আমার প্রশংসা কর by আল মাহমুদ
বেঁচে আছি। কিন্তু বাঁচার কার্যকারণ সম্পর্ক সূত্রগুলো একটা একটা করে ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে আমি কার জন্য বেঁচে আছি। কেন বেঁচে আছি। এ অবস্থায় হাতড়ে দেখেছি আমার কাছাকাছি কেউই অবস্থান করছে না। একটা কিছু ধরতে পারলে আমি প্রশ্ন করতে পারতাম।
কিন্তু শূন্যতা প্রশ্নের বিপরীতে দাঁড়ায় না। মুখ লুকিয়ে হাসে। আমি সব সময় যত্রতত্র হাসির শব্দে বিরক্তবোধ করি। অকারণ হাসি। কিন্তু এই জগতে ক্রমেই অকারণ হাসির মানুষ কমে এসেছে।
আমি অবশ্য নিজে গম্ভীর মানুষ হিসেবে নিজেকে বিবেচনা করি। আমার কাছে কেউ সহজে ভিড়ে না। মাঝেমধ্যে ভাবি লেখাটাই আমার আসল কাজ কিনা, পর মুহূর্তেই মনে পড়ে লেখাটা না থাকলে আমার অবশিষ্ট থাকে কী? আমি তো আর কোনো কাজেই খুব বেশি মনোযোগ দেইনি। তাহলে আমাকে খুঁজে পেতে হলে হাটেঘাটে, মাঠে-ময়দানে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাকে খুঁজতে হলে আমারই সাহায্য নিতে হবে। আমার কাছে আসতে হবে। আমার কৌতূহলের জবাব দিতে হবে। তারপরও যদি আমার অস্তিত্ব কারও কাছে গ্রাহ্য হয় তাহলেই বুঝতে হবে আমি আছি। আমিই ছিলাম। আমি সারা জীবন একটা জিনিস দেখেছি মেয়েদের কাছে কোনো ঋণ চাইলে তারা নগদে সেটা দিয়ে দেয়। প্রশ্ন করে না, প্রত্যাখ্যানও করে না। তাগাদাও দেয় না। এই যেমন আমি এক মহিলার কাছে সব সময় টাকা-পয়সা ধার চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছি। ফেরত দেইনি কিছুই। তিনি তাগাদাও দেননি।
নিজের ঋণের বোঝা কত হলো সেটা যখন নিজেই পরীক্ষা করতে গেছি তখন লজ্জায় মাথা আরও হেঁট হয়ে গেছে।
এত টাকা আমি নগদে এ মহিলার কাছ থেকে নিয়ে গেছি এটা ভাবলেই আমার হৃত্কম্প হতো। আমি একথা কাউকে কোনো দিন বলতাম না। ঋণদাত্রী নিজেই একদিন আমাকে ডেকে নিজের বোঝাটা কত বড় তা বুঝিয়ে দিলেন।
আমি হতবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, আমি তাগাদা দিতে ডাকিনি। আর এক্ষণি এত টাকা আপনি ফেরত দিতে পারবেনও না। তবে একটা কাজ পারবেন—সেটা হলো আমার প্রতি বিশ্বাস রাখা।
আমি হতবুদ্ধি হয়ে বোকার মতো হাসলাম। বললাম, আমি তো ফেরত দিতে পারব না। এটা জেনেও তুমি এখনও টাকা চাইলেই আমাকে দিয়ে যাচ্ছ কেন?
একজন পুরুষ মানুষ আত্মাকে কিনতে কত টাকা লাগে সেটা আমি দেখতে চাই। আমি হতবিহ্বল হয়ে যাই। আমি কি আমার আত্মাকে বিক্রি করে দিয়েছি?
সে তো অনেক আগেই। আমি হাসার চেষ্টা করলাম। আজই যদি সব টাকা আমি ফেরত দিই তাহলে কি অব্যাহতি পাব? না টাকাটা ফেরত দেয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেটা আমি জানি। তবে চেষ্টা করলে তুমি তাগাদা না দেয়ার জন্য কিছু অন্যরকম ব্যবস্থা করতে পার।
অন্যরকম ব্যবস্থা মানে কি সুদ? আসলে লেনদেনের ব্যাপারে এটাকে সুদই বলে। কিন্তু তুমি তো আবার সুদে বিশ্বাস কর না। যদি সুদ না দাও তাহলে আমাকে প্রবোধ দাও। বল আমাকে ভালোবাস। যদিও আমি জানি এটা ডাহা মিথ্যা কথা। তবে আশ্বাসের বাক্য যদি মিথ্যা হয় নারী তাতে বিশ্বাস করে। আমিও তো নারী। তোমার মিথ্যায় আমি বিশ্বাস করব। তোমার কবিতায় যখন আমার সন্দেহ নেই, তখন তোমার ভালোবাসায় সন্দেহ করে আমি কেন আমার নিজের জীবনটাই মাটি করে ফেলব?
আমি ভয় পেয়ে বললাম, আমি ফেরত দেব। সব টাকা ফেরত দেব। মহিলাটি হাসল। তোমার টাকা থাকলেও তুমি ফেরত দিতে না। কারণ পুরুষ মানুষ যা নেয় অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করে নেয়। নেয় নিয়ে যাওয়ার জন্যই। কিন্তু সে এত বেশি নেয় যে, ঋণটা তার দেহের চেয়েও ভারি বোঝা হয়ে তাকে, বাঁকা করে রাখে। আমি তোমাকে দিয়েছি। এখনও দিই। কারণ তুমি একজন নারীর মুখ অন্তত প্রত্যেক দিন মনে করবে। আর সে নারী হলো এই আমি। কখনও বল না যে, তুমি কোনো নারীকে ভালোবেসেছিলে। কেবল প্রতারণা করেছিলে। এখন বোঝা নিয়ে পালাতে পারছ না। আমার কাছে পরামর্শ চাইছ।
আমি চিত্কার করে বললাম, আমি পরিশোধ করব।
না তা তুমি করবে না। কারণ তুমি যে ঋণ নিয়েছ তা অপরিশোধ্য।
তাহলে আমি কী করব? আমার প্রশংসা কর। আমার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের, এই চোখের, এই ভ্রুর, এই কেশরাশির।
লেখক : কবি
আমি অবশ্য নিজে গম্ভীর মানুষ হিসেবে নিজেকে বিবেচনা করি। আমার কাছে কেউ সহজে ভিড়ে না। মাঝেমধ্যে ভাবি লেখাটাই আমার আসল কাজ কিনা, পর মুহূর্তেই মনে পড়ে লেখাটা না থাকলে আমার অবশিষ্ট থাকে কী? আমি তো আর কোনো কাজেই খুব বেশি মনোযোগ দেইনি। তাহলে আমাকে খুঁজে পেতে হলে হাটেঘাটে, মাঠে-ময়দানে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাকে খুঁজতে হলে আমারই সাহায্য নিতে হবে। আমার কাছে আসতে হবে। আমার কৌতূহলের জবাব দিতে হবে। তারপরও যদি আমার অস্তিত্ব কারও কাছে গ্রাহ্য হয় তাহলেই বুঝতে হবে আমি আছি। আমিই ছিলাম। আমি সারা জীবন একটা জিনিস দেখেছি মেয়েদের কাছে কোনো ঋণ চাইলে তারা নগদে সেটা দিয়ে দেয়। প্রশ্ন করে না, প্রত্যাখ্যানও করে না। তাগাদাও দেয় না। এই যেমন আমি এক মহিলার কাছে সব সময় টাকা-পয়সা ধার চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছি। ফেরত দেইনি কিছুই। তিনি তাগাদাও দেননি।
নিজের ঋণের বোঝা কত হলো সেটা যখন নিজেই পরীক্ষা করতে গেছি তখন লজ্জায় মাথা আরও হেঁট হয়ে গেছে।
এত টাকা আমি নগদে এ মহিলার কাছ থেকে নিয়ে গেছি এটা ভাবলেই আমার হৃত্কম্প হতো। আমি একথা কাউকে কোনো দিন বলতাম না। ঋণদাত্রী নিজেই একদিন আমাকে ডেকে নিজের বোঝাটা কত বড় তা বুঝিয়ে দিলেন।
আমি হতবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, আমি তাগাদা দিতে ডাকিনি। আর এক্ষণি এত টাকা আপনি ফেরত দিতে পারবেনও না। তবে একটা কাজ পারবেন—সেটা হলো আমার প্রতি বিশ্বাস রাখা।
আমি হতবুদ্ধি হয়ে বোকার মতো হাসলাম। বললাম, আমি তো ফেরত দিতে পারব না। এটা জেনেও তুমি এখনও টাকা চাইলেই আমাকে দিয়ে যাচ্ছ কেন?
একজন পুরুষ মানুষ আত্মাকে কিনতে কত টাকা লাগে সেটা আমি দেখতে চাই। আমি হতবিহ্বল হয়ে যাই। আমি কি আমার আত্মাকে বিক্রি করে দিয়েছি?
সে তো অনেক আগেই। আমি হাসার চেষ্টা করলাম। আজই যদি সব টাকা আমি ফেরত দিই তাহলে কি অব্যাহতি পাব? না টাকাটা ফেরত দেয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেটা আমি জানি। তবে চেষ্টা করলে তুমি তাগাদা না দেয়ার জন্য কিছু অন্যরকম ব্যবস্থা করতে পার।
অন্যরকম ব্যবস্থা মানে কি সুদ? আসলে লেনদেনের ব্যাপারে এটাকে সুদই বলে। কিন্তু তুমি তো আবার সুদে বিশ্বাস কর না। যদি সুদ না দাও তাহলে আমাকে প্রবোধ দাও। বল আমাকে ভালোবাস। যদিও আমি জানি এটা ডাহা মিথ্যা কথা। তবে আশ্বাসের বাক্য যদি মিথ্যা হয় নারী তাতে বিশ্বাস করে। আমিও তো নারী। তোমার মিথ্যায় আমি বিশ্বাস করব। তোমার কবিতায় যখন আমার সন্দেহ নেই, তখন তোমার ভালোবাসায় সন্দেহ করে আমি কেন আমার নিজের জীবনটাই মাটি করে ফেলব?
আমি ভয় পেয়ে বললাম, আমি ফেরত দেব। সব টাকা ফেরত দেব। মহিলাটি হাসল। তোমার টাকা থাকলেও তুমি ফেরত দিতে না। কারণ পুরুষ মানুষ যা নেয় অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করে নেয়। নেয় নিয়ে যাওয়ার জন্যই। কিন্তু সে এত বেশি নেয় যে, ঋণটা তার দেহের চেয়েও ভারি বোঝা হয়ে তাকে, বাঁকা করে রাখে। আমি তোমাকে দিয়েছি। এখনও দিই। কারণ তুমি একজন নারীর মুখ অন্তত প্রত্যেক দিন মনে করবে। আর সে নারী হলো এই আমি। কখনও বল না যে, তুমি কোনো নারীকে ভালোবেসেছিলে। কেবল প্রতারণা করেছিলে। এখন বোঝা নিয়ে পালাতে পারছ না। আমার কাছে পরামর্শ চাইছ।
আমি চিত্কার করে বললাম, আমি পরিশোধ করব।
না তা তুমি করবে না। কারণ তুমি যে ঋণ নিয়েছ তা অপরিশোধ্য।
তাহলে আমি কী করব? আমার প্রশংসা কর। আমার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের, এই চোখের, এই ভ্রুর, এই কেশরাশির।
লেখক : কবি
No comments