বাজেট-নিরলস কর্মযজ্ঞের পথ খুলে দিন by এম এ হাসান

কৃষকের সমস্যা ও প্রান্তিক মানুষের জীবন বাঁচাতে যথাযথ বরাদ্দ প্রয়োজন। দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থায়ী স্থাপনা এবং স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল নির্মাণে প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন শ্রমশক্তি কাজে লাগাতে যথাযথ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। দেশের বৃহৎ এনজিওগুলোকে এ সংক্রান্ত কাজে সম্পৃক্ত করা দরকার। ক্ষুদ্রশিল্পের বিকাশ, কৃষিবান্ধব অর্থনীতি,


সাম্যভিত্তিক বাজার ও সমাজ অর্থনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী এনজিওগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন


দু'-চারদিনের মধ্যে ঘোষিত হতে যাচ্ছে ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেট। এই বাজেট ভাবনা আজ শুধু সরকারের অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক, দেশের রাজস্ব বিভাগ, দেশের অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের নয়; জনগণকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এ কারণে দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ধস, শেয়ার কেলেঙ্কারি, লিমন ইস্যু এবং ইউনূস ইস্যু ছাড়িয়ে দেশের সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমের মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে এই বাজেট। জনগণ সর্বদাই এই বাজেটকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। এর কারণ দেশের অর্থনৈতিক প্রবণতা, ব্যবসায়ী সমাজের সহজ মুনাফা অর্জনের প্রবণতা, ভঙ্গুর তথা দুর্বল, দূরদৃষ্টিহীন মুদ্রা ও বাজারনীতি এবং সার্বিক লুটেরা সংস্কৃতি। লুটেরা সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত মধ্যস্বত্বভোগী লুম্পেন সমাজ, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মুখ্য অংশ ঢেউ গুনে পয়সা বানাতে চায়; যেখানে ফাটকা ব্যবসা, রাতারাতি ভাগ্যবদল হয়, অল্প আয়াসে ভাগ্য বদলে নেওয়া যায়, সেখানেই পা রাখতে চায় সবাই। মনন নয়, মেধা নয়, শ্রম নয়, নিরলস কর্মযজ্ঞ নয়; শঠতাকে আশ্রয় করে বিজয়ী হতে চায় সমাজের সুবিধাভোগী এবং সুবিধাবাদী শ্রেণী। কচ্ছপ নয়, শশকের নীতি এবং মাৎস্যন্যায় হলো ক্ষমতাবানদের ধর্ম। কৌটিল্যশাস্ত্র এবং শঠতাশাস্ত্র সমার্থক হয়ে গেছে। এরপর আছে ভেদনীতি আর গোষ্ঠীপ্রীতি।
এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য সংকট তথা জ্বালানি সংকটকে সামনে রেখে ঘোষিত হতে যাচ্ছে বাজেট। লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ৮-১০ ভাগ মুদ্রাস্টম্ফীতি, সরকার নিয়ন্ত্রিত বায়বীয় বাজার, মৃতবৎ টিসিবি, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি মানুষের জীবনকে আক্ষরিক অর্থে ওষ্ঠাগত করেছে। সীমাহীন অন্ধকারে, খরতাপে দগ্ধ হয়ে, অসহনীয় যানজটে অচল হয়ে মানুষ যখন বিদ্যুৎ সংকট, পানি সংকট, গ্যাস সংকট প্রভৃতি সংকটে নিমজ্জিত এবং পদে পদে এক যুদ্ধক্ষেত্র অতিক্রম করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে রাজনীতিবিদদের যে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি থাকা প্রয়োজন তা আছে কি-না, তা সবার মনে প্রশ্ন হয়ে আছে। যারা এ সরকারের শতভাগ শুভাকাঙ্ক্ষী, যারা মনে করেন এ সরকার ডুবলে তাদের জীবনে সংকট সৃষ্টি হবে তারাও এ কথা ভাবছেন।
এ ক্ষেত্রে সরকারের বোধোদয় প্রয়োজন, তেমনি সরকারের জন্য প্রয়োজন ধারালো ছুরি এবং কৌটিল্যশাস্ত্রে পারদর্শী এমন শাস্ত্রী, যিনি অনাবশ্যক মেদ ছেঁটে নতুন ঘোড়া এবং পারঙ্গম কর্মী নিয়োগ করতে পারবেন। আঞ্চলিকতার ঊধর্ে্ব উঠে, চেনামুখের মায়া ছেড়ে প্রকৃত বোদ্ধা, যোদ্ধা এবং ওঝা নিয়োগ করতে হবে। সব অক্ষমকে অপসারণ করে এখনই মন্ত্রিসভা বদলাতে হবে। নিজেদের মান-সম্মান, প্রাণ এবং জনগণের জীবন ও দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় এর বিকল্প নেই। তবে এর আগে বাজেট ঘোষণার জায়গা করে দিতে হবে। এতে সম্পূরক বাজেটের জন্য একটি বরাদ্দ ও স্থান রেখে যেতে হবে। সংকটের যথাযথ মূল্যায়ন ব্যতিরেকে উচ্চাভিলাষী বাজেট জাতির জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। বর্তমানে দেশের প্রধান সংকট জ্বালানি সংকট। এ সংকট থেকে উত্তরণে দেশি-বিদেশি উদ্যোগে তেল-গ্যাস খননকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু এ কারণে ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় বছরে ২ বিলিয়ন ডলারের ব্যবস্থা করতে হবে যে কোনো গ্রহণযোগ্য শর্তে।
এক্ষণে কয়লাসমৃদ্ধ অঞ্চলে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুত কয়লা উত্তোলন এবং কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অন্যান্য শিল্প স্থাপনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটা জাতির বাঁচা-মরার ব্যাপার। এ সংক্রান্ত ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা প্রয়োজন। আর ইতিবাচক প্রচারে ব্যর্থতার দায় উচ্চ পর্যায়ে কাউকে নিতেই হবে। দ্রুত কয়লা উত্তোলনের কার্যকর পদ্ধতি নির্ণয়ে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে এখনই কমিটি গঠন করতে হবে। এ সংক্রান্ত ব্যয় বাজেটে প্রতিফলিত হতে হবে।
বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং সিস্টেম লস হ্রাসে জার্মান সরকার অনেক আগেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছিল। সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে এবং নানা উচ্চ প্রযুক্তিতে সাহায্য দিতে তারা আগ্রহী হয়েছিল এ সরকার আসার পরপরই। পরিকল্পনামন্ত্রী ও বৈদেশিক সাহায্য দফতরের (ইআরডি) অক্ষমতার কারণেই তা যথাসময়ে অগ্রসর হতে পারেনি। অনেক ভালো ভালো সাহায্য প্রস্তাব অযোগ্যতা, অক্ষমতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে বাস্তবতার মুখ দেখেনি। এই বিকল্প বিদ্যুৎ প্রকল্পে যেমন বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন, তেমনি দেশের উন্নয়নে প্রায়োরিটি ও প্রায়োগিক বাস্তবতা মূল্যায়নে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের জন্য যথাযথ বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। নির্ধারণ করা প্রয়োজন উন্নয়নের ধাপ এবং তার ব্যয়। এই জ্বালানি সমস্যা সমাধানে যথাযথ মনোযোগ প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত প্রক্ষেপণ তথা কর্ম-অগ্রগতি সংক্রান্ত তথ্য জনসমক্ষে আনতে হবে। পরিকল্পনা, বাজেট বরাদ্দ, অর্থ সঞ্চালন, তার স্বচ্ছ ব্যবহার ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে জনগণকে অবহিত করতে হবে।
কৃষকের সমস্যা ও প্রান্তিক মানুষের জীবন বাঁচাতে যথাযথ বরাদ্দ প্রয়োজন। দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থায়ী স্থাপনা এবং স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল নির্মাণে প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন শ্রমশক্তি কাজে লাগাতে যথাযথ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। দেশের বৃহৎ এনজিওগুলোকে এ সংক্রান্ত কাজে সম্পৃক্ত করা দরকার। ক্ষুদ্রশিল্পের বিকাশ, কৃষিবান্ধব অর্থনীতি, সাম্যভিত্তিক বাজার ও সমাজ অর্থনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী এনজিওগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে যারা উৎসাহী হবে না তেমন এনজিওর কর্মকাণ্ড সীমিত করে আনতে হবে। এছাড়া পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
বিচার ব্যবস্থাকে মানুষের দোরগোড়ায় নেওয়ার জন্য সামাজিক সমঝোতামূলক বিচার তৃণমূল পর্যায়ে নিতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকারকে যেমন শক্তিশালী করতে হবে, তেমনি ইউনিয়ন পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার, সামাজিক বাজার এবং জ্বালানি নিরাপত্তা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি দমনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ সংক্রান্ত আইনি জটিলতা ও বিরোধ পঞ্চায়েত পর্যায়ে নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই গ্রাম্য পঞ্চায়েত ও সালিশ ব্যবস্থার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে যারা ফিরছেন বা যারা শেয়ারবাজারে নিঃস্ব হয়েছেন তাদের সংকট উত্তরণের একটি প্রেসক্রিপশন থাকা প্রয়োজন এই বাজেটে। এর একটা সমাধান হতে পারে বাজারে অংশীদারিত্ব বা সমবায় ব্যাংক।
আকর্ষণীয় সুদে সরকারি বন্ডের সঞ্চালন, বিনিয়োগকারীদের জন্য শর্তসাপেক্ষে ইন্স্যুরেন্স প্রথা প্রচলন, এক্সপ্যাট্রিয়েট ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স সময়ের দাবি। বাজেট ভাবনায় এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ কোটি মানুষের দেশে নানা সংকট নিরসনের সঙ্গে সঙ্গে বিশুদ্ধ পানীয়জল, সেচের জল নিশ্চিত করতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। একই সঙ্গে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ জলের সরবরাহ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বায়োটেকনোলজি ও ন্যানোটেকনোলজি প্রয়োগসহ সারফেস ওয়াটার সংরক্ষণ ও পরিশোধনের ওপর যথাযথ মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আর্সেনিক দূষণাক্রান্ত দুই কোটি মানুষের জীবন এবং জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থে সিলেট ও ময়মনসিংহের হাওর ও নদী খননসহ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সর্বাত্মক চেষ্টা নিতে হবে। নদী দূষণসহ শিল্পবর্জ্য শোধনের ব্যর্থতা সমগ্র জাতিকে আর্সেনিক, সিসা, ক্যাডমিয়াম পারদসহ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী অ্যানিলিন ডাই ও পেস্টিসাইড সংক্রান্ত মৃত্যুফাঁদে ঠেলে দিচ্ছে। এ সংক্রান্ত নিষ্ক্রিয়তা বা দুর্বল পদক্ষেপ 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' সেবাকে প্রহসনমূলক উদ্যোগ হিসেবে প্রমাণিত হবে। যে সাম্যভিত্তিক সমাজ এবং মানব মর্যাদা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ ছিল, তার সফল বাস্তবায়ন চায় এদেশের মানুষ। সেই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থবহ সম্মান চায় জাতি।

ডা. এম এ হাসান : সভাপতি ও প্রধান বৈজ্ঞানিক, অ্যালার্জি অ্যাজমা অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট
aaersci@aitlbd.net
 

No comments

Powered by Blogger.