আওয়ামী স্বপ্নবিলাস বাস্তবায়ন কি আদৌ সম্ভব? by সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
ওয়ান-ইলেভেন ও নাইন-ইলেভেন যে একই সূত্রে গ্রথিত তা বোধহয় এখন কাউকে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিষয়টি ইতোমধ্যেই যারা উপলব্ধি করেছেন, তাদের আর বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। নাইন-ইলেভেনের জন্ম দেয়া হয়েছিল বিশ্বময় ক্রমবর্ধমান ইসলামী শক্তিকে সমূলে উত্খাতের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য।
আর এ নীলনকশার অংশ হিসেবেই লাদেন পাকড়াও-এর বাহানা তুলে আফগানিস্তান দখল করে নেয়া হয়েছে এবং কথিত মারণাস্ত্র সংরক্ষণের দায়ে দখলদারিত্ব কায়েম করা হয়েছে ইরাকেও। আর এর ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, তারা লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য বাস্তবিকই আপসহীন।
এবার আসা যাক ওয়ান-ইলেভেনের কথায়। এর প্রধান কারণই ছিল আওয়ামী স্বপ্নবিলাস। অবশ্য আওয়ামী নেত্রীকে তার দলের নেতাকর্মীরা ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বেশ পুলকবোধ করেন। অতিউত্সাহী নেতা-কর্মীরা তা অবশ্য মনে করতেই পারেন, এতে দোষের কিছু নেই, তবে তার এই অভিধা কতখানি যৌক্তিক তা-ই এখন আলোচনা-পর্যালোচনার বিষয়। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করেছিল। এ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও সুষ্ঠুতা নিয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক মহলের কোনো অভিযোগ ছিল না; কিন্তু আওয়ামী লীগ এ নির্বাচন মেনে নেয়নি এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংসদেও যায়নি। মাঝে মাঝে শুধু বেতন-ভাতা প্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য সদস্যপদ রক্ষার্থে সংসদে গিয়ে কোনো অজুহাত সৃষ্টি করেই সংসদ বর্জন অব্যাহত রেখেছে এবং রাজপথে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অকারণে হরতাল আহ্বান করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। জনগণকে হরতাল পালনে বাধ্য করার জন্য যাত্রীবাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকার পতনের ডেডলাইন দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। পর্যুদস্ত হয়েছে তাদের সব অপতত্পরতা। অবশেষে তাদের স্বপ্নবিলাস চরিতার্থ করার জন্য তারা বেছে নেয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল কেয়ারটেকার সরকারের শাসন আমলকে।
দীর্ঘ ৫ বছর পর্যন্ত তথা চারদলীয় জোট সরকারের পুরো মেয়াদকাল দেশব্যাপী নৈরাজ্য ও ধ্বংসাত্মক তত্পরতা চালিয়ে তারা যখন সুবিধা করতে পারেনি তখন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির শকুনির শ্যেনদৃষ্টি পড়ে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমির উপর। আওয়ামী লীগ তাদের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রভুদের দ্বারস্থ হয় এবং তাদেরকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয় যে, জনগণের সমর্থন নিয়ে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসীন হওয়া সম্ভব নয়। তাই যে কোনোভাবেই হোক দেশে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর তা করতে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটবে এবং বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান ঠেকানো যাবে না। আর তা না গেলে তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য মোটেই সুখকর হবে না বরং তাদের অখণ্ডতাও মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে। আর এই আওয়ামী স্বপ্নবিলাসের নেপথ্যের প্রধান কুশীলব ছিলেন ইতিহাসের দ্বিতীয় মীর জাফর তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ। আর সেনাপ্রধান ও আওয়ামী লীগের সম্মিলিত অপতত্পরতার মাধ্যমে দেশবাসীকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রভুদের কাছে দাসখত দিয়ে ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির মাধ্যমে সম্পূর্ণ কদর্যপন্থায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। এ কথা প্রমাণের জন্য আমাদেরকে তথ্যানুসন্ধানী হতে হবে না বরং আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্ষীয়ান নেতা আবদুল জলিলের আত্মস্বীকৃতিই এর প্রমাণ। এরপরও যারা আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন হওয়ার মাজেজাটা বোঝে না। তাদের জন্য করুণাই হয় বৈকি!
‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’ বলে একটা বহুল প্রচলিত কথা আছে। কথাটা কপটদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আওয়ামী নেত্রী মুখে গণতন্ত্রের ফুলঝুরি ফুটিয়ে ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কর্মতত্পরতায় মনে হচ্ছে তাদের ঘাড়ে রীতিমত বাকশালের ভূত চেপে বসেছে। ১৯৭৪ সালে মাত্র ১১ মিনিটের ব্যবধানে সংবিধান সংশোধন করে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। আর জনগণের মাঝে এমন বিশ্বাসঘাকতার চরম মূল্য দিতে হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের মাধ্যমে। আওয়ামী নেত্রী অন্যদেরকে ইতিহাস শেখান এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলেন; কিন্তু তিনি ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছেন আর স্মৃতি বিভ্রম তার এত প্রবল যে, তার মনের মুকুরে অতীতের কোনো কিছুই প্রতিভাত হচ্ছে না। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও অন্তরে ছিল বাকশালের প্রেতাত্মা। তাই তো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে। তারা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ওপর ভর করে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দেশে আবার বাকশালী শাসনের ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। অবশ্য এর বাস্তবতা নিয়ে ইতোমধ্যেই তাদের মধ্যে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন ১৯৭৪-এর ঢোল বর্তমান সময়ে নাও বাজতে পারে। তাই তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও দীর্ঘায়িত করার জন্য তারা একটি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের ভৌতিক কথা বলতে শুরু করেছেন। অবশ্য এখন পর্যন্ত তারা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের রূপরেখা দেশের মানুষের কাছে উপস্থাপন করেননি; কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যে তাদের নীতি-নির্ধারকদের আলাপ-আলোচনা চলছে তা অর্থমন্ত্রীর কথায় প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য লিবারেল ডেমোক্রাসি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ডেমোক্রাসি ও লিবারেল শব্দ দুটো পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের সঙ্গে তো উদারতা থাকতেই হবে তাহলে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় আমাদেরকে গণতন্ত্রের কোন্ দীক্ষা দিতে চান তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তির সহায়তায় ক্ষমতাসীন হয়েছে আওয়ামী লীগ। দেশের মানুষের উপর তাদের কোনো আস্থা নেই। তাই তারা শুরু থেকে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই মাননীয় আইনমন্ত্রী ঘোষণা করলেন যে, নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার নাকি প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়েছে। যারা একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও একজন নির্বাচন কমিশনারের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে প্রশ্ন তুলে নির্বাচন বর্জন করে দেশে ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, তাদের মুখে এ কথা কতখানি শোভনীয় তা সচেতন মানুষের কাছে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এরপর তারা ১৯৭২-এর সংবিধানে ফেরার কথা বলছে, আবার নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের কথাও বলছে। আসলে এসব হচ্ছে জনগণের উপর বিশ্বাসহীনতা এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপতত্পরতা। আর এজন্য তারা পঞ্চম সংশোধনী বাতিলবিষয়ক আদালতের রায় প্রদর্শনের মওকা দেখাচ্ছে। দেখাচ্ছে ’৭২-এর সংবিধান। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত সংবিধানের জন্য জনগণ নয় বরং জনগণের জন্যই সংবিধান। আর এ ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশের বড় বড় রাজনৈতিক সঙ্কটকালীন সময়ে এবং সে সঙ্কট উত্তরণের জন্য সাংবিধানিক বাধা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। আসা যাক ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনের কথায়। সে সময় তিন জোট ও অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, তাদের দাবি মোটেই সংবিধান সম্মত নয়। কিন্তু জনগণের কাছে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতেই হয়েছে। সংবিধানের সুড়ঙ্গপথ তৈরি করে বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মাধ্যমেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালেও কেয়ারটেকার আন্দোলন সংবিধানসম্মত ছিল না; কিন্তু পরবর্তীতে তা স্থায়ী বিধান হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি হয়েছে সংবিধানকে পদদলিত করেই। কেয়ারটেকার সরকারের ২ বছর ক্ষমতায় থাকার কোনো সাংবিধানিক বিধানই ছিল না। আর দেশের পবিত্র সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত ও অপমানিত করেই আওয়ামী-বাকশালীরা দেশময় নৈরাজ্য ও ধ্বংসাত্মক তত্পরতা শুরু করে দেয়। ফলে একটি অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসে। আর এই সংবিধান লঙ্ঘনের মহড়া শুরু করে আওয়ামী লীগই। তাই পঞ্চম সংশোধনী বাতিল বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় এবং ’৭২-এর সংবিধান আওয়ামী দিবাস্বপ্নকে কতখানি বাস্তব রূপদান করবে তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসেনি।
এবার আসা যাক ওয়ান-ইলেভেনের কথায়। এর প্রধান কারণই ছিল আওয়ামী স্বপ্নবিলাস। অবশ্য আওয়ামী নেত্রীকে তার দলের নেতাকর্মীরা ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বেশ পুলকবোধ করেন। অতিউত্সাহী নেতা-কর্মীরা তা অবশ্য মনে করতেই পারেন, এতে দোষের কিছু নেই, তবে তার এই অভিধা কতখানি যৌক্তিক তা-ই এখন আলোচনা-পর্যালোচনার বিষয়। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করেছিল। এ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও সুষ্ঠুতা নিয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক মহলের কোনো অভিযোগ ছিল না; কিন্তু আওয়ামী লীগ এ নির্বাচন মেনে নেয়নি এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংসদেও যায়নি। মাঝে মাঝে শুধু বেতন-ভাতা প্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য সদস্যপদ রক্ষার্থে সংসদে গিয়ে কোনো অজুহাত সৃষ্টি করেই সংসদ বর্জন অব্যাহত রেখেছে এবং রাজপথে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অকারণে হরতাল আহ্বান করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। জনগণকে হরতাল পালনে বাধ্য করার জন্য যাত্রীবাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকার পতনের ডেডলাইন দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। পর্যুদস্ত হয়েছে তাদের সব অপতত্পরতা। অবশেষে তাদের স্বপ্নবিলাস চরিতার্থ করার জন্য তারা বেছে নেয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল কেয়ারটেকার সরকারের শাসন আমলকে।
দীর্ঘ ৫ বছর পর্যন্ত তথা চারদলীয় জোট সরকারের পুরো মেয়াদকাল দেশব্যাপী নৈরাজ্য ও ধ্বংসাত্মক তত্পরতা চালিয়ে তারা যখন সুবিধা করতে পারেনি তখন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির শকুনির শ্যেনদৃষ্টি পড়ে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমির উপর। আওয়ামী লীগ তাদের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রভুদের দ্বারস্থ হয় এবং তাদেরকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয় যে, জনগণের সমর্থন নিয়ে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসীন হওয়া সম্ভব নয়। তাই যে কোনোভাবেই হোক দেশে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর তা করতে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটবে এবং বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান ঠেকানো যাবে না। আর তা না গেলে তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য মোটেই সুখকর হবে না বরং তাদের অখণ্ডতাও মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে। আর এই আওয়ামী স্বপ্নবিলাসের নেপথ্যের প্রধান কুশীলব ছিলেন ইতিহাসের দ্বিতীয় মীর জাফর তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ। আর সেনাপ্রধান ও আওয়ামী লীগের সম্মিলিত অপতত্পরতার মাধ্যমে দেশবাসীকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রভুদের কাছে দাসখত দিয়ে ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির মাধ্যমে সম্পূর্ণ কদর্যপন্থায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। এ কথা প্রমাণের জন্য আমাদেরকে তথ্যানুসন্ধানী হতে হবে না বরং আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্ষীয়ান নেতা আবদুল জলিলের আত্মস্বীকৃতিই এর প্রমাণ। এরপরও যারা আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন হওয়ার মাজেজাটা বোঝে না। তাদের জন্য করুণাই হয় বৈকি!
‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’ বলে একটা বহুল প্রচলিত কথা আছে। কথাটা কপটদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আওয়ামী নেত্রী মুখে গণতন্ত্রের ফুলঝুরি ফুটিয়ে ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কর্মতত্পরতায় মনে হচ্ছে তাদের ঘাড়ে রীতিমত বাকশালের ভূত চেপে বসেছে। ১৯৭৪ সালে মাত্র ১১ মিনিটের ব্যবধানে সংবিধান সংশোধন করে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। আর জনগণের মাঝে এমন বিশ্বাসঘাকতার চরম মূল্য দিতে হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের মাধ্যমে। আওয়ামী নেত্রী অন্যদেরকে ইতিহাস শেখান এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলেন; কিন্তু তিনি ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছেন আর স্মৃতি বিভ্রম তার এত প্রবল যে, তার মনের মুকুরে অতীতের কোনো কিছুই প্রতিভাত হচ্ছে না। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও অন্তরে ছিল বাকশালের প্রেতাত্মা। তাই তো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে। তারা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ওপর ভর করে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দেশে আবার বাকশালী শাসনের ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। অবশ্য এর বাস্তবতা নিয়ে ইতোমধ্যেই তাদের মধ্যে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন ১৯৭৪-এর ঢোল বর্তমান সময়ে নাও বাজতে পারে। তাই তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও দীর্ঘায়িত করার জন্য তারা একটি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের ভৌতিক কথা বলতে শুরু করেছেন। অবশ্য এখন পর্যন্ত তারা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের রূপরেখা দেশের মানুষের কাছে উপস্থাপন করেননি; কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যে তাদের নীতি-নির্ধারকদের আলাপ-আলোচনা চলছে তা অর্থমন্ত্রীর কথায় প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য লিবারেল ডেমোক্রাসি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ডেমোক্রাসি ও লিবারেল শব্দ দুটো পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের সঙ্গে তো উদারতা থাকতেই হবে তাহলে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় আমাদেরকে গণতন্ত্রের কোন্ দীক্ষা দিতে চান তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তির সহায়তায় ক্ষমতাসীন হয়েছে আওয়ামী লীগ। দেশের মানুষের উপর তাদের কোনো আস্থা নেই। তাই তারা শুরু থেকে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই মাননীয় আইনমন্ত্রী ঘোষণা করলেন যে, নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার নাকি প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়েছে। যারা একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও একজন নির্বাচন কমিশনারের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে প্রশ্ন তুলে নির্বাচন বর্জন করে দেশে ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, তাদের মুখে এ কথা কতখানি শোভনীয় তা সচেতন মানুষের কাছে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এরপর তারা ১৯৭২-এর সংবিধানে ফেরার কথা বলছে, আবার নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের কথাও বলছে। আসলে এসব হচ্ছে জনগণের উপর বিশ্বাসহীনতা এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপতত্পরতা। আর এজন্য তারা পঞ্চম সংশোধনী বাতিলবিষয়ক আদালতের রায় প্রদর্শনের মওকা দেখাচ্ছে। দেখাচ্ছে ’৭২-এর সংবিধান। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত সংবিধানের জন্য জনগণ নয় বরং জনগণের জন্যই সংবিধান। আর এ ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশের বড় বড় রাজনৈতিক সঙ্কটকালীন সময়ে এবং সে সঙ্কট উত্তরণের জন্য সাংবিধানিক বাধা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। আসা যাক ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনের কথায়। সে সময় তিন জোট ও অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, তাদের দাবি মোটেই সংবিধান সম্মত নয়। কিন্তু জনগণের কাছে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতেই হয়েছে। সংবিধানের সুড়ঙ্গপথ তৈরি করে বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মাধ্যমেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালেও কেয়ারটেকার আন্দোলন সংবিধানসম্মত ছিল না; কিন্তু পরবর্তীতে তা স্থায়ী বিধান হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি হয়েছে সংবিধানকে পদদলিত করেই। কেয়ারটেকার সরকারের ২ বছর ক্ষমতায় থাকার কোনো সাংবিধানিক বিধানই ছিল না। আর দেশের পবিত্র সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত ও অপমানিত করেই আওয়ামী-বাকশালীরা দেশময় নৈরাজ্য ও ধ্বংসাত্মক তত্পরতা শুরু করে দেয়। ফলে একটি অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসে। আর এই সংবিধান লঙ্ঘনের মহড়া শুরু করে আওয়ামী লীগই। তাই পঞ্চম সংশোধনী বাতিল বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় এবং ’৭২-এর সংবিধান আওয়ামী দিবাস্বপ্নকে কতখানি বাস্তব রূপদান করবে তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসেনি।
No comments