রক্ত ও তরবারির গান-বাবার মৃত্যুর দিনেই তিনি শপথ নিলেন by ফাতিমা ভুট্টো

জুলফি সিদ্ধান্ত নিল, সে বেনজিরের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকবে। সে পরিবারের বেঁচে যাওয়া একমাত্র পুরুষ সদস্য। তাঁর দাফন সম্পন্ন করতে পরিবারের পক্ষ থেকে কারও না কারও থাকা প্রয়োজন। শেষকৃত্যে আরও যাঁরা এসেছেন, তাঁরা সবাই রাজনৈতিক কর্মী, অক্ষম, অপরাধী ও চোর। তিনি (বেনজির) তাঁদের হাতে দাফন হতে পারেন না।


আমি কাঁদতে থাকি ও আমার ভাইকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করি। আমি চাইছিলাম না সে তাঁর (জারদারির) কাছাকাছি থাকুক। আমি চাইছিলাম না ছয় ফুট গভীর কবরে সে জারদারির সঙ্গে দাঁড়াক। অনেকেই বিশ্বাস করে যে লোকটি আমার বাবার হত্যার জন্য দায়ী। এই হত্যা (বেনজির হত্যাকাণ্ড) সম্পর্কেও মানুষ একই কথা বলেন। এটা আরও ভয়ংকর।
তুমি কি পাগল হয়েছ? আমি চিৎকার দিতে থাকি।
জুলফি ছিল অনেক মর্যাদাবান, অধিক উদার, যা আমি কখনো হতে পারিনি। সে বেনজিরের মরদেহ কবরে নামাল, ফাতিহা পাঠ করল এবং সেখান থেকে বাবার কবরে গেল। সে বাবার কবরে রাখা কাপড় ও গোলাপ পাপড়িতে চুমু খেল। এবং এরপর সে চলে এল। তখন তার বয়স মাত্র ১৭।
দুই মাস পর আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে আবারও আমার বাদানুবাদ হয়। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারির কারচুপির নির্বাচনে পিপিপি জয়লাভ করে। স্ত্রী মারা যাওয়ার তৃতীয় দিনে জারদারি হাস্যকরভাবে সন্তানদের নামের শেষাংশ পাল্টে দেন। জারদারির স্থলে ভুট্টো বসান। তার উদ্দেশ্য ছিল ‘শেষ ভুট্টো’কে (আমার ভাই জুলফি বা জুলফিকার আলি জুনিয়র) বাইরে রাখা।
২০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ আমার বাবার ১২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আসিফ জারদারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন। শপথ নেওয়ার নির্ধারিত তারিখ ছিল এক দিন আগে, ১৯ সেপ্টেম্বর; কিন্তু নতুন প্রেসিডেন্টের নির্দেশে এক দিন পিছিয়ে নেওয়া হয়। পার্লামেন্ট সদস্যরা তাঁর উপস্থিতিতেই সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে নির্বাচিত করেন (একই ধরনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পারভেজ মোশাররফও ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন!)।
জারদারি তাঁর বক্তৃতার মাঝখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করলেন তাঁর শ্যালকের মৃত্যুকে স্মরণ করে। আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। এটি ছিল আমাদের প্রতি মসকরা। কিন্তু এর পর যে কাজটি করলেন, তার কোনো তুলনা হয় না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম পাকিস্তান দিবসে তিনি সোহেব সুদলকে হিলাল ই ইমতিয়াজ পদকে ভূষিত করলেন, যিনি আমার বাবার হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যপটে উপস্থিত ছিলেন একজন জ্যেষ্ঠতম পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে। পাকিস্তানের জনগণকে সেবা করার স্বীকৃতি হিসেবে এই জাতীয় পদক দেওয়া হয়। সোহেব সুদলকে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর প্রধান করা হয়।
এমকিউএম (মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট) অপারেশন ক্লিন-আপের কথা ভুলে গেছে এবং এখন জারদারি সরকারের অত্যুৎসাহী শরিক। এমকিউএমের নেতা আলতাফ হোসেন এখনো লন্ডনে বসবাস করছেন। জারদারি তাঁর ঘনিষ্ঠ এবং প্রায়ই তাঁরা ছবি তোলার জন্য ক্যামেরার সামনে পরস্পর করমর্দন ও আলিঙ্গন করে থাকেন।
নিসার খুরোর সভাপতিত্বে সিন্ধু প্রাদেশিক পরিষদ ২০০৯ সালের গ্রীষ্মে, যখন সোয়াত ও উত্তরাঞ্চলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধের কারণে ৩০ লাখ পাকিস্তানি বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তখন পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছে। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে আমেরিকার ড্রোন বিমান হামলা ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণে বহু লোক নিহত হওয়ার ঘটনায় পরিষদ একটি কথাও বলেনি (কিংবা এক মিনিট নীরবতাও পালন করেনি)। ইতিমধ্যে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ গ্রীষ্মকালীন অধিবেশনে ‘সাইবার অপরাধ বিল’ পাস করেছে, যাতে প্রেসিডেন্টকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ বা চরিত্র হননকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শাস্তির মেয়াদ ছয় মাস থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত (আমার কাছে এটি হাস্যকর প্রতারণা মনে হয়)।
যে চারটি হত্যা মামলার অভিযোগ মাথায় নিয়ে জারদারি প্রেসিডেন্টের আসনে বসেছেন, এর একটি হলো বিচারপতি নিজাম হত্যা। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন সিন্ধু হাইকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি। বাবার মৃত্যুর মাত্র তিন মাস আগে বাড়ির বাইরে তাঁকে হত্যা করা হয়।
১ জুন ১৯৯৯। বেলা দুইটার দিকে খাওয়ার জন্য বাড়িতে যাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর পুত্র নাদিম তাঁর অফিস থেকে বাবাকে তুলে নিয়ে আসেন। চালকের অনুপস্থিতিতে এ কাজটি তাঁরা প্রায়ই করতেন। বিদেশে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর সম্প্রতি নাদিম করাচিতে ফিরে এসেছেন। তাঁরা যখন গেটের কাছে গাড়িটি নিয়ে এলেন, তখনই স্কুটারে আসা দুজন লোক তাঁদের গাড়ির কাছে নামালেন। দুজনের একজন বিচারপতি নিজাম ও তাঁর ছেলেকে সালাম দিল। চালকের আসনে বসা নাদিম গাড়ি থামিয়ে গাড়ির কাচটা নামাল। সঙ্গে সঙ্গে লোক দুটি গাড়ির ভেতরে গুলি করে এবং বিচারপতি নিজাম ও তাঁর ছেলে নিহত হন।
আমি যখন বিচারপতি নিজামের ভাই নূর আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করলাম, তার আগেই জারদারি রহস্যজনকভাবে দুটি মামলা থেকে দায়মুক্ত হয়েছেন। তৃতীয়টি ছিল বিচারপতি নিজাম হত্যা মামলা। বাবার হত্যা মামলাটি পরের। শুক্রবার জুমার নামাজের পর আমরা নূর আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কী মনে করেন, কখনো ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে। জবাবে তিনি বললেন, ‘আমার সন্দেহ আছে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি মনে করেন, জারদারি আপনার ভাইয়ের হত্যার নেপথ্যে ছিলেন? তিনি বললেন, ‘তাঁর মৃত্যুর পরই আমি বিষয়টি জানতে পারি।’ এরপর তিনি উর্দু ও ইংরেজিতে বলতে থাকেন, ‘প্রত্যেক বিচারপতি ও আইনজীবীই জানেন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন ও পরিকল্পনা করেছেন জারদারি।’
এরপর নূর আহমেদ শান্ত কণ্ঠে বললেন, হত্যার পর দ্বিতীয় দিনে আসিফ জারদারির বাবা হাকিম জারদারি আমার কাছে এলেন সমবেদনা জানাতে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে এ ঘটনা ঘটল? আমি বললাম, ‘প্রত্যেকে জানেন, এটি আপনার ছেলের কাজ’।
তিনি কি কোনো জবাব দিয়েছিলেন?
না, চুপ করেছিলেন, বললেন নূর আহমেদ। জারদারি যেদিন আমার বাবার হত্যা মামলা থেকে দায়মুক্ত হলেন, আমি পৃথিবীর অপর প্রান্তে। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ক্যাষ্ট্রোর ক্ষমতা গ্রহণের ৫০তম বার্ষিকীতে কিউবা বিপ্লবের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে লেখার জন্য। আমি জানতাম এটা হবে। এমনকি তিনি যখন হত্যা ও অসংখ্য মামলার আসামি, তখনো খুব কম সময়ই জেলখানায় থেকেছেন। জেলখানার বদলে রোগী হিসেবে তিনি থাকতেন করাচিতে তাঁর বন্ধুর মালিকানাধীন বেসরকারি হাসপাতালের বিলাসবহুল স্যুটে। পরবর্তীকালে বন্ধুকে পুরস্কৃত করেছেন তেল ও জ্বালানিমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত করে।
আমি কিউবার হাসপাতাল ও স্কুলগুলো পরিদর্শন করেছি, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি এবং সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি ছিলাম ই-মেইল যোগাযোগের বাইরে। এক দিন অপরাহ্নে হাভানায় আমি একটি টেলিফোন পাই। সেটা ছিল এপ্রিল মাস এবং আবহাওয়া ছিল গরম ও আর্দ্র। বাড়ি থেকে টেলিফোনটি করেছিলেন হামিদ। বললেন, আমি দুঃখিত। কেন দুঃখিত, তা বললেন না। শুধু জানালেন, জারদারি আদালতের প্রক্রিয়া এড়িয়ে বাবার মামলা থেকে নিজেকে দায়মুক্ত করেছেন।
পরের কিস্তি: বিরোধের শুরু উত্তরাধিকার নিয়ে
গ্রন্থনা ও ভাষান্তর: সোহরাব হাসান।

No comments

Powered by Blogger.