লা ওমরের সঙ্গে রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচিতি। সেদিন তিনি আমার কাছে এই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন, যা প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। হামিদ মির সেদিন আমার কাছে তাঁর এই বিশ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন যে ওমর আর ওসামাকে মেরে ফেললেও তালেবানদের শেষ করা যাবে না। হামিদ মিরের এই মত ছিল যে বুশ সাহেবের বোমাবর্ষণের ফলে তালেবানরা আরও সুসংহত, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আর শক্তিশালী হয়েছে। যাদের অভিধানে জেহাদে মৃত্যু নেই, রয়েছে শাহাদাতের দরজায় প্রবেশের অপূর্ব সুযোগ, তাদের বোমা মেরে দমিয়ে রাখা যাবে না। তারপর দৃশ্যত তালেবানরা পরাজিত হলেও আজ আবার তারা ফিরে এসেছে। বুশ সাহেব নেই। ওবামা সাহেব রয়েছেন। বুশ সাহেবের ‘কারপেট বোম্বিং’-এর স্থানে এখন ওবামা সাহেবের ‘ড্রোন’ বিমান আক্রমণের পালা।
নিজ নিজ অভিজ্ঞতায় তালেবানদের ভালো করেই চেনেন পারভেজ মোশাররফ আর হামিদ মির। তালেবানদের সম্পৃক্ত না করে আফগানিস্তানে অতীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি এবং ভবিষ্যতেও তা হওয়ার কোনো আলামত চোখে পড়ছে না। তবে কট্টরবাদী একটি রাষ্ট্র যে বাস্তবধর্মী হতে পারে, ইরানই তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আহমাদিনেজাদ মাথা নত করছেন না ঠিকই, তবে বিশ্বময় তিনি বিপ্লব ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, তা তো নয়। আর লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি? তিনি বদলে যাননি? বস্তুনিষ্ঠ বিচার একজন রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। তা ছাড়া সব তালেবানি কি এক?
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি একটি কাহিনি পুনর্ব্যক্ত করছি। ২০০১ সালের অক্টোবরে আমি ইসলামাবাদে সেই সময়কার তালেবান রাষ্ট্রদূত আবদুস সালাম জায়েফের সাক্ষাৎকার নিই। প্রথম আলোতে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তালেবানদের সংগ্রাম চলবেই। তালেবানদের মৃত্যুচিন্তা নেই এই কারণে যে জন্মের ১২০ দিন পর আল্লাহ নবজাতকের মৃত্যুর দিনক্ষণ ঠিক করে দেন। সেই মাওলানা জায়েফ তারপর গোয়ানতানামোতে কারাবন্দী ছিলেন এবং এখন কাবুলে ফিরে এসে বলেছেন যে আফগানিস্তানের সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেত, যদি মার্কিনরা তা চাইত। হালে প্রকাশিত লাইফ উইথ দ্য তালেবান-এর লেখক আবদুস সালাম জায়েফ কিন্তু বলছেন যে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা বৃদ্ধি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্নটি হচ্ছে, আফগানিস্তানে ওবামা আসলে কেন তাঁর সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করলেন? মধ্য এশিয়াকে দৃষ্টিতে রেখে যদি এই সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে, তাহলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। অন্যদের মধ্যে চীন ও ইরানে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটবেই। সেনাসংখ্যা বৃদ্ধিটি যদি তালেবানদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার অভিপ্রায়ে হয়ে থাকে, তাহলে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে একবাক্যে বলা যায়, তা অসম্ভব। আফগানিস্তানে তাজেক, উজবেক, হাজারা, পশতুন ইত্যাদি নিয়ে যে নৃতাত্ত্বিক মোজাইকটি রয়েছে তার সঙ্গে ভারসাম্য—তা তালেবানই হোক অথবা অতালেবান—আফগানরাই আনতে পারবে। আফগানিস্তানে আমেরিকান পেশিশক্তি বৃদ্ধি যদি তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সুগম করার উদ্দেশ্যে করা হয় থাকে, তাহলে ওবামা সাহেবকে লক্ষ রাখতে হবে, তিনি তাঁর সময় সীমারেখা যেন লঙ্ঘন না করেন। টেকসই সমাধানের স্বার্থে তাঁকে ভবিষ্যতে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করতেই হবে। তবে হ্যাঁ, আফগানিস্তান সমস্যার অন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক বিবেচনা রয়েছে, তা হলো ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক।
পাকিস্তানের ভারতবিরোধী স্ট্র্যাটেজিতে আফগানিস্তানে তালেবান তোষণনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আফগানিস্তানে তালেবানরা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেই দেশে ক্রমবর্ধমান ভারতীয় প্রভাব পাকিস্তান স্বস্তির দৃষ্টিতে দেখে না। আমার বিশ্বাস, এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি রয়েছে শুধু ভারত-পাকিস্তান সমঝোতা নয়, আফগানিস্তানে তাদের সহযোগিতার ওপর। অতএব এই দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান কোনো সমস্যাই যাতে উপেক্ষিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ভারত-পাকিস্তান সমস্যাবলির স্থায়ী এবং দূরদর্শী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ছেড়ে যাওয়া কাশ্মীর দক্ষিণ এশিয়ায় একাধিক যুদ্ধ ঘটিয়েছে এবং সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক অশান্তি। কোনো সমঝোতা ছাড়া আফগানিস্তানের বুকে ভারত আর পাকিস্তানকে একটি উত্তেজনাময় প্রতিযোগিতায় রেখে যাওয়া, অন্যান্য অশান্তির মধ্যে, পাকিস্তানকে নিয়ে এই গোটা অঞ্চলটির কট্টর তালেবানীকরণের ভয়াবহ সম্ভাবনা প্রকটতর করবে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
দেশটি থেকে ব্যাপক দুর্নীতি হ্রাস করার বাড়তি উদ্যোগ নিয়ে ঝটিকা সফরে কাবুলে গিয়ে সরেজমিনে প্রেসিডেন্ট কারজাইকে ওয়াজ-নসিহত করলেন। সীমান্তের ওপারে পাকিস্তান যাতে তালেবানদের অভয়াশ্রম হয়ে না থাকতে পারে, তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সক্রিয় করালেন। আল-কায়েদাকে নেতাশূন্য করার অভিপ্রায়ে ‘স্টেট অব দি আর্ট’ পাইলটবিহীন ড্রোন বিমান আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন। আফগানিস্তান সম্পর্কে তাঁর কথায় আর কাজে মিলই তো রাখলেন ওবামা। অসীম ধৈর্যে আফগানিস্তান সম্বন্ধে তাঁর ঘোষিত পদক্ষেপ তিনি অনুসরণ করছেন। কিন্তু সবুরে মেওয়া ফলছে না এই আফগানিস্তানে।
গত ফেব্রুয়ারিতে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের মারজা আক্রমণ করল। বলা হলো যে সেই অঞ্চল থেকে তালেবানরা বিতাড়িত হয়েছে। এখন সেই অঞ্চলে আবার তালেবানরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দুই হাতে ডলার বিলিয়ে যাচ্ছে মার্কিনরা। কিন্তু কোন শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যক্তিটি ‘তালেবান’ আর কে ‘জানে মান’ (প্রাণপ্রিয়) তা ঠাহর করা নাকি কঠিন হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ না জেনে অনেক তালেবানের পকেট ভারী করছে মার্কিনরা। অনেক প্রদেশেই নবনির্বাচিত সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাদের সুরক্ষিত অফিসে বসে ঝিমাচ্ছেন; বাইরে বেরোনোর হিম্মত তাঁদের নেই। গেরিলাদের যে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ করানো কঠিন, তা আক্ষরিকভাবেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মার্কিনরা। এদিকে ক্রমবর্ধমান বিভিন্নমুখী চাপে অস্থির হয়ে পড়ছেন কারজাই। সেদিন তো তিনি নাকি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তাঁকে আর বেশি তকলিফ দিলে তিনি নিজেই তালেবান বনে যাবেন। এতে অত্যুক্তি রয়েছে, কারণ রাবণ রাম হয়ে গেলে তো রামায়ণের কিসসাই খতম। এ ছাড়া ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদকে কাবুলে আমন্ত্রণ করে তাঁর মুখে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তা শুনিয়েছেন। চীন সফর করেছেন কারজাই এবং চীনারা মধ্য এশিয়ার নিকটবর্তী আফগানিস্তানে লক্ষাধিক মার্কিন সেনার উপস্থিতিতে উল্লসিত নয়। পাইলটবিহীন ড্রোন আক্রমণে বেশ কজন আল-কায়েদা নেতা নাকি নিহত হয়েছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এও প্রমাণিত হচ্ছে যে আল-কায়েদার ঘাড়ে একাধিক নেতার মাথাই যে শুধু রয়েছে তা-ই নয়, তাদের মধ্যে কারও শিরশ্ছেদ হলে নতুন শির গজাতেও সময় লাগে না। বিজ্ঞানপ্রসূত ড্রোন বিমান এখানে মানুষের সংগঠন শক্তির কাছে পরাভূত।
আফগানিস্তানের মতো জটিল একটি সমস্যার চটজলদি কোনো সমাধান নেই। শুধু তা-ই নয়, ঘটনাপ্রবাহে সমস্যাটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন জটিলতরই হচ্ছে। সমস্যাটি সংগত কারণেই আমাকে দুই ধারার দুজন মানুষের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাঁদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের সময় তারা এখনকার মতো ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেননি। তাঁরা হলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ আর সাংবাদিক হামিদ মির।
সেই সময়ে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মোশাররফকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯৯ সালের ১২ এপ্রিল, করাচির বিচ লাক্সারি হোটেলে একটি আলোচনা সভায়। তালেবানদের ওপর তাঁর মন্তব্য আগ্রহ-উদ্দীপক ছিল বলেই এ সম্পর্কে একাধিকবার লিখে পাঠককে হয়তো বা বিরক্তই করেছি। তিনি তখন বলেছিলেন যে আফগানিস্তানের ৩১টি প্রদেশের (এপ্রিল ১৯৯৯) ২৬টিই তালেবানদের আয়ত্তে। তাঁর অভিমত ছিল, একমাত্র তালেবানরাই আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম, কারণ তারাই হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে সেই দেশের একমাত্র সুসংগঠিত শক্তি। যেহেতু আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে, পাকিস্তানের উচিত তালেবানদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা। তালেবানদের মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতের স্থিতিশীল আফগানিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে পাকিস্তান তালেবানশাসিত সেই দেশকে তার কট্টরবাদী ও চরমপন্থী মনোভাব পরিহারে বাধ্য করতে সক্ষম হবে। সেই বছরের শেষ দিকে এই জেনারেল মোশাররফ কলম্বো থেকে উড়ে এসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদটিতে ক্রমে ক্রমে জুড়ে বসলেন। ৯/১১ হলো। বুশ সাহেব প্রেসিডেন্ট মোশাররফকে বললেন, ‘হয় আপনি আমার সঙ্গে, নাহয় আপনি আমার বিপক্ষে।’ তারপর ক্ষমতার মায়ায় ১৮০ ডিগ্রি ‘অ্যাবাউট টার্ন’ করে মোশাররফ যা করলেন তা এখন ইতিহাস। এখন বুশ সাহেব নেই, ওবামা সাহেব এসেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে আফগানিস্তানে তালেবানরাও বিস্তৃতি লাভ করছে। ‘লাইন অব ফায়ার’ থেকে মোশাররফ সাহেব অন্তত এখনকার ঘটনাবলির জন্য অবান্তর। কিন্তু তিনি ১৯৯৯ সালের ১২ এপ্রিল করাচির বিচ লাক্সারি হোটেলে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা কিন্তু আজও কানে বাজে।
সাংবাদিক হামিদ মির। তিনি এখন এশিয়ার জনপ্রিয় একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। এই সেদিনই তো পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে সার্ক তাঁকে সম্মানজনক স্বীকৃতি প্রদান করল। আমাদের এবারের স্বাধীনতা দিবসে কী চমৎকার একটি বাণী তিনি বাংলাদেশকে পাঠিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ইসলামাবাদে ২০০১ সালের ২০ অক্টোবর। তখন আফগানিস্তানে বুশ সাহেবের বোমাবাজি চলছে। হামিদ মির তখন ইসলামাবাদের উর্দু দৈনিক আওসাফ-এর সম্পাদক; ওসামা বিন লাদেন আর মোল্লা ওমরের সঙ্গে রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচিতি। সেদিন তিনি আমার কাছে এই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন, যা প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। হামিদ মির সেদিন আমার কাছে তাঁর এই বিশ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন যে ওমর আর ওসামাকে মেরে ফেললেও তালেবানদের শেষ করা যাবে না। হামিদ মিরের এই মত ছিল যে বুশ সাহেবের বোমাবর্ষণের ফলে তালেবানরা আরও সুসংহত, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আর শক্তিশালী হয়েছে। যাদের অভিধানে জেহাদে মৃত্যু নেই, রয়েছে শাহাদাতের দরজায় প্রবেশের অপূর্ব সুযোগ, তাদের বোমা মেরে দমিয়ে রাখা যাবে না। তারপর দৃশ্যত তালেবানরা পরাজিত হলেও আজ আবার তারা ফিরে এসেছে। বুশ সাহেব নেই। ওবামা সাহেব রয়েছেন। বুশ সাহেবের ‘কারপেট বোম্বিং’-এর স্থানে এখন ওবামা সাহেবের ‘ড্রোন’ বিমান আক্রমণের পালা।
নিজ নিজ অভিজ্ঞতায় তালেবানদের ভালো করেই চেনেন পারভেজ মোশাররফ আর হামিদ মির। তালেবানদের সম্পৃক্ত না করে আফগানিস্তানে অতীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি এবং ভবিষ্যতেও তা হওয়ার কোনো আলামত চোখে পড়ছে না। তবে কট্টরবাদী একটি রাষ্ট্র যে বাস্তবধর্মী হতে পারে, ইরানই তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আহমাদিনেজাদ মাথা নত করছেন না ঠিকই, তবে বিশ্বময় তিনি বিপ্লব ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, তা তো নয়। আর লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি? তিনি বদলে যাননি? বস্তুনিষ্ঠ বিচার একজন রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। তা ছাড়া সব তালেবানি কি এক?
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি একটি কাহিনি পুনর্ব্যক্ত করছি। ২০০১ সালের অক্টোবরে আমি ইসলামাবাদে সেই সময়কার তালেবান রাষ্ট্রদূত আবদুস সালাম জায়েফের সাক্ষাৎকার নিই। প্রথম আলোতে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তালেবানদের সংগ্রাম চলবেই। তালেবানদের মৃত্যুচিন্তা নেই এই কারণে যে জন্মের ১২০ দিন পর আল্লাহ নবজাতকের মৃত্যুর দিনক্ষণ ঠিক করে দেন। সেই মাওলানা জায়েফ তারপর গোয়ানতানামোতে কারাবন্দী ছিলেন এবং এখন কাবুলে ফিরে এসে বলেছেন যে আফগানিস্তানের সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেত, যদি মার্কিনরা তা চাইত। হালে প্রকাশিত লাইফ উইথ দ্য তালেবান-এর লেখক আবদুস সালাম জায়েফ কিন্তু বলছেন যে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা বৃদ্ধি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্নটি হচ্ছে, আফগানিস্তানে ওবামা আসলে কেন তাঁর সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করলেন? মধ্য এশিয়াকে দৃষ্টিতে রেখে যদি এই সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে, তাহলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। অন্যদের মধ্যে চীন ও ইরানে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটবেই। সেনাসংখ্যা বৃদ্ধিটি যদি তালেবানদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার অভিপ্রায়ে হয়ে থাকে, তাহলে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে একবাক্যে বলা যায়, তা অসম্ভব। আফগানিস্তানে তাজেক, উজবেক, হাজারা, পশতুন ইত্যাদি নিয়ে যে নৃতাত্ত্বিক মোজাইকটি রয়েছে তার সঙ্গে ভারসাম্য—তা তালেবানই হোক অথবা অতালেবান—আফগানরাই আনতে পারবে। আফগানিস্তানে আমেরিকান পেশিশক্তি বৃদ্ধি যদি তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সুগম করার উদ্দেশ্যে করা হয় থাকে, তাহলে ওবামা সাহেবকে লক্ষ রাখতে হবে, তিনি তাঁর সময় সীমারেখা যেন লঙ্ঘন না করেন। টেকসই সমাধানের স্বার্থে তাঁকে ভবিষ্যতে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করতেই হবে। তবে হ্যাঁ, আফগানিস্তান সমস্যার অন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক বিবেচনা রয়েছে, তা হলো ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক।
পাকিস্তানের ভারতবিরোধী স্ট্র্যাটেজিতে আফগানিস্তানে তালেবান তোষণনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আফগানিস্তানে তালেবানরা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেই দেশে ক্রমবর্ধমান ভারতীয় প্রভাব পাকিস্তান স্বস্তির দৃষ্টিতে দেখে না। আমার বিশ্বাস, এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি রয়েছে শুধু ভারত-পাকিস্তান সমঝোতা নয়, আফগানিস্তানে তাদের সহযোগিতার ওপর। অতএব এই দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান কোনো সমস্যাই যাতে উপেক্ষিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ভারত-পাকিস্তান সমস্যাবলির স্থায়ী এবং দূরদর্শী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ছেড়ে যাওয়া কাশ্মীর দক্ষিণ এশিয়ায় একাধিক যুদ্ধ ঘটিয়েছে এবং সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক অশান্তি। কোনো সমঝোতা ছাড়া আফগানিস্তানের বুকে ভারত আর পাকিস্তানকে একটি উত্তেজনাময় প্রতিযোগিতায় রেখে যাওয়া, অন্যান্য অশান্তির মধ্যে, পাকিস্তানকে নিয়ে এই গোটা অঞ্চলটির কট্টর তালেবানীকরণের ভয়াবহ সম্ভাবনা প্রকটতর করবে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
No comments