সবার ভালোবাসায় সিক্ত একজন মূসা ভাই by মনজুর আহমদ
মূসা ভাইকে জন্মদিনের অভিনন্দন। আশি বছরে পা দিলেন তিনি। ২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল তার জন্মদিন। একদা মনে হতো আশি বছর অতি দীর্ঘ সময়। এখন মনে হয় এই তো সেদিন। এই তো সেদিন মূসা ভাইকে দেখলাম তার টগবগে দিনগুলোতে।
সালটা ১৯৬১ না বাষট্টি মনে করে উঠতে পারছি না। বিলেতে সাংবাদিকতায় উচ্চ প্রশিক্ষণ শেষে মূসা ভাই সদ্য দেশে ফিরেছেন। ফিরেই ‘পাকিস্তান অবজারভার’-এর চেহারা বদলে দিয়েছেন। মেকআপে একটা আধুনিকতার ছাপ এনেছেন। নানাজনের মুখে তার প্রশংসা শুনছি। তখনও তাকে দেখিনি। আমি তখনই মাত্র সাংবাদিকতায় ঢুকেছি। একষট্টির মে মাসে চাকরি পেয়েছি ‘সংবাদ’-এ সাব এডিটর হিসেবে। মূসা ভাই তখন বিলেতে। সাংবাদিকতা পেশায় নবিশ হিসেবে তখন আমার অনেক দূরের মানুষ মূসা ভাই। ‘সংবাদ’ অফিসে বসেই ঘন ঘন শুনতে লাগলাম মূসা ভাইয়ের নাম। তিনি ফিরেছেন। দিনের ‘অবজারভার’টি উল্টে-পাল্টে দেখে সিনিয়র সাংবাদিকরা বলতে লাগলেন, মূসা এসেই কাগজের চেহারা বদলে দিয়েছেন। এমনই এক সময়ে হঠাত্ দেখলাম মূসা ভাইকে। তখন প্রেসক্লাবের সদস্য তালিকায় সবে আমার নাম প্রার্থী হিসেবে উঠেছে। একটু-আধটু যাওয়া-আসা করি। একদিন সকালে ক্লাবে গিয়ে ঢুকতেই তাকে দেখলাম। দেখলাম বাইরের বসার যে ঘরটিতে র্যাকের ওপর সারি সারি দিনের কাগজগুলো সাজানো থাকত সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি কাগজ পড়ছেন। চিনতাম না। পাশের খাওয়ার ঘরে গিয়ে যতদূর মনে পড়ে বেয়ারা উমেদ খানকে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি কে? উমেদ খান খানিক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বুঝেছিলেন আমি নবাগত। তারপর আমারই মতো গলা নামিয়ে বলেছিলেন, মূসা সাহেব।
মূসা সাহেব, মানে এবিএম মূসা। গত ক’দিন ধরে যার নাম প্রচুর শুনছি। সেখান থেকেই একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। কেমন যেন মেলাতে পারছিলাম না। বিলাত ফেরত মানুষ এত সাধারণ কেন? সদ্য বিলাত থেকে ফেরার সেই চাকচিক্য কই? তবে ওই পর্যন্তই। তখনও পর্যন্ত বুকের এমন পাটা হয়নি যে সামনে গিয়ে আলাপ করব, নিজের পরিচয় দেব। মূসা ভাই আমার দূরের মানুষই রয়ে গেলেন। দূর থেকেই দেখতাম মূসা ভাইকে। প্রেসক্লাবে এবং কখনও-সখনও অবজারভার অফিসে গেলে। অবজারভার অফিসে গেলে সেখানকার পরিবেশই যেন বলে দিত, কী দারুণ তার প্রভাব বিস্তারি ব্যক্তিত্ব।
সঙ্কোচটা কাটতে একটু সময় লেগেছিল আমার। ধীরে ধীরে বুঝেছিলাম যতটা ভয় তাকে পাই তেমন ভয়ঙ্কর মানুষ তিনি আদৌ নন। আমি কখনই তার সঙ্গে কাজ করিনি। তাই চাকরিগত কোনো সম্পর্ক তার সঙ্গে আমার গড়ে ওঠেনি। সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সাংবাদিক ইউনিয়ন আর প্রেসক্লাবের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ততদিনে তিনি আমাকে চিনে গেছেন। ওই চেনাজানা পর্যন্তই। প্রয়োজন ছাড়া কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ তখনও হয়নি। প্রথম তার পাশাপাশি বসলাম তার গাড়িতে ফুলার রোড থেকে গোপীবাগ আসতে। মূসা ভাইয়ের একটা ছোট ফিয়াট গাড়ি ছিল। যাকে বলা হতো ফিয়াট ৬০০। ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলে একটি ফরাসি ছবি দেখে রাতে গোপীবাগের বাসায় ফিরতে তার গাড়িতে রাইড নিয়েছিলাম। মূসা ভাইও তখন গোপীবাগে থাকতেন। গাড়ি চালাতে চালাতে অনেক কথা বলেছিলেন মূসা ভাই। তবে সে সবই ছিল ফরাসি ছবিটা সম্পর্কে।
দিনে দিনে আমি তার অনেক কাছাকাছি এলেও একটা ব্যবধান সব সময়েই বজায় থেকেছে। ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি, কারণ তার কাছাকাছি যাওয়ার তেমন কোনো প্রয়োজন আমার কখনও হয়নি। আর সবচেয়ে বড় কথা, অনেক সিনিয়র হওয়ায় তার থেকে একটা দূরত্ব আমি সব সময় রক্ষা করে চলতাম।
কিন্তু মূসা ভাই আমাকে দূরে থাকতে দেননি। তিনি কি কাউকে দূরে থাকতে দিয়েছেন? মুক্ত মনের উদার এই মানুষটির স্বভাবই সবাইকে কাছে টেনে নেয়া। আমিও নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমিও দিনে দিনে কখন যে তার স্নেহভাজনে পরিণত হয়েছি নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি। আমার প্রতি তার স্নেহের প্রকাশ ঘটেছে নানাভাবে। সেই সাতষট্টি সালে সংবাদ থেকে চাকরি খুইয়ে আমি যখন বেকার তখন একদিন প্রেসক্লাবে হঠাত্ দেখা হতে মূসা ভাই আমাকে বললেন, অবজারভার-এ যোগ দিতে। বললেন, স্পোর্টস বিভাগে একজন রিপোর্টার লাগবে। তুমি ঢুকে পড়।
তার পাশেই বসা ছিলেন সাংবাদিকদের অধিকার আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা কে জি মুস্তফা। কে জি ভাই চিন্তিত ছিলেন আমার কর্মসংস্থান নিয়ে। মূসা ভাইয়ের এমন অযাচিত প্রস্তাবে উত্সাহী হয়ে উঠলেন তিনি। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, দেরি কর না। আজই সন্ধ্যায় অফিসে গিয়ে মূসার সঙ্গে দেখা করো। মূসা ভাইয়ের এ প্রস্তাব ছিল আমার কাছে আকস্মিক ও অভাবিত। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবোধ আপ্লুত হলাম; কিন্তু সঙ্কোচে পড়ে গেলাম একটি কারণে।
খেলাধুলার সঙ্গে আমার সামান্য কোনো সম্পর্কও ছিল না। স্টেডিয়ামে ঢুকে কোনোদিন কোনো খেলাও দেখিনি। সেই আমার পক্ষে খেলাধুলার ওপর রিপোর্ট করা আদৌ সম্ভব হবে এমন আস্থা পেলাম না। তাই মূসা ভাইয়ের কাছে আর যাইনি। অবশ্য ততদিনে সুযোগ এসে গিয়েছিল দৈনিক পাকিস্তান-এ যোগ দেয়ার। সেখানেই ঢুকলাম। সেখানেই কেটে গেল টানা ত্রিশটি বছর। মূসা ভাই যখন প্রেস ইনস্টিটিউটের ডিজি তখন আমার স্ত্রী রেখা আহমদ পর্যটন কর্পোরেশনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। মূসা ভাই একদিন প্রেসক্লাবে তাকে বললেন, প্রেস ইনস্টিটিউটে যোগ দিতে। রেখা তাকে অনুরোধ জানিয়েছিল তার বদলে তার ছোট বোন শহীদ সাংবাদিক আনম গোলাম মোস্তফার বিধবা স্ত্রীকে চাকরিটা দিতে। মূসা ভাই দ্বিরুক্তি করেননি। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছিলেন এবং চাকরিটা দিয়েছিলেন। পরিচিতজনদের অসুখ-বিসুখ বা মৃত্যুর খবরে ছুটে যাওয়া মূসা ভাইয়ের সবর্জন প্রশংসিত একটি বৈশিষ্ট্য। সে পরিচিতজন কোন পক্ষের বা কোন মতাবলম্বী তা তার কাছে বিবেচ্য নয়। এখানেই তার উদারতা আকাশছোঁয়া, এখানেই অনুপম তার হৃদয় মাধুর্য। এখানেই মূসা ভাইয়ের মানবতাবোধের উজ্জ্বল প্রকাশ। পিজি হাসপাতালে আহমেদ হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুর খবর জানাতে আমি তাকে বাসায় ফোন করেছিলাম। শুনলাম তিনি ঘুমাচ্ছেন। বলেছিলাম ঘুম ভাঙলে যেন তাকে খবরটা দেয়া হয়। খবর পেয়েই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন হুমায়ুন সাহেবের উত্তরার বাড়িতে। জানাজা-দাফনে অংশ নিয়েছিলেন। আর আমাকে একটু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খবরটা দিলে না কেন? এ খবর কি কেউ দেরি করে দেয়? দল মত নির্বিশেষে মূসা ভাই সবার আপনজন। মূসা ভাই আজকের বিভাজিত সাংবাদিক সমাজের সব মহলের কাছেই সৌহার্দ্যের এক আশ্চর্য প্রতীক। মূসা ভাইয়ের নিশ্চয় একটি রাজনৈতিক মতবাদ রয়েছে। তিয়াত্তর সালে তিনি সংসদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন; কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সে পরিচয় কখনও প্রধান হয়ে ওঠেনি। সবার সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে তার ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই আশি বছর বয়সেও মূসা ভাই প্রেসক্লাবে অবলীলায় মিশছেন সবার সঙ্গে। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা বঞ্চিত হচ্ছে না তার স্নেহ-ভালোবাসা থেকে। পঞ্চাশ বছর আগে যেমন আমার মতো নবীনেরা দূর থেকে ভীরু ভীরু পায়ে একটু একটু করে এগিয়ে তার ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছেছি, আজকের প্রজন্মও তেমনিভাবে তার সান্নিধ্যে এগিয়ে যেতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। কোনো বিভাজন মূসা ভাইকে কোনো একটি পক্ষে দাঁড় করায়নি। আর এই কারণেই সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন মূসা ভাই।
বছর তিনেক আগে কয়েক দিনের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ঢাকায় বেশিদিন থাকতে পারিনি। আমেরিকায় ফিরে আসার আগে মূসা ভাইকে ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাব ভাবতে পারি না। বলেছিলাম, একটু সময় করে প্রেসক্লাবে আসেন, আমি অপেক্ষা করব। মূসা ভাই ঠিক সময়মত এসেছিলেন। দেখা হলো। সেই আনন্দ নিয়েই ফিরেছিলাম।
আশি বছরেও তারুণ্যের প্রভায় দীপ্ত আজকের মূসা ভাই। লেখালেখিতে এখনও অক্লান্ত। তার লেখার সঙ্গে কেউ একমত হন বা না হন সে লেখা সবাইকে আলোড়িত করে। মূসা ভাই আমার শ্রদ্ধেয় তার পরমতসহিষ্ণুতার জন্য, ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি তার ঔদার্যের জন্য, তার উন্নত রুচির মানসিকতার জন্য। মূসা ভাই দীর্ঘজীবী হোন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি লেখালেখিতে সক্রিয় থাকুন। তার জন্মদিনে এটুকুই কামনা।
নিউ ইয়র্ক, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১০
মূসা সাহেব, মানে এবিএম মূসা। গত ক’দিন ধরে যার নাম প্রচুর শুনছি। সেখান থেকেই একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। কেমন যেন মেলাতে পারছিলাম না। বিলাত ফেরত মানুষ এত সাধারণ কেন? সদ্য বিলাত থেকে ফেরার সেই চাকচিক্য কই? তবে ওই পর্যন্তই। তখনও পর্যন্ত বুকের এমন পাটা হয়নি যে সামনে গিয়ে আলাপ করব, নিজের পরিচয় দেব। মূসা ভাই আমার দূরের মানুষই রয়ে গেলেন। দূর থেকেই দেখতাম মূসা ভাইকে। প্রেসক্লাবে এবং কখনও-সখনও অবজারভার অফিসে গেলে। অবজারভার অফিসে গেলে সেখানকার পরিবেশই যেন বলে দিত, কী দারুণ তার প্রভাব বিস্তারি ব্যক্তিত্ব।
সঙ্কোচটা কাটতে একটু সময় লেগেছিল আমার। ধীরে ধীরে বুঝেছিলাম যতটা ভয় তাকে পাই তেমন ভয়ঙ্কর মানুষ তিনি আদৌ নন। আমি কখনই তার সঙ্গে কাজ করিনি। তাই চাকরিগত কোনো সম্পর্ক তার সঙ্গে আমার গড়ে ওঠেনি। সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সাংবাদিক ইউনিয়ন আর প্রেসক্লাবের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ততদিনে তিনি আমাকে চিনে গেছেন। ওই চেনাজানা পর্যন্তই। প্রয়োজন ছাড়া কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ তখনও হয়নি। প্রথম তার পাশাপাশি বসলাম তার গাড়িতে ফুলার রোড থেকে গোপীবাগ আসতে। মূসা ভাইয়ের একটা ছোট ফিয়াট গাড়ি ছিল। যাকে বলা হতো ফিয়াট ৬০০। ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলে একটি ফরাসি ছবি দেখে রাতে গোপীবাগের বাসায় ফিরতে তার গাড়িতে রাইড নিয়েছিলাম। মূসা ভাইও তখন গোপীবাগে থাকতেন। গাড়ি চালাতে চালাতে অনেক কথা বলেছিলেন মূসা ভাই। তবে সে সবই ছিল ফরাসি ছবিটা সম্পর্কে।
দিনে দিনে আমি তার অনেক কাছাকাছি এলেও একটা ব্যবধান সব সময়েই বজায় থেকেছে। ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি, কারণ তার কাছাকাছি যাওয়ার তেমন কোনো প্রয়োজন আমার কখনও হয়নি। আর সবচেয়ে বড় কথা, অনেক সিনিয়র হওয়ায় তার থেকে একটা দূরত্ব আমি সব সময় রক্ষা করে চলতাম।
কিন্তু মূসা ভাই আমাকে দূরে থাকতে দেননি। তিনি কি কাউকে দূরে থাকতে দিয়েছেন? মুক্ত মনের উদার এই মানুষটির স্বভাবই সবাইকে কাছে টেনে নেয়া। আমিও নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমিও দিনে দিনে কখন যে তার স্নেহভাজনে পরিণত হয়েছি নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি। আমার প্রতি তার স্নেহের প্রকাশ ঘটেছে নানাভাবে। সেই সাতষট্টি সালে সংবাদ থেকে চাকরি খুইয়ে আমি যখন বেকার তখন একদিন প্রেসক্লাবে হঠাত্ দেখা হতে মূসা ভাই আমাকে বললেন, অবজারভার-এ যোগ দিতে। বললেন, স্পোর্টস বিভাগে একজন রিপোর্টার লাগবে। তুমি ঢুকে পড়।
তার পাশেই বসা ছিলেন সাংবাদিকদের অধিকার আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা কে জি মুস্তফা। কে জি ভাই চিন্তিত ছিলেন আমার কর্মসংস্থান নিয়ে। মূসা ভাইয়ের এমন অযাচিত প্রস্তাবে উত্সাহী হয়ে উঠলেন তিনি। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, দেরি কর না। আজই সন্ধ্যায় অফিসে গিয়ে মূসার সঙ্গে দেখা করো। মূসা ভাইয়ের এ প্রস্তাব ছিল আমার কাছে আকস্মিক ও অভাবিত। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবোধ আপ্লুত হলাম; কিন্তু সঙ্কোচে পড়ে গেলাম একটি কারণে।
খেলাধুলার সঙ্গে আমার সামান্য কোনো সম্পর্কও ছিল না। স্টেডিয়ামে ঢুকে কোনোদিন কোনো খেলাও দেখিনি। সেই আমার পক্ষে খেলাধুলার ওপর রিপোর্ট করা আদৌ সম্ভব হবে এমন আস্থা পেলাম না। তাই মূসা ভাইয়ের কাছে আর যাইনি। অবশ্য ততদিনে সুযোগ এসে গিয়েছিল দৈনিক পাকিস্তান-এ যোগ দেয়ার। সেখানেই ঢুকলাম। সেখানেই কেটে গেল টানা ত্রিশটি বছর। মূসা ভাই যখন প্রেস ইনস্টিটিউটের ডিজি তখন আমার স্ত্রী রেখা আহমদ পর্যটন কর্পোরেশনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। মূসা ভাই একদিন প্রেসক্লাবে তাকে বললেন, প্রেস ইনস্টিটিউটে যোগ দিতে। রেখা তাকে অনুরোধ জানিয়েছিল তার বদলে তার ছোট বোন শহীদ সাংবাদিক আনম গোলাম মোস্তফার বিধবা স্ত্রীকে চাকরিটা দিতে। মূসা ভাই দ্বিরুক্তি করেননি। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছিলেন এবং চাকরিটা দিয়েছিলেন। পরিচিতজনদের অসুখ-বিসুখ বা মৃত্যুর খবরে ছুটে যাওয়া মূসা ভাইয়ের সবর্জন প্রশংসিত একটি বৈশিষ্ট্য। সে পরিচিতজন কোন পক্ষের বা কোন মতাবলম্বী তা তার কাছে বিবেচ্য নয়। এখানেই তার উদারতা আকাশছোঁয়া, এখানেই অনুপম তার হৃদয় মাধুর্য। এখানেই মূসা ভাইয়ের মানবতাবোধের উজ্জ্বল প্রকাশ। পিজি হাসপাতালে আহমেদ হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুর খবর জানাতে আমি তাকে বাসায় ফোন করেছিলাম। শুনলাম তিনি ঘুমাচ্ছেন। বলেছিলাম ঘুম ভাঙলে যেন তাকে খবরটা দেয়া হয়। খবর পেয়েই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন হুমায়ুন সাহেবের উত্তরার বাড়িতে। জানাজা-দাফনে অংশ নিয়েছিলেন। আর আমাকে একটু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খবরটা দিলে না কেন? এ খবর কি কেউ দেরি করে দেয়? দল মত নির্বিশেষে মূসা ভাই সবার আপনজন। মূসা ভাই আজকের বিভাজিত সাংবাদিক সমাজের সব মহলের কাছেই সৌহার্দ্যের এক আশ্চর্য প্রতীক। মূসা ভাইয়ের নিশ্চয় একটি রাজনৈতিক মতবাদ রয়েছে। তিয়াত্তর সালে তিনি সংসদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন; কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সে পরিচয় কখনও প্রধান হয়ে ওঠেনি। সবার সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে তার ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই আশি বছর বয়সেও মূসা ভাই প্রেসক্লাবে অবলীলায় মিশছেন সবার সঙ্গে। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা বঞ্চিত হচ্ছে না তার স্নেহ-ভালোবাসা থেকে। পঞ্চাশ বছর আগে যেমন আমার মতো নবীনেরা দূর থেকে ভীরু ভীরু পায়ে একটু একটু করে এগিয়ে তার ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছেছি, আজকের প্রজন্মও তেমনিভাবে তার সান্নিধ্যে এগিয়ে যেতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। কোনো বিভাজন মূসা ভাইকে কোনো একটি পক্ষে দাঁড় করায়নি। আর এই কারণেই সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন মূসা ভাই।
বছর তিনেক আগে কয়েক দিনের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ঢাকায় বেশিদিন থাকতে পারিনি। আমেরিকায় ফিরে আসার আগে মূসা ভাইকে ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাব ভাবতে পারি না। বলেছিলাম, একটু সময় করে প্রেসক্লাবে আসেন, আমি অপেক্ষা করব। মূসা ভাই ঠিক সময়মত এসেছিলেন। দেখা হলো। সেই আনন্দ নিয়েই ফিরেছিলাম।
আশি বছরেও তারুণ্যের প্রভায় দীপ্ত আজকের মূসা ভাই। লেখালেখিতে এখনও অক্লান্ত। তার লেখার সঙ্গে কেউ একমত হন বা না হন সে লেখা সবাইকে আলোড়িত করে। মূসা ভাই আমার শ্রদ্ধেয় তার পরমতসহিষ্ণুতার জন্য, ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি তার ঔদার্যের জন্য, তার উন্নত রুচির মানসিকতার জন্য। মূসা ভাই দীর্ঘজীবী হোন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি লেখালেখিতে সক্রিয় থাকুন। তার জন্মদিনে এটুকুই কামনা।
নিউ ইয়র্ক, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১০
No comments