নববর্ষ-বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া by আনিসুল হক
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বৈশাখ এলে আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে। আমাদের রংপুর শহরের উপকণ্ঠে চড়কের মেলা বসত চৈত্রসংক্রান্তির দিনে। তাতে প্রধান আকর্ষণ ছিল ঘুড়ি। নানা বর্ণের ঘুড়ি যে শুধু মেলায় উঠত,
বৈশাখ এলে আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে। আমাদের রংপুর শহরের উপকণ্ঠে চড়কের মেলা বসত চৈত্রসংক্রান্তির দিনে। তাতে প্রধান আকর্ষণ ছিল ঘুড়ি। নানা বর্ণের ঘুড়ি যে শুধু মেলায় উঠত,
তা-ই নয়, ঘুড়ির কাটাকাটি খেলার প্রতিযোগিতাও হতো প্রতিটি চৈত্রসংক্রান্তিতে। মেলার আগে আগে আমাদের পাড়ায় ঘুড়ির সুতোয় মাঁজা দেওয়ার ধুম পড়ে যেত। কাচ গুঁড়ো করে মাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে সুতোয় মেখে মাঠের মধ্যে টানা দিয়ে রোদে শুকানো হতো। তারপর চড়কের মেলার দিন মেলার আকাশে কত যে ঘুড়ি। আগে-পরে সমস্ত শহরের আকাশেই ঘুড়ি আর ঘুড়ি। তখন মাঠ-ঘাট ছিল প্রচুর, শহরের মধ্যেই ধানখেত ছিল। ভোকাট্টা হয়ে যাওয়া ঘুড়ির পেছনে ধানখেত, পুকুর, নালা-নর্দমা পেরিয়ে নিজেই কত ছুটেছি। কিন্তু চড়কের মেলায় যে পিঠে আংটা বিঁধে মানুষকে শূন্যে ঘোরানো হয়, ওই ভয়ংকর দৃশ্য কখনো দেখিনি, এর কথা জানতামই না। আর আমাদের গ্রামের বাড়িতে বিখ্যাত ছিল বারুণীর মেলা। একবার সেই মেলায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম। তখন নিতান্তই বালক। হাঁটছি হাঁটছি, হাঁটার শেষ নেই, বোধ হয় মাইল বিশেক হাঁটার পর পৌঁছানো গেল মেলাস্থলে। অনেক তরমুজ আর রসুন দেখেছিলাম মেলায়, সেটা মনে পড়ে। গরুগাড়িগুলো একটা বৃত্তের গায়ে একটা সরলরেখার মতো কাত হয়ে আছে মাটিতে, গরুগুলো চাকার সঙ্গে বাঁধা। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে পিঁপড়ের সারির মতো, আর মেলা প্রাঙ্গণ থেকে ভেসে আসছে মানুষের গমগম আওয়াজ। আমাদের গ্রামের বাড়িতে এই মেলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রসুন সব গোছগাছ করা হচ্ছে, রসুনের সাদা খোসায় ঘর ভরে গেছে, উঠোনেও রসুনের খোসা উড়ছে, এই দৃশ্যটা মনে পড়ে। মেলার উপলক্ষ আদিতে ছিল ধর্মীয় পার্বণ, কিন্তু সব মেলার একটা বাস্তবিক প্রয়োজনও থাকে, তা হলো গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করা। কামার, কুমোর, তাঁতি, চাষা—সবাই সারাটা বছর অপেক্ষা করে মেলার দিনটার জন্য, যার যার মতো করে পণ্য প্রস্তুত করে দিনরাত খেটে, খেলনা, পুতুল, বাঁশ, বেত, পোড়ামাটির সামগ্রী, চুড়ি, ফিতা, মিষ্টি, মণ্ডা, মিঠাই থেকে শুরু করে ওই তরমুজ কিংবা রসুন। সবাই যার যার পণ্য নিয়ে ছুটল মেলায়। বিকিকিনি দুটোই চলল। কৃষক তার কৃষিপণ্য বেচে হয়তো শিল্পপণ্য কিনল কিছু। তারপর বাড়তি টাকা দিয়ে জিলেপি বা রসগোল্লা খেয়ে ঠোঙা ভরে নিয়ে চলল বাড়ির জন্য। কেউ বা বসে গেল জুয়ার আসরে, বাবার হাত থেকে ফসকে ছেলে হাঁ করে তাকিয়ে আছে পুতুলনাচের প্যান্ডেলের দিকে। এ রকমই কোনো বাবা ছেলের নাম ভুলে গিয়ে হাঁক পাড়ছিলেন, আমি কার বাবা, আমি কার বাবা! মেলা থেকে ফেরার সময় প্রত্যেকেই খানিকটা রং নিয়ে ফেরে, হাতে অবশ্যই থাকবে রঙিন ঘূর্ণি, লাটিম, পুতুল, চুড়ি-শাড়ি, টমটম, বাঁশি, হাতপাখা, হাওয়াই মিঠাই—যা-ই আসুক না কেন, সেসবের একটা অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো রং। তীব্র ম্যাজেন্টা, চোখ পোড়ানো হলুদ।
সেই রংটাই যেন আজ দেখতে পাই ঢাকা শহরের পয়লা বৈশাখে। নববর্ষ বাংলার গ্রামগঞ্জে, শহর-বন্দরে চিরটা কালই ছিল হালখাতার উৎসব। ব্যবসায়ীরা তাঁদের বাকিবকেয়া আদায় করার জন্য দেনাদারদের নিমন্ত্রণ করে আনেন নিজ ব্যবসাস্থলে, মিষ্টিমুখ করিয়ে বাকিটা আদায় করে নেন। পাকিস্তান আমলে যখন আক্রমণ এল শাড়ি কিংবা টিপ, রবীন্দ্রসংগীত তথা বাঙালির সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলোর ওপর, তখন বিপুল বিক্রমে জেগে উঠল আমাদের নাগরিকেরা, ছায়ানট বর্ষবরণের আসর বসাল রমনায়, সেটা আস্তে আস্তে হয়ে উঠল আমাদের অন্যতম প্রধান উৎসব। ঢাকায় বৈশাখী মেলাও বসতে লাগল। তারপর, আশির দশকের শেষে গণ-আন্দোলনের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে চারুকলা থেকে বেরোতে লাগল আনন্দ শোভাযাত্রা। এটা নাকি প্রথম হয় যশোরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় চলছিল ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’, ঢাকা-পড়ুয়া যশোরের ছেলেরা বসে থেকে কী করবে, আচ্ছা পয়লা বৈশাখটাই একটু বর্ণাঢ্য করে পালন করা যাক। এইভাবে তারা শুরু করেছিল। তারপর শুরু হলো ঢাকায়। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর বড় করে হলো ডিসেম্বরের বিজয় উৎসব, আরও বড় করে হলো নববর্ষের রংদার শোভাযাত্রা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার চত্বর থেকে। ওই শোভাযাত্রায় তখন যোগ দিতাম, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে যে লাফালাফিটা করতাম ঢোলের বাড়ির সঙ্গে, তার বর্ণনা করার জন্য অভিধানে একটা শব্দ আছে—তাণ্ডব।
এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আমাদের দেশি ফ্যাশন হাউসগুলো। ভাবতেই ভালো লাগে, প্রতিটা উৎসবের জন্য তারা একটা করে রংও নির্বাচন করে দিতে পেরেছে। ফাল্গুনের উৎসবে বাসন্তী রং, যেন পৃথিবীর সব গাঁদা ফুটেছে বাংলার প্রতিটি জনপদে। একুশে ফেব্রুয়ারির রং সাদা আর কালো। বর্ষায় নীলাম্বরি। আর বৈশাখে? লাল আর সাদা! কে কবে এই রংগুলো নির্বাচন করে দিল, কে জানে, কিন্তু দাঁড়িয়ে গেছে।
আজ পয়লা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর একটা। চৈত্রের শেষ দিনগুলোয় দোকানে এমন ভিড় লেগে যায় যে ব্যবসায়ীদের মুখের হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হয়। কাপড়-চোপড়, গয়নাগাটি, মিষ্টিমিঠাই থেকে শুরু করে ইলিশ মাছ পর্যন্ত সব বিকোচ্ছে দেদার! আর ছুটির দিন পেয়ে লাল-সাদা পাঞ্জাবি পরে ছেলেরা, শাড়ি পরে মেয়েরা, এমনকি আমাদের গার্মেন্টসের কর্মীরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ছে, ঘুরছে রাস্তায়, পার্কে, মেলায়! কিছুই করার নেই, শুধু হাঁটা, তাতেই আনন্দ! তাদের গালে রঙিন আল্পনা, তাদের খোঁপায় ফুলের মালা, দেখে আমার দুই চোখে আনন্দে জল চিকচিক করে! আহা! একটা দিন আমরা দিতে পেরেছি এদের, একটা মাত্র দিন, যেদিন সবাই সমান।
আমাদের বিশাল বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের কাছে বাংলা পঞ্জিকা নিত্যদিনের বাস্তবতা! কবে বীজ বুনতে হবে, কবে ধান কাটা হবে—সবই হয় বাংলা পঞ্জিকা ধরে। আমাদের কৃষকেরা হয়তো আজকেও পান্তায় ইলিশ খাবে না, তাদের পান্তায় কোনো দিনও ইলিশ থাকে না, থাকে একদলা নুন, শুকনো মরিচপোড়া, কিন্তু সকালে তারা পান্তাটা খায়ই। পান্তা খাওয়াটা সহজ বলে। পান্তাটাই কেবল নুন-মরিচ দিয়ে খাওয়া যায়, গরম ভাত খেতে হলে একটু তরকারি লাগে যে! কত যে ভোরবেলা তারা ওঠে ঘুম থেকে, লাঙল কাঁধে খেতে যায়, ১০টা-১১টার সময় পান্তাবেল, মানে পান্তার ব্রেক, রাতেই ভাতে পানি দিয়ে রাখা হয়েছিল, এতক্ষণে সেটা ফারমেন্টেশনের ধাপ পেরিয়ে বড় সুস্বাদু হয়ে উঠেছে। তবুও আমাদের নাগরিকেরা যে শখের পান্তা খায় বছরে একটা দিন, তারও একটা ভালো দিক, ইতিবাচকতা আছে। মানুষ চিরটা কাল তার উৎস, তার শেকড় সন্ধান করেছে। তার জীবন-যাপনের আদি চিহ্নগুলো, বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করেছে, পুনরাবিষ্কার করেছে, উদ্যাপন করেছে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যৎবের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেই দিন। যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না—যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখ-দুঃখের দ্বারা ক্ষুব্ধ করি, সেদিন না...প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহত্, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহত্, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যৎবের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’
আজ আমাদের সেই মেলার আর মেলানোর দিন। মেলা কথাটার মধ্যেই যে মিলের কথা আছে, মিলনের কথা আছে। আজ আমরা মিলব আর মেলাব। আজ আমরা একা আর ক্ষুদ্র নই, সবার সঙ্গে মিলিত হয়ে আমরা বিরাট।
আজ সমস্ত বাঙালি, সমস্ত আদিবাসী, সবাই মিলেছি উৎসবে, আমাদের নিজস্ব এক উৎসবে, আমাদের ফসলি সনের প্রথম দিনটার উৎসবে, সম্রাট আকবরের আমল থেকে যে সনটা বহু প্রাচীন পঞ্জিকার সঙ্গে সমন্বিত হয়ে প্রচলিত হলো! আজ মনুষ্যৎবের সামগ্রিকতার শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করার দিন।
আজ সারা বাংলাদেশের পথে পথে বেরিয়ে পড়া উদ্দাম তারুণ্যের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বুকটা ভরে ওঠে, আমরা আরেকবার এ জাতির মহত্ত্ব আর মাহাত্ম্য নিয়ে আশ্বস্ত বোধ করতে পারি—এই সপ্রাণ স্বতঃস্ফূর্ত জাতির আত্মাকে কে রুখতে পারবে? বাঙালি অজেয়, বাংলাদেশ চির অপরাজেয়।
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
সেই রংটাই যেন আজ দেখতে পাই ঢাকা শহরের পয়লা বৈশাখে। নববর্ষ বাংলার গ্রামগঞ্জে, শহর-বন্দরে চিরটা কালই ছিল হালখাতার উৎসব। ব্যবসায়ীরা তাঁদের বাকিবকেয়া আদায় করার জন্য দেনাদারদের নিমন্ত্রণ করে আনেন নিজ ব্যবসাস্থলে, মিষ্টিমুখ করিয়ে বাকিটা আদায় করে নেন। পাকিস্তান আমলে যখন আক্রমণ এল শাড়ি কিংবা টিপ, রবীন্দ্রসংগীত তথা বাঙালির সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলোর ওপর, তখন বিপুল বিক্রমে জেগে উঠল আমাদের নাগরিকেরা, ছায়ানট বর্ষবরণের আসর বসাল রমনায়, সেটা আস্তে আস্তে হয়ে উঠল আমাদের অন্যতম প্রধান উৎসব। ঢাকায় বৈশাখী মেলাও বসতে লাগল। তারপর, আশির দশকের শেষে গণ-আন্দোলনের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে চারুকলা থেকে বেরোতে লাগল আনন্দ শোভাযাত্রা। এটা নাকি প্রথম হয় যশোরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় চলছিল ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’, ঢাকা-পড়ুয়া যশোরের ছেলেরা বসে থেকে কী করবে, আচ্ছা পয়লা বৈশাখটাই একটু বর্ণাঢ্য করে পালন করা যাক। এইভাবে তারা শুরু করেছিল। তারপর শুরু হলো ঢাকায়। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর বড় করে হলো ডিসেম্বরের বিজয় উৎসব, আরও বড় করে হলো নববর্ষের রংদার শোভাযাত্রা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার চত্বর থেকে। ওই শোভাযাত্রায় তখন যোগ দিতাম, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে যে লাফালাফিটা করতাম ঢোলের বাড়ির সঙ্গে, তার বর্ণনা করার জন্য অভিধানে একটা শব্দ আছে—তাণ্ডব।
এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আমাদের দেশি ফ্যাশন হাউসগুলো। ভাবতেই ভালো লাগে, প্রতিটা উৎসবের জন্য তারা একটা করে রংও নির্বাচন করে দিতে পেরেছে। ফাল্গুনের উৎসবে বাসন্তী রং, যেন পৃথিবীর সব গাঁদা ফুটেছে বাংলার প্রতিটি জনপদে। একুশে ফেব্রুয়ারির রং সাদা আর কালো। বর্ষায় নীলাম্বরি। আর বৈশাখে? লাল আর সাদা! কে কবে এই রংগুলো নির্বাচন করে দিল, কে জানে, কিন্তু দাঁড়িয়ে গেছে।
আজ পয়লা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর একটা। চৈত্রের শেষ দিনগুলোয় দোকানে এমন ভিড় লেগে যায় যে ব্যবসায়ীদের মুখের হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হয়। কাপড়-চোপড়, গয়নাগাটি, মিষ্টিমিঠাই থেকে শুরু করে ইলিশ মাছ পর্যন্ত সব বিকোচ্ছে দেদার! আর ছুটির দিন পেয়ে লাল-সাদা পাঞ্জাবি পরে ছেলেরা, শাড়ি পরে মেয়েরা, এমনকি আমাদের গার্মেন্টসের কর্মীরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ছে, ঘুরছে রাস্তায়, পার্কে, মেলায়! কিছুই করার নেই, শুধু হাঁটা, তাতেই আনন্দ! তাদের গালে রঙিন আল্পনা, তাদের খোঁপায় ফুলের মালা, দেখে আমার দুই চোখে আনন্দে জল চিকচিক করে! আহা! একটা দিন আমরা দিতে পেরেছি এদের, একটা মাত্র দিন, যেদিন সবাই সমান।
আমাদের বিশাল বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের কাছে বাংলা পঞ্জিকা নিত্যদিনের বাস্তবতা! কবে বীজ বুনতে হবে, কবে ধান কাটা হবে—সবই হয় বাংলা পঞ্জিকা ধরে। আমাদের কৃষকেরা হয়তো আজকেও পান্তায় ইলিশ খাবে না, তাদের পান্তায় কোনো দিনও ইলিশ থাকে না, থাকে একদলা নুন, শুকনো মরিচপোড়া, কিন্তু সকালে তারা পান্তাটা খায়ই। পান্তা খাওয়াটা সহজ বলে। পান্তাটাই কেবল নুন-মরিচ দিয়ে খাওয়া যায়, গরম ভাত খেতে হলে একটু তরকারি লাগে যে! কত যে ভোরবেলা তারা ওঠে ঘুম থেকে, লাঙল কাঁধে খেতে যায়, ১০টা-১১টার সময় পান্তাবেল, মানে পান্তার ব্রেক, রাতেই ভাতে পানি দিয়ে রাখা হয়েছিল, এতক্ষণে সেটা ফারমেন্টেশনের ধাপ পেরিয়ে বড় সুস্বাদু হয়ে উঠেছে। তবুও আমাদের নাগরিকেরা যে শখের পান্তা খায় বছরে একটা দিন, তারও একটা ভালো দিক, ইতিবাচকতা আছে। মানুষ চিরটা কাল তার উৎস, তার শেকড় সন্ধান করেছে। তার জীবন-যাপনের আদি চিহ্নগুলো, বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করেছে, পুনরাবিষ্কার করেছে, উদ্যাপন করেছে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যৎবের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেই দিন। যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না—যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখ-দুঃখের দ্বারা ক্ষুব্ধ করি, সেদিন না...প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহত্, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহত্, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যৎবের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’
আজ আমাদের সেই মেলার আর মেলানোর দিন। মেলা কথাটার মধ্যেই যে মিলের কথা আছে, মিলনের কথা আছে। আজ আমরা মিলব আর মেলাব। আজ আমরা একা আর ক্ষুদ্র নই, সবার সঙ্গে মিলিত হয়ে আমরা বিরাট।
আজ সমস্ত বাঙালি, সমস্ত আদিবাসী, সবাই মিলেছি উৎসবে, আমাদের নিজস্ব এক উৎসবে, আমাদের ফসলি সনের প্রথম দিনটার উৎসবে, সম্রাট আকবরের আমল থেকে যে সনটা বহু প্রাচীন পঞ্জিকার সঙ্গে সমন্বিত হয়ে প্রচলিত হলো! আজ মনুষ্যৎবের সামগ্রিকতার শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করার দিন।
আজ সারা বাংলাদেশের পথে পথে বেরিয়ে পড়া উদ্দাম তারুণ্যের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বুকটা ভরে ওঠে, আমরা আরেকবার এ জাতির মহত্ত্ব আর মাহাত্ম্য নিয়ে আশ্বস্ত বোধ করতে পারি—এই সপ্রাণ স্বতঃস্ফূর্ত জাতির আত্মাকে কে রুখতে পারবে? বাঙালি অজেয়, বাংলাদেশ চির অপরাজেয়।
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments