সমকালীন প্রসঙ্গ-প্রশাসনিক বিষয়ে হাইকোর্টের ঘনঘন রায় কোন পরিণাম নির্দেশ করছে? by বদরুদ্দীন উমর
মানুষের মূল্যবোধ, অন্যের প্রতি বিবেচনা, সাধারণ আইন-কানুন মান্য করে চলা ইত্যাদি এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে সর্বক্ষেত্রে বেপরোয়া অপরাধমূলক তৎপরতা বন্ধ করা হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে হবে এমন মনে করা সম্পূর্ণ অবাস্তব ব্যাপার। যেখানে অপরাধ সকল প্রকার প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের চোখের ওপর হচ্ছে তাদের
ঔদাসীন্যে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতার কারণে হচ্ছে, সেখানে এ অবস্থার পরিবর্তন যে সহজে সম্ভব নয় তাই নয়, কোনো গুরুতর সমাজ পরিবর্তন ছাড়া যে এ কাজ সম্ভব নয় এমনটাই মনে হয়
কুয়াকাটা সৈকতের সব স্থাপনা সাত দিনের মধ্যে সরাতে হবে, এই মর্মে এক নির্দেশ জারি করেছেন হাইকোর্ট (কালের কণ্ঠ ৩-৬-২০১১)। এ আদেশ কার্যকর করে সাত দিনের মধ্যে আদালতে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার ও কলাপাড়া থানার ওসিকে। সেই সঙ্গে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের সীমানা চিহ্নিত করার জন্য কমিটি গঠন করতেও জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনের পরই তারা এ নির্দেশ জারি করেন। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের জমি দখল বন্ধ ও ভবিষ্যতে সৈকত এলাকায় স্থায়ী-অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করার জন্য কেন ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না, এটা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট পৃথক দুটি রুলও জারি করেছেন। পরিকল্পনা, পরিবেশ, ভূমি, অর্থ, স্থানীয় সরকার ও পানিসম্পদ সচিব, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক, পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, কলাপাড়া থানার ওসি এবং কলাপাড়ার সহকারী ভূমি কমিশনারকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ওই এলাকায় যে কোনো ধরনের দখল ও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের জন্য পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপার ও কলাপাড়া থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (ঐ)
এত বিস্তারিতভাবে হাইকোর্টের উপরোক্ত রায় ও নির্দেশের বিবরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে, হাইকোর্ট এভাবে নির্দেশ জারি করে যেসব কাজ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে করতে বলেছেন সে কাজগুলো করা প্রশাসনেরই নিয়মিত দায়িত্ব। এ কাজগুলো বিদ্যমান প্রশাসন না করার কারণেই রিট করার প্রয়োজন হয়েছে এবং হাইকোর্ট রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের উপরোক্ত নানা নির্দেশ জারি করেছেন! এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, এ ধরনের রিট ও হাইকোর্টের নির্দেশ এটাই প্রথম বা কোনো ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে দেখা যায়, কোনো না কোনো বিষয়ে হাইকোর্টে রিট এবং রিটের পর হাইকোর্টের একই ধরনের নির্দেশ। নদী-খাল-বিলসহ বিভিন্ন ধরনের জলাভূমি দখল, সরকারি জমি দখল, বনভূমি উজাড়, বন্যপ্রাণী নিধন, শিল্প-কারখানা থেকে বর্জ্য পদার্থ নদী, লেক ইত্যাদিতে নিক্ষেপ, অন্যান্য উপায়ে পরিবেশ দূষিতকরণ ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে হাইকোর্টকে প্রায়ই নির্দেশ জারি করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর থেকে শাসক শ্রেণীর দ্বারা যেভাবে এখানে লুটপাট চলে আসছে ও ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে সব থেকে বড় আক্রমণ হচ্ছে সরকারি বা জনগণের সাধারণ সম্পত্তির ওপর। চুরি-জোচ্চুরি, লুটপাট সব দেশেই অল্পবিস্তর আছে, তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অবস্থা কোনো দেশে আছে বলে জানা নেই। কারণ এখানে শুধু রেলের জমির মতো সরকারি সম্পত্তিই নয়, নদী, লেক এবং সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত অপরাধীদের দ্বারা দখল হচ্ছে এবং এমনভাবে এটা হচ্ছে, যাতে মনে হয়, এ দেশে সরকার ও প্রশাসন বলে কিছু নেই, সরকারি সম্পত্তি লুণ্ঠিত হতে থাকলেও সরকার এগুলো বন্ধ করার মতো অবস্থায় নেই অথবা তাদের সে শক্তি নেই!
যে রায়ের উল্লেখ ওপরে করা হয়েছে সে ধরনের রায় হাইকোর্ট যে প্রায়ই দিয়ে থাকেন, এটা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু হাইকোর্ট এসব রায় দেওয়ার পর সেগুলো যে কার্যকর হয়েছে এমন বলা যাবে না। ঢাকার পার্শ্ববর্তী চারটি নদী যেভাবে দখল ও দূষিত হচ্ছে তা বন্ধ করার জন্য হাইকোর্ট অনেক রায় ইতিপূর্বে দিয়েছেন। দেখা যাবে যে, এসব রায় দেওয়ার পর কোনো কোনো সময় তা শিথিলভাবে কার্যকর করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তাকে বিশেষ আমলেই নেন না এবং হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশ সত্ত্বেও পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে। তাছাড়া রায় অনুযায়ী একবার নদী দখলমুক্ত করার কয়েকদিন পরই আবার দখলকারীরা ফিরে এসে নিজেদের দখল কায়েম করে! শুধু নদীর ক্ষেত্রেই নয়, সব ক্ষেত্রেই হাইকোর্টের রায়ের এ অবস্থা! তা সত্ত্বেও লোকে নানা অপরাধমূলক কাজের বিরুদ্ধে রিট করছে এবং হাইকোর্ট রায় দিয়েও যাচ্ছেন।
এর মধ্য দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে তা হলো, সরকার ও প্রশাসন নিজেদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করছে না এবং লোকে বেপরোয়াভাবে দুর্বৃত্তগিরি করে শুধু অন্য লোকের নয়, জনগণ ও সরকারের সম্পত্তিও নিজেদের দখলভুক্ত করছে। বাংলাদেশে এখন যেভাবে লুটপাট চলছে তার শুরু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে হলেও এখন তা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যাকে শুধু ভয়াবহ বললেও বিশেষ কিছু বলা হয় না। এ এক ধ্বংসাত্মক ব্যাপার। মানুষের মূল্যবোধ, অন্যের প্রতি বিবেচনা, সাধারণ আইন-কানুন মান্য করে চলা ইত্যাদি এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে সর্বক্ষেত্রে বেপরোয়া অপরাধমূলক তৎপরতা বন্ধ করা হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে হবে এমন মনে করা সম্পূর্ণ অবাস্তব ব্যাপার। যেখানে অপরাধ সকল প্রকার প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের চোখের ওপর হচ্ছে তাদের ঔদাসীন্যে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতার কারণে হচ্ছে, সেখানে এ অবস্থার পরিবর্তন যে সহজে সম্ভব নয় তাই নয়, কোনো গুরুতর সমাজ পরিবর্তন ছাড়া যে এ কাজ সম্ভব নয় এমনটাই মনে হয়।
একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, হাইকোর্ট কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকত লুটপাটকারীদের দখল থেকে রক্ষার জন্য যেভাবে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন, এটা এক অস্বাভাবিক ব্যাপার। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, এ নির্দেশের মাধ্যমে হাইকোর্ট শুধু যে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া এবং ভবিষ্যৎ অপরাধ প্রতিরোধের কথাই বলছেন তাই নয়। এর মাধ্যমে তারা বিদ্যমান প্রশাসনের আকাশচুম্বী, গাফিলতির দিকে আঙুল দেখিয়ে তাদেরও অভিযুক্ত করছেন।
বাংলাদেশে এখন চারদিকে, সর্বক্ষেত্রে, নৈরাজ্য রীতিমতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং তা দিন দিন আরও ছড়িয়ে পড়ে সর্বগ্রাসী হচ্ছে। এ ভয়াবহ অবস্থার সব থেকে উল্লেখযোগ্য ও মারাত্মক দিক হচ্ছে এই যে, এটা সৃষ্টিতে সরকারের বিভিন্ন সংগঠিত সংস্থা, উচ্চতম থেকে মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের সরকারি ব্যক্তিরা, শাসকশ্রেণীর প্রধান দুই দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সক্রিয় এজেন্টের ভূমিকা পালন করছে। যে দেশে প্রশাসন ও পুলিশ কর্তৃপক্ষকে তাদের দায়িত্বে অবহেলা না করে পালন করার জন্য হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টকে নিয়মিতভাবে ও ঘনঘন নির্দেশ জারি করতে হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেসব নির্দেশ কার্যকর হয় না, সে দেশ যে মহাবিপদের কার্নিশে এসে দাঁড়িয়েছে এটা বোঝা কঠিন নয়। এ জন্য বাংলাদেশে এখন যে প্রশ্ন সবার মুখে মুখে তা হলো : কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে? যা হতে যাচ্ছে তার পূর্ণ চিত্র এখন দেশের জনগণের সামনে না থাকলেও এটা বোঝার অসুবিধা নেই যে, এর ফলে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের জীবনযাত্রার ওপর বিভিন্ন নৈরাজ্যিক শক্তির হামলা এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা নৈরাজ্যের এ দেশেও এখন লোকের পক্ষে পুরোপুরি আন্দাজ করা সম্ভব নয়।
সমাজের এই নিদারুণ ভাঙনের গতিরোধ করা বিদ্যমান শাসকশ্রেণী ও তাদের কোনো রাজনৈতিক দল অথবা অন্য কোনো ধরনের সংগঠিত শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য এমন শক্তির প্রয়োজন, যার মূল জনগণের মধ্যে প্রোথিত থাকবে, যে শক্তি নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দলীয় স্বার্থের জন্য দেশ ও সমাজ ধ্বংস করে জনগণের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টির পরিবর্তে তাদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা বিধান করবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু থেকে অন্য যেসব ইস্যু নিয়ে শাসকশ্রেণীর দুই প্রধান দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলছে তাকে জনস্বার্থের দিক থেকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, নিষ্ফল ও হাস্যকর বলা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু শুধু এই ইস্যুই নয়, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যেসব ইস্যু নিয়ে এ দুই দল ও তাদের জোট চিৎকার ও নাচানাচি করে, বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়, মারধর করে, হরতাল দেয় তার কোনোটির সঙ্গেই জনস্বার্থের বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু তাই নয়, এগুলো সবই জনস্বার্থবিরোধী। এ পরিস্থিতিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের যে চেহারা ও কার্যকলাপ আমরা দেখি তাকে ভূতের নাচ বলাই সঙ্গত। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্র বলে অনেক আগে যদি কিছু থেকেও থাকে তাহলে তার মৃত্যু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম রাখা-না রাখা ইত্যাদি বিষয় একেবারে ভুয়া ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ভুয়া কারবার যেখানে শাসকশ্রেণীর আশ্রয় ও অবলম্বন সেখানে শাসকশ্রেণীর উচ্ছেদের শর্ত দ্রুত পরিপকস্ফ হচ্ছে। এর পরিণাম দর্শন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
৬.৬.২০১১
কুয়াকাটা সৈকতের সব স্থাপনা সাত দিনের মধ্যে সরাতে হবে, এই মর্মে এক নির্দেশ জারি করেছেন হাইকোর্ট (কালের কণ্ঠ ৩-৬-২০১১)। এ আদেশ কার্যকর করে সাত দিনের মধ্যে আদালতে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার ও কলাপাড়া থানার ওসিকে। সেই সঙ্গে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের সীমানা চিহ্নিত করার জন্য কমিটি গঠন করতেও জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনের পরই তারা এ নির্দেশ জারি করেন। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের জমি দখল বন্ধ ও ভবিষ্যতে সৈকত এলাকায় স্থায়ী-অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করার জন্য কেন ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না, এটা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট পৃথক দুটি রুলও জারি করেছেন। পরিকল্পনা, পরিবেশ, ভূমি, অর্থ, স্থানীয় সরকার ও পানিসম্পদ সচিব, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক, পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, কলাপাড়া থানার ওসি এবং কলাপাড়ার সহকারী ভূমি কমিশনারকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ওই এলাকায় যে কোনো ধরনের দখল ও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের জন্য পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপার ও কলাপাড়া থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (ঐ)
এত বিস্তারিতভাবে হাইকোর্টের উপরোক্ত রায় ও নির্দেশের বিবরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে, হাইকোর্ট এভাবে নির্দেশ জারি করে যেসব কাজ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে করতে বলেছেন সে কাজগুলো করা প্রশাসনেরই নিয়মিত দায়িত্ব। এ কাজগুলো বিদ্যমান প্রশাসন না করার কারণেই রিট করার প্রয়োজন হয়েছে এবং হাইকোর্ট রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের উপরোক্ত নানা নির্দেশ জারি করেছেন! এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, এ ধরনের রিট ও হাইকোর্টের নির্দেশ এটাই প্রথম বা কোনো ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে দেখা যায়, কোনো না কোনো বিষয়ে হাইকোর্টে রিট এবং রিটের পর হাইকোর্টের একই ধরনের নির্দেশ। নদী-খাল-বিলসহ বিভিন্ন ধরনের জলাভূমি দখল, সরকারি জমি দখল, বনভূমি উজাড়, বন্যপ্রাণী নিধন, শিল্প-কারখানা থেকে বর্জ্য পদার্থ নদী, লেক ইত্যাদিতে নিক্ষেপ, অন্যান্য উপায়ে পরিবেশ দূষিতকরণ ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে হাইকোর্টকে প্রায়ই নির্দেশ জারি করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর থেকে শাসক শ্রেণীর দ্বারা যেভাবে এখানে লুটপাট চলে আসছে ও ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে সব থেকে বড় আক্রমণ হচ্ছে সরকারি বা জনগণের সাধারণ সম্পত্তির ওপর। চুরি-জোচ্চুরি, লুটপাট সব দেশেই অল্পবিস্তর আছে, তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অবস্থা কোনো দেশে আছে বলে জানা নেই। কারণ এখানে শুধু রেলের জমির মতো সরকারি সম্পত্তিই নয়, নদী, লেক এবং সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত অপরাধীদের দ্বারা দখল হচ্ছে এবং এমনভাবে এটা হচ্ছে, যাতে মনে হয়, এ দেশে সরকার ও প্রশাসন বলে কিছু নেই, সরকারি সম্পত্তি লুণ্ঠিত হতে থাকলেও সরকার এগুলো বন্ধ করার মতো অবস্থায় নেই অথবা তাদের সে শক্তি নেই!
যে রায়ের উল্লেখ ওপরে করা হয়েছে সে ধরনের রায় হাইকোর্ট যে প্রায়ই দিয়ে থাকেন, এটা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু হাইকোর্ট এসব রায় দেওয়ার পর সেগুলো যে কার্যকর হয়েছে এমন বলা যাবে না। ঢাকার পার্শ্ববর্তী চারটি নদী যেভাবে দখল ও দূষিত হচ্ছে তা বন্ধ করার জন্য হাইকোর্ট অনেক রায় ইতিপূর্বে দিয়েছেন। দেখা যাবে যে, এসব রায় দেওয়ার পর কোনো কোনো সময় তা শিথিলভাবে কার্যকর করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তাকে বিশেষ আমলেই নেন না এবং হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশ সত্ত্বেও পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে। তাছাড়া রায় অনুযায়ী একবার নদী দখলমুক্ত করার কয়েকদিন পরই আবার দখলকারীরা ফিরে এসে নিজেদের দখল কায়েম করে! শুধু নদীর ক্ষেত্রেই নয়, সব ক্ষেত্রেই হাইকোর্টের রায়ের এ অবস্থা! তা সত্ত্বেও লোকে নানা অপরাধমূলক কাজের বিরুদ্ধে রিট করছে এবং হাইকোর্ট রায় দিয়েও যাচ্ছেন।
এর মধ্য দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে তা হলো, সরকার ও প্রশাসন নিজেদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করছে না এবং লোকে বেপরোয়াভাবে দুর্বৃত্তগিরি করে শুধু অন্য লোকের নয়, জনগণ ও সরকারের সম্পত্তিও নিজেদের দখলভুক্ত করছে। বাংলাদেশে এখন যেভাবে লুটপাট চলছে তার শুরু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে হলেও এখন তা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যাকে শুধু ভয়াবহ বললেও বিশেষ কিছু বলা হয় না। এ এক ধ্বংসাত্মক ব্যাপার। মানুষের মূল্যবোধ, অন্যের প্রতি বিবেচনা, সাধারণ আইন-কানুন মান্য করে চলা ইত্যাদি এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে সর্বক্ষেত্রে বেপরোয়া অপরাধমূলক তৎপরতা বন্ধ করা হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে হবে এমন মনে করা সম্পূর্ণ অবাস্তব ব্যাপার। যেখানে অপরাধ সকল প্রকার প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের চোখের ওপর হচ্ছে তাদের ঔদাসীন্যে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতার কারণে হচ্ছে, সেখানে এ অবস্থার পরিবর্তন যে সহজে সম্ভব নয় তাই নয়, কোনো গুরুতর সমাজ পরিবর্তন ছাড়া যে এ কাজ সম্ভব নয় এমনটাই মনে হয়।
একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, হাইকোর্ট কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকত লুটপাটকারীদের দখল থেকে রক্ষার জন্য যেভাবে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন, এটা এক অস্বাভাবিক ব্যাপার। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, এ নির্দেশের মাধ্যমে হাইকোর্ট শুধু যে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া এবং ভবিষ্যৎ অপরাধ প্রতিরোধের কথাই বলছেন তাই নয়। এর মাধ্যমে তারা বিদ্যমান প্রশাসনের আকাশচুম্বী, গাফিলতির দিকে আঙুল দেখিয়ে তাদেরও অভিযুক্ত করছেন।
বাংলাদেশে এখন চারদিকে, সর্বক্ষেত্রে, নৈরাজ্য রীতিমতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং তা দিন দিন আরও ছড়িয়ে পড়ে সর্বগ্রাসী হচ্ছে। এ ভয়াবহ অবস্থার সব থেকে উল্লেখযোগ্য ও মারাত্মক দিক হচ্ছে এই যে, এটা সৃষ্টিতে সরকারের বিভিন্ন সংগঠিত সংস্থা, উচ্চতম থেকে মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের সরকারি ব্যক্তিরা, শাসকশ্রেণীর প্রধান দুই দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সক্রিয় এজেন্টের ভূমিকা পালন করছে। যে দেশে প্রশাসন ও পুলিশ কর্তৃপক্ষকে তাদের দায়িত্বে অবহেলা না করে পালন করার জন্য হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টকে নিয়মিতভাবে ও ঘনঘন নির্দেশ জারি করতে হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেসব নির্দেশ কার্যকর হয় না, সে দেশ যে মহাবিপদের কার্নিশে এসে দাঁড়িয়েছে এটা বোঝা কঠিন নয়। এ জন্য বাংলাদেশে এখন যে প্রশ্ন সবার মুখে মুখে তা হলো : কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে? যা হতে যাচ্ছে তার পূর্ণ চিত্র এখন দেশের জনগণের সামনে না থাকলেও এটা বোঝার অসুবিধা নেই যে, এর ফলে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের জীবনযাত্রার ওপর বিভিন্ন নৈরাজ্যিক শক্তির হামলা এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা নৈরাজ্যের এ দেশেও এখন লোকের পক্ষে পুরোপুরি আন্দাজ করা সম্ভব নয়।
সমাজের এই নিদারুণ ভাঙনের গতিরোধ করা বিদ্যমান শাসকশ্রেণী ও তাদের কোনো রাজনৈতিক দল অথবা অন্য কোনো ধরনের সংগঠিত শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য এমন শক্তির প্রয়োজন, যার মূল জনগণের মধ্যে প্রোথিত থাকবে, যে শক্তি নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দলীয় স্বার্থের জন্য দেশ ও সমাজ ধ্বংস করে জনগণের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টির পরিবর্তে তাদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা বিধান করবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু থেকে অন্য যেসব ইস্যু নিয়ে শাসকশ্রেণীর দুই প্রধান দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলছে তাকে জনস্বার্থের দিক থেকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, নিষ্ফল ও হাস্যকর বলা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু শুধু এই ইস্যুই নয়, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যেসব ইস্যু নিয়ে এ দুই দল ও তাদের জোট চিৎকার ও নাচানাচি করে, বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়, মারধর করে, হরতাল দেয় তার কোনোটির সঙ্গেই জনস্বার্থের বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু তাই নয়, এগুলো সবই জনস্বার্থবিরোধী। এ পরিস্থিতিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের যে চেহারা ও কার্যকলাপ আমরা দেখি তাকে ভূতের নাচ বলাই সঙ্গত। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্র বলে অনেক আগে যদি কিছু থেকেও থাকে তাহলে তার মৃত্যু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম রাখা-না রাখা ইত্যাদি বিষয় একেবারে ভুয়া ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ভুয়া কারবার যেখানে শাসকশ্রেণীর আশ্রয় ও অবলম্বন সেখানে শাসকশ্রেণীর উচ্ছেদের শর্ত দ্রুত পরিপকস্ফ হচ্ছে। এর পরিণাম দর্শন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
৬.৬.২০১১
No comments