বাংলাদেশের এখন ঘোর দুর্দিন by বদরুদ্দীন উমর

বাংলাদেশের এখন ঘোর দুর্দিন। এই দুর্দিন প্রতিদিন ঘোরতর হচ্ছে। এই দুর্দিনের সর্বপ্রধান দিক হলো, এখানে শাসকশ্রেণীর মধ্যে তাদের উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর বিরাট ব্যতিক্রম ছাড়া কারও চরিত্রে সততা বলে কিছু নেই। এখানে চুরি, দুর্নীতির ব্যাপকতার কথা সবাই জানে, কিন্তু কী ধরনের চারিত্রিক গঠন ও সাংস্কৃতিক অপদার্থতার কারণে এসব হয় এটা বিচার-বিশ্লেষণের দেখা পাওয়া যায় না।

লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি ও প্রতারণার বিরুদ্ধে গালাগালি করা এক জিনিস এবং সমাজে কেন এসবের দেখা পাওয়া যাচ্ছে, কী কারণে অপরাধপ্রবণতা এভাবে মানুষের চিন্তাচেতনা প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে পরিচালনা করছে, এ নিয়ে ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন যে কত জরুরি হয়েছে সেটা এখনও পর্যন্ত ক’জনইবা উপলব্ধি করছে? এটাই হলো বর্তমান পরিস্থিতির শুধু ট্র্যাজিক নয়, সব থেকে ভয়াবহ দিক।
অর্থলোভ এবং আত্মপ্রচারণার তাগিদ এমনই জিনিস যা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি, লেখক, কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকের সততা রক্ষার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় প্রতিবন্ধক। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একজনের বাংলাদেশে অর্থলোভ ও আত্মপ্রচারণাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সব গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক এবং অধিমানসিক (রহঃবষষবপঃঁধষ) কাজকর্মের মুখ্য চালিকাশক্তি। এর পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। শুধু নগণ্য বা গণনার অযোগ্যরাই যে এই প্রবণতার বশবর্তী তাই নয়। যারা পরিচিত, এমনকি প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক তাদের মধ্যেও এই প্রবণতা এখন ব্যাধির আকার ধারণ করেছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, বাংলা একাডেমীর মেলায় প্রকাশ্যে এখন মহামারীর আকারে বই উত্পাদিত হচ্ছে। মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০০০-এর বেশি! এর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক হলো কবিতার বই! তার পরই উপন্যাস!!
এইভাবে যেসব বই বের হচ্ছে তার মধ্যে একটা বড়সংখ্যক লেখক নিজেরাই টাকা-পয়সা দিয়ে বই ছাপাচ্ছে, নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে এদের কারও কারও ছবি প্রকাশ হচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রন্থ সমালোচনা বলে কিছু নেই। কিছু কিছু যে ‘গ্রন্থ সমালোচনা’ দেখা যায় তার মধ্যে অধিকাংশই লেখকদের নিজেদেরই লেখা; তাঁরা সেগুলো লিখে হয় তদ্বির করেন, কিংবা পয়সার যোগান দিয়ে সেগুলো সংবাদপত্রে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন।
বাংলা একাডেমীর বইমেলায় বই প্রকাশের হিড়িক দেখে মনে হয় এটা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক মর্যাদারও ব্যাপার। এ কারণে যাদের সঙ্গে লেখালেখি বা বিদ্যা ও সাহিত্য চর্চার কোনো সম্পর্ক কোনোকালেই থাকেনি, তারা হঠাত্ করেই লেখকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মেলায় বই প্রকাশ করছেন। কী হারে এসব বই প্রকাশিত হচ্ছে এটা ওপরে বলা হয়েছে। শুধু যে সামাজিক মর্যাদার জন্যই বই প্রকাশ করা হচ্ছে তাই নয়। অনেক অপরাধীও বই প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের নিরপরাধ ও সাধুসন্ত বলে প্রচারের উদ্দেশ্যে বই লিখছে। এর সব থেকে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো, ফেনীর কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী, বহু ক্রিমিনাল মামলার আসামি জয়নাল হাজারী। জয়নাল হাজারী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই তার পলাতক জীবনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশে ফিরেছে এবং নিজেকে আবার রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বইমেলায় তার আত্মজীবনী প্রকাশ তার এই চেষ্টারই একটি দিক। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, জয়নাল হাজারীর এই প্রচেষ্টার শরিক এদেশের খুব পরিচিত ও খ্যাতিমান সাংবাদিক ও লেখক, কবিরাও। বাংলা একাডেমী বইমেলায় জয়নাল হাজারীর উপরোক্ত ‘আত্মজীবনী’র মোড়ক উন্মোচন করেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার লেখালেখি এবং প্রত্যেক কর্মের সঙ্গে কাঞ্চনযোগের কথা সবাই জানে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়েছে মনে করার কারণ নেই এ জন্য যে, জয়নাল হাজারীর মতো একজন ক্রিমিনালের আত্মজীবনীর মোড়ক উন্মোচন করলে যে বদনাম হবে এটা অন্যদের মতো তাঁরও অজানা নয়। জয়নাল হাজারী তার এই ক্ষতি যে অন্যভাবে পুষিয়ে দিয়েছে এ নিয়ে বাংলাদেশে একজনেরও, এমনকি গাফফারের বন্ধু-বান্ধবদেরও কোনো সংশয় আছে এটা ভাবাই যায় না।
এদিক দিয়ে বাংলাদেশ যে ঘোর দুর্দিনের মধ্যে পতিত হয়েছে তার অন্য দৃষ্টান্ত হলো কবি নির্মলেন্দু গুণ। দেখা গেল জয়নাল হাজারী তার এবং গাফফারের লেখা দিয়ে বই মেলাতে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন, যার নাম ‘গাফফার চৌধুরী ও নির্মলেন্দু গুণের দৃষ্টিতে জয়নাল হাজারী’। গাফফারকে সবাই চেনেন, কিন্তু নির্মলেন্দু গুণও যে সেই একই পালকের পাখি এটা আমার ও আমার মতো অনেকেরই একেবারেই জানা ছিল না। দেখলাম অন্য অনেকেও এটা দেখে স্তম্ভিত। জয়নাল হাজারী গুণকে দিয়ে এ কাজ করাতে গিয়ে নিশ্চয়ই তাকেও সন্তুষ্ট করেছেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি কয়েকটি পত্রিকায় জয়নাল হাজারীর এই পুস্তিকা থেকে কিছু অংশ পুরো পাতাজুড়ে ছাপা হয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ভালো জিনিস। কিন্তু স্বাধীনতার নামে সত্ লেখকদের অসুবিধাজনক লেখা না ছাপা এবং হাজারীর মতো লেখকের বইয়ের এই বিজ্ঞাপন ছাপা সংবাদপত্রের কী ধরনের স্বাধীনতা? এই হলো বর্তমান বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর ও সেই সঙ্গে আওয়ামী ঘরানার লেখক-সাংবাদিকদের অবস্থা। এই হলো বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মর্মার্থ!!
দেশের লেখক-বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশের এই অবস্থা যে নতুন প্রজন্মের ওপরও প্রভাব বিস্তার করবে এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক ব্যাপারটিও এখন দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যেও চিন্তাভাবনা, যত্ন, শ্রম ও নিজেদের ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহারের পরিবর্তে সিরিজের মতো করে বই প্রকাশ, বিশেষত কবিতা, গল্প, উপন্যাস প্রকাশের উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ হলো ছাত্রসমাজ। শাসকশ্রেণীর কয়েকটি ছাত্র সংগঠন এখন যে কী করছে সেটা কারও অজানা নয়। এসবের রিপোর্ট প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। একটি জাতি কী ঘোরতর দুর্দিনে পতিত হলে তার নতুন প্রজন্ম ও ছাত্রসমাজের এই অবস্থা হতে পারে এটা উপলব্ধি করা কঠিন কাজ নয়। এ পরিস্থিতি যে শুধু ছাত্রসমাজকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাই নয়। ব্যাপক জনগণের জীবনও এর দ্বারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মূল্য বৃদ্ধি আজ জনগণের, বিশেষত গরিব ও শ্রমিক এবং নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যবিত্তের জীবনের সব থেকে বড় সমস্যা। এই মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না, উপরন্তু এ পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। সবাই জানে এবং সরকারও জানে যে, এই মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। কিন্তু এ সিন্ডিকেট এত বেপরোয়া কেন? জনগণ ভোট দিয়ে লোকজনকে জাতীয় সংসদে পাঠিয়েছে, তারা সরকার গঠন করেছে কি ভোটপ্রাপ্তদের ও সরকারি লোকদের পকেট ভর্তি ও পেট মোটা করার জন্য? আসলে অবস্থা দাঁড়িয়েছে সেরকমই। সরকার যদি ইচ্ছে করে কঠোর হস্তে সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে পারে। তাহলে এটা তারা পারে না, এমন নয়। নিশ্চয় পারে। কিন্তু সরকারের ও আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষত শীর্ষস্থানীয় লোকদের সঙ্গে এই সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণেই দিবারাত্রি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের কথাবার্তা সত্ত্বেও সিন্ডিকেটগুলি বহাল-তবিয়তে চাল, ডাল, চিনিসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী গুদামজাত করে রেখে মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে, মুনাফা দ্বিগুণ, তিনগুণ, বহুগুণ করছে। এ মুনাফার অংশ তাদের মুরব্বি ও রক্ষা কর্তাদের পকেটেও পড়ছে। রক্ষক যেখানে নিজেই ভক্ষক সেখানে কোনো কিছুই রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই।
দেশের দুর্দিনের অবস্থা বলতে গেলে জনগণের নিরাপত্তার সমস্যা এক বড় ভাবনার বিষয়। শুধু সন্ত্রাস নয়, সারা দেশে চলাচল ব্যবস্থা এখন যেমন আছে তাতে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় দশ বা বারো, বিশ অথবা তার থেকে বেশি লোকের মৃত্যু হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলে। হিসাব করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সড়ক পথে নিরাপত্তার অভাবে এখানে প্রতি বছর যে সংখ্যক লোকের মৃত্যু হয় সেই সংখ্যক বেসামরিক লোকের মৃত্যু বোমা বা বিমান হামলায় ইরাক যুদ্ধের উচ্চতম পর্যায়ে হয়নি, অথবা বর্তমান আফগান যুদ্ধেও হচ্ছে না। এছাড়া নিরাপত্তার অন্য দিকও তো আছে। সাধারণ সন্ত্রাসী থেকে নিয়ে ছাত্র পর্যন্ত যেভাবে সন্ত্রাস করছে তাতেও নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এর ওপর আছে খোদ সরকারের পুলিশ ও র্যাবের সন্ত্রাস। এই শান্তিরক্ষী বাহিনীর হাতে সাধারণ-নিরিহ কত লোকের মৃত্যু হচ্ছে তার হিসাব নেই।
সরকারি কর্তা-ব্যক্তিদের ও নেতা-নেত্রীদের নিরাপত্তার জন্য যেখানে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, সেখানে জনগণের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। খাদ্য, বস্ত্র থেকে নিয়ে জীবনের নিরাপত্তা পর্যন্ত একই ব্যাপার।
বাংলাদেশের যে ঘোর দুর্দিন এখন চলছে তা জনগণের জীবনের প্রত্যেকটি দিক স্পর্শ করছে। তার পূর্ণ বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এর পরিবর্তনের তাগিদ আজ জনগণের মধ্যে প্রবলভাবে সৃষ্টি হচ্ছে। এই তাগিদ আগামী দিনগুলোতে অবশ্যম্ভাবীরূপে এমন এক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামের সূচনা ও বিকাশ ঘটাবে যা এখন অনেকের পক্ষে কল্পনা করাও এক অসম্ভব ব্যাপার।
৩.৩.২০১০

No comments

Powered by Blogger.