শিক্ষা-শিক্ষার মান বাড়ানোর চ্যালেঞ্জে জয়ী হবোই by নুরুল ইসলাম নাহিদ
শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যে কঠিন কাজ তা সবাই স্বীকার করবেন। আর্থিক ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। জাতীয় সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে জরুরি চাহিদার চেয়েও অনেক কম বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তা সত্ত্বেও গত আড়াই বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট নই। আমাদের আরও সাফল্য অর্জন করতে হবে। আমরা আশাবাদী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি অব্যাহত রাখবে
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের স্বপ্ন ছিল দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, পশ্চাৎপদতা, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতিমুক্ত এক উন্নত, সমৃদ্ধ, সুখী, মর্যাদাশীল, গণতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা ধারণ করে, জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি এবং লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। একটি 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আমরা কাজ করছি। দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা, নিরক্ষরতা ও দুর্নীতিমুক্ত একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, সুখী দেশ গড়ার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে (যখন আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করব) অর্জন করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ লক্ষ্যই 'ভিশন ২০২১'। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ', 'ভিশন ২০২১' অর্থাৎ দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, পশ্চাৎপদতা ও দুর্নীতিমুক্ত উন্নত, সমৃদ্ধ, আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং আরও সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান শক্তি হবে আমাদের নতুন প্রজন্ম। আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। প্রশ্ন হলো, কীভাবে গড়ে তুলব?
সবাই একবাক্যে এর জবাবে বলবেন, শিক্ষা। প্রচলিত গতানুগতিক শিক্ষা দিয়ে এ লক্ষ্য অর্থাৎ আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলা যাবে না। নতুন প্রজন্ম যাতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আয়ত্ত করে তা প্রয়োগ করতে পারে সেই শিক্ষা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরই ২০০৯ সালে প্রথম থেকে নবম-দশম শ্রেণীর ১৯ কোটি পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ নিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন তাকে অনেকে অবাস্তব, পাগলামি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরের বার ২৩ কোটি ২২ লাখ পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কর্মসূচিকেও অনেকে অসম্ভব বলে আমাকে বিভিন্ন কথা বলেছেন। অনেকে বাধার সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমি বলেছি, চ্যালেঞ্জিং কাজ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা সব বই ছাপিয়ে নির্ধারিত দিনে সব স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় সব শিক্ষার্থীর হাতে সুষ্ঠুভাবে তা পেঁৗছাতে পেরেছি। আমাদের শিক্ষার সার্বিক লক্ষ্য অর্জন করার জন্য সব রাজনৈতিক ধারা ও সমাজের সব অংশের মানুষের মতামত গ্রহণ করে আমরা যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছি। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, আমরা যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করব তা কোনো দলীয় শিক্ষানীতি হবে না। তা হবে জাতীয় শিক্ষানীতি। আজ বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে, জাতির সব অংশের মানুষের মতামতকে ধারণ করে আমরা জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছি। আমরা সব শিশুকে ২০১১ সালের মধ্যে স্কুলে নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাফল্য অর্জন করতে যাচ্ছি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঝরে পড়া বন্ধ করতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান, ৪০ শতাংশ গরিব এবং মেধাবী শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে জাতীয়ভাবে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ করায় শিক্ষার্থীদের সনদ লাভ এবং সারাদেশে একই মান অর্জনের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা, অন্যান্য সহায়তা প্রদান ও সার্বিক কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া হ্রাস করছে। সর্বাত্মক চেষ্টায় শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে, দুর্নীতি কমে আসছে। এ বিষয়ে টিআইবির রিপোর্টে তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি ২৯ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
সবাই জানেন, স্কুলগুলোতে প্রতিবছর ক্লাস শুরু করতেই মার্চ-এপ্রিল হয়ে যেত। আমরা এখন স্কুলে ১ জানুয়ারি ক্লাস শুরু করছি। এতে সময় বাঁচছে, বেশি ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষা হতো এপ্রিল-মে মাসে। এইচএসসি তারও পরে। ফল প্রকাশ হতো ৩ মাস বা সাড়ে ৩ মাস পর। আমরা তা এগিয়ে আনতে পেরেছি। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এসএসসি ও এইচএসসি ফল প্রকাশ করা হচ্ছে পরীক্ষা সমাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে। পরীক্ষার্থীদের ফল ওয়েবসাইট, ই-মেইলে দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। অনলাইনে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রবেশপত্র অনলাইনে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এ জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। তাই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষায় আকৃষ্ট করার জন্য আমরা বিভিন্নভাবে বিজ্ঞানের ক্লাস আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করার চেষ্টা করছি। একটি মোবাইল বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি তৈরি করে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আমরা ২০ হাজার ৫০০ স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক ই-বুকে রূপান্তর করা হয়েছে। সব পাঠ্যপুস্তক ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুবিধ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে আরেকটি নতুন উদ্যোগ হলো দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে শ্রেণী পাঠদান সারাদেশের স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য শোনা ও দেখার ব্যবস্থা গ্রহণ। ভালো শিক্ষকের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান বিটিভির মাধ্যমে প্রচার করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য আধুনিক ও সময়োপযোগী কারিকুলাম অনুসারে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হচ্ছে। মুখস্থ ও নোট-গাইড বইভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে মূল পাঠ্যবই পড়া এবং যা পড়ানো হবে তা শিখতে হবে। পরীক্ষা বা মূল্যায়ন পদ্ধতির আধুনিকায়ন করা হয়েছে। এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা শিখে পরীক্ষা দিচ্ছে। ফলে শিক্ষার মান বাড়ছে, ফলও ভালো করছে।
শিক্ষকদের আর্থিক সমর্থন ও মর্যাদা বাড়াতে আমরা কাজ করছি। এ বছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরা বেসরকারি শিক্ষকদের বেতনও সমানভাবে বৃদ্ধি করেছি। মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার বৈষম্য দূর করা হয়েছে। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন উপায় খোঁজা হচ্ছে। ভবিষ্যতে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেলের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি। শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে 'টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রকল্প'-এর আওতায় এ পর্যন্ত এক লাখ ৯৩ হাজার শ্রেণীশিক্ষক, সাড়ে ১৬ হাজার প্রধান শিক্ষক, ৪৫ হাজার স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য এবং এক হাজার ১০০ শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ঈড়হহবপঃরহম ঈষধংংৎড়ড়স প্রকল্পের আওতায় ১০০ প্রধান শিক্ষক ও ১০০ শ্রেণীশিক্ষক যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। 'সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট'-এর আওতায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্য 'সৃজনশীল' প্রশ্ন পদ্ধতিবিষয়ক ব্যাপক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। আরেকটি প্রকল্পের নাম 'সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট'। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা হলো এর প্রধান কাজ।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বন্ধ করা এবং লেখাপড়ায় উৎসাহিত করার জন্য এ প্রকল্পের আওতায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাসিক ১২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়া হয়। তা ছাড়া প্রতিটি স্কুলে ভালো শিক্ষক, প্রথম স্থান অধিকারী ছাত্রছাত্রীসহ ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দেওয়া হয়।
আমরা উচ্চশিক্ষাকে বিশ্বমানে পেঁৗছাতে চাই। এ জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, নতুন জ্ঞান অনুসন্ধানসহ মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে উচ্চতর গবেষণার জন্য পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের ৩৯টি প্রকল্পে ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাইব্রেরি গড়ে তোলা বা উন্নত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনায় শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করতে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনসহ বহু কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। লাখ লাখ তরুণ-তরুণীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শুধু টেক্সটাইল সেক্টরে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত দক্ষ মানুষের অভাবে আমাদের দেশে প্রায় ২০ হাজার বিদেশি চাকরি করছেন। তাই আমরা টেক্সটাইল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেছি।
এবারের এসএসসির ফল সর্বকালের মধ্যে সেরা। ১০টি শিক্ষা বোর্ড থেকে ১৩ লাখ ৭ হাজার ১৫৫ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে ১০ লাখ ৭৫ হাজার ৮৮৬ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। শতকরা পাসের হার হচ্ছে ৮২ দশমিক ৩১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৬ হাজার ৭৪৯ জন। গতবারের তুলনায় এবার এক লাখ ১৫ হাজার ৩৯৪ জন বেশি পাস করেছে। গ্রামাঞ্চলসহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ফল ভালো হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের কয়েকটি স্কুলের উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো।
সারাদেশে শুধু শহরে নয়, গ্রামেও যে শিক্ষার মান ও ফলে উন্নতি হয়েছে তার প্রমাণ মিলবে শহর থেকে দূরের কয়েকটি স্কুলের উদাহরণ থেকে। যেমন_ ঢাকা বোর্ডের রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির নবাবপুর হাই স্কুল থেকে ২০১০ সালে পাসের হার ছিল ৩২ দশমিক ৩১। এ বছর তথা ২০১১ সালে সেখানে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গত বছর ৩৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ পাস করেছিল। এ বছর পাস করেছে ৮২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মির্জাকালু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গত বছর পাস করেছিল ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ বছর পাস করেছে শতভাগ। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে সন্দ্বীপের সন্তোষপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গত বছর পাস করেছিল ৪০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ বছর পাস করেছে ৯৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেট বিভাগ অনেক পিছিয়ে আছে। তাই সিলেটের উদাহরণ দেওয়া যায়। অঞ্চল হিসেবে আপাতদৃষ্টিতে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে তুলনামূলকভাবে সিলেট বিভাগ কিছু এগিয়ে থাকলেও শিক্ষায় সিলেট বিভাগ সবার চেয়ে পেছনে। সিলেটে এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, পাসের হার_ সবই ছিল হতাশাজনক। গত দু'বছরে বিশেষ উদ্যোগ ও চেষ্টার ফলে অনেক পরিবর্তন এসেছে সার্বিক শিক্ষার ক্ষেত্রে।
সিলেট শিক্ষা বোর্ড থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ৪৯২, পাস করেছিল ১৫ হাজার ২৭০ জন এবং পাসের হার ছিল ৪৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। এবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৮ হাজার ৪৭৮ এবং পাস করেছে ৩৯ হাজার ৩৭৮ জন। ২০০৭ সালের চেয়ে ২৪ হাজার ১০৮ পরীক্ষার্থী বেশি পাস করেছে।
গ্রামাঞ্চলের স্কুল এবং শিক্ষায় দেশের পশ্চাৎপদ অঞ্চলের ফলে উন্নতি প্রমাণ করে সার্বিকভাবে শহর, গ্রামনির্বিশেষে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। এ ছাড়া আমরা বহু বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা জনপ্রিয় করা এবং শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য ২০১০ সালের জুনে প্রথমবারের মতো 'কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সপ্তাহ' পালন করে ব্যাপক প্রচার, সেমিনার, আলোচনা সভা, সমস্যা ও সমাধান চিহ্নিত করে কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ছাত্রীদের ওপর বখাটে-সন্ত্রাসীদের আক্রমণ ও তাদের উত্ত্যক্ত করা এবং চাপ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছাত্রী ও মা-বোনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আমরা সামাজিক আন্দোলন এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৩ হাজার হাই স্কুল, এক হাজার মাদ্রাসা, দেড় হাজার কলেজ, ৭০টি বড় কলেজ, ৩০৬টি মডেল স্কুল, ৩৫টি মডেল মাদ্রাসাসহ প্রায় ৬ হাজার ভবন নির্মাণের কাজ চলছে বা প্রক্রিয়াধীন। সব শিক্ষা বোর্ডের সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিবছর শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করা হচ্ছে যাতে শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হতে পারে। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা, পাঠদান, শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ, নারীর নিরাপত্তা ও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং মাদক ও জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকার জন্য সচেতন করা প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষকদের 'টিচার্সর্ গাইড' তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যে কঠিন কাজ, তা সবাই স্বীকার করবেন। আর্থিক ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। জাতীয় সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে জরুরি চাহিদার চেয়েও অনেক কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও গত আড়াই বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট নই। আমাদের আরও সাফল্য অর্জন করতে হবে। আমরা আশাবাদী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি অব্যাহত রাখবে। আমরা নতুন প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ এবং নৈতিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। আমরা সবার সহযোগিতা ও সাহায্যপ্রার্থী।
নুরুল ইসলাম নাহিদ : শিক্ষামন্ত্রী
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের স্বপ্ন ছিল দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, পশ্চাৎপদতা, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতিমুক্ত এক উন্নত, সমৃদ্ধ, সুখী, মর্যাদাশীল, গণতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা ধারণ করে, জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি এবং লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। একটি 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আমরা কাজ করছি। দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা, নিরক্ষরতা ও দুর্নীতিমুক্ত একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, সুখী দেশ গড়ার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে (যখন আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করব) অর্জন করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ লক্ষ্যই 'ভিশন ২০২১'। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ', 'ভিশন ২০২১' অর্থাৎ দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, পশ্চাৎপদতা ও দুর্নীতিমুক্ত উন্নত, সমৃদ্ধ, আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং আরও সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান শক্তি হবে আমাদের নতুন প্রজন্ম। আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। প্রশ্ন হলো, কীভাবে গড়ে তুলব?
সবাই একবাক্যে এর জবাবে বলবেন, শিক্ষা। প্রচলিত গতানুগতিক শিক্ষা দিয়ে এ লক্ষ্য অর্থাৎ আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলা যাবে না। নতুন প্রজন্ম যাতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আয়ত্ত করে তা প্রয়োগ করতে পারে সেই শিক্ষা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরই ২০০৯ সালে প্রথম থেকে নবম-দশম শ্রেণীর ১৯ কোটি পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ নিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন তাকে অনেকে অবাস্তব, পাগলামি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরের বার ২৩ কোটি ২২ লাখ পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কর্মসূচিকেও অনেকে অসম্ভব বলে আমাকে বিভিন্ন কথা বলেছেন। অনেকে বাধার সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমি বলেছি, চ্যালেঞ্জিং কাজ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা সব বই ছাপিয়ে নির্ধারিত দিনে সব স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় সব শিক্ষার্থীর হাতে সুষ্ঠুভাবে তা পেঁৗছাতে পেরেছি। আমাদের শিক্ষার সার্বিক লক্ষ্য অর্জন করার জন্য সব রাজনৈতিক ধারা ও সমাজের সব অংশের মানুষের মতামত গ্রহণ করে আমরা যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছি। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, আমরা যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করব তা কোনো দলীয় শিক্ষানীতি হবে না। তা হবে জাতীয় শিক্ষানীতি। আজ বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে, জাতির সব অংশের মানুষের মতামতকে ধারণ করে আমরা জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছি। আমরা সব শিশুকে ২০১১ সালের মধ্যে স্কুলে নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাফল্য অর্জন করতে যাচ্ছি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঝরে পড়া বন্ধ করতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান, ৪০ শতাংশ গরিব এবং মেধাবী শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে জাতীয়ভাবে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ করায় শিক্ষার্থীদের সনদ লাভ এবং সারাদেশে একই মান অর্জনের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা, অন্যান্য সহায়তা প্রদান ও সার্বিক কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া হ্রাস করছে। সর্বাত্মক চেষ্টায় শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে, দুর্নীতি কমে আসছে। এ বিষয়ে টিআইবির রিপোর্টে তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি ২৯ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
সবাই জানেন, স্কুলগুলোতে প্রতিবছর ক্লাস শুরু করতেই মার্চ-এপ্রিল হয়ে যেত। আমরা এখন স্কুলে ১ জানুয়ারি ক্লাস শুরু করছি। এতে সময় বাঁচছে, বেশি ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষা হতো এপ্রিল-মে মাসে। এইচএসসি তারও পরে। ফল প্রকাশ হতো ৩ মাস বা সাড়ে ৩ মাস পর। আমরা তা এগিয়ে আনতে পেরেছি। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এসএসসি ও এইচএসসি ফল প্রকাশ করা হচ্ছে পরীক্ষা সমাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে। পরীক্ষার্থীদের ফল ওয়েবসাইট, ই-মেইলে দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। অনলাইনে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রবেশপত্র অনলাইনে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এ জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। তাই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষায় আকৃষ্ট করার জন্য আমরা বিভিন্নভাবে বিজ্ঞানের ক্লাস আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করার চেষ্টা করছি। একটি মোবাইল বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি তৈরি করে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আমরা ২০ হাজার ৫০০ স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক ই-বুকে রূপান্তর করা হয়েছে। সব পাঠ্যপুস্তক ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুবিধ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে আরেকটি নতুন উদ্যোগ হলো দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে শ্রেণী পাঠদান সারাদেশের স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য শোনা ও দেখার ব্যবস্থা গ্রহণ। ভালো শিক্ষকের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান বিটিভির মাধ্যমে প্রচার করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য আধুনিক ও সময়োপযোগী কারিকুলাম অনুসারে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হচ্ছে। মুখস্থ ও নোট-গাইড বইভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে মূল পাঠ্যবই পড়া এবং যা পড়ানো হবে তা শিখতে হবে। পরীক্ষা বা মূল্যায়ন পদ্ধতির আধুনিকায়ন করা হয়েছে। এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা শিখে পরীক্ষা দিচ্ছে। ফলে শিক্ষার মান বাড়ছে, ফলও ভালো করছে।
শিক্ষকদের আর্থিক সমর্থন ও মর্যাদা বাড়াতে আমরা কাজ করছি। এ বছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরা বেসরকারি শিক্ষকদের বেতনও সমানভাবে বৃদ্ধি করেছি। মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার বৈষম্য দূর করা হয়েছে। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন উপায় খোঁজা হচ্ছে। ভবিষ্যতে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেলের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি। শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে 'টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রকল্প'-এর আওতায় এ পর্যন্ত এক লাখ ৯৩ হাজার শ্রেণীশিক্ষক, সাড়ে ১৬ হাজার প্রধান শিক্ষক, ৪৫ হাজার স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য এবং এক হাজার ১০০ শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ঈড়হহবপঃরহম ঈষধংংৎড়ড়স প্রকল্পের আওতায় ১০০ প্রধান শিক্ষক ও ১০০ শ্রেণীশিক্ষক যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। 'সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট'-এর আওতায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্য 'সৃজনশীল' প্রশ্ন পদ্ধতিবিষয়ক ব্যাপক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। আরেকটি প্রকল্পের নাম 'সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট'। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা হলো এর প্রধান কাজ।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বন্ধ করা এবং লেখাপড়ায় উৎসাহিত করার জন্য এ প্রকল্পের আওতায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাসিক ১২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়া হয়। তা ছাড়া প্রতিটি স্কুলে ভালো শিক্ষক, প্রথম স্থান অধিকারী ছাত্রছাত্রীসহ ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দেওয়া হয়।
আমরা উচ্চশিক্ষাকে বিশ্বমানে পেঁৗছাতে চাই। এ জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, নতুন জ্ঞান অনুসন্ধানসহ মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে উচ্চতর গবেষণার জন্য পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের ৩৯টি প্রকল্পে ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাইব্রেরি গড়ে তোলা বা উন্নত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনায় শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করতে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনসহ বহু কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। লাখ লাখ তরুণ-তরুণীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শুধু টেক্সটাইল সেক্টরে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত দক্ষ মানুষের অভাবে আমাদের দেশে প্রায় ২০ হাজার বিদেশি চাকরি করছেন। তাই আমরা টেক্সটাইল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেছি।
এবারের এসএসসির ফল সর্বকালের মধ্যে সেরা। ১০টি শিক্ষা বোর্ড থেকে ১৩ লাখ ৭ হাজার ১৫৫ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে ১০ লাখ ৭৫ হাজার ৮৮৬ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। শতকরা পাসের হার হচ্ছে ৮২ দশমিক ৩১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৬ হাজার ৭৪৯ জন। গতবারের তুলনায় এবার এক লাখ ১৫ হাজার ৩৯৪ জন বেশি পাস করেছে। গ্রামাঞ্চলসহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ফল ভালো হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের কয়েকটি স্কুলের উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো।
সারাদেশে শুধু শহরে নয়, গ্রামেও যে শিক্ষার মান ও ফলে উন্নতি হয়েছে তার প্রমাণ মিলবে শহর থেকে দূরের কয়েকটি স্কুলের উদাহরণ থেকে। যেমন_ ঢাকা বোর্ডের রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির নবাবপুর হাই স্কুল থেকে ২০১০ সালে পাসের হার ছিল ৩২ দশমিক ৩১। এ বছর তথা ২০১১ সালে সেখানে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গত বছর ৩৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ পাস করেছিল। এ বছর পাস করেছে ৮২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মির্জাকালু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গত বছর পাস করেছিল ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ বছর পাস করেছে শতভাগ। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে সন্দ্বীপের সন্তোষপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গত বছর পাস করেছিল ৪০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ বছর পাস করেছে ৯৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেট বিভাগ অনেক পিছিয়ে আছে। তাই সিলেটের উদাহরণ দেওয়া যায়। অঞ্চল হিসেবে আপাতদৃষ্টিতে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে তুলনামূলকভাবে সিলেট বিভাগ কিছু এগিয়ে থাকলেও শিক্ষায় সিলেট বিভাগ সবার চেয়ে পেছনে। সিলেটে এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, পাসের হার_ সবই ছিল হতাশাজনক। গত দু'বছরে বিশেষ উদ্যোগ ও চেষ্টার ফলে অনেক পরিবর্তন এসেছে সার্বিক শিক্ষার ক্ষেত্রে।
সিলেট শিক্ষা বোর্ড থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ৪৯২, পাস করেছিল ১৫ হাজার ২৭০ জন এবং পাসের হার ছিল ৪৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। এবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৮ হাজার ৪৭৮ এবং পাস করেছে ৩৯ হাজার ৩৭৮ জন। ২০০৭ সালের চেয়ে ২৪ হাজার ১০৮ পরীক্ষার্থী বেশি পাস করেছে।
গ্রামাঞ্চলের স্কুল এবং শিক্ষায় দেশের পশ্চাৎপদ অঞ্চলের ফলে উন্নতি প্রমাণ করে সার্বিকভাবে শহর, গ্রামনির্বিশেষে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। এ ছাড়া আমরা বহু বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা জনপ্রিয় করা এবং শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য ২০১০ সালের জুনে প্রথমবারের মতো 'কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সপ্তাহ' পালন করে ব্যাপক প্রচার, সেমিনার, আলোচনা সভা, সমস্যা ও সমাধান চিহ্নিত করে কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ছাত্রীদের ওপর বখাটে-সন্ত্রাসীদের আক্রমণ ও তাদের উত্ত্যক্ত করা এবং চাপ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছাত্রী ও মা-বোনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আমরা সামাজিক আন্দোলন এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৩ হাজার হাই স্কুল, এক হাজার মাদ্রাসা, দেড় হাজার কলেজ, ৭০টি বড় কলেজ, ৩০৬টি মডেল স্কুল, ৩৫টি মডেল মাদ্রাসাসহ প্রায় ৬ হাজার ভবন নির্মাণের কাজ চলছে বা প্রক্রিয়াধীন। সব শিক্ষা বোর্ডের সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিবছর শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করা হচ্ছে যাতে শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হতে পারে। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা, পাঠদান, শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ, নারীর নিরাপত্তা ও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং মাদক ও জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকার জন্য সচেতন করা প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষকদের 'টিচার্সর্ গাইড' তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যে কঠিন কাজ, তা সবাই স্বীকার করবেন। আর্থিক ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। জাতীয় সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে জরুরি চাহিদার চেয়েও অনেক কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও গত আড়াই বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট নই। আমাদের আরও সাফল্য অর্জন করতে হবে। আমরা আশাবাদী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি অব্যাহত রাখবে। আমরা নতুন প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ এবং নৈতিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। আমরা সবার সহযোগিতা ও সাহায্যপ্রার্থী।
নুরুল ইসলাম নাহিদ : শিক্ষামন্ত্রী
No comments