১৯৭১ সালের মার্চের রাজনীতি by জিবলু রহমান
এ কথা সত্য, ১৯৬৬ সালে ঘোষিত ৬ দফার ভিত্তিতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক আন্দোলনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে আওয়ামী লীগ যেভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিল, তা পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে অর্জন করা কোনো রকমেই সম্ভব ছিল না।
তাই স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এমন এক পর্যায়ে রূপলাভ করে, যেখান থেকে সামনে এগোনোর কোনো সাংবিধানিক পথ ছিল না। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার লক্ষ্যে এক দফা ঘোষণার পর স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন নয়, স্বাধীনতা আন্দোলনেই জনগণ ঝুঁকে পড়ে।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন বসার কথা ছিল, ১ মার্চ তা মুলতবি করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ প্রচারিত হওয়ার পর স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে। ৭ মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ ও কারা প্রশাসনসহ প্রাদেশিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কার্যত নিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। একটি সাংবিধানিক রাজনৈতিক দলের জন্য এটা ছিল এক ব্যতিক্রমী অর্জন। মওলানা ভাসানীও জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন, শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে; কিন্তু আওয়ামী লীগের আন্দোলন সেদিকে অগ্রসর হয়নি কারণ তাদের সেরকম পরিকল্পনা ছিল না। তারা বরং সাংবিধানিক পথে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে; কিন্তু এটা তারা শুরু করে এমন এক পর্যায়ে, যখন সারা দেশ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল এবং আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে রক্ষা করতে জনগণ এক হয়ে দাঁড়িয়ে যেত।
আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নেয়ায় মুজিবের অক্ষমতার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল প্রশাসন, ছাত্র সমাজসহ বিক্ষুব্ধ জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান দ্রুত দুর্বল হতে শুরু করে। বিশেষত ছাত্র সমাজ প্রকাশ্যে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। শেখ মুজিবের সিদ্ধান্তহীনতা ও ছাত্র সমাজের অগ্রসর মনোভাব ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং ভুট্টো লক্ষ্য করতে পেরেছিল। তাই মুজিবকে আলোচনার ফাঁদে ফেলে সময়ক্ষেপণ করা এবং ওই সময়ের মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা তাদের জন্য কঠিন হয়নি। আলোচনা প্রক্রিয়াটি ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সময় যতই যাচ্ছিল ততই আওয়ামী লীগের দরকষাকষির ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছিল আর তাদের ওপর সরকারি আলোচক দলের চাপ বাড়ছিল।
শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের পর মওলানা ভাসানী ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বলেন, “... ১৩ বছর পূর্বে কাগমারী সম্মেলনে আমি ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলেছিলাম, পশ্চিম পাকিস্তানকে বলেছিলাম যে তোমরা তোমাদের শাসনতন্ত্র রচনা কর, আমরা আমাদের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করি। আমি ৭ কোটি বাঙালিকে আজ মোবারকবাদ জানাই এ জন্য যে তারা এই বৃদ্ধের কথা এতদিন পর অনুধাবন করতে পেরেছে। শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে...।” সভায় জাতীয় লীগের প্রধান আতাউর রহমান খানও বক্তব্য প্রদান করেন। সভায় মওলানা ভাসানী ১৪ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তবে বলা হয় যে, ‘প্রয়োজন মতো এই কর্মসূচির সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হবে।’ একই সভায় মওলানা ভাসানী ‘পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র বিলি করেন।
মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার আহ্বান সত্ত্বেও শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপসের চেষ্টায় নিমগ্ন থাকলেন। অপরদিকে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করে ১ থেকে ৩৫টি নির্দেশ তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদের মাধ্যমে দেশের চারদিকে প্রচার করতে থাকেন। ১৪ মার্চ এই ৩৫টি নির্দেশ পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। এদিন ভুট্টো দুই প্রদেশের দুই নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। অথচ পরের দিনই তিনি বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য নয়।’
১৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আগমন করেন। এই বৈঠকের আয়ুকাল ছিল দশ দিন। ১৬ মার্চ থেকে ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে অনুষ্ঠিত পর্যায়ক্রমিক বৈঠকেও শেখ মুজিবুর রহমান তার চার দফা দাবি ও পূর্বশর্ত তুলে ধরেছিলেন। ১৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই মুজিব-ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়ার পক্ষে লে. জেনারেল শরীফুদ্দিন পীরজাদা, বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান বৈঠকে যোগদান করেছিলেন। এসব বৈঠকেও শেখ মুজিবের প্রস্তাব প্রসঙ্গে ইয়াহিয়ার সুরে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার যুক্তি আনা হয়েছিল। জবাবে ড. কামাল হোসেন পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করবেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
ইয়াহিয়া-মুজিবের বৈঠক ১৭ মার্চ এক ঘণ্টা চলে। বৈঠকে শেখ মুজিব অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবির পুনরুল্লেখ করে নতুন এক প্রস্তাবে বলেছিলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে মিলিত হয়ে দু’অঞ্চলের জন্য দুটি সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে এ দুটির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হবে।’ দু’পক্ষের উপদেষ্টাদের বৈঠকে এই তথ্য জানিয়ে জেনারেল পীরজাদা আরও বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে রাজি হয়েছিলেন—যাকে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নতুন সংবিধান গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’ দু’পক্ষের ১৭ মার্চের বৈঠকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া তৈরির আগে উভয় পক্ষের আইন উপদেষ্টারা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে মিলিত হবেন।
১৯ মার্চ এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটব্যাপী উভয় পক্ষের তিনজন উপদেষ্টা নিয়ে পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ইয়াহিয়া-মুজিবের। এ দিন আলোচনায় অগ্রগতি হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। পরদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবকে গতকাল প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে আসার পর খুবই হর্ষোত্ফুল্ল দেখায়।’ ভয়েস অব আমেরিকার খবরেও বলা হয়, ‘২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে উভয়ে আলোচনা করেছেন।’
মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চলাকালে ১৯ মার্চ টঙ্গী ও গাজীপুরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। ২০ মার্চ প্রথমবারের মতো মুজিব ও ইয়াহিয়া দু’জনই উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন ও কামাল হোসেনের সঙ্গে শেখ মুজিবের পক্ষে যোগ দেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী ও এইচএম কামরুজ্জামান। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণায় নিচের তিনটি মৌলিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে—১. সামরিক আইন প্রত্যাহার; ২. জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ৩. পূর্বাঞ্চলীয় অংশের (পূর্ব পাকিস্তান) জন্য ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা (৬ দফার ভিত্তিতে)।
উভয় পক্ষকে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহীর অভিমত নিতে হয়। পরদিনই তিনি এক লিখিত অভিমতে বলেন যে, ‘আওয়ামী লীগের প্রস্তাবানুযায়ী প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ হিসেবে ঘোষণা জারি করলে আইনগত শূন্যতা সৃষ্টি হবে না এবং আইনসম্মতভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে।’
২০ মার্চ আওয়ামী লীগের ছয়জন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে নিয়ে দুই ঘণ্টা দশ মিনিটব্যাপী বৈঠক হওয়ার পর শেখ মুজিব সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘আলোচনা চালু রয়েছে এবং রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আমরা অগ্রসর হচ্ছি।’
২১ মার্চ এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটব্যাপী ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২১ মার্চ ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এই খসড়ায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব ছিল।’ খসড়ার অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়, ‘প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে।’
আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাকে অসম্পূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বিশেষ করে দুটি প্রশ্নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে অভিমত দেয়। বিষয় দুটি ছিল—১. প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি অবিলম্বে প্রচার করতে হবে এবং ২. যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব ঘটতে পারে, সেহেতু দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে প্রদেশগুলোতে নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাত দিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
এদিনই ইয়াহিয়া-মুজিবের আলোচনার আলোকে ভুট্টো পনের সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদলসহ ঢাকায় আগমন করেন এবং আলোচনা পর্বের শেষে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন, ‘যদি কোনো অগ্রগতি না হতো তাহলে আমি কেন আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি?’
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউসে আকস্মিকভাবে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাত্ হয়েছিল। ইয়াহিয়ার মাধ্যমে পরোক্ষ আলোচনায় ভুট্টোকে শেখ মুজিব তার প্রস্তাব মেনে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার প্রশ্নে ভুট্টো বলেছিলেন, ‘তেমন কোনো আয়োজন বা সমঝোতা অনুমোদনের জন্য হলেও প্রথমে জাতীয় পরিষদকে অধিবেশনে বসতে হবে।’
এদিকে ২৫ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দ্বিতীয়বারের মতো স্থগিত ঘোষিত হয়েছিল ২২ মার্চ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা ২২ মার্চ সারাদিন-সারারাত প্রেসিডেন্টের ঘোষণা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন।
২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণার চূড়ান্ত খসড়া প্রতিপক্ষকে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। সেদিনের বৈঠকে ইয়াহিয়ার পক্ষে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে এম এম আহমদ একের পর এক সংশোধনী এনে আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করেছিলেন। উপদেষ্টাদের সান্ধ্য বৈঠকও সমাপ্ত হয়েছিল কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া।
২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নতুন এক প্রস্তাবে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ রাখার কথা বলা হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা এতে তীব্র আপত্তি জানায়। কর্নেলিয়াস বলেন, “কনফেডারেশনের পরিবর্তে ‘ইউনিয়ন অব পাকিস্তান’ রাখা যেতে পারে।”
২৪ মার্চ রাতে আলোচনা ভেঙে যায়। ২৫ মার্চ রাতে আরম্ভ হয় সামরিক হামলা। আক্রমণটি যখন আসে তখন আওয়ামী লীগ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। এরকম অবস্থায় তাদের পক্ষে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব ছিল না। এসব সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকার একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় আর জনগণ সেই যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যা আপনা থেকেই এবং অনিবার্যভাবে জনগণকে যুদ্ধের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। যুদ্ধের শুরুতেই শেখ মুজিব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাদের নেতৃবৃন্দ ও অনুসারীরা যেভাবে পারেন যত দ্রুত সম্ভব দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। আওয়ামী নেতৃবৃন্দের এসব পদক্ষেপ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যকার আলোচনা ভেঙে গেলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া বা যুদ্ধ সংগঠিত করার কোনো পরিকল্পনাই আওয়ামী লীগের ছিল না।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন বসার কথা ছিল, ১ মার্চ তা মুলতবি করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ প্রচারিত হওয়ার পর স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে। ৭ মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ ও কারা প্রশাসনসহ প্রাদেশিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কার্যত নিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। একটি সাংবিধানিক রাজনৈতিক দলের জন্য এটা ছিল এক ব্যতিক্রমী অর্জন। মওলানা ভাসানীও জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন, শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে; কিন্তু আওয়ামী লীগের আন্দোলন সেদিকে অগ্রসর হয়নি কারণ তাদের সেরকম পরিকল্পনা ছিল না। তারা বরং সাংবিধানিক পথে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে; কিন্তু এটা তারা শুরু করে এমন এক পর্যায়ে, যখন সারা দেশ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল এবং আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে রক্ষা করতে জনগণ এক হয়ে দাঁড়িয়ে যেত।
আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নেয়ায় মুজিবের অক্ষমতার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল প্রশাসন, ছাত্র সমাজসহ বিক্ষুব্ধ জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান দ্রুত দুর্বল হতে শুরু করে। বিশেষত ছাত্র সমাজ প্রকাশ্যে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। শেখ মুজিবের সিদ্ধান্তহীনতা ও ছাত্র সমাজের অগ্রসর মনোভাব ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং ভুট্টো লক্ষ্য করতে পেরেছিল। তাই মুজিবকে আলোচনার ফাঁদে ফেলে সময়ক্ষেপণ করা এবং ওই সময়ের মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা তাদের জন্য কঠিন হয়নি। আলোচনা প্রক্রিয়াটি ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সময় যতই যাচ্ছিল ততই আওয়ামী লীগের দরকষাকষির ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছিল আর তাদের ওপর সরকারি আলোচক দলের চাপ বাড়ছিল।
শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের পর মওলানা ভাসানী ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বলেন, “... ১৩ বছর পূর্বে কাগমারী সম্মেলনে আমি ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলেছিলাম, পশ্চিম পাকিস্তানকে বলেছিলাম যে তোমরা তোমাদের শাসনতন্ত্র রচনা কর, আমরা আমাদের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করি। আমি ৭ কোটি বাঙালিকে আজ মোবারকবাদ জানাই এ জন্য যে তারা এই বৃদ্ধের কথা এতদিন পর অনুধাবন করতে পেরেছে। শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে...।” সভায় জাতীয় লীগের প্রধান আতাউর রহমান খানও বক্তব্য প্রদান করেন। সভায় মওলানা ভাসানী ১৪ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তবে বলা হয় যে, ‘প্রয়োজন মতো এই কর্মসূচির সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হবে।’ একই সভায় মওলানা ভাসানী ‘পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র বিলি করেন।
মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার আহ্বান সত্ত্বেও শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপসের চেষ্টায় নিমগ্ন থাকলেন। অপরদিকে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করে ১ থেকে ৩৫টি নির্দেশ তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদের মাধ্যমে দেশের চারদিকে প্রচার করতে থাকেন। ১৪ মার্চ এই ৩৫টি নির্দেশ পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। এদিন ভুট্টো দুই প্রদেশের দুই নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। অথচ পরের দিনই তিনি বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য নয়।’
১৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আগমন করেন। এই বৈঠকের আয়ুকাল ছিল দশ দিন। ১৬ মার্চ থেকে ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে অনুষ্ঠিত পর্যায়ক্রমিক বৈঠকেও শেখ মুজিবুর রহমান তার চার দফা দাবি ও পূর্বশর্ত তুলে ধরেছিলেন। ১৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই মুজিব-ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়ার পক্ষে লে. জেনারেল শরীফুদ্দিন পীরজাদা, বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান বৈঠকে যোগদান করেছিলেন। এসব বৈঠকেও শেখ মুজিবের প্রস্তাব প্রসঙ্গে ইয়াহিয়ার সুরে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার যুক্তি আনা হয়েছিল। জবাবে ড. কামাল হোসেন পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করবেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
ইয়াহিয়া-মুজিবের বৈঠক ১৭ মার্চ এক ঘণ্টা চলে। বৈঠকে শেখ মুজিব অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবির পুনরুল্লেখ করে নতুন এক প্রস্তাবে বলেছিলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে মিলিত হয়ে দু’অঞ্চলের জন্য দুটি সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে এ দুটির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হবে।’ দু’পক্ষের উপদেষ্টাদের বৈঠকে এই তথ্য জানিয়ে জেনারেল পীরজাদা আরও বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে রাজি হয়েছিলেন—যাকে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নতুন সংবিধান গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’ দু’পক্ষের ১৭ মার্চের বৈঠকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া তৈরির আগে উভয় পক্ষের আইন উপদেষ্টারা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে মিলিত হবেন।
১৯ মার্চ এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটব্যাপী উভয় পক্ষের তিনজন উপদেষ্টা নিয়ে পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ইয়াহিয়া-মুজিবের। এ দিন আলোচনায় অগ্রগতি হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। পরদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবকে গতকাল প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে আসার পর খুবই হর্ষোত্ফুল্ল দেখায়।’ ভয়েস অব আমেরিকার খবরেও বলা হয়, ‘২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে উভয়ে আলোচনা করেছেন।’
মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চলাকালে ১৯ মার্চ টঙ্গী ও গাজীপুরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। ২০ মার্চ প্রথমবারের মতো মুজিব ও ইয়াহিয়া দু’জনই উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন ও কামাল হোসেনের সঙ্গে শেখ মুজিবের পক্ষে যোগ দেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী ও এইচএম কামরুজ্জামান। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণায় নিচের তিনটি মৌলিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে—১. সামরিক আইন প্রত্যাহার; ২. জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ৩. পূর্বাঞ্চলীয় অংশের (পূর্ব পাকিস্তান) জন্য ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা (৬ দফার ভিত্তিতে)।
উভয় পক্ষকে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহীর অভিমত নিতে হয়। পরদিনই তিনি এক লিখিত অভিমতে বলেন যে, ‘আওয়ামী লীগের প্রস্তাবানুযায়ী প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ হিসেবে ঘোষণা জারি করলে আইনগত শূন্যতা সৃষ্টি হবে না এবং আইনসম্মতভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে।’
২০ মার্চ আওয়ামী লীগের ছয়জন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে নিয়ে দুই ঘণ্টা দশ মিনিটব্যাপী বৈঠক হওয়ার পর শেখ মুজিব সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘আলোচনা চালু রয়েছে এবং রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আমরা অগ্রসর হচ্ছি।’
২১ মার্চ এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটব্যাপী ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২১ মার্চ ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এই খসড়ায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব ছিল।’ খসড়ার অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়, ‘প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে।’
আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাকে অসম্পূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বিশেষ করে দুটি প্রশ্নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে অভিমত দেয়। বিষয় দুটি ছিল—১. প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি অবিলম্বে প্রচার করতে হবে এবং ২. যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব ঘটতে পারে, সেহেতু দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে প্রদেশগুলোতে নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাত দিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
এদিনই ইয়াহিয়া-মুজিবের আলোচনার আলোকে ভুট্টো পনের সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদলসহ ঢাকায় আগমন করেন এবং আলোচনা পর্বের শেষে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন, ‘যদি কোনো অগ্রগতি না হতো তাহলে আমি কেন আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি?’
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউসে আকস্মিকভাবে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাত্ হয়েছিল। ইয়াহিয়ার মাধ্যমে পরোক্ষ আলোচনায় ভুট্টোকে শেখ মুজিব তার প্রস্তাব মেনে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার প্রশ্নে ভুট্টো বলেছিলেন, ‘তেমন কোনো আয়োজন বা সমঝোতা অনুমোদনের জন্য হলেও প্রথমে জাতীয় পরিষদকে অধিবেশনে বসতে হবে।’
এদিকে ২৫ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দ্বিতীয়বারের মতো স্থগিত ঘোষিত হয়েছিল ২২ মার্চ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা ২২ মার্চ সারাদিন-সারারাত প্রেসিডেন্টের ঘোষণা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন।
২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণার চূড়ান্ত খসড়া প্রতিপক্ষকে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। সেদিনের বৈঠকে ইয়াহিয়ার পক্ষে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে এম এম আহমদ একের পর এক সংশোধনী এনে আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করেছিলেন। উপদেষ্টাদের সান্ধ্য বৈঠকও সমাপ্ত হয়েছিল কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া।
২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নতুন এক প্রস্তাবে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ রাখার কথা বলা হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা এতে তীব্র আপত্তি জানায়। কর্নেলিয়াস বলেন, “কনফেডারেশনের পরিবর্তে ‘ইউনিয়ন অব পাকিস্তান’ রাখা যেতে পারে।”
২৪ মার্চ রাতে আলোচনা ভেঙে যায়। ২৫ মার্চ রাতে আরম্ভ হয় সামরিক হামলা। আক্রমণটি যখন আসে তখন আওয়ামী লীগ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। এরকম অবস্থায় তাদের পক্ষে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব ছিল না। এসব সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকার একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় আর জনগণ সেই যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যা আপনা থেকেই এবং অনিবার্যভাবে জনগণকে যুদ্ধের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। যুদ্ধের শুরুতেই শেখ মুজিব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাদের নেতৃবৃন্দ ও অনুসারীরা যেভাবে পারেন যত দ্রুত সম্ভব দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। আওয়ামী নেতৃবৃন্দের এসব পদক্ষেপ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যকার আলোচনা ভেঙে গেলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া বা যুদ্ধ সংগঠিত করার কোনো পরিকল্পনাই আওয়ামী লীগের ছিল না।
No comments