আমার চারপাশের জগৎ, আইন ও মানবতা by সালেহা চৌধুরী



আমি সমকালে গাছ নিয়ে কলাম লিখেছি। আজকের লেখাতেও গাছ আছে; তবে এখানে আছে গাছ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার গল্প। গাছ নিয়ে কিছু লিখতে যাওয়ার আগে আমার দীর্ঘদিনের লন্ডন জীবনের গাছ বিষয়ে দুটি কিংবা তিনটি গল্প না বলে পারছি না। আমাদের লন্ডনের বাড়ির পেছনে একটা বাগান আছে।
সেখানে ফুল ও সবজি ফলে। কিন্তু ঠিক তার পেছনে ছিল এক বিশাল সিকামোর গাছ। সিকামো এমন এক গাছ, যা প্রতিদিন এক ইঞ্চি বাড়ে, ঘন সবুজ পাতায় চারপাশ ছেয়ে ফেলে। প্রায় আকাশছোঁয়া গাছটা আমার পেছনের প্রতিবেশীর। সিকামোর গাছটা যেভাবে সূর্য আলোর পথ বন্ধ করে রাখে, মনে হয় না আমার বাড়ির বাগানে যতটা ফুল ফোটার কথা তা ফোটে, যতটা ফসল হওয়ার কথা তা হয়। তা ছাড়া সে এমন পাতাবৃষ্টি করে প্রায় দিনই সেগুলো ঝাড়ূ দিয়ে বিনে ফেলতে হয়। একেবারে অসহ্য অবস্থা। যেহেতু গাছটা আমার নয়, আমি কিছুই করতে পারি না। একবার জানতে পারি, আমার পেছনের সেই প্রতিবেশী সপরিবারে হলিডেতে গেছে। আমি সুযোগ বুঝে মই দিয়ে প্রথমে আমার বাগানের শেডের ছাদে উঠি। শেডের ছাদে উঠে ধারালো করাত দিয়ে যতগুলো পারি ডাল কেটে দেই। সিকামোর গাছটা বেশ নরম জাতের গাছ। আমার ডাল কাটতে তেমন অসুবিধা হয় না। এরপর সেগুলো কাউন্সিলে ফোন করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে যখন মনে মনে হাসছি, একদিন আমার পেছনের সেই প্রতিবেশী এসে দরজায় বেল নাড়ে। কথোপকথন ইংরেজিতে, আমি বাংলায় লিখছি।
সাহস তো আপনার কম নয়, আমার গাছের ডাল কাটেন!
কী করব, আমার বাগান আপনার গাছের জন্য প্রাণশূন্য হয়ে উঠছে!
কিন্তু এটা আইনত অন্যায়।
না, অন্যায় নয়। কারণ যদি অন্য বাড়ির গাছ কারও বাগান শেষ করে, তার বাগানে সেই গাছের যতগুলো ডাল এসে পড়ে, তা কাটার অধিকার তার আছে।
আপনি ঠিক বলছেন না। আপনি আইন জানেন না।
জানি এবং কাটার অধিকার আমার আছে, সেটাও জানি।
আমি আপনাকে 'সু' করব। আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।
নেবেন। আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলি।
লোকটা রাগে গরগর করতে করতে চলে যায়। আমি বসে আছি, কখন আমার কোর্টে যাওয়ার ডাক পড়ে। তিন সপ্তাহ চলে যায়। একদিন দেখি সেই প্রতিবেশী তার বাড়ির বেড়া খুলে আবার নতুন করে বেড়া বাঁধতে শুরু করেছে এবং গাছটাকে আমার বাড়ির সীমানায় দিয়ে দিয়েছে। আমি তো অবাক। এটা আবার কী হলো? গাছটা কি তিনি আমাদের দান করলেন? পরে জানি তিনি যখন তার বাড়ির মানচিত্র নিয়ে উকিলের কাছে গেছেন, উকিল নাকি দেখেশুনে বলেছেন, ও গাছ আসলে আমাদের। ভুল করে তার সীমানায় চলে গেছে। এখন নতুন করে বেড়া দিয়ে তিনি সেই ভুল শোধরালেন। পরে আমার বাড়ির দেয়ালে যখন ফাটল দেখা দেয়, গাছের সার্জন এনে পুরো গাছটাই আমাদের কাটতে হয়। এখন সেই কাটা গাছের গুঁড়িটার ওপর বসি। আমার বাগান ফুলে ফুলময়। সূর্যের আলো ঠেকায় কে? পাঁচ রঙের গোলাপে পরিপূর্ণ বাগান। গোলাপ গাছ মাত্র ১৩টি। ফুল হয় অনেক। এরপরের গল্প এমন। আমাদের বাড়ির সামনে ছিল একটা লাল পাতার গাছ। আমাদের ও পাশের বাড়ির দেয়ালে ফাটল দেখা যায়। ইন্স্যুরেন্সের লোক এসে বলে গাছটা কেটে ফেলতে। কারণ গাছের দীর্ঘ শিকড় মাটি থেকে রস টেনে এমন কাণ্ড করেছে। এসব গাছ কাটে কাউন্সিল। এটা আমাদের গাছ নয়, সরকারি। যখন কাউন্সিলকে লেখা হয় ওরা বলে, এটা আমাদের কাজ নয়, আপনি ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্টকে লিখুন। ওরা তখন জানায়, এটা তাদের কাজও নয়। লেখে- আপনি সোসাল সিকিউরিটি বিভাগকে লেখেন। আসলে পৃথিবীর সব সিভিল সার্ভিসই একরকম। আঠারো মাসে বছর। আমরা যখন চিঠি চালাচালিতে ব্যস্ত হঠাৎ এক ভয়ানক ঝড় হয়। সকালবেলা দেখি গাছটা শিকড়সুদ্ধ মাটিতে পড়ে আছে। পাশের বাসার গোয়েন আর আমার আনন্দ দেখে কে? ও খুব ধর্মভীরু মেয়ে বলে- আটলাস্ট গড হাজ ডান ইট। পরে আমাদের দু'জনের বাড়িতেই 'আন্ডারপিনিং' করতে হয়। মানে পুরো বাড়ির ফাউন্ডেশন বদলাতে হয়। এখন আমাদের দু'জনের বাড়িতে আর কোনো ফাটল নেই। এই বড় ঝড়ে একটা গাছ উপড়ে পড়েছিল আরও অনেক গাছের সঙ্গে। সেই প্রিয় গাছটি আমার বাড়ির কাছে গ্রিনিচ পার্কে ছিল। ১৪৫০-৬০-এর দিকে অষ্টম হেনরির স্ত্রী অ্যান বোলিন সেই গাছের নিচে বসে পিকনিক করতেন। পরে তাকে অষ্টম হেনরি সন্দেহ করে মুণ্ডু কেটে ফেলেন। তার একমাত্র মেয়ে ভবিষ্যতের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছোটবেলায় এই গাছ ঘিরে নাচত। পাঁচশ' বছর আগের সেই গাছকে ঘিরে রেখেছিল একটা বন্য আইভির ঝাড়। সেই আইভির গাছটা এই পুরনো গাছের প্রাণ হয়ে তাকে রক্ষা করছিল। কিন্তু ১৯৮৪ সালের সেই ভয়ঙ্কর ঝড়ে অনেক গাছ পড়ে যায়। মন খারাপ হয়েছিল একটা পাঁচশ' বছরের পুরনো গাছের মৃত্যুতে। মন খারাপ হয়েছিল বন্য আইভির সেই দুরন্ত ঝাড় সাপের ফণার মতো বাতাসে দুলে এক ভাগ্যহত রানীর কথা বারবার মনে করিয়ে দিত তাকে আর দেখব না বলে। সেই সময় কিউ গার্ডেন নামের লন্ডনের বোটানিক্যাল গার্ডেনের অনেক দুর্লভ গাছ শিকড় উপড়ে মাটিতে পড়ে। আমার বাড়িতে কোনো বিশেষ অতিথি এলে আমি তাদের আমার বাড়ির আশপাশে নিয়ে যাই। শওকত আলী যখন লন্ডনে গিয়ে আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন, আমি তাকে বাড়ির আশপাশে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তার পছন্দ হয় সেসব দিগন্ত ছোঁয়া মাঠ আর গাছ। সবুজ মেডো, শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ আর নির্জনতা। ওখান দিয়ে হাঁটতে গেলে অনেক কবিতা মনে পড়ে যায়। ওয়াশিংটন ডি সিতে ইংরেজি কবিতা প্রতিযোগিতায় যে কবিতা আমাকে 'রানার্স আপ' পুরস্কার এনে দেয়, সেটাও ওখানে প্রথম মাথায় এসেছিল। কবিতাটির নাম 'মোমেন্ট অব ক্রিয়েশন'। শওকত আলী যেই বেঞ্চটাতে কিছুক্ষণের জন্য বসেছিলেন, সেখানে সাঈদ ভাইকেও (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) বসতে বলেছিলাম। তিনিও কিছুক্ষণের জন্য বসেছিলেন এবং সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল ও আরও অনেকে। শওকত ভাই আমাকে গাছেদের নাম মুখস্থ করতে বলেছিলেন। গাছ চিনতে বলেছিলেন। ওক, বার্চ, সিলভার বার্চ, পপলার, সিকামোর, উইলো, টিক, বক্স, পাইন এমন কিছু গাছ আমি ছাড়াও আরও কিছু গাছ জেনেছিলাম। সিলভার বার্চের কাণ্ড সাদা। তাই ও সিলভার বার্চ। আমার একটি বিশেষ প্রিয় গাছ আছে। নাম তার উইপিং উইলো। যে গাছ হ্রদ বা নদীর পাশে জন্মে। ক্রন্দসী নারীর মতো সে ঝুঁকে থাকে জলের দিকে। তাই ওকে সবাই বলে 'উইপিং উইলো'। মাও সে তুং একটি কবিতায় এই উইপিং উইলোর কথা বলেছেন- 'তুমি আমার উইপিং উইলো আর আমি তোমার প্রাউড পপলার। মাও সে তুংও এমন কবিতা লেখেন? সত্যি এই পৃথিবীতে কতই না অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে। রাস্তার পাশের গাছগুলোকে বছরে একবার ট্রিমিং করা হয়। শীতে পত্রশূন্য আর বসন্তে জেগে ওঠা। আমার বাড়ির কাছে আছে এক সাদা চেরি ফুলের গাছ। এক বসন্তে সেই গাছের তলা দিয়ে ছুটছিলাম একটা দরকারি ওষুধ আনতে। চেরির বৈভবীরূপে বেশ কিছুক্ষণ সেই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। হাইড পার্কের মচমচে পাতার ওপর দিয়ে শরতে যে হেঁটে গেছে, সে কখনও তার সেই ঘটনার কথা ভুলে যেতে পারবে না। এবার গাছ সম্বন্ধে কিছু প্রয়োজনীয় কথা :আমাদের পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখতে গাছের প্রয়োজন অনেক। প্রতিদিন যে পরিমাণ গাছ কেটে ফেলা হয়, সে পরিমাণ লাগানো হয় না। প্রতি বছর ১৩ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি কেটে ফেলা হয়। যে জায়গার পরিমাণ গ্রিস দেশের সমান। বাংলাদেশের গাছ কেটে ফেলা হয় নির্মমভাবে। শালবন, সুন্দরবন সবকিছু শেষ হতে চলেছে। গাছের কারণে আমাদের পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমতে থাকে। এই সিও-২-কে গ্রিনহাউস গ্যাসও বলা হয়। প্রতিদিন যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়, হয়তো একদিন পৃথিবী গাছশূন্য হয়ে যাবে। তখন? পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য।
ব্রিটেন এ কথা জানে। তারা নিয়মিত গাছ লাগায়। তবু সেখানে গাছের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। এই পৃথিবীর ৩০ ভাগ বনভূমির দেশ হলো- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, ব্রাজিল, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইন্দোনেশিয়া, পেরু ও ভারত। এই পৃথিবীর ৩০ ভাগ জায়গা বনভূমিতে ঢাকা। আমাদের উচিত যেখানে যতটুকু খালি জায়গা আছে গাছ লাগানো। বাড়ির সামনে-পেছনে, ছাদে-ব্যালকনিতে। কত সব গাছ আছে যা থেকে দামি ওষুধও পাওয়া যায়। উইলো থেকে আসপিরিন। অর্জুন থেকে হার্টের ওষুধ। আর্নিকা গাছ থেকে ভাঙাচোরা মেরামতির ওষুধ। আরও কত কি। আমার বাড়িতে এই গাছের গুণাগুণের একটি বিশাল কলেবর বই আছে। পড়তে পড়তে অবাক হয়ে ভাবি, এই পৃথিবীতে কেবল গাছই তো মানুষের সব অসুখ সারাতে পারে। রেন ফরেস্ট এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অরণ্য। যার পরিমাণ ২.৫ মিলিয়ন স্কয়ার মাইল। একে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। কারণ আমাজনের রেন ফরেস্ট এই পৃথিবীতে যত অক্সিজেন প্রয়োজন, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে। গাছ অক্সিজেন দেয়। টেনে নেয় পৃথিবীর ক্ষতিকারক গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড। এই কার্বন যত বাড়বে পৃথিবী তত বেশি ভয়াবহ জায়গা হয়ে উঠবে। এবার একটা গাছ কতটা কার্বন টেনে নেয় নিজের শরীরে বা ধরে রাখে, তার একটা হিসাব। একশ' বছরে একটা গাছ দুই টন কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নেয়। ৫০ বছরে টেনে নেয় এক টন কার্বন। ২৫ বছরে টানে .৫ কার্বন ডাই-অক্সাইড। দশ বছরে টেনে নেয় ০.২ টন কার্বন এবং পাঁচ বছরে টেনে নেয় ০.১ টন কার্বন। গাছের নিচ দিয়ে হাঁটতে গেলে শরীর জুড়িয়ে যায় কেন আমাদের? ওরা আর কিছু নয়, কেবল আমাদের জন্য বিতরণ করে অক্সিজেন আর সবুজ আশ্বাস। এই গাছের ভবিষ্যৎ নিয়ে ২০০২-এর সেপ্টেম্বর মাসে একটা বড় কনফারেন্স হয় জোহানেসবার্গে। যাকে বলা যেতে পারে 'ওয়ার্ল্ড সামিট'। সেখানে প্রধান বিষয় ছিল- সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফরেস্ট। গাছ যেভাবে শেষ হতে চলেছে সে নিয়ে শঙ্কিত প্রায় পৃথিবীর সব দেশের মানুষ। এই সমস্যার সমাধান না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ কার্বনময়। প্রথমে যেমন গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, তেমন একটা গল্প দিয়ে আমার রচনা শেষ করি। আমার স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী লন্ডনের 'হারি নীল লিমিটেডের' সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। একবার চার্চ কমিশন বিল্ডিং বানাতে গিয়ে তাদের কাজ একটা গাছের কারণে বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। কারণ কী? কারণ সেখানে একটা পাখি বেশ কতগুলো ডিম পেড়ে সেখানে তা দিতে শুরু করেছে। ফলে গাছ কাটা বন্ধ। তারপর যখন ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়, সেগুলো একসময় আকাশে উড়তে শেখে, তখন গাছ কেটে কাজ শুরু করা হয়। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় একশ' হাজার পাউন্ড। কেবল একটা গাছ আর কয়েকটা পাখি? মনে হয় পৃথিবীতে এখনও কোথায় মানবতার চাষ হয়।
ব্রিটেন প্রবাসী কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.