গাদ্দাফীর সুইজারল্যান্ডবিরোধী ডাক by জুলফিকার আহমদ কিসমতী
সম্প্রতি সুইজারল্যান্ড সরকার সে দেশের মুসলমানদের মসজিদে মিনার নির্মাণ নিষিদ্ধ করায় এবং লিবিয়া ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে উভয় দেশের নাগরিকদের ভিসা দেয়া না দেয়ার প্রশ্নে তিক্ততা সৃষ্টির এক পর্যায়ে গত শুক্রবার (২৬/০২/২০১০ইং) লিবীয় নেতা মুয়াম্মার আল গাদ্দাফী বেনগাজীতে এক সিরাত সমাবেশে বক্তৃতাদানকালে কড়া বক্তব্য রাখেন।
মুয়াম্মার গাদ্দাফী নাকি বিদেশি আগ্রাসন এবং ইসরাইলকে ইহুদি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্দোলন এবং মুসলমানদের মসজিদ ধ্বংস ও মিনার নির্মাণ নিষিদ্ধ করার কারণে সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন।
পাশ্চাত্য সমাজে এক শ্রেণীর ইসলাম বিদ্বেষী প্রচার মাধ্যম অতীত থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে পরিবেশিত সংবাদে এমন বিকৃতির আশ্রয় নিয়ে আসছে, যাতে এ ব্যাপারে অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি এমনকি ঘৃণার সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইহুদি প্রভাবিত এক শ্রেণীর প্রচার মিডিয়া মুসলমানদের পবিত্র কোরআন, মহানবীর (সা.) এবং বিশেষ করে জেহাদের অপব্যাখ্যাকে পাশ্চাত্য সমাজের যে কোনো নাগরিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম দেশে এ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ শাসক ও যুব সমাজ জেহাদ শব্দ শুনেই একে ঘৃণার চোখে দেখে।
বলাবাহুল্য হিংসায় হিংসা ডেকে আনে। অতঃপর এর ধারাবাহিকতায় পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, যা সূচনা পর্ব থেকে পরবর্তী পরিস্থিতিকে হাজার গুণ হিংসাত্মক ও বেদনাদায়ক অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করায়। এমন একটি অবস্থা থেকে মানবসমাজকে রক্ষা করার জন্যই যত নীতিকথা ও আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের অস্তিত্ব। যেমন তা আমরা দেখতে পাই জাতিসংঘ সনদে, তেমনি খোদায়ী ধর্মগ্রন্থেও। অন্যদের কথা যাই হোক, পবিত্র কোরআনে এ বহুজাতিক পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি বজায় রাখার তাগিদ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন, লা-তাসুব্বুল্লাযীনা ইয়াদড়না মিন্ দুনিল্লাহে, ফাইয়া সুব্বুল্লাহা আদভান্ বেগাইরে ইলিমন।
অর্থাত্ ‘যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর প্রার্থনা-পূজা অর্চনা করে, তোমরা তাদের গালি বা তিরস্কার কর না। তাহলে তারাও অজ্ঞতাবশত বৈরী মনোভাবাপন্ন হয়ে আল্লাহকে গালি দিবে।’ অভিন্ন লক্ষ্যে অন্যত্র আল্লাহ্ নির্দেশ করেছেন, ‘তোমরা সূক্ষ্মজ্ঞান-বুদ্ধি বৃত্তিক পন্থায় ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে তোমাদের প্রভুর দিকে ডাকো।’ (সূরা : ৬:১০৮)
কিন্তু অতীব দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানুষে মানুষে, দেশে দেশে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে মানবজাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এসব নীতিমালা না মেনে চলাতে সর্বত্র অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তার অন্তর্নিহিত কারণগুলোর গভীরে গিয়ে দেখলে যা সামনে উঠে আসে সেটা হলো, কী জাতীয়, কী আন্তর্জাতিক কোথাও কেউ ধর্মীয় কিংবা জাতিসংঘ সনদ উভয়ের কোনোটিরই অনুসরণের তোয়াক্কা করছে না। এসব ব্যাপারে উভয় স্তরের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যেসব নীতিকথা আওড়ানো হয়, নিজেদের আধিপত্যবাদী প্রবণতা কিংবা সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থের দরুন বাস্তবে সেগুলো মানা হয় না। বরং নিজেদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মোড়লিপনা বজায় রাখার স্বার্থে সেই স্তরের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে চাতুর্য ও অসাধুতার আশ্রয় নিতেও দেখা যায়। দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট এ জাতীয় আন্তর্জাতিক অনেক ঘটনাই সবার জানা। যেগুলো এক বছর, দু’বছর, একযুগ, দু’যুগ নয় অর্ধশতাধিক কাল ধরে সেসব ব্যক্তিত্বের দ্বিমুখী, পরস্পরবিরোধী নীতি তুলে ধরে আসছে। নেতৃত্বের পরস্পর বিরোধিতাজনিত সে সব আগুন নিভানোর নিষ্ঠাপূর্ণ প্রয়াস যেখানে এখনও অনুপস্থিত, সেক্ষেত্রে একই মানসিকতা নিঃসৃত আন্তর্জাতিক কোনো নতুন তিক্ততার সূচনা ঘটুক এটা বিশ্বের কোনো শান্তিকামী মানুষ কামনা করে না। কিন্তু হলে কী হবে, বিশ্বের ধর্ম নিরপেক্ষ জড়বাদী মানসিকতার এক শ্রেণীর নেতৃত্ব নিজেদের হীনস্বার্থে বা সাম্প্রদায়িক ঘৃণ্য মানসিকতাবশত জাতিসংঘ সনদ ও সব মানবীয় প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ বিরোধী কাজ করতেই যেন অধিক উত্সাহী, যদ্দরুন আজ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ অতীব হতাশাগ্রস্ত।
এক্ষেত্রেও গাদ্দাফীর তরফ থেকে ‘জেহাদের’ ঘোষণা দানের খবরটি কোনো উদ্দেশ্যমূলক কিনা, বিভিন্ন কারণে এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কারণ লক্ষ্য করা গেছে, এ জাতীয় নানা প্রকার ও নানা চরিত্রের বক্তব্যের পথ ধরেই অসত্য অভিযোগের ভিত্তিতে ইরাক-আফগানকেন্দ্রিক শুরু হওয়া যুদ্ধ এখন এক পা, দু’পা করে পাকিস্তান, ইরান, ইয়েমেন, সোমালিয়া ও নাইজেরিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এক্ষেত্রেও জেহাদের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়াটা উল্লেখিত ইরাক, আফগান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের রক্তাক্ত অবস্থার কথাই অনেককে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশধারী রাষ্ট্রগুলোর চেহারা
এদিকে আরেক সংবাদ সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, সুইজ সরকার সে দেশে ইসলাম প্রচারে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার অবসান এবং মসজিদ-মন্দিরগুলো নির্মাণের পুনঃঅনুমতি প্রদানেরও চিন্তা করছেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সম্পর্কিত খবরটি সত্য হলে এর দ্বারা সুইজ সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতার কপালে কালিমার যেই কলঙ্ক তিলক পড়েছিল, তা মোছার একটি ব্যবস্থা হতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে বুঝায়, এমন একটি রাষ্ট্র যার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্ম থাকে না অর্থাত্ রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্মের ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ থাকে না। সরকার থাকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের সব নাগরিক নিজেদের ধর্মীয় ব্যাপারে থাকে স্বাধীন। কেউ মসজিদে যেতে চাইলে যাবে, কেউ যাবে মন্দিরে, কেউ চাইলে যাবে গির্জায়। প্রত্যেকে যার যার উপাসনালয়ে বা ইবাতখানায় থাকবে স্বাধীন। কেউ যদি ধর্ম বা আল্লাহকেই না মানে, তাতেও রাষ্ট্র ঠিক থাকার ব্যাপারে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। রাষ্ট্রকে সব কিছুই রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী চালাতে হয়। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে যখন প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকে তার অর্থ দাঁড়ায়, প্রত্যেক ধর্মেরই নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানগুলো অনুযায়ী নিজ ইবাদতখানা বা উপাসনালয় নির্মাণেরও অনুমতি থাকে। কিন্তু তার বিপরীত সভ্যদেশ হিসেবে পরিচিত সুইজারল্যান্ডে সেখানকার মসজিদের মিনার নির্মাণ প্রশ্নে যা কিছু ঘটেছে, এটা কেবল অবিশ্বাস্যই ছিল না, বরং ধর্মনিরপেক্ষ বলে খ্যাত সুইজারল্যান্ডের চেহারায় ছিল এক চির কলঙ্ক আর বিশ্বের প্রায় ৬২টির অধিক ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারগুলো এবং দেড়শ’ কোটির অধিক মুসলমানদের মুখে ছিল এক চপেটাঘাত।
২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত রেফারান্ডামে শতকরা ৯৭.৫ সুইজ ভোটার মুসলমানদের মসজিদগুলোতে মিনার নির্মাণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আইনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এটি এমন এক সময় ঘটেছিল, যখন তুর্কী কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন (তুর্কী সাংস্কৃতিক সমিতি) ইসলামী কমিউনিটি সেন্টার ভবনের ওপর ছয় মিটার উচ্চ মিনার নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। তখনই এ নিয়ে সৃষ্টি হয় হৈ চৈ। অতঃপর কেসটি যখন স্থানীয় সংশ্লিষ্ট বিচারালয়ে চলে যায়, তখন এ জন্য মুসলমানদের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য নিরপেক্ষ এবং সেক্যুলার জাতিরূপে দাবিদার সুইজরা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। তারা একে রাজনৈতিক রং দিয়ে প্রচারণা চালায় যে, ‘মুসলমানদের মিনার হচ্ছে মূলত ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক।’ অবশেষে কেসটি ফেডারেল সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে ফয়সালা মুসলমানদের অনুকূলে গেছে। ফলে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ৬ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট মিনারটি নির্মিত হয়। তারপরই সুসংগঠিত এবং অতীব উত্তেজনাপূর্ণ প্রচারণা শুরু হয়। সেই প্রচারণায় বিভিন্ন পোস্টারে মিনারগুলোকে মিজাইলের আকৃতিতে দেখানো হয়, যা সুইজারল্যান্ডের জাতীয় পতাকা চিরে ভেদ করে বের হয়েছে বলে দর্শকদের ধারণা দেয়া হয়। এসব কিছু প্রচারণা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেই করা হয়। এখানে এটাও এক মজার ব্যাপার যে, সুইজারল্যান্ডের ৭৭ লাখ বাসিন্দার মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা মাত্র ৩ লাখ। আর গোটা দেশে মাত্র ৩টা মসজিদের মিনার রয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, গোটা দেশের মাত্র এই ৩টি মসজিদের মিনারও তাদের বরদাস্ত হয়নি। এটা ঠিক যে, ইসলাম কখনও মিনারের মুখাপেক্ষী নয়। তবে এ থেকে সুইজারল্যান্ডের ধর্মনিরপেক্ষতার আসল স্বরূপটিই উদঘাটিত হয়ে পড়ে। এটাও আরেক লক্ষণীয় বিষয় যে, একদিকে বিশ্বময় বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমঝোতা, আলোচনা বৈঠকের চেষ্টা করা হয়। অপরদিকে বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় এবং নিরপেক্ষ দেড়শ’ কোটি মুসলমানের আবেগ-অনুভূতির প্রতি মারাত্মক আঘাত হানা হয়।
নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পর তো মুসলমানদের ওপরই প্রথম বিপদ নেমে আসে। এ ব্যাপারে ইউরোপও আমেরিকা থেকে পিছে নেই। ব্রিটেনে মুসলিম নারীদের হিজাব পরায় কখনও ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়, কখনও শিক্ষয়িত্রীকে। কয়েকবার আদালতে এ ব্যাপারে কয়েকটি মামলাও হয়ে গেছে। প্রথমে কেবল জনগণের পক্ষ থেকে বিরোধিতা হচ্ছিল। কিন্তু ব্রিটেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর বিরোধিতা করে পার্লামেন্ট পর্যন্ত ইস্যুটি পৌঁছিয়েছে। এখন ফ্রান্স মুসলিম নারীদের হিজাব পরার উপর আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে। ইটালি, হল্যান্ড এবং অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোতেও হিজাববিরোধী আন্দোলন চলছে। অথচ এটি মুসলমান নারীদের জন্য একটি ধর্মীয় অপরিহার্য বিধান। এ ছাড়া সাধারণ অর্থে নারী-মর্যাদা ও সত্যিকার মানব সভ্যতার প্রশ্নেও হিজাবের প্রয়োজন আছে বৈকি।
আমাদের প্রতিবেশেও একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিদ্যমান। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবিদার ভারতে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে এমন মানবতাবিরোধী আচরণ এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকার এমনভাবে পদদলিত করা হয় যে, আজকের মানব সমাজে যা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু এসব দৃশ্য ভারত না বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে থাকে, না আন্তর্জাতিক সমাজ এদিকে দৃষ্টি দান করে। তেমনি তারা এটা দেখতেও চায় না। কেননা, আন্তর্জাতিক মহলও এ স্বার্থের দর্পণ দিয়েই সব দেখে। তাদের সামনে কেবল দেড়শ’ কোটি জনবসতির মুদ্রা নজরে পড়ে। এছাড়া আরেকটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিচারবিভাগ যা কিছু আচরণ ডা. আফিয়ার সঙ্গে করেছে। এরপরও এসব দেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অভিধায় আখ্যায়িত হওয়ার কি করে যোগ্য হয়? উল্লেখিত ঘটনাবলীর দর্পণে তাদের কুিসত চেহারা উদঘাটিত হতে এখনও কি বাকি? চরমপন্থীদের এসব আচরণ কি আরও উন্মুক্ত করার দরকার আছে? অথচ তার বিপরীতে কোন একটি মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের সঙ্গে হাজারও গুণ উন্নত আচরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বজ্রপাত ঘটে শুধু মুসলমানদের ওপরই।
এসব দেখেও যতদিন বিশ্ববিবেক কথা না বলবে এবং ইসলাম ও মুসলিম নীতি-আদর্শের বাস্তবতাকে স্বীকৃতি না দেয়া হবে, ততদিন বিশ্বশান্তি সুদূরপরাহতই থেকে যেতে বাধ্য।
পাশ্চাত্য সমাজে এক শ্রেণীর ইসলাম বিদ্বেষী প্রচার মাধ্যম অতীত থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে পরিবেশিত সংবাদে এমন বিকৃতির আশ্রয় নিয়ে আসছে, যাতে এ ব্যাপারে অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি এমনকি ঘৃণার সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইহুদি প্রভাবিত এক শ্রেণীর প্রচার মিডিয়া মুসলমানদের পবিত্র কোরআন, মহানবীর (সা.) এবং বিশেষ করে জেহাদের অপব্যাখ্যাকে পাশ্চাত্য সমাজের যে কোনো নাগরিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম দেশে এ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ শাসক ও যুব সমাজ জেহাদ শব্দ শুনেই একে ঘৃণার চোখে দেখে।
বলাবাহুল্য হিংসায় হিংসা ডেকে আনে। অতঃপর এর ধারাবাহিকতায় পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, যা সূচনা পর্ব থেকে পরবর্তী পরিস্থিতিকে হাজার গুণ হিংসাত্মক ও বেদনাদায়ক অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করায়। এমন একটি অবস্থা থেকে মানবসমাজকে রক্ষা করার জন্যই যত নীতিকথা ও আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের অস্তিত্ব। যেমন তা আমরা দেখতে পাই জাতিসংঘ সনদে, তেমনি খোদায়ী ধর্মগ্রন্থেও। অন্যদের কথা যাই হোক, পবিত্র কোরআনে এ বহুজাতিক পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি বজায় রাখার তাগিদ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন, লা-তাসুব্বুল্লাযীনা ইয়াদড়না মিন্ দুনিল্লাহে, ফাইয়া সুব্বুল্লাহা আদভান্ বেগাইরে ইলিমন।
অর্থাত্ ‘যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কিছুর প্রার্থনা-পূজা অর্চনা করে, তোমরা তাদের গালি বা তিরস্কার কর না। তাহলে তারাও অজ্ঞতাবশত বৈরী মনোভাবাপন্ন হয়ে আল্লাহকে গালি দিবে।’ অভিন্ন লক্ষ্যে অন্যত্র আল্লাহ্ নির্দেশ করেছেন, ‘তোমরা সূক্ষ্মজ্ঞান-বুদ্ধি বৃত্তিক পন্থায় ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে তোমাদের প্রভুর দিকে ডাকো।’ (সূরা : ৬:১০৮)
কিন্তু অতীব দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানুষে মানুষে, দেশে দেশে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে মানবজাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এসব নীতিমালা না মেনে চলাতে সর্বত্র অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তার অন্তর্নিহিত কারণগুলোর গভীরে গিয়ে দেখলে যা সামনে উঠে আসে সেটা হলো, কী জাতীয়, কী আন্তর্জাতিক কোথাও কেউ ধর্মীয় কিংবা জাতিসংঘ সনদ উভয়ের কোনোটিরই অনুসরণের তোয়াক্কা করছে না। এসব ব্যাপারে উভয় স্তরের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যেসব নীতিকথা আওড়ানো হয়, নিজেদের আধিপত্যবাদী প্রবণতা কিংবা সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থের দরুন বাস্তবে সেগুলো মানা হয় না। বরং নিজেদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মোড়লিপনা বজায় রাখার স্বার্থে সেই স্তরের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে চাতুর্য ও অসাধুতার আশ্রয় নিতেও দেখা যায়। দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট এ জাতীয় আন্তর্জাতিক অনেক ঘটনাই সবার জানা। যেগুলো এক বছর, দু’বছর, একযুগ, দু’যুগ নয় অর্ধশতাধিক কাল ধরে সেসব ব্যক্তিত্বের দ্বিমুখী, পরস্পরবিরোধী নীতি তুলে ধরে আসছে। নেতৃত্বের পরস্পর বিরোধিতাজনিত সে সব আগুন নিভানোর নিষ্ঠাপূর্ণ প্রয়াস যেখানে এখনও অনুপস্থিত, সেক্ষেত্রে একই মানসিকতা নিঃসৃত আন্তর্জাতিক কোনো নতুন তিক্ততার সূচনা ঘটুক এটা বিশ্বের কোনো শান্তিকামী মানুষ কামনা করে না। কিন্তু হলে কী হবে, বিশ্বের ধর্ম নিরপেক্ষ জড়বাদী মানসিকতার এক শ্রেণীর নেতৃত্ব নিজেদের হীনস্বার্থে বা সাম্প্রদায়িক ঘৃণ্য মানসিকতাবশত জাতিসংঘ সনদ ও সব মানবীয় প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ বিরোধী কাজ করতেই যেন অধিক উত্সাহী, যদ্দরুন আজ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ অতীব হতাশাগ্রস্ত।
এক্ষেত্রেও গাদ্দাফীর তরফ থেকে ‘জেহাদের’ ঘোষণা দানের খবরটি কোনো উদ্দেশ্যমূলক কিনা, বিভিন্ন কারণে এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কারণ লক্ষ্য করা গেছে, এ জাতীয় নানা প্রকার ও নানা চরিত্রের বক্তব্যের পথ ধরেই অসত্য অভিযোগের ভিত্তিতে ইরাক-আফগানকেন্দ্রিক শুরু হওয়া যুদ্ধ এখন এক পা, দু’পা করে পাকিস্তান, ইরান, ইয়েমেন, সোমালিয়া ও নাইজেরিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এক্ষেত্রেও জেহাদের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়াটা উল্লেখিত ইরাক, আফগান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের রক্তাক্ত অবস্থার কথাই অনেককে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশধারী রাষ্ট্রগুলোর চেহারা
এদিকে আরেক সংবাদ সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, সুইজ সরকার সে দেশে ইসলাম প্রচারে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার অবসান এবং মসজিদ-মন্দিরগুলো নির্মাণের পুনঃঅনুমতি প্রদানেরও চিন্তা করছেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সম্পর্কিত খবরটি সত্য হলে এর দ্বারা সুইজ সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতার কপালে কালিমার যেই কলঙ্ক তিলক পড়েছিল, তা মোছার একটি ব্যবস্থা হতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে বুঝায়, এমন একটি রাষ্ট্র যার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্ম থাকে না অর্থাত্ রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্মের ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ থাকে না। সরকার থাকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের সব নাগরিক নিজেদের ধর্মীয় ব্যাপারে থাকে স্বাধীন। কেউ মসজিদে যেতে চাইলে যাবে, কেউ যাবে মন্দিরে, কেউ চাইলে যাবে গির্জায়। প্রত্যেকে যার যার উপাসনালয়ে বা ইবাতখানায় থাকবে স্বাধীন। কেউ যদি ধর্ম বা আল্লাহকেই না মানে, তাতেও রাষ্ট্র ঠিক থাকার ব্যাপারে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। রাষ্ট্রকে সব কিছুই রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী চালাতে হয়। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে যখন প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকে তার অর্থ দাঁড়ায়, প্রত্যেক ধর্মেরই নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানগুলো অনুযায়ী নিজ ইবাদতখানা বা উপাসনালয় নির্মাণেরও অনুমতি থাকে। কিন্তু তার বিপরীত সভ্যদেশ হিসেবে পরিচিত সুইজারল্যান্ডে সেখানকার মসজিদের মিনার নির্মাণ প্রশ্নে যা কিছু ঘটেছে, এটা কেবল অবিশ্বাস্যই ছিল না, বরং ধর্মনিরপেক্ষ বলে খ্যাত সুইজারল্যান্ডের চেহারায় ছিল এক চির কলঙ্ক আর বিশ্বের প্রায় ৬২টির অধিক ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারগুলো এবং দেড়শ’ কোটির অধিক মুসলমানদের মুখে ছিল এক চপেটাঘাত।
২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত রেফারান্ডামে শতকরা ৯৭.৫ সুইজ ভোটার মুসলমানদের মসজিদগুলোতে মিনার নির্মাণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আইনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এটি এমন এক সময় ঘটেছিল, যখন তুর্কী কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন (তুর্কী সাংস্কৃতিক সমিতি) ইসলামী কমিউনিটি সেন্টার ভবনের ওপর ছয় মিটার উচ্চ মিনার নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। তখনই এ নিয়ে সৃষ্টি হয় হৈ চৈ। অতঃপর কেসটি যখন স্থানীয় সংশ্লিষ্ট বিচারালয়ে চলে যায়, তখন এ জন্য মুসলমানদের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য নিরপেক্ষ এবং সেক্যুলার জাতিরূপে দাবিদার সুইজরা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। তারা একে রাজনৈতিক রং দিয়ে প্রচারণা চালায় যে, ‘মুসলমানদের মিনার হচ্ছে মূলত ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক।’ অবশেষে কেসটি ফেডারেল সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে ফয়সালা মুসলমানদের অনুকূলে গেছে। ফলে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ৬ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট মিনারটি নির্মিত হয়। তারপরই সুসংগঠিত এবং অতীব উত্তেজনাপূর্ণ প্রচারণা শুরু হয়। সেই প্রচারণায় বিভিন্ন পোস্টারে মিনারগুলোকে মিজাইলের আকৃতিতে দেখানো হয়, যা সুইজারল্যান্ডের জাতীয় পতাকা চিরে ভেদ করে বের হয়েছে বলে দর্শকদের ধারণা দেয়া হয়। এসব কিছু প্রচারণা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেই করা হয়। এখানে এটাও এক মজার ব্যাপার যে, সুইজারল্যান্ডের ৭৭ লাখ বাসিন্দার মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা মাত্র ৩ লাখ। আর গোটা দেশে মাত্র ৩টা মসজিদের মিনার রয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, গোটা দেশের মাত্র এই ৩টি মসজিদের মিনারও তাদের বরদাস্ত হয়নি। এটা ঠিক যে, ইসলাম কখনও মিনারের মুখাপেক্ষী নয়। তবে এ থেকে সুইজারল্যান্ডের ধর্মনিরপেক্ষতার আসল স্বরূপটিই উদঘাটিত হয়ে পড়ে। এটাও আরেক লক্ষণীয় বিষয় যে, একদিকে বিশ্বময় বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমঝোতা, আলোচনা বৈঠকের চেষ্টা করা হয়। অপরদিকে বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় এবং নিরপেক্ষ দেড়শ’ কোটি মুসলমানের আবেগ-অনুভূতির প্রতি মারাত্মক আঘাত হানা হয়।
নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পর তো মুসলমানদের ওপরই প্রথম বিপদ নেমে আসে। এ ব্যাপারে ইউরোপও আমেরিকা থেকে পিছে নেই। ব্রিটেনে মুসলিম নারীদের হিজাব পরায় কখনও ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়, কখনও শিক্ষয়িত্রীকে। কয়েকবার আদালতে এ ব্যাপারে কয়েকটি মামলাও হয়ে গেছে। প্রথমে কেবল জনগণের পক্ষ থেকে বিরোধিতা হচ্ছিল। কিন্তু ব্রিটেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর বিরোধিতা করে পার্লামেন্ট পর্যন্ত ইস্যুটি পৌঁছিয়েছে। এখন ফ্রান্স মুসলিম নারীদের হিজাব পরার উপর আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে। ইটালি, হল্যান্ড এবং অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোতেও হিজাববিরোধী আন্দোলন চলছে। অথচ এটি মুসলমান নারীদের জন্য একটি ধর্মীয় অপরিহার্য বিধান। এ ছাড়া সাধারণ অর্থে নারী-মর্যাদা ও সত্যিকার মানব সভ্যতার প্রশ্নেও হিজাবের প্রয়োজন আছে বৈকি।
আমাদের প্রতিবেশেও একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিদ্যমান। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবিদার ভারতে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে এমন মানবতাবিরোধী আচরণ এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকার এমনভাবে পদদলিত করা হয় যে, আজকের মানব সমাজে যা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু এসব দৃশ্য ভারত না বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে থাকে, না আন্তর্জাতিক সমাজ এদিকে দৃষ্টি দান করে। তেমনি তারা এটা দেখতেও চায় না। কেননা, আন্তর্জাতিক মহলও এ স্বার্থের দর্পণ দিয়েই সব দেখে। তাদের সামনে কেবল দেড়শ’ কোটি জনবসতির মুদ্রা নজরে পড়ে। এছাড়া আরেকটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিচারবিভাগ যা কিছু আচরণ ডা. আফিয়ার সঙ্গে করেছে। এরপরও এসব দেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অভিধায় আখ্যায়িত হওয়ার কি করে যোগ্য হয়? উল্লেখিত ঘটনাবলীর দর্পণে তাদের কুিসত চেহারা উদঘাটিত হতে এখনও কি বাকি? চরমপন্থীদের এসব আচরণ কি আরও উন্মুক্ত করার দরকার আছে? অথচ তার বিপরীতে কোন একটি মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের সঙ্গে হাজারও গুণ উন্নত আচরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বজ্রপাত ঘটে শুধু মুসলমানদের ওপরই।
এসব দেখেও যতদিন বিশ্ববিবেক কথা না বলবে এবং ইসলাম ও মুসলিম নীতি-আদর্শের বাস্তবতাকে স্বীকৃতি না দেয়া হবে, ততদিন বিশ্বশান্তি সুদূরপরাহতই থেকে যেতে বাধ্য।
No comments