শপথবাক্য পাঠ কি নিছক আনুষ্ঠানিকতা? by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন
নির্বাচন শেষে বিজয়ীরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণকালে সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী শপথবাক্য পাঠ করেন এবং এই শপথবাক্য পাঠ করান সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। প্রশ্ন শপথবাক্য পাঠ করা নিয়ে নয়, প্রশ্ন হচ্ছে শপথবাক্যের অন্তর্নিহিত বিষয় নিয়ে।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণকালে যেসব ব্যক্তি এ শপথবাক্য পাঠ করেন তারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে তার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে সাংবিধানিকভাবে কতটুকু বাধ্য? শপথবাক্যের অন্তর্নিহিত বিষয় ভঙ্গ করলে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা যায় কিনা? শপথ ভঙ্গ করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থাকা যদি যৌক্তিক না হয়ে থাকে তবে এ ক্ষেত্রে শপথ ভঙ্গকারী ব্যক্তিটিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অপসারণ করার সাংবিধানিক ক্ষমতা কার হাতে? শপথ ভঙ্গ করেও যদি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা যায় তবে এই শপথবাক্য পাঠ করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণের যৌক্তিকতা কতটুকু? শপথবাক্য পাঠ কি নিছক সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতা?
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকের বিরুদ্ধেই সাংবিধানিক শপথ ভঙ্গের অভিযোগ আনা কোনো কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু যে বিষয়টি কঠিন তা হলো শপথ ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা। এ দেশে শপথবাক্য পাঠ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণকারীদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের ধরন দেখলে মনে হয় সংবিধানে বর্ণিত নিয়মনীতি মানা না মানা তাদের ইচ্ছার অধীন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে যে রাষ্ট্রীয় সংবিধান নিয়ে যাত্রা শুরু সেই সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়েই আমার প্রশ্ন আছে। অবশ্য এটা ভিন্ন ব্যাপার; কিন্তু যারা প্রচলিত সংবিধানকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন তাদের কাছ থেকে একটা বিষয় আশা করা মনে হয় অযৌক্তিক হবে না, সেটি হলো তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য সংবিধানের নীতি-কাঠামো মেনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা। এ কাজটিও এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা পালন করেন না। সবকিছু দেখেশুনে মনে হয় এক খামখেয়ালির রাজত্বে আমাদের বসবাস। এই খামখেয়ালিপনাকে আর যাই বলা যাক গণতান্ত্রিক শাসন বলা যায় না। সম্প্রতি জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে আপত্তি ওঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।’ তিনি বিরোধী দল বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, অতীত থেকে যারা শিক্ষা নেয়নি তাদের শেখানোর প্রয়োজন আছে। তাদের শিক্ষা দিতেই জিয়ার নাম বদল করা হয়েছে। তারা একবারও ভাবেনি নাম বদলের খেলা ভালো হবে না। ভাবেনি তাদেরও খারাপ দিন আসতে পারে।’ (সূত্র : আমার দেশ, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।
নাম পরিবর্তন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন সে ক্ষেত্রে মনে হয়েছে তিনি তার দলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী তিনি হয়ে উঠতে পারেননি। আরেকটি বিষয় মনে হয়েছে, তিনি বিরোধী দল বিএনপির প্রতি বিরাগভাজন হয়েই এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। এ নাম পরিবর্তনের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। এ যদি হয় অবস্থা তবে বলতে হয় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণকালে তিনি যে শপথবাক্য পাঠ করেছেন তা তিনি ভঙ্গ করেছেন।
সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত শপথ বা ঘোষণা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিম্নলিখিত শপথবাক্য পাঠ করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শপথ বা ঘোষণাটি হচ্ছে, ‘আমি... সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা), করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী (কিংবা ক্ষেত্রমত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী) পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব;
আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব;
আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’
পাঠকসমাজ লক্ষ্য করুন, শপথবাক্যে বলা হয়েছে—অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব। কিন্তু জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তাতে এটা স্পষ্ট যে, বিরোধী দল বিএনপির প্রতি বিরাগভাজন হয়েই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অর্থাত্ তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। এ শপথ ভঙ্গের ঘটনায় সাংবিধানিকভাবে তিনি কি প্রধানমন্ত্রী পদে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের অযোগ্য হয়ে যাননি? অবশ্যই হয়েছেন, কিন্তু তারপরও তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই দায়িত্ব পালন করে যাবেন এবং এ দেশে যারা সংবিধানের ব্যাখ্যা দেন সেইসব সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবেন।
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের অর্থ শুধু নাম পরিবর্তন নয়, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের একটি আর্থিক খরচ আছে। এ খরচ সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায়, যার শিরোনাম হচ্ছে—জিয়ার নাম বদলে খরচ হবে ১,২০০ কোটি টাকা। সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের ফলে ১,২০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিমানবন্দরের নিয়নসাইনগুলো, মনোগ্রাম সংবলিত দাফতরিক কাগজপত্র বদলাতে এবং আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন মনোনীত বিভিন্ন জায়গায় নতুন নামাঙ্করণে এ পরিমাণ অর্থ খরচ হবে। (সূত্র : আমাদের সময়, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।
খরচের অঙ্কটি মোটেই কম নয়। আর এ অর্থ কারও ব্যক্তিগত নয়, এটা হচ্ছে জনগণ প্রদত্ত করের অর্থ। জনগণ প্রদত্ত করের অর্থ এভাবে খরচ হবে জেনেও যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তবে বলতে হবে জনগণের করের অর্থকে মনে হয় তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন। এ মানসিকতা আর যাই হোক, গণতান্ত্রিক মানসিকতা নয় এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কর্মসংস্থানের সীমাহীন সঙ্কটের এ দেশে উত্পাদনশীল খাত বিকাশের প্রয়োজনে যেসব প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা দরকার তার পেছনে জনগণের করের অর্থ খরচ করাটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয়। এ গণতান্ত্রিক মানসিকতার আরেক নাম হচ্ছে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা। নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে সেই অর্থ এ দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের পেছনে খরচ করলে আমরা অন্তত গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে অনেকটা স্বাবলম্বী হতে পারতাম এবং এ কাজ করতে সক্ষম হলে এ দেশে নতুন নতুন কল-কারখানা স্থাপন করে, কারখানায় প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহে আমরা সঙ্কটে পড়তাম না। আমাদের সম্পদ সীমিত, আমরা গরিব এ ধরনের নানা অজুহাতে এ দেশের শাসকরা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অক্ষম করে রাখার নানান ছুঁতো খুঁজে বেড়ায়, অথচ কারও প্রতি বিরাগভাজন হয়ে হাজার কোটি টাকা খরচের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না। অর্থাত্ এদের মানসিকতায় জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার প্রয়োজনে জনগণের করের অর্থ ব্যবহারের বিষয়টি প্রাধান্য পায় না।
জনগণের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিত্সাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা, কর্মের অধিকার, অর্থাত্ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাত্ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উত্পাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধনের কথা। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে জনগণের অর্থের পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করা সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আমাদের দেশের শাসকরা এ সাংবিধানিক দায়িত্বটিকে পাশ কাটিয়ে চলতেই বেশি অভ্যস্ত। অর্থাত্ অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নেও এদের সংবিধান লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ কারণে সাংবিধানিকভাবে অর্থনৈতিক প্রশ্নে যা করণীয় তাকে পাশ কাটিয়ে তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে ওকালতি করতে এদের মোটেই বাধে না। অর্থাত্ শপথবাক্য পাঠ করা এদের কাছে নিছক আনুষ্ঠানিকতা। এর কোনো কার্যকর প্রয়োগ নেই আমাদের এ দেশে। যদি সেটা থাকত তবে সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদ বহাল রেখে এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতাধররা মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুশীলন করতে সক্ষম হতো না।
এটা ছাড়াও জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের কারণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিবর্গ ও সরকারি মুখপাত্রের বক্তব্যে মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সরকারের পক্ষ থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে বলা হয়, সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিলের যে সিদ্ধান্ত হাইকোর্ট দিয়েছেন এবং আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন তার জন্যই এ নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ ১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভাষা দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপিকে শিক্ষা দেয়ার জন্যই জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তের প্রশ্নে দু’রকম কথাবার্তা। এ ধরনের দু’রকম কথাবার্তা দেশে চাল সঙ্কটকে কেন্দ্র করেও শোনা গেছে। দেশে চাল সঙ্কট নেই, আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দাবি করলেও তার সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, দেশে কিছুটা চাল সঙ্কট রয়েছে। গত মৌসুমে আমন ধানের ফলন কম হওয়া এ সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের দু’রকম কথাবার্তার কারণে জনগণ পড়েছে সমস্যায়। কার কথা ঠিক সেটা তাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বক্তব্যে এ ধরনের অসঙ্গতি দেশবাসী কামনা করে না। এ ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য প্রমাণ করে, রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে খামখেয়ালির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। মুখে যা আসে তাই বলে দিয়ে জনগণকে প্রবোধ দিতে চান তারা, যার সঙ্গে বাস্তব তথ্যের যোগসূত্র থাকে না। এ ধরনের কথাবার্তার জন্য সাংবিধানিকভাবে তাদের জবাবদিহিও করতে হয় না। জবাবদিহি করতে হলে কথাবার্তায় তারা সংযমী হতে বাধ্য হতেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের খামখেয়ালির বা স্বেচ্ছাচারিতার আরও উদাহরণ দেয়া যায়। কথায় বলে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা নাকি জনগণের সেবক। জনগণের সেবা করাই নাকি এদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এর বিপরীতটাই আমাদের চোখে পড়ে। রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তখনই জনগণের সেবক হতে পারেন যখন জনগণের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তারা তাদের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গতিবিধান করেন; কিন্তু এ দেশে তা হয় না। যেখানে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের গড় মাসিক আয় চার/পাঁচ হাজার টাকার বেশি নয়, সেখানে এই দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বেতন লক্ষ্য করলে এ অসঙ্গতি ধরা পড়ে। নতুন করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ দেশের সাংবিধানিক সব পদে বেতন-ভাতা বাড়ানো হচ্ছে। এবার বাড়ানো হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য এরই মধ্যে একটি খসড়া সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগিরই এটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হবে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে। সাংবিধানিক সব পদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সাংবিধানিক পদের নতুন বেতন কাঠামো যেদিনই ঘোষণা করা হোক না কেন, এটা গত বছরের জুলাই থেকে কার্যকর হবে। সরকারি সূত্রে প্রাপ্ত ওই খসড়া সারসংক্ষেপ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও এমপিসহ সব সাংবিধানিক পদের পারিশ্রমিক ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও তাদের অন্য ভাতাদিও প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে। এবারই প্রথম এমপিদের জন্য যানবাহন ভাতা চালু করা হচ্ছে। এ ভাতা হিসেবে এমপিরা প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা পাবেন। সাংবিধানিক পদে পারিশ্রমিক ও ভাতা বাড়ানোর জন্য পৃথক ১২টি আইন সংশোধনের প্রস্তাব এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতির মূল বেতন ৩৩ হাজার ৪শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬১ হাজার ২শ’ টাকা, প্রধানমন্ত্রীর ৩২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৮ হাজার ৫শ’ টাকা, বিরোধীদলীয় নেতার ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, মন্ত্রীদের ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, প্রতিমন্ত্রীদের ২৬ হাজার ১শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৭ হাজার ৭৪০ টাকা, উপমন্ত্রীদের ২৪ হাজার ৬৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫ হাজার ২শ’ টাকা, স্পিকারের ৩১ হাজার ২শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৭ হাজার টাকা, ডেপুটি স্পিকারের ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, সংসদ উপনেতার ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, চিফ হুইপ ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, হুইপ ২৬ হাজার ১শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ হাজার ৪১০ টাকা করার প্রস্তাবে করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির মূল বেতন ৩০ হাজার ৫শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৬ হাজার টাকা, আপিল বিভাগের বিচারপতির ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির ২৭ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ হাজার ৪১০ টাকা, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, নির্বাচন কমিশনারদের পারিশ্রমিক ২৭ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ হাজার ৪১০ টাকা, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের (পিএসসি) ২৩ হাজার ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৩ হাজার ৪৬২ টাকা, পিএসসির সদস্যদের পারিশ্রমিক ৩৭ হাজার ৮৮১ টাকা, মহাহিসাবরক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ হাজার টাকা ও এমপিদের পারিশ্রমিক ১৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জানা গেছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার গত বছর জুলাই থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সপ্তম বেতন স্কেল কার্যকর করে। কিন্তু সপ্তম বেতন স্কেল অনুযায়ী কর্মকর্তাদের বেতন সাংবিধানিক পদধারীদের পারিশ্রমিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় সরকার তাদের পারিশ্রমিক পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। (সূত্র : সমকাল, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সপ্তম বেতন স্কেল কার্যকর করার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক পদাধিকারীদের পারিশ্রমিক পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জনগণের সেবার অদ্ভুত নমুনা বৈকি? সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য জনগণের করের অর্থ যতটা না এ দেশে ব্যবহার হয় তার থেকে রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিদের জীবন উন্নত করার ক্ষেত্রে তার ব্যবহার বেশি। জনগণের করের অর্থ নিয়ে এ স্বেচ্ছাচারিতা গণতান্ত্রিক মান
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকের বিরুদ্ধেই সাংবিধানিক শপথ ভঙ্গের অভিযোগ আনা কোনো কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু যে বিষয়টি কঠিন তা হলো শপথ ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা। এ দেশে শপথবাক্য পাঠ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণকারীদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের ধরন দেখলে মনে হয় সংবিধানে বর্ণিত নিয়মনীতি মানা না মানা তাদের ইচ্ছার অধীন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে যে রাষ্ট্রীয় সংবিধান নিয়ে যাত্রা শুরু সেই সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়েই আমার প্রশ্ন আছে। অবশ্য এটা ভিন্ন ব্যাপার; কিন্তু যারা প্রচলিত সংবিধানকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন তাদের কাছ থেকে একটা বিষয় আশা করা মনে হয় অযৌক্তিক হবে না, সেটি হলো তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য সংবিধানের নীতি-কাঠামো মেনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা। এ কাজটিও এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা পালন করেন না। সবকিছু দেখেশুনে মনে হয় এক খামখেয়ালির রাজত্বে আমাদের বসবাস। এই খামখেয়ালিপনাকে আর যাই বলা যাক গণতান্ত্রিক শাসন বলা যায় না। সম্প্রতি জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে আপত্তি ওঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।’ তিনি বিরোধী দল বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, অতীত থেকে যারা শিক্ষা নেয়নি তাদের শেখানোর প্রয়োজন আছে। তাদের শিক্ষা দিতেই জিয়ার নাম বদল করা হয়েছে। তারা একবারও ভাবেনি নাম বদলের খেলা ভালো হবে না। ভাবেনি তাদেরও খারাপ দিন আসতে পারে।’ (সূত্র : আমার দেশ, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।
নাম পরিবর্তন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন সে ক্ষেত্রে মনে হয়েছে তিনি তার দলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী তিনি হয়ে উঠতে পারেননি। আরেকটি বিষয় মনে হয়েছে, তিনি বিরোধী দল বিএনপির প্রতি বিরাগভাজন হয়েই এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। এ নাম পরিবর্তনের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। এ যদি হয় অবস্থা তবে বলতে হয় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণকালে তিনি যে শপথবাক্য পাঠ করেছেন তা তিনি ভঙ্গ করেছেন।
সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত শপথ বা ঘোষণা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিম্নলিখিত শপথবাক্য পাঠ করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শপথ বা ঘোষণাটি হচ্ছে, ‘আমি... সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা), করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী (কিংবা ক্ষেত্রমত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী) পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব;
আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব;
আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’
পাঠকসমাজ লক্ষ্য করুন, শপথবাক্যে বলা হয়েছে—অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব। কিন্তু জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তাতে এটা স্পষ্ট যে, বিরোধী দল বিএনপির প্রতি বিরাগভাজন হয়েই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অর্থাত্ তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। এ শপথ ভঙ্গের ঘটনায় সাংবিধানিকভাবে তিনি কি প্রধানমন্ত্রী পদে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের অযোগ্য হয়ে যাননি? অবশ্যই হয়েছেন, কিন্তু তারপরও তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই দায়িত্ব পালন করে যাবেন এবং এ দেশে যারা সংবিধানের ব্যাখ্যা দেন সেইসব সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবেন।
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের অর্থ শুধু নাম পরিবর্তন নয়, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের একটি আর্থিক খরচ আছে। এ খরচ সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায়, যার শিরোনাম হচ্ছে—জিয়ার নাম বদলে খরচ হবে ১,২০০ কোটি টাকা। সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের ফলে ১,২০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিমানবন্দরের নিয়নসাইনগুলো, মনোগ্রাম সংবলিত দাফতরিক কাগজপত্র বদলাতে এবং আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন মনোনীত বিভিন্ন জায়গায় নতুন নামাঙ্করণে এ পরিমাণ অর্থ খরচ হবে। (সূত্র : আমাদের সময়, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।
খরচের অঙ্কটি মোটেই কম নয়। আর এ অর্থ কারও ব্যক্তিগত নয়, এটা হচ্ছে জনগণ প্রদত্ত করের অর্থ। জনগণ প্রদত্ত করের অর্থ এভাবে খরচ হবে জেনেও যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তবে বলতে হবে জনগণের করের অর্থকে মনে হয় তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন। এ মানসিকতা আর যাই হোক, গণতান্ত্রিক মানসিকতা নয় এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কর্মসংস্থানের সীমাহীন সঙ্কটের এ দেশে উত্পাদনশীল খাত বিকাশের প্রয়োজনে যেসব প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা দরকার তার পেছনে জনগণের করের অর্থ খরচ করাটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয়। এ গণতান্ত্রিক মানসিকতার আরেক নাম হচ্ছে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা। নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে সেই অর্থ এ দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের পেছনে খরচ করলে আমরা অন্তত গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে অনেকটা স্বাবলম্বী হতে পারতাম এবং এ কাজ করতে সক্ষম হলে এ দেশে নতুন নতুন কল-কারখানা স্থাপন করে, কারখানায় প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহে আমরা সঙ্কটে পড়তাম না। আমাদের সম্পদ সীমিত, আমরা গরিব এ ধরনের নানা অজুহাতে এ দেশের শাসকরা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অক্ষম করে রাখার নানান ছুঁতো খুঁজে বেড়ায়, অথচ কারও প্রতি বিরাগভাজন হয়ে হাজার কোটি টাকা খরচের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না। অর্থাত্ এদের মানসিকতায় জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার প্রয়োজনে জনগণের করের অর্থ ব্যবহারের বিষয়টি প্রাধান্য পায় না।
জনগণের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিত্সাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা, কর্মের অধিকার, অর্থাত্ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাত্ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উত্পাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধনের কথা। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে জনগণের অর্থের পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করা সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আমাদের দেশের শাসকরা এ সাংবিধানিক দায়িত্বটিকে পাশ কাটিয়ে চলতেই বেশি অভ্যস্ত। অর্থাত্ অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নেও এদের সংবিধান লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ কারণে সাংবিধানিকভাবে অর্থনৈতিক প্রশ্নে যা করণীয় তাকে পাশ কাটিয়ে তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে ওকালতি করতে এদের মোটেই বাধে না। অর্থাত্ শপথবাক্য পাঠ করা এদের কাছে নিছক আনুষ্ঠানিকতা। এর কোনো কার্যকর প্রয়োগ নেই আমাদের এ দেশে। যদি সেটা থাকত তবে সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদ বহাল রেখে এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতাধররা মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুশীলন করতে সক্ষম হতো না।
এটা ছাড়াও জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের কারণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিবর্গ ও সরকারি মুখপাত্রের বক্তব্যে মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সরকারের পক্ষ থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে বলা হয়, সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিলের যে সিদ্ধান্ত হাইকোর্ট দিয়েছেন এবং আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন তার জন্যই এ নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ ১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভাষা দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপিকে শিক্ষা দেয়ার জন্যই জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তের প্রশ্নে দু’রকম কথাবার্তা। এ ধরনের দু’রকম কথাবার্তা দেশে চাল সঙ্কটকে কেন্দ্র করেও শোনা গেছে। দেশে চাল সঙ্কট নেই, আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দাবি করলেও তার সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, দেশে কিছুটা চাল সঙ্কট রয়েছে। গত মৌসুমে আমন ধানের ফলন কম হওয়া এ সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের দু’রকম কথাবার্তার কারণে জনগণ পড়েছে সমস্যায়। কার কথা ঠিক সেটা তাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বক্তব্যে এ ধরনের অসঙ্গতি দেশবাসী কামনা করে না। এ ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য প্রমাণ করে, রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে খামখেয়ালির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। মুখে যা আসে তাই বলে দিয়ে জনগণকে প্রবোধ দিতে চান তারা, যার সঙ্গে বাস্তব তথ্যের যোগসূত্র থাকে না। এ ধরনের কথাবার্তার জন্য সাংবিধানিকভাবে তাদের জবাবদিহিও করতে হয় না। জবাবদিহি করতে হলে কথাবার্তায় তারা সংযমী হতে বাধ্য হতেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের খামখেয়ালির বা স্বেচ্ছাচারিতার আরও উদাহরণ দেয়া যায়। কথায় বলে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা নাকি জনগণের সেবক। জনগণের সেবা করাই নাকি এদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এর বিপরীতটাই আমাদের চোখে পড়ে। রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তখনই জনগণের সেবক হতে পারেন যখন জনগণের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তারা তাদের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গতিবিধান করেন; কিন্তু এ দেশে তা হয় না। যেখানে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের গড় মাসিক আয় চার/পাঁচ হাজার টাকার বেশি নয়, সেখানে এই দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বেতন লক্ষ্য করলে এ অসঙ্গতি ধরা পড়ে। নতুন করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ দেশের সাংবিধানিক সব পদে বেতন-ভাতা বাড়ানো হচ্ছে। এবার বাড়ানো হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য এরই মধ্যে একটি খসড়া সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগিরই এটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হবে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে। সাংবিধানিক সব পদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সাংবিধানিক পদের নতুন বেতন কাঠামো যেদিনই ঘোষণা করা হোক না কেন, এটা গত বছরের জুলাই থেকে কার্যকর হবে। সরকারি সূত্রে প্রাপ্ত ওই খসড়া সারসংক্ষেপ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও এমপিসহ সব সাংবিধানিক পদের পারিশ্রমিক ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও তাদের অন্য ভাতাদিও প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে। এবারই প্রথম এমপিদের জন্য যানবাহন ভাতা চালু করা হচ্ছে। এ ভাতা হিসেবে এমপিরা প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা পাবেন। সাংবিধানিক পদে পারিশ্রমিক ও ভাতা বাড়ানোর জন্য পৃথক ১২টি আইন সংশোধনের প্রস্তাব এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতির মূল বেতন ৩৩ হাজার ৪শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬১ হাজার ২শ’ টাকা, প্রধানমন্ত্রীর ৩২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৮ হাজার ৫শ’ টাকা, বিরোধীদলীয় নেতার ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, মন্ত্রীদের ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, প্রতিমন্ত্রীদের ২৬ হাজার ১শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৭ হাজার ৭৪০ টাকা, উপমন্ত্রীদের ২৪ হাজার ৬৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫ হাজার ২শ’ টাকা, স্পিকারের ৩১ হাজার ২শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৭ হাজার টাকা, ডেপুটি স্পিকারের ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, সংসদ উপনেতার ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, চিফ হুইপ ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, হুইপ ২৬ হাজার ১শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ হাজার ৪১০ টাকা করার প্রস্তাবে করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির মূল বেতন ৩০ হাজার ৫শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৬ হাজার টাকা, আপিল বিভাগের বিচারপতির ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির ২৭ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ হাজার ৪১০ টাকা, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ২৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৭০ টাকা, নির্বাচন কমিশনারদের পারিশ্রমিক ২৭ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ হাজার ৪১০ টাকা, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের (পিএসসি) ২৩ হাজার ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৩ হাজার ৪৬২ টাকা, পিএসসির সদস্যদের পারিশ্রমিক ৩৭ হাজার ৮৮১ টাকা, মহাহিসাবরক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ হাজার টাকা ও এমপিদের পারিশ্রমিক ১৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জানা গেছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার গত বছর জুলাই থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সপ্তম বেতন স্কেল কার্যকর করে। কিন্তু সপ্তম বেতন স্কেল অনুযায়ী কর্মকর্তাদের বেতন সাংবিধানিক পদধারীদের পারিশ্রমিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় সরকার তাদের পারিশ্রমিক পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। (সূত্র : সমকাল, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সপ্তম বেতন স্কেল কার্যকর করার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক পদাধিকারীদের পারিশ্রমিক পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জনগণের সেবার অদ্ভুত নমুনা বৈকি? সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য জনগণের করের অর্থ যতটা না এ দেশে ব্যবহার হয় তার থেকে রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিদের জীবন উন্নত করার ক্ষেত্রে তার ব্যবহার বেশি। জনগণের করের অর্থ নিয়ে এ স্বেচ্ছাচারিতা গণতান্ত্রিক মান
No comments